দিনটাকে ঠিক পহেলা বৈশাখ নামে জানতাম না, জানতাম "গলিয়া" নামে। গলিয়া ছিল পহেলা বৈশাখের একটি গ্রাম্য মেলার নাম। অর্থাৎ বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিই ছিল বহু কাংখিত গলিয়ার দিন। এই দিনটির জন্য আমাদের সকলের প্রস্তুতি ছিল ৪/৫ মাস পূর্ব থেকেই। আমরা বলতে - আমি, আমার বড় আপু, আমার ভাই, আমার মেঝ চাচার তিন ছেলে অর্থাৎ কাশিম ভাই, হাশিম ভাই এবং জাফর ভাই। উক্ত ৬ জনের মধ্যে আমার বড় আপু ছিল সবার বড় এবং আমি ছিলাম সবার ছোট। আমাদের পরিবার, চাচার পরিবার তখন দাদার সাথেই ছিল। আমাদের ৬ জনের টাকা-পয়সা জমা করার একটা মাটির ব্যাংক ছিল। সারা বছর বড়দের কাছ থেকে যে যা টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতে পারতাম তা মাটির ব্যাংটিতে রেখে দিতাম। ব্যাংকের মধ্যে বড় অংশের টাকা আসতো আপু এবং কাশিম ভাইয়ের মাধ্যমে। বাকীরা যখন ই যা পেতাম তা দিয়ে টুকটাক কিনে খেয়ে ফেলতাম। তারপরও কখনো সখনো আমরা ছোটরা ও কিছু পয়মা রেখে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতাম। তবে গলিয়া নিকটবর্তী হলেই নিজেদের টুকটাক খাওয়ার লোভ সংবরন করে ব্যাংকে পয়সাপাতি চালান করে দিতাম।
পহেলা বৈশাখের সকাল:
পহেলা বৈশাখের দিন খুব ভোরে ই ঘুম থেকে উঠে সবাই আমাদের মাটির ব্যাংকটি নিয়ে বসতাম। মাটির ব্যাংকটি ভেঙ্গে যতো টাকা পাওয়া যেত তা গননা করে আপুর কাছে রাখতাম। তারপর আমরা এবং প্রতিবেশী সঙ্গি-সাথীরা একসাথে নদীতে গোসল করতে যেতাম। গোসল করতে যাওয়ার পূর্বে আমরা সবাই একটা মিশন সম্পন্ন করতাম। কাপিলা গাছের বীজ সংগ্রহ করতাম এবং কিছু বীজ মুখে নিয়ে পানিতে ডুব দিয়েই নদীর কিছু পানির সাথে টুপ করে গিলে ফেলতাম। আমাদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল - এই দিনটিতে পানির নিচে গিয়ে কপিলার বীজ খেতে পারলে সারা বছর কোন রোগ-বালাই থাকবে না। তবে শর্ত থাকে যে, পানির উপরে তা খাওয়া যাবে না কারন গিলে ফেলার দৃশ্য কেউ দেখে ফেললে কপিলার বীজ তার কার্যকারিতা হারাবে।
মা, চাচী ভোর সকালে উঠেই ভালো খাবারের আয়োজন করতেন। আমরা সবাই মিলে গোসল সেরে আসতেই খাবার রেডী। তারপর তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে সুন্দর পোশাক পরে গলিয়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম। এরই ফাকে আমরা সবাই বাবা, চাচা আর দাদার কাছ থেকে পছন্দের জিনিস পত্তর কেনার জন্য অতি সামান্য পরিমানে টাকা পেয়ে যেতাম। যার বয়স যতো বেশি তার প্রাপ্ত টাকার পরিমান ততো বেশি। সেই হিসেবে আপুর টাকার অংক থাকতো বড়। তবে হিংসা করার কিছু ছিল না। কেননা ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত টাকা এবং মুরুব্বিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সকল টাকা এক সাথে জড়ো করে কেনাকাটার জন্য মৌখিক ভাবেই বাজেট ঘোষনা করা হতো। আপু আর কাশিম ভাই বাজেট তৈরি করতো আর আমরা ছোটরা তা সানন্দে সায় দিতাম। বাজেটের জন্য বরাদ্ধকৃত খাতগুলো ছিল - মেয়েদের সাজগোজ সামগ্রী, মেয়েদের গৃহকর্ম ও খেলনা সামগ্রী, ছেলেদের খেলনা সামগ্রী এবং টুকটাক মজাদার খাবার সামগ্রী।
মেলায় গমন:
আমাদের গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকেই আলাদা আলাদা গ্রুপ করে ছেলেমেয়েরা গলিয়ায় যেত। কারন ছিল একটা ই - প্রতিযোগীতা। এক ঘরের মানুষেরা অন্য ঘরের সদস্যদের জানতে দিতাম না কার কত বাজেট, কি কি কেনাকাটার প্লান। সন্ধ্যায় এসে অন্য ঘরের ছেলেমেয়েদের দেখাতাম কে কি পরিমান কিনতে পেরেছি। যেহেতু আমরা সংখ্যায় অনেক ছিলাম, আমাদের মেলার সামগ্রী ও অন্য সব ঘর থেকে বেশি হতো। নৌকা করে ছোট্ট নদীটি পার হয়েই আমরা হাটা ধরতাম এবং প্রায় ২৫/৩০ মিনিট হাটার পরই গলিয়ায় পৌছে যেতাম।
মেলার কেনাকাটা:
মেলায় পৌছে ই তো চোখ ছানাবড়া। এটা সেটা দেখে দেখে মনের মধ্যে তখন শুধু লোভ আর লোভ। এটা কিনবো, ওটা কিনবো, এটা পছন্দ, ওটা পছন্দ - পছন্দের যেন কোন সীমা নেই। আপু ঠিকই মাথা ঠান্ডা রেখে বাজেট অনুযায়ী কেনাকাটা শুরু করতো। আমি যেহেতু সব থেকে ছোট ছিলাম তাই আপু আমার হাত ধরেই মেলার সমগ্র মাঠ ঘুরে আমার জন্য সাজগোজ সামগ্রী কেনা শুরু করতো। আমার ভাইটি তখন থেকেই বদমেজাজী, তাই সে চাইতো সবার আগে যেন তার খেলনাগুলো কিনে দেওয়া হয়। ওই বদমেজাজীকে না চটিয়ে সবার প্রথমে ওর পছন্দের খেলনা কিনে দিত। তারপর আমার জন্য কেনা হতো হরেক রকম চুড়ি, নেইল পলিশ, লিপিস্টিক, কপালের টিপ, নূপুর, মাটির টেপা পুতুল, হাড়ি-পাতিল, ঢেকি ও আরো অনেক কিছু। একটা কিছু কিনে দিলে আরো হাজারটা কিনিবার লোভ জাগতো মনের মধ্যে। তারপর একে একে বাকিদের জন্য লাঠিম, বাঁশি, ঢোল,লাঠিতে লাগানো হেলিকপ্টার, মাটির ব্যাংক, বেলুন, বিভিন্ন রকম মাটির ও প্লাস্টিকের প্রানী সামগ্রী। আপু খুব স্থিরতার সাথেই বাজেটের মধ্যে ভারসাম্য রেখে সবার ইচ্চা পূরনে ব্যস্ত থাকতেন। আপু তার শৌখিন জিনিসটি কিনেছে কি না অথবা তা কেনার স্বচ্ছলতাটুকু অবশিষ্ট আছে কি না সে ব্যাপারগুলো আমাদের কারো মাথায় ই আসতো না। সে ব্যাপারে আপুর মধ্যে মন খারাপের অভিব্যাক্তিটি ও ছিল না। এখন বুঝি, বড় আপু আসলেই বড় আপু। মায়ের মতো অসীম ভালোবাসা, সহনশীলতা আর ধৈর্য্য নিয়ে একজন ই পৃথিবীতে আসতে পারে - সে হলো ঘরের বড় মেয়েটি।
তারপর কেনাকাটা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসতো , অল্প বিস্তর টাকা দিয়েই কিনে নিতাম বাতাশা, মুড়ির মোয়া, লাড্ডু, মুরালী ও নাম না জানা আরো কিছু। মেলার কোন এক পাশ ঘেষে বড়রা নানা ধরনের খেলার আয়োজন করতো। আমি অবশ্য নগরদোলাতে চড়তে খুব ভয় পেতাম। তাই আমার আপু তার ইচ্ছা সত্ত্বেও ওটাতে চড়তো না। ছেলেগুলো তো নগরদোলায় একাধিকবার চড়েও তৃপ্ত হতো না।
এদিকে মেলায় ঘুর ঘুর করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যেত তা বুঝতে পারতাম না। আকাশের কালো মেঘ দেখেই আমাদের চৈতন্য ফিরতো বাড়িতে পৌছার। যে যার মতো হাতে পলি ব্যাগ নিয়ে বাড়ির জন্য প্রানপনে দৌড়াতে থাকতাম। একটা ব্যাপার আজ ও বুঝলাম না, পহেলা বৈশাখে ই কেন ঝড় হবে। অন্য দিন হলে ক্ষতি কি।
সন্ধ্যার আধাঁরে উপচে পড়া আনন্দ:
গলিয়ার সব চেয়ে আনন্দের সময়টা ছিল সন্ধ্যার দিকে। দাদা-দাদী, মা, চাচীকে সামনে রেখে আমরা সবাই আমাদের ক্রয়কৃত সামগ্রী একে একে ব্যাগ থেকে বের করতাম। কাপড় ও বাশেঁর পাখা, দাদার জন্য লাঠি আর দাদীর জন্য পানের খুপরি যে আপু কখন কিনেছে তা মেলাতে বুঝতে পারতাম না। সব কিছু সামনে নিয়ে বসে থাকার মধ্যে কি যে অপার্থিব আনন্দ ছিল তা লিখে প্রকাশ করার মতো না। এখন ও যদি এই মুহুর্তগুলোর কথা মনে পড় তবে শৈশবে ফেলে আসা আনন্দটুকু ঠিকই সময়ের ব্যবধান কাটিয়ে মনের মধ্যে অদ্ভূত রকম দোলা দিয়ে যায়।
পহেলা বৈশাখের সেই গলিয়ার দিনগুলো যদি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো তবে সব কিছুর বিনিময়ে হয়তো তা ফিরে পেতে চাইতাম। শুধু আমি ই নই, মানুষ মাত্রই তার শৈশবকে জড়িয়ে ধরতে চায়। এটাই হয়তো প্রকৃতি প্রদত্ত ভালোলাগার অনুভূতি। এই অনুভূতিতে এতটুকুও খাঁদ নাই, এতটুকু ও ভনিতা নেই।।