ব্লগে ফেসবুক আলোচনা কেন - এই কথাটির জবাবে সর্বপ্রথমেই পোস্টের প্রাসঙ্গিকতা ও যৌক্তিকতার প্রয়োজন অনুভব করছি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে যেই আপনি ব্লগে লিখছেন এবং/অথবা পড়ছেন, সেই আপনি ই কিন্তু ফেসবুকে প্রায় নিয়মিত। আর ফেসবুক যেমন একাধারে আপনার শিক্ষাগত, পেশাগত, সামাজিক, পারিবারিক ও চিন্তা-চেতনার বহি:প্রকাশের অনন্য মাধ্যম। তাই এতে নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশে সচেতনতার আবশ্যিকতাও অনস্বীকার্য।
..................................................
১. ফেবু হোমপেজে চোখ রাখতেই রিফাত দেখতে পেল একটা পর্ণস্টারের পেজে তার অফিসের বসের লাইক দেওয়ার নিউজ। ব্যাক্তিগত ভাবে তাকে যতটুকু ই জানতো মুহূর্তের মধ্যে কেন যেন তা অস্বচ্ছ হয়ে উঠে। ব্যাক্তিসত্ত্বার সাথে ভার্চুয়ালী চেনা-জানার দূরত্বটা ক্রমান্বয়ে বিস্তৃতি পেতে থাকে তার কাছে।
২. ফেবু ওপেন করার পর ই রিনিতা তার হোমপেজে তার এক বিজ্ঞবন্ধুর লিখা অসাধারণ একটা কবিতা দেখতে পেল। কবিতা পাঠে নিজের মুগ্ধতা জানিয়ে দিতে "লাইক" অপশনে ক্লিক করতে যাবে তখনি তার মোবাইলে রিনঝিন সুরটা বেজে উঠে। তারপর কিছুক্ষন পর ফেবুতে ফিরে এসে দেখে ঐ বিজ্ঞবন্ধুটি ইতোমধ্যে তার কোন এক ফেবু বন্ধুর লুল জাতীয় কবিতায় লাইক দিয়ে রেখেছে। রিনিতা কিছুটা নির্বাক হয়ে গেলো। লাইক অপশনটিতে ক্লিক করতে কোন কার্পণ্যতা থাকার কথা নয় কিন্তু যে এত অসাধারণ লিখতে পারে সে কিভাবে এই রুপ লুল লেখায় মুগ্ধ হয়? তাহলে কি লেখার গভীরতা আর মুগ্ধতার বহি:প্রকাশে কোন সম্পর্ক নেই?
৩. রিক্তা তো সবার চেয়ে আরো এক ডিগ্রি এগিয়ে। তার এক বন্ধু কমলের লাইক দেওয়া ১৮+ জোকসের নিউজ হোমপেজে ডিসপ্লে হওয়া মাত্রই সে বন্ধুটিকে ব্লকের ঘরে পাঠিয়ে দেয়। রিক্তার যুক্তিমতে সে এমন কোন বন্ধু আশা করে না যারা রুচির মানদন্ডে ১৮+ হিসাব-নিকাশকে বেছে নিবে।
এভাবে ই আমরা আমাদের ভালোলাগা, পছন্দ ও মুগ্ধতা ভার্চুয়ালি জানাতে গিয়ে অন্যদের কাছে নিজেদের ব্যাক্তিসত্ত্বাকে প্রকাশ করে ফেলি। নিজের স্বরুপ প্রকাশে এটা একটি ভালো মাধ্যম হলেও আমাদের জেনে রাখা উচিত ঠিক কি কারনে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ফেবু লাইক অপশনটি ব্যবহার করছি। তাহলে নিজের কাছেই নিজে স্বচ্ছ থাকা সম্ভব, অন্যথায় নয়।
০ আমি মুগ্ধ: ফেবু বন্ধুদের লেখা, ছবি ও কমেন্টে নিজের ভালো লাগার কথাটি জানিয়ে দেওয়ার জন্যই এই "লাইক" অপশনটির জন্ম। কারো লেখা, ছবি কিংবা কমেন্টে লাইক দিয়ে আমি আমার মুগ্ধতাটি জানিয়ে যেতে পারি।
০ সহমত জ্ঞাপন: আপনি সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা দার্শনিক কোন চিন্তা-ধারা, তত্ত্ব বা পরিসংখ্যান নির্ভর কোন স্ট্যাটাস শেয়ার করলেন। সেখানে আমি মন্তব্য অপশনে না গিয়ে ও শুধুমাত্র "লাইক" অপশনে ক্লিক করে নিজের সমর্থন, সম্মতি বা সহমত জ্ঞাপন করতে পারি।
০ উৎসাহিত করন: কারো কারো লেখা পড়ে কিংবা ছবি দেখেও আমি তাকে উৎসাহ দিতে পারি শুধু মাত্র এই লাইক অপশনটি ব্যবহার করে।
০ হাই/ হ্যালো পর্ব: ফেবুর ইনবক্স অপশনে প্রক্সিমিটির একটা ব্যাপার আছে। তাই অনেক ক্ষেত্রে হয়তো আমি আপনার ইনবক্সে নক করার স্পর্ধা নাও করতে পারি, কিংবা ইচ্ছা থাকলেও ইনবক্সে নক করার জন্য যুক্তিসংগত কোন কথা নাও পেতে পারি অথবা ইনবক্সে আপনার সাথে আলাপ কন্টিনিউ করার সময় ও সুযোগ নাও পেতে পারি। এই পরিস্থিতিতে আমার হোমপেজে ডিসপ্লে করা আপনার লেখা, ছবিতে ছোট্ট করে একটা লাইক দিয়ে হাই/হ্যালো বুঝানোর অব্যক্ত ইচ্ছাটা উচ্চারন করে তা জানান দেওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।
০ ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় বহন: মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরনে অনুভূতির ভিন্নতা আসতেই পারে। নিয়মিত ইনবক্সে আলাপ না করেও বন্ধুর লেখা বা ছবিতে লাইক দিয়ে আমি ও জানিয়ে যেতে চাই যে তার ব্যাপারে আমার অনুভূত ইতিবাচক অবস্থান।
০ বিরুদ্ধ অবস্থান: আপনার লেখার সাথে সহমত জ্ঞাপন যদি না করতে পারি এবং তা যদি আপনাকে জানিয়ে দেওয়ান প্রয়োজন উপলব্ধি করি তবে মন্তব্য অপশনে না গিয়েও লাইকের মাধ্যমে জানান দিতে পারি। কিভাবে? আপনার ঐ লেখার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া কোন যুক্তিসংগত মন্তব্যকে লাইক দিয়েই সম্ভব।
০ এখানেই আজ সমাপ্তি: অনেক সময় দেখা যায় বন্ধুর কোন লেখায় বা আমার কোন লেখায় বন্ধুর সাথে মন্তব্য পর্যায়ক্রমে বাড়তে ই থাকে। এক্ষেত্রে ইনবক্স এর আদতে মন্তব্যে আলাপচারিতার লাগাম টেনে ধরতে সর্বশেষ মন্তব্যে লাইক দিয়ে ইতিবাচকভাবেই সমাপ্তি টানা যায়।
০ পাশেই আছি: বন্ধু/বন্ধুদের লেখা, ছবিতে ছোট্ট একটা লাইক দিয়ে তাদের পাশে থাকার ইচ্ছা ও ভালোলাগাটুকু জানিয়ে দেয়া যায়।
০ নিরবে ভালোবেসে যাওয়া: আমি না বললেও এই কাজটা যে অনেক মানুষ দিনের পর দিন করে যায় সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আপনি ফেবু লিস্টে থাকা যেই বন্ধুটিকে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন তা হয়তো মুখে বা ইনবক্সে জানাতে ইচ্ছুক নন। এই ক্ষেত্রে সব সময় এবং অনেকটা নিয়ম করেই তার লেখা, ছবিতে অক্লান্তভাবে লাইক দিয়ে যান। স্থূল মস্তিষ্কের মানুষের কাছে ব্যাপারটা পরিস্কার না হলেও যারা একটু গভীর অনুসন্ধানী টাইপের তারা কিন্তু এইরুপ নিরবে ভালোবাসার বার্তাটি ঐ ক্রমাগত লাইক থেকেই বুঝতে পারে।
আমি কিন্তু নিজের কাছে ক্লিয়ার যে মুগ্ধতা ছাড়াও ঠিক কোন কারনে আমি আমার ফেবু বন্ধুদের লেখা, ছবি কিংবা মন্তব্যে লাইক দিয়ে যাই। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা নিজেরা ই নিজের কাছে ক্লিয়ার না এই ব্যাপারটাতে। বন্ধু কিছু একটা লিখেছে, কিছু একটা ছবি আপলোড দিয়েছে অথবা কিছু একটা মন্তব্য করেছে আর তাই তাতে লাইক দিয়ে সামাজিকতা দেখাতে হবে। তার প্রতি নিজের ইতিবাচক অবস্থান দেখাতে হবে। এরুপ অন্ধ হয়ে গেলে আপনার পছন্দ, রুচি, ব্যাক্তিত্ববোধে যে কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে যা হয়তো আপনি সচেতন ভাবে আশা করেন না। নিজের অজান্তে ই হয়তো আপনি লাইক অপশন ব্যবহার করে নিজেকে ক্রমশ ছোট করে ফেলছেন। তাই আপনার সচেতনতার জন্য ঐ ব্যাপারগুলো একটু আলোচনা করতে আগ্রহ বোধ করছি।
০ জ্ঞান বা বুঝের অপরিপক্কতা: অনেকেই আছেন যারা চিন্তা-ভাবনায় যথেষ্ট ডিসেন্ট হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুর নোংরা, অযৌক্তিক ও একপেশে লেখার তাৎপর্য না ভেবেই লাইক দিয়ে দেন। এতে অন্যরা আপনাকে ব্যাক্তিগত ভাবে ভালো জানলেও ফেবু ব্যবহারে আপনার অপরিপক্কতাকে অপছন্দ করবে।
০ চাটুকারিতা: বলার অপেক্ষা ই রাখে না যে ফেবুতে ক্রমান্বয়ে চাটুকারিতা বেড়ে যাচ্ছে। "হাই গাইজ, গুড মর্নিং" - টাইপের স্ট্যাটাশে কিংবা ছোট্টদের "আগডুম বাগডুম" জাতিয় কথা যখন বড়রা তার ওয়ালে জুড়ে দেয় তাতে লাইকের বন্যা বয়ে যায়। এই ধরনের চাটুকারদের সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না হলেও ওই হাই গাউজ বা আগডুম বাগডুম লেখকদের মনে ঈদের আনন্দ বয়ে আনে।
০ লেনদেনের ইস্যু: ভাবতে অবাক লাগলেও সত্য যে ফেবুতে " লাইকের বিনিময়ে লাইক" দেয়ার একটা প্রচলন রয়েছে। তা অনেকটা খাবিকা/কাবিখা মতোই মনে হয়। এর চেয়ে নোংরা ব্যাক্তিত্ব আর কি ই বা হতে পারে?
০ লুলামিতে নিজের পরিচয় জ্ঞাপন: অনেকেই স্ট্যাটাসে, ছবি আপলোড করার মাধ্যমে নিজের লুলামি প্রদর্শন করে থাকেন। আর এতে লাইক দিয়ে আপনিও কিন্তু নিজের মনের লুলামির পরিচয় জ্ঞাপন করে থাকেন।
০ মন্তব্যে মুগ্ধতায় সহজলভ্যতা: কিছু কিছু বন্ধু আছে যাদের স্ট্যাটাসে সামান্য একটা ইমো দিয়ে আসলেও তাতে লাইক দিয়ে দেন। আমার কাছে কিন্তু মন্তব্যের মুগ্ধতা এতো সহজলভ্য নয়।
০ নিজের ঢোল নিজে পেটানো: কিছু আজিব পাবলিক আছে যারা নিজের লেখায, ছবিতে নিজেই লাইক দিয়ে নিজের মূর্খতার জানান দিয়ে থাকেন।
আমার কিছু বন্ধু আছে যাদের সামান্য একটা লাইক আমার মনে অনেকটা প্রশান্তি ও সাহস এনে দেয়। এর কারন কিন্তু এই নয় যে সে সমাজের কোন বিখ্যাত মানুষ কিংবা তাকে আমি একান্ত ই ভালোবাসি। এর কারন সেই বন্ধুটি/বন্ধুরা তার/তাদের পছন্দ-অপছন্দ ও রুচিবোধে অনেক পারফেকশনিস্ট। তাদের প্রতিটি কথা, ভাবনা ও সমর্থনে পারফেকশন এর উপস্থিতি উপলব্ধি করার মতো। আর আমার কাছে এই রুপ কোয়ালিটি ই যথেস্ট, কোয়ান্টিটি নয়।
আর একটি বিষয় টেনে আনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। আপনার লেখায় বা ছবিতে হাজার হাজার লাইক দেখতে পাওয়া যায় তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনি আহামরি কিছু লিখতে পারেন। তার মানে এই যে আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে অথবা এভাবেও বলা যায় যে আপনার ফ্রেন্ড লিস্টের ফ্রেন্ডদের পারফেকশন এর ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর হ্যা, আপনার অনলাইন উপস্থিতির আধিক্য ও অনলাইন সামাজিকতা (?) ও কিন্তু্ এইখানে হিসাবভূক্ত।
তবে আমি এমন কিছু ফেবু সেলিব্রেটি বন্ধুকে পেয়েছি যাদের লেখা কিংবা ছবি আমার হোমপেজে "Just Now" অবস্থাতেই থাকা মাত্র ই তা না পড়ে লাইক দিয়ে দিতে পারি এবং লাইক দেওযার পর তা পড়ে অগ্রিম মুগ্ধতা জানানো তে কোন দ্বিমত আসে না। এই অবস্থাটা কিন্তু এমনিতে ই আসে নি এবং এক দিনেই আসে নি। তাই এদের লেখায় হাজার হাজার লাইক আসলেও আমি তাতে জনসংখ্যার আধিক্যতা বলবো না, বরং কোয়ালিটি দিয়ে ই তারা কোয়ালিটি লাইক অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমার কিছু ফেবু ফ্রেন্ডদের স্ট্যাটাস, স্কীন শট এর ভিত্তিতে বেশ কিছু জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছি ইতোমধ্যে। কিছু নমুনা দিয়ে যাই -
- যারা আউট সোর্সিং এ কাজ করে থাকেন তাদের নক করে কয়েক ডলার বিনিময়ে নাকি নিজের লেখায় বা ছবিতে শত শত লাইক পাওয়া যায়।
- কেউ কেউ নাকি আবার একাধিক ছাইয়া আইডি তৈরি করে নিজের আসল আইডির লেখায় লাইক বসিয়ে দেয়।
- ফেবুতে নাকি লাইকের বিনিময় চুক্তি ভালোই চলে।
- আবার কিছু ফেবু ব্যবহারকারী নিজে স্ট্যাটাস দিয়ে ইনবক্সে তা অন্য বন্ধুদের নক করে জানিয়ে দিয়ে যায় যদি কিছু লাইক পাওয়া যায়।
- কিছু আবাল পাবলিক ও নাকি আছে যারা ফ্রেন্ড রিকু পাঠিয়েই ইনবক্সে তা গ্রহন করতে জানিয়ে যায় এই মর্মে যে তাকে বন্ধু করা হয়ে সে সব ফেবু লেখায়, ছবিতে নিয়মিত লাইক দিয়ে যাবে ।
"লাইক" এর ব্যবহারে যখন এমন বেহাল অবস্থা তখন আমিও একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারছি না। নতুন একটা ফেবু আইডি ক্রিয়েট করবো যার নাম হবে "No One"। অর্থাৎ আপত্তিকর, সিন্ডিকেট, ক্যাচালযুক্ত ও লুল টাইপের স্ট্যাটাসে, ছবিতে ও কমেন্টে এই আইডি থেকে লাইক দিয়ে দিব ইচ্ছামতো। তারপর তারা তাদের নোটিফিকেশন বক্সে দেখতে পাবে -
-No One likes your Status.
-No One Likes your Picture.
-No One likes your Comment.