ইসলাম ফিতরাত বা স্বভাবের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), তাতে এমন কোন মূলনীতি নেই যা মানুষের স্বভাব বিরুদ্ধ বা ফিতরাতকে ধ্বংস করে, বরং ইসলামে তাই বিদ্যমান রয়েছে যা ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলাম ফিতরাতকে ধ্বংস করে না; একে লালন করে।
আল্লাহ তা‘আলা যেই ফিতরাতের উপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে রয়েছে মালিকানার বাসনা যা এমনকি অবুঝ শিশুদের মধ্যেও আমরা ল্ক্ষ্য করি। মূলতঃ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এই প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যাতে তা মানুষের কর্মচঞ্চলতা, উৎকর্ষতা ও দক্ষতার শক্তিশালী চালিকাশক্তি হতে পারে। কেউ যখন জানতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত সে তাঁর অর্জন ও পরিশ্রমের ফল পাবে তখন সে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে নিয়োজিত করে, প্রাণপনে চেষ্টা করে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এতে জীবন উন্নত হয়, সভ্যতা বিকশিত হয়।
মালিকানা হলো মানবতার বৈশিষ্ট্য। কেননা পশু-পাখি মালিকানা লাভ করতে পারে না, মানুষই শুধুমাত্র মালিকানা লাভ করতে পারে। তাই তো ইসলাম ব্যক্তি মালিকানার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেননা এটি এমন দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) যা এসেছে ফিতরাত, স্বাধীনতা ও মানবতাকে সম্মান জানানোর জন্য।
এটা সুবিচারপ্রসূত নয় যে, মানুষ তাঁর কর্ম প্রচেষ্টা ও উপার্জনের ফল থেকে বঞ্চিত হবে এবং তা অকর্মণ্য ও অলসদেরকে এমনি এমনি দিয়ে দেবে। বরং সুবিচার ও ইহসানের কথা হলো সবাইকেই উপার্জন করার ও মালিক হওয়ার সুযোগ প্রদান করা। এতে যদি কেউ নিজ মেধা, প্রচেষ্টা, দক্ষতা ও সাধনা দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকর্ষ অর্জন করে তাহলে তাঁর কর্ম অনুযায়ী সে তা প্রাপ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ “উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম প্রতিদান ব্যতীত কি হতে পারে?” (সূরা আর রাহমানঃ ৬০) “প্রত্যেকের জন্যে তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর রয়েছে।” (সূরা আহক্বাফঃ ১৯)
এখান থেকেই ইসলাম মালিকানা লাভ করাকে বৈধ করেছে, যদিও কারো নিকট অঢেল ধন-সম্পদের সম্মিলন ঘটে আর সে যদি হালালভাবে তা উপার্জন করে এবং যথাযথভাবে তা ব্যয় করে, হারাম সম্পদ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে, বৈধ সম্পদ খরচের ক্ষেত্রেও অপব্যয় না করে, অধিকার আদায়ে কৃপণতা না করে, কারো প্রতি জুলম (অন্যায়) না করে, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন না করে , তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। এটাই ইসলামের দাবি।
সম্ভবতঃ এই সংক্রান্ত বিষয়ে সবচাইতে উজ্জ্বল উদাহরণ, আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা)। তিনি ছিলেন প্রথম পর্যায়ের অগ্রবর্তী সাহাবীদের একজন এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ জনের অন্যতম। তিনি তাঁর অন্যান্য মুহাজির ভাইদের মত রিক্ত হস্তে মক্কা থেকে বের হলেন, ঘর নেই, বাড়ী নেই, সহায়-সম্পদ নেই। রাসূল (সা) তাঁকে সাদ বিন রাবী (রা)-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন। সাদ বিন রাবী তাঁকে নিজের সম্পদের অর্ধাংশ দিয়ে দিলেন এবং নিজের দু’জন স্ত্রীর একজনকে তালাক দিলেন যাতে ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) তাকে বিয়ে করতে পারেন। এতে খুশী হয়ে তিনি সাদ বিন রাবীর জন্য দোয়া করলেনঃ "আল্লাহ তা‘আলা, তোমার পরিবার পরিজন ও সম্পদে বরকত দান করুন।” অতঃপর বললেন, আমাকে একটি বাজারের সন্ধান দাও (যেখানে আমি ব্যবসা করতে পারি।)”
আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) ব্যবসা শুরু করলেন এবং বাজারে বাজারে ঘুরে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ তালাশ করতে লাগলেন। তখন বাজারে মদীনার ইহুদীদের আধিপত্য ছিল। তিনি প্রত্যুষে উঠে কাজে লেগে যেতেন, পরিশ্রম করতেন, ছুটাছুটি করতেন। তাঁর বিরাট অর্থনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি মুসলিমদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন। মৃত্যুর সময় তিনি এমন বিশাল সম্পদ রেখে গেলেন যে, সেখানে যে স্বর্ণ ছিল তা করাত দিয়ে কাটতে হয়েছিল।
ইবনে সাদ তাঁর ‘ত্বাবাকাত’-এ বর্ণনা করেছেনঃ তাঁর চার স্ত্রীর একেক জন তাঁর রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে যে অংশ পেয়েছিলেন (মীরাসী আইন অনুসারে তা হলো আট ভাগের একভাগের এক চতুর্থাংশ)-এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আশি হাজার দিনার।”
ইসলাম এই ধন-সম্পদকে নিষিদ্ধ করেনি এবং এর বৃদ্ধির পথও রুদ্ধ করেনি। কেননা তা কারো ক্ষতি করা বা নিজে ক্ষতির শিকার হওয়া ব্যতীত হালাল উপায়ে অর্জিত হয়েছে এবং কৃপণতা ও অপব্যয় ব্যতীত সঠিক খাতে খরচ হয়েছে।
আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) একবার চল্লিশ হাজার দিনারের বিনিময়ে এক খণ্ড জমি ক্রয় করেন, অতপর তা তাঁর বনী যাহরা গোত্রীয় আত্মীয়-স্বজন, দরিদ্র মুসলিমগণ ও উম্মাহাতুল মুমিনীনদের মাঝে বণ্টন করে দেন।”
শাম থেকে মদীনায় একটি উটের কাফেলা আসলো। এতে ছিলো সাতশত উষ্ট্রবাহন। এগুলির মালিক ছিলেন হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ)। এগুলিতে অনেক ধন-সম্পদ ছিল। আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) এই সকল বাহন ও এগুলিতে বহনকৃত সকল সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলেন, এবং মৃত্যুর পূর্বে তিনি পঞ্চাশ হাজার দিনার আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার জন্য এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জীবিত প্রত্যেক সাহাবীর জন্য চারশ দিনার করে দেয়ার জন্য ওয়াসিয়্যাত করে যান। এর পূর্বেও তিনি অনেক দান-সাদাকাহ করেছেন, আর ফরয যাকাত ও করণীয় খরচ তো করেছেনই। সুতরাং এ ধরনের সম্পদই হলো উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে উপযুক্ত সম্পদ। কতইনা উত্তম সম্পদ! কতই না উত্তম মালিক!
ইসলাম প্রত্যেকের জন্য মালিকানা লাভ করার অনুমতি দেয়, বরং তাকে মালিকানা লাভ করতে আহ্বান জানায়, তার মালিকানা স্বত্বকে রক্ষা করে এবং পরবর্তীতে তাঁর বংশধরদেরকে এর উত্তরাধিকারী করে এবং এর মাধ্যমে অনবরত প্রচেষ্টা চালানোর ও কঠোর পরিশ্রমের জোরালো উদ্দীপনা জোগায়, যাতে ব্যক্তি যখনই মালিকানার স্বাদ গ্রহণ করে তখনই তার মাঝে কর্তৃত্ববোধ ও সম্মানবোধ সৃষ্টি হয়।
ইসলাম মানুষকে রাষ্ট্রের গোলামে পরিণত করেনি যে রাষ্ট্রের উপর মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছড়ি ঘুরায়, মানুষকে দাসত্বের মাধ্যমে অবজ্ঞা করে, ধর্ম ও চরিত্রকে ধ্বংস করে। যেখানে এর প্রতিবাদ করারও কোন সুযোগ নেই। কারণ সেখানে রাষ্ট্রই সবকিছুর মালিক, সাধারণ মানুষ কোন কিছুরই মালিক নয়।
ব্যক্তিমালিকানা ও এর রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের যে নির্দেশান রয়েছে তার মধ্যে মুসলিম উম্মাহর সার্বিক অর্থনীতির কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কারণ একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, ব্যক্তিগত উদ্দীপনাই অধিক পরিমাণ উৎপাদন নিশ্চিত করে, সামষ্টিক সম্পত্তি ও প্রতিষ্ঠানে যা হয় না। ব্যক্তিমালিকানার প্রেরণা থেকে উৎসারিত উদ্দীপনা ও নজরদারী না থাকার কারণে এতে উৎপাদন কমে যায়।
তাছাড়াও ইসলাম ব্যক্তিমালিকানা সংরণের জন্য দু’টি শর্ত প্রদান করেঃ
১. এই মালিকানা শারী‘আহ্সম্মত পন্থায় বৈধ উপায়ে অর্জিত হতে হবে নতুবা ইসলাম তাঁর স্বীকৃতি প্রদান করে না, যদিও অন্যায়ভাবে অর্জনকারীর নিকট এই মালিকানা বহুকাল পর্যন্ত থাকে। এখানে ইসলামের শারী‘আহ্ মানবরচিত বিধানের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। কারণ মানব রচিত বিধান একটি নিষিদ্ধ সময় পার হওয়ার পরে নিষিদ্ধ মালিকানাকে স্বীকৃতি দেয় যেমন পনের বছর বা এ ধরনের কোন সময়। ইসলামের দর্শন হলো, কালের বিবর্তন অকাট্য ও স্বীকৃত হারামকে হালালে পরিণত করে না।
২. ব্যক্তিমালিকানা সমাজের সাধারণ স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। সাংঘর্ষিক হলে তা মালিকের সন্তুষ্টিতে বা অসন্তুষ্টিতে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেয়া হবে এবং তাকে ন্যায়ানুগ ক্ষতিপুরণ দেয়া হবে। কেননা সমষ্টির স্বার্থ ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে অগ্রগণ্য।
উমার বিন খাত্তাব (রা)-এর যুগে একটি ঘটনা ঘটেছে। যখন আল-মাসজিদুল হারামে লোকসংখ্যা বেড়ে গেল এবং স্থান সংকুলান হচ্ছিল না তখন তিনি তাকে সম্প্রসারণের ইচ্ছা করেন এবং মসজিদ সংলগ্ন কিছু বাড়ি কিনে নেন। অন্যান্য বাড়ির মালিকেরা তাদের বাড়ি বিক্রয়ে অসম্মতি জানালো এবং তাতে অটল রইলো। অতঃপর উমার (রা) তা জোর করে দখল করলেন এবং মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর এসব বাড়ির মূল্য কাবা শরীফের ফান্ডে জমা রাখলেন যাতে মালিকগণ তা নিয়ে নিতে পারে। উসমান (রা)-এর সময়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
এমনিভাবে হাসপাতাল, শিক্ষালয়, এতিমখানা, আশ্রয় কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনের কোন নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট মালিক তা বিক্রি করতে অসম্মতি জানাতে পারবে না। যদি অসম্মত হয় তাহলে কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে সরকার তাকে তা বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারবে।
সূতরাং সৎপথে অঢেল সম্পদ আহরনের চেষ্টায় কোন অন্যায় নেই। আপনি যে কোন পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারেন। তাবে সম্পদ অর্জনের উপায় হতে হবে হালাল ও অনুমোদিত। হারাম উপায়ে সম্পদ আহরণ করা যাবে না। আবার সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম মেনে চলতে হবে এবং সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে এবং সম্পদে অভাবী, ভিক্ষাপ্রার্থী ও বঞ্চিত মানুষের হক থাকতে হবে। অধিক সম্পদ আহরনের চেষ্টা যেন আল্লাহর পথ থেকে, দ্বীনি ফরজ, ওয়াজিব থেকে বিরত না করে ফেলে এবং সম্পদের প্রাচুর্য যেন ভোগ-বিলাস ও হারাম পথে নিয়ে যেতে না পারে সে বিষয়েও সদা সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫৩