একটা সম্পর্ক তৈরিতে দুইজন মানুয়ের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা থাকলেও সেই সস্পর্কটা ভেঙ্গে ফেলতে একজনের ভূমিকা ই যথেষ্ট। অথচ এই সম্পর্কটাই আপনার জীবনের প্রানের উৎস, বেঁচে থাকার অবলম্বন এবং সকল সফলতা ও ব্যর্থতার জিয়নকাঠি। প্রবল ভালোলাগা বোধ থেকে যেই সস্পর্কের পথচলা শুরু হয়, নিজেদের মধ্যে সামান্য ভুল বুঝাবুঝি, অবিশ্বাস, সন্দেহ কিংবা পারিপার্শ্বিক টানপোড়নে সেই সম্পর্ক মুহূর্তেই প্রকৃতির কাঠগড়ায় দাড়িয়ে যায়। কিন্তু এই সামান্য সীমাবদ্ধতা যদি দু'হাতে সরিয়ে সামনের দিকে হেটে যাওয়ার ইচ্ছা অনুভব করেন তবে পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্কটাই হয়ে উঠবে সত্য অন্যথায় সম্পর্কের ভাঙ্গন বা ব্রেকআপ ই হয়ে উঠবে নিষ্ঠুর নিয়তি।
অস্বীকার করছি না যে সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে বিশ্বাস ও ভালোবাসা বোধ। তবে যৌক্তিক মনের প্রচেষ্টাও সম্পর্কের গতিময়তা বাড়িয়ে দিতে কিংবা পুনঃজন্ম দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সম্পর্কের মধ্যে ব্রেকআপ যখন আপনার দ্বারপান্তে এসে দাড়াবে, আবেগ ঝেড়ে ফেলে আপনাকে হতে হবে আরো কৌশলী, সচেতন ও সময় নির্ভর।
ব্রেক আপ থেকে সম্পর্কটিকে বাঁচাতে কিংবা রক্ষা করতে আপনি প্রধানত ৩টি ধাপ অনুসরন করতে পারেন যার মধ্যে প্রথম ধাপটি হবে অনেক বেশী মনস্তাত্ত্বিক ও জটিল। প্রথম ধাপের প্রচেষ্টায় সফল হতে পারলে আপনি হয়তো আপনার সম্পর্কটিকে রক্ষা করতে পারবেন অপ্রত্যাশিত নিয়তি থেকে।
ক) সম্পর্কের প্রতিফলন:
পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্কটিকে বাঁচিয়ে রাখতে আপনাকে এবং আপনার সঙ্গীটিকে আরো বেশী যৌক্তিক ও বাস্তববাদী হতে হবে। এই ধাপের কোন কিছুতেই অতিরিক্ত আবেগকে স্থান দেওয়া যাবে ন্। তাড়াহুড়া না করে, জিদ কিংবা অভিমানের বশবর্তী না হয়ে সম্পর্কের গভীরতা থেকে এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।
=) সমস্যার স্বরুপ নির্ণয় করুন: আপনার সঙ্গীর সাথে ঠিক কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে বা কি কারনে পারস্পরিক সম্পর্কটি ব্রেকআপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা নির্ণয় করার চেষ্টা করুন। মুখে হয়তো তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তুলে ধরবেন কিন্তু কিছুটা সময় নিয়ে একটু ভেবে দেখুন তো আপনি সম্পর্কের যে সমস্যাগুলোর কথা ভাবছেন তা আসলে সত্য কিনা। একটা ড়ায়েরীতে তা ক্রমান্বয়ে লিখতে পারেন। এতে আপনার মনের অভিমান/অভিযোগগুলো যৌক্তিক বিন্যস্ততা পাবে।হতে পারে প্রিয় মানুষটি আপনাকে অহেতুক সন্দেহ করছে, অথবা সে আপনাকে আগের মতো সময় দিচ্ছে না। এমন ও হতে পারে তার কাজকর্মে ঠিক আগের মতো বিশ্বাসবোধ আসছে না অথবা সে আপনার ব্যাপারে অনেক বেশৗ কর্তৃত্বপরায়নতা দেখাচ্ছে।
=) আলোচনায় বসুন: জেদের বশে নিজেদের তৈরী করা ভালোবাসার সম্পর্কটির হটাৎ ইতি না টেনে দু'জন মুখোমুখী বসে আলোচনা করার চেষ্টা করুন। আপনাদের সম্পর্কটির ব্যাপারে সে (সঙ্গী) ঠিক কি কি সমস্যা দেখতে পাচ্ছে তা তাকে আলোচনা করার সুযোগ দিন এবং আপনিও ঠিক কি কি সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন তা তাকে পরিস্কার ও যুক্তিসংগতভাবে জানিয়ে দিন। এবার দু'জনের পক্ষ থেকে দেখতে পাওয়া সমস্যাগুলো বিচারকরুন, সত্যতা যাচাই করুন এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করুন।
=) সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করুন: কিছু কিছু ক্ষেত্রে ই অনেক সম্পর্ক যুক্তিযুক্ত কারনে ভেঙ্গে যেতে পারে কিন্তু আপনি যদি এই পর্যায়ে এসে অনুধাবন করেন যে তাকে আপনি সত্যি সত্যিই ভালোবাসেন, তার অনুপস্থিতি সহ্য করতে পারবেন না এবং আপনার সঙ্গীর ও যদি এই রকম উপলদ্ধি আসে তবে ব্যক্তিগত ইগো সমস্যা কাটিয়ে সম্পর্কটিকে টিকিযে রাখতে নিজ থেকে উদ্যোগী হোন। আপনাদের সম্পর্কের ভাঙ্গা সেতুর দুইপাশে দু'জন দাড়িয়ে এবার সেতুর নিচের পানির দিকে একটু তাকান। দেখেনতো ঐ পানির পর্যাপ্ততায় সম্পর্কের সমস্যাগুলো পরিস্কার করা যায় কিনা।
=) সম্পর্কের পরিকল্পনা ছক তৈরি করুন: অনেকেই ভেঙ্গে যেতে থাকা সম্পর্কটিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষণে এসে অনেক বেশী প্রকিশ্রুতি বা পরিকল্পনা করে বসেন যা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। তাই এই ক্ষেত্রে এসে আপনার ও আপনার সঙ্গীর সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রেখে সম্পর্কের পরিকল্পনা ছক তৈরি করতে পারেন। লেখাপড়া, চাকুরী প্রভৃতির মাঝেও নিজেদের জন্য কিছুটা সময় বরাদ্ধ করুন।মনে রাখবেন, প্রতিটা সম্পর্কের জন্য অনুভূতির সাথে সাথেই সময়ের প্রয়োজনীয়তা ও জড়িত।
খ) কমিউনিকেশন গ্যাপ হ্রাস করন:
দ্বিতীয় ধাপে এসে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের সমীকরণটা আরো নিবিড় করার চেষ্টা করতে হবে। এইক্ষেত্রে সঙ্গীর চিন্তা ভাবনা, ভালোলাগা মন্দ লাগার মতো ব্যাপারগুলোকে প্রতিটি পদক্ষেপে গুরুত্ব দিতে হবে।
=) নতুন করে নিজেকে প্রকাশ করুন: এই ধাপে এসে অনেকেই নিজের কথা-বার্তা, চিন্তা-ভাবনাগুলোকে সঙ্গীর কাছে প্রকাশ করতে কুন্ঠা বোধ করনে। আমি বলবো, এই ক্ষেত্রে এসে নিজেকে সরাসরি সততার সাথে প্রকাশ করুন। প্রতিটি অনুভূতি তার সাথে শেয়ার করুন। দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া ভালো মন্দ ঘটনাগুলো ও তাকে জানাতে ভুলবেন না। অনেকেই এই রকম শেয়ারিং এর ক্ষেত্রে প্রাচীনপন্থি মনোভাবের হয়ে থাকেন। কিন্তু আপনি যদি সৎ থাকেন, আপনার সঙ্গীর জন্য যদি আপনার মনে সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে তবে কোন রুপ লুকোচুরি করার প্রয়োজন পড়ে না। মনের ভেতরের অনুভূতি অথবা মনের বাহিরের ঘটনা বা পারিপার্শ্বিকতা চেপে রেখে সাময়িক ভাবে সুখী হওয়া যায় কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটা ঠিকই নড়বড়ে থেকে যায়।
=) সিদ্ধান্ত গ্রহনে সঙ্গীর মতামতকে গুরুত্ব দিন: আপনি যদি আপনার গুরুত্বপূর্ন কোন সিদ্ধান্ত সঙ্গীকে না জানান, তার মতামতের প্রওয়াজনীয়তা না দেখেন তবে সে ঠিকই মন থেকে হীনমন্যতা বোধ করবে এবং আপনার ঐ সিদ্ধান্তের প্রতি তার কোন শ্রদ্ধা ও থাকবে না। আমার বাবা-মা, দাদা-দাদীদের মধ্যে এই সমস্যাটির প্রকট অবস্থা দেখেছি এবং এই রুপ ভুল হিসাবের বাজে প্রতিক্রিয়া ও দেখে আসছি।
বড় কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে সঙ্গীকে কাছে ডাকুন, তার সাথে সিদ্ধান্তের প্রতিটি দিক আলোচনা করুন এবং তার চিন্তা-ভাবনা, আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনের সুযোগ দিন।
=) আর যুদ্ধ নয়: কোন অবস্থাতেই সঙ্গীর প্রতি মারমুখী আচরন করবেন না। নিজেদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব থাকবে না তা নয়, বরং সেই দ্বন্দ্বগুলো কতোটা সততার সাথে নিরসন করতে আগ্রহী সেটা ই মুখ্য বিষয়। প্রতিটি কথা ভদ্র ভাবে প্রকাশ করতে শিখুন। নিজেদের সম্পর্কটিকে সম্মান করতে শিখুন।
গ) সম্পর্কের পুনঃজন্ম:
সম্পর্কের রুপরেখার ছকটি আরো মজবুত ও উন্নত করতে প্রতিটি কাজের মধ্যেই সঙ্গী ও তার ভালালাগাকে প্রাধান্য দিন। তার সম্পৃক্ততায় সামান্য একটা কাজ ও হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশী উপভোগ্য।
=) শখ/ইচ্ছাগুলোর বাস্তবায়ন: সময় করেই সঙ্গীকে নিয়ে পার্কে ঘুরে আসতে পারেন,জিমে যেতে পারেন অথবা কোন রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে ডিনার সেরে আসতে পারেন কিংবা একসাথে শপিং করা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন বাজার করার কাজটাও করে ফেলতে পারেন। তারপর সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনটিতে আপনারা একসাথে কোন সিনেপ্লেক্স থেকে মুভি ও দেখে আসতে পারেন। ধরুন আপনার প্রিয় মানুষটির সাথে একটা ভৌতিক মুভি দেখছেন। এক পর্যায়ে মুভির পর্দায় কোন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে পাশে বসা প্রিয় মানুয়টি ভয়ে আপনার হাতটি শক্ত করে আকড়ে ধরলো। আপনার উপর তার অবচেতন মনের এই রকম পরম নির্ভরতা কিন্তু আপনার মন্দ লাগবে না। আমি বরং নিশ্চিত করে বলতে পারি, এই ধরনের এটাচমেন্ট নিজেদের সম্পর্কের মধ্যে ইনোসেন্স ছড়িয়ে দেয়।
=) দূর কোথাও থেকে ঘুরে আসুন: তল্পি-তল্পা নিয়ে নিজেদের পরিচিত গন্ডি থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যেতে পারেন। অপরিচিত স্থান বলছি এই জন্য যে প্রতিটি মানুয় ই নিজের বৃত্তের মধ্যে কনফিডেন্ট, অন্যের উপর নির্ভরশীলতা তেমন না ও থাকতে পারে। অজানা কোন স্থানে যখন দু'জন একসাথে ঘুরতে যাবেন তখন পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা অনেক বেড়ে যাবে। সামান্য দোষ-ত্রুটি তখন চোখেই পড়বে না।
=) ভালোলাগা কাজগুলো একসাথে করুন: ভালোলাগে এমন কিছু কাজ দু'জনে মিলে করে ফেলতে পারেন তা যত ই ছোট হোক না কেন। নতুন আইটেমের কোন রান্নার এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখুন, তখন রান্না ঘরটাকে ই মনে হবে স্বর্গ।
=) স্মৃতির সাগরে একসাথে ডুব দিন: একা একা দিনগুলো থেকে শুরু করে দু'জনের এ্কই পথে হাটা পর্যন্ত সবটুকু স্মৃতির ফ্রেমবন্দি মুহূর্ত আপনাকে ও আপনার সঙ্গীকে অসাধারন অনুভূতি দিবে। দু'জন মিলে ফ্রেমবন্দি ফটো অ্যালবাম দেখতে গিয়ে পেছনের দিনগুলোর জীবন্ত তরঙ্গের ছোঁয়া অনুভব করতে পারবেন হয়তো।
সম্পর্কের গতিময়তা ও পারস্পরিক ভালোবাসা বোধ বাচিঁয়ে রাখার কথা বলতে গিয়ে "অনুপ্রেরণা" নামক পেজ এর একটা স্ট্যাটাস মনে পড়ে গেলো। তাই সেটাও আপনাদের সাথে শেয়ার করছি :
"খুব সহজেই নিজের ভুল মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই থাকে। অধিকাংশ সময় আমরা নিজেদের কষ্টটাকে বড় করে দেখি, আমাদের কথায় যে অন্য কেউ কষ্ট পেতে পারে সেইকথা ভুলে যাই।
আমরা কখনই আগে সরি বলিনা, ওপাশের মানুষটি কখন সরি বলবে এই আশায় থাকি। আমরা খেয়াল করি না যে সেও আমার মতোই মানুষ, সেও সরি না বলে অপেক্ষায় আছে। এই দ্বন্দ্বের কারণেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যে মানুষ একসময় হৃদয়ের অনেক কাছে ছিল সে অনেক দূরে সরে যায়।
এই ইটপাথরের জগত অনেক বেশি স্বার্থপর, আপনজন খুব কম মিলে এইখানে। নিজেদের ছোট ছোট কিছু ভুল, নিজেদের ইগোর কারণে সে মানুষগুলোকেও আমরা দূরে সরিয়ে দিই। একা হয়ে যাই আমরা। শুধু একটু প্রচেষ্টা, অন্যের দিকটা বুঝতে পারার মানসিকতাই কাছের মানুষগুলোকে হারিয়ে যেতে দিবে না কখনও"।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন:
ট্রেনিং এর বিভিন্ন আর্টিকেল, মডিউল তৈরি করতে গিয়েই WikiHow এর সাথে পরিচয়। সেই থেকে ই আমার প্রতিটা কাজে সামান্য করে হলেও এর সাহায্য নিয়েছি। ব্রেকআপ থেকে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার নিজস্ব ভাবনা ও উপায়সমূহ WikiHow এর স্ট্রাকচারে ফেলে উপস্থাপন করে বেশ ভালো লাগছে। আর ছবিগুলো সরাসরি এখান থেকেই নেওয়া।