somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লৌকিক অলৌকিকতা

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পান্নুকে দেখেই ধক্‌ করে আমার বুকটা কেঁপে ওঠে। অতটুকু ছেলেকে দেখে ভয় পাবার কিছু নেই তবুও আমার বুক কাঁপতে থাকে অশুভ কোনো আশংকায়। অবশ্য পান্নুকে যে অতটুকু ছেলে বললাম তা বলাটাও যৌক্তিক না। নিতান্তই কিশোর। বয়স পনেরো বা ষোল হবে বড়জোর। দুপুরের খাবার খেতে অফিসের গেট দিয়ে বের হতেই শুনি রাস্তার অপর পার থেকে হাত উঁচিয়ে পান্নু আমাকেই ইশারা করছে

- আন্টি দাঁড়ান, দাঁড়ান।

ওকে দেখে আমার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং বা স্পীড ব্রেকার থাকলেও সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটে চলেছে ব্যস্ত রাস্তার দুই ধারে। এরই মাঝে হাত তুলে গাড়ির গতি স্লো করিয়ে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় হাসি মুখে।

আন্টি কেমন আছেন?

আমি কোনো উত্তর দেয়ার আগেই বলে ওঠে- আপনার কাছেই আসছিলাম। জরুরী কাজ আছে। বাবা বলছে কাজটা করে তবেই যেন বাড়ি ফিরি। না হলে আমার পড়াশুনা করা বন্ধ করিয়ে দিবে। আন্টি আমার কাজটা করে দেন প্লিজ।

পান্নুর কথা শুনে রাশেদের উপর ঘৃণায় আরেক দফায় আমার মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগতে থাকে। নিজের সন্তানকে কোনো বাবা এসব বলতে পারে আমার বিশ্বাস হতে চায় না। অবশ্য বিশ্বাস না হয়ে উপায় কি, রাশেদের সাথে আমার অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না। আরেকটু হলেই অসাবধানতায় রাশেদের সাথে জড়িয়ে জীবনটাকে ভীষণ অনিশ্চয়তায় ফেলে দিচ্ছিলাম আর কি।

এখন তো লাঞ্চ টাইম। আমি খেতেই বের হচ্ছিলাম। চলো খেতে খেতে শুনি তোমার কাজের কথা।

চলেন।

আমার একে তো খিদে লেগেছে তার উপর পান্নুর আগমন আর তার বাবার ফালতু ঝামেলা পাকাবার দুশ্চিন্তার সাথে যোগ হয়েছে খাবারের দোকান খুঁজে পাচ্ছি না। আমার অফিসের আশেপাশের জায়গাটা ভীষণ অদ্ভুত। এই দেখি রাস্তার ধার ঘেঁষে এতো এতো খাবারের দোকান, টং দোকান আবার মুহূর্তেই সব উধাউ হয়ে যায়। পুলিশের লোকজন এসে কি ধুপধাপ দোকান ভেঙেচুরে দিয়ে যায় কিনা কে জানে! আজকাল কারো উপরেই ভরসা রাখা যায় না।

আন্টি কই আপনার খাবারের দোকান। আমার খুব খিদা লাগসে। সেই সকাল বেলা বাসে উঠছি। দুইবার টেম্পো বদলাইছি। বাবা খুব হিসাব করে টাকা দিছে। দশ টাকায় একটা বনরুটিও খাওয়া যায় না। রিকশাতে না আইসা হাঁইটা হাঁইটা আপনার অফিসে আসছি। আন্টি বিরানি খাওয়ান।

পান্নুর কথার যন্ত্রণায় আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। লাঞ্চের জন্য এক ঘণ্টা সময় দেয় মাত্র । অফিসের সামনে এরকম লেক কখন বানালো কে জানে। ভাসমান রেস্তোরাঁর মত কি যেন দোল খাচ্ছে লেকে। বাঁশের সাঁকো কাঁপা কাঁপা পায়ে কোনোমতে পার হয়ে রেস্তোরাঁয় ঢোকার আগেই দেখি পান্নু তরতরিয়ে দক্ষ পায়ে ভেতরে একটা টেবিল দখল করে দাঁড়িয়ে আছে।

তাড়াতাড়ি বসেন আন্টি। নাইলে জায়গা দখল হইয়া যাইব। দখল হইলে কারো কাছ থেইকা জায়গা নেওন অনেক দিগদারীর বিষয়। মাইরা জায়গার দখল নেওন যাইব কিন্তু আন্টি আমার এহন মারামারি করতেও ভালো লাগে না। তবে আমি একজনরে মারমু ঠিক করছি। কিন্তু শালার ব্যাটাগো হোটেলে ভালো কোনো খাওন নাই। হুদা ডাইল পুরি আর চা। ভাবছিলাম খামু বিরানি আর কপালে জুটলো ডাইল পুরি।

ছেলেটা এবার এস এস সি পাশ করার পরেও মুখের ভাষার কি ছিরি, ভাবি আমি। আবার বলে মারামারিও নাকি করে। আমি অদ্ভুত এক আতংক নিয়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। আমার খিদেটা মরে গেছে ততক্ষণে। কিন্তু পান্নু গপগপিয়ে পুরি খাচ্ছে, চা'য়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। ঐ মিয়ারা সস্‌ দিতারো না। পয়সা নিবা কিন্তু সস্‌ খাওয়াইবা না। ফাইজলামি পাইসো? নাক নকশা ফাটাইয়া হালামু কিন্তু।

খামু না খামু না কইরাও বিশটা পুরি খাইয়া ফালাইলাম, বলে পান্নু ঢেঁকুর তোলে। বিরানিটা পাইলে ভালো হইত, আন্টি। ঐ মিয়া দুধ চা দিবা,চিনি দুই চামচ। লগে একটা এলাচ ভাইঙ্গা দিও তো!

পান্নু, তুমি তো আগে এভাবে কথা বলতে না। তোমার মুখের ভাষা এতো বাজে হয়েছে কীভাবে! সত্যি ওর অবস্থা দেখে আমার খারাপ লাগতে থাকে। ওকে সে কথা বলার আগে ও আমাকে থামিয়ে দেয়।

শোনেন আন্টি, এইবার কাজের কথা কই। ওর ইন করা শার্টের ভেতর থেকে ও একটা সাদা খাম বের করে। শার্ট আর গেঞ্জির ঘামে খামটা কেমন ভিজে ভিজে মনে হচ্ছে দেখে। ইসশ গরমে ভিজ্যা গেছে। একটু কড়া রইদে শুকাইলে নাইলে চুলার নিচে রাখলে কাগজটা আবার ফকফকা হইয়া যাইতো মনে হয়। থাউক সমস্যা নাই। নিজেই হড়বড়িয়ে ও এতো গুলো কথা বলে। এই নেন আন্টি কাগজটা ফিলাপ করেন, বলে আমার দিকে এগিয়ে দেয়।

ঘামে ভেজা কাগজটা হাতে নিতে আমার কেমন কেমন লাগে। তবুও খাম খোলার আগে জানতে চাই কি আছে এর ভেতর।

আমি আসলে পুরাপুরি কিছু জানি না। বাবায় দিয়া কইলো তোমার সিমিন আন্টিরে এইটা দিয়া বলবা ফিলাপ কইরা দিতে। আমি তো পইড়া দেখি নাই কিন্তু মনে হয় আপনার লগে কোনো ছাড়াছাড়ির কাগজ।

পান্নুর কথা শুনে আমার রাগে জা জ্বলতে থাকে। ইচ্ছে করে জোরে ধমক লাগাই বা চড় মেরে বসি। এবার আমিই আর আমার বিরক্তি গোপন করতে পারি না।

কি সব বাজে কথা বলছ? কীসের আবার ছাড়াছাড়ি! তোমার বাবাকে আমি বিয়ে করলাম কবে! অল্প বয়সে বেশি পেকে গিয়েছ তুমি, পান্নু।

আমি তো আগেই বলছি আন্টি আমি জানি না পুরাপুরি। কিন্তু বাবার লগে তো আপনার বিয়া হবার কথা আছিলো। কিন্তু আমার চাচা আর চাচি পুরা বিষয়টা জানে। আপনে চাইলে তাগো সাথেও কথা কইতে পারেন। বাবায় অবশ্য আমারে বইলা দিসে আপনারে বুঝাইয়া কইতে না পারলে জানি আমি নিজে আপনারে চাচার বাসায় লইয়া যাই। তারপর এই কাগজ সই কইরা দিবেন।

পান্নু, তুমি কি একটু সুন্দর করে কথা বলতে পার?আমার খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে সবকিছু শুনে। তুমি একটু সুন্দর ভাষায় কথা বলো। আর এইসব ফালতু পেপার টেপার সই করা দূরের কথা, আমার খুলে দেখার ইচ্ছাও নাই।

আন্টি আমি আগে সুন্দর কইরাই কথা বলতাম। আপনি তো জানেনও আমার পাইলট হবার শখ ছিল। কিন্তু বাবার কথামত চলি নাই বইলা আমার ডানা দুইটা কাইটা দিছে, দেখেন। বলে ও ওর শার্ট কাঁধের কাছে এনে আমাকে দেখায়। দেখলাম হাতের জয়েন্টের জায়গায় সূক্ষ্ম করে কাঁটা এবং রিপু করার মত ডিজাইন। আমার অবাক চাহনি দেখে ও হাসতে হাসতে বলে,

ভয় পাইয়েন না। হাত দুইটা দেখতে আসলের মত লাগলেও বাবায় নকল হাত কিন্যা দিছে। গাড়ি চালাইতেও এখন আর সমস্যা হয় না।

গাড়ি মানে ? তুমি কি ড্রাইভারের পেশা বেছে নিয়েছ?

আন্টি কথা বাড়াইয়েন না, তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠেন। নাসিম চাচার বাড়িত যাওন লাগব সন্ধ্যার আগে আগে। সন্ধ্যার পরে গেলে বিপদ। আপনে আপনের অফিসে ফোন কইরা কইয়া দেন আইজকা আপনে আর ফিরবেন না। কোনোদিনই ফিরবেন না।

বাঁশের সাঁকোটা পার হতে হতেই কোত্থেকে এক গাড়ি এসে হাজির হয়। আমি অবাকের পর অবাক হচ্ছি। নিউ মডেলের অডি গাড়ি। ড্রাইভিং সিটের ড্রাইভারকে ঝাড়ি মেরে ও গাড়ি থেকে নামিয়ে বলে -

মিয়া গাঞ্জা খাইসো নি ? কতক্ষণ ধইরা আন্টি খাড়াইয়া আছে কানে বাতাস ঢুকে না যে ফোন করতাছি। নামো গাড়ি ত্থিকা।

পান্নু , তোমাকে না বলেছি সুন্দর করে কথা বলতে?

গ্রামে থাইকা আন্টি টাউট,বাটপার হইয়া গেছি। ভালো কইরা কথা বলতে ভুইলা গেছি। বাবায়ও বাটপার হইয়া গেছে। বাবায়ও এমনে কথা বলে। কিন্তু আন্টি আপনের মাথায় কিন্তু অনেক বুদ্ধি। বাবার লগে না জড়াইয়া আপনে ভালো কাম করছেন।

পান্নুর কথা শুনে আমার দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে। কার সাথে যেন পান্নু ফোনে কথা বলছে - হ, হ পাইসি হেরে। আমার লগে লইয়া আসতাছি।

শোনেন আন্টি, আপনে ভয় পাইয়েন না। চাচা-চাচির লগে কথা কইবেন। কাগজে একটা সই দিবেন। ব্যাস আপনের কাজ শেষ। তখন আবার দিয়া যামু নে।

দাঁড়াও আমি আমার সাথে আরেকজনকে নিয়ে যাবো। বাসায় ফিরতে রাত হলে অন্ধকারে আমি ভয় পেতে পারি। সামনেই মুনের বাসা পড়ে, ওকে ঝটপট তুলে নেই। মুনের আবার আরেক সমস্যা। পান্নুর মতোই বেশি কথা বলে আর বেশি অস্থির হয়। তাই ওকে গাড়িতে তুলেই বলে নেই আজকে যাতে কথা বলে আমাকে বেশি বিরক্ত না করে। মুন আমার সম্পর্কে ভাইএর শ্যালিকা হলেও ওকে বোনের মতোই ভাবি, বন্ধুও।

গাড়ি যতই সামনে আগায় কেমন শহরের কোলাহল কমে আসতে থাকে। শুধু হুশহাস করে গাড়ি চলে যাবার শব্দ পাই। আর ঠাণ্ডা, নির্মল বাতাসের ঝলকে ভেতরটা কেমন জুড়িয়ে আসতে চায়। এতো সুন্দর জায়গাটা! রাস্তায় নেমপ্লেটের দিকে চোখ পড়তেই মনে হতে থাকে খুব চেনা কোনো জায়গা কিংবা এর এখানে আমার আসার কথা ছিল এমন মনে হয়।

পান্নু তোমরা এই এলাকায় কবে আসলে?

আমার কথা শুনে পান্নু ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে আমার দিকে তাকায় অবাক হয়ে। কি বলেন আন্টি, আমরা তো এখন এদিকেই থাকি চাচার বাসায়। বাবায়ও কয়দিন ধরে চাচার বাসায় আইসা উঠছে।

রাশেদও এখানে থাকছে তাহলে?

বাবায় যারে বিয়া করবো, সেও সাথে আসছে। বিয়া হয় নাই এখনো, কিন্তু এইখানে বিয়া ছাড়াও থাকনের নিয়ম আছে। কিন্তু আলাদা বাসা এখনো নিতে পারে নাই। আলাদা বাসা নিতে গেলে আপনার সই কইরা ঐ কাগজটা বাবার দরকার। আর ওইটা আপনের কাছ থেইকা আদায় করতে না পারলে আমার বাবার আমার পা'ও কাইট্যা ফেলবো বলছে। তাই যেমনেই হোক আপনেরে আমার দরকার আছিলো।

ওর কথা শুনে আমার ভেতরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসে অজানা আতংকে। মনে হয় অপারেশন থিয়েটারের বেডে নীল আলো জ্বালিয়ে কেউ আমার পা দুটোই যেন কেটে দিচ্ছে। ঐ সময় মুনের মোবাইল এতো ঝংকার নিয়ে বেজে ওঠে ,আমি ভীষণভাবে চমকে উঠি।

সিমিন আপু, তালুই ফোন দিচ্ছে। তালুই যদি শোনে আমরা রাশেদ ভাইদের বাসায় যাচ্ছি, খুব রাগ করবে কিন্তু। কি উত্তর দিবো উনাকে বলেন, তারপর ফোন ধরব।

ধ্যাত, সবসময় ফান করবে না তো মুন। আব্বা কোত্থেকে ফোন দিবে, আব্বা তো সেই কবেই মারা গেছে।

মারা যাক আর যাইই হোক, আপনাকে তো বলেছিল রাশেদ ভাইএর সাথে যোগাযোগ না রাখতে। আমি এখন উনারে মিথ্যা কথা বলবো, আমরা পার্কে যাই?

যা খুশী বলো গিয়া।

আপু, বিশ্বাস না হলে দেখেন তালুই কিন্তু ভিডিও কল দিচ্ছে।

হঠাৎ করেই পান্নু মুনের হাত থেকে খপ করে মোবাইলটা নিয়ে বললো - নানাজান এতো অস্থির হইতাসেন ক্যান ? আপনের মাইয়ার ওটিতে অপারেশন হইতাসে তার। পা মেশিন দিয়া কাঁটা শেষ, এখন আঠা লাগাইতে হইব। ঐ যে কস্মেটিক্স সার্জারি কয় না ওইটা? রাইতে বাসায় আইসা পড়বো, ফোন দিয়া আর জ্বালাইয়েন না তো। বলেই ফোনর লাইন কেটে দেয়।

আন্টি নামেন ,নামেন। চইলা আসছি।

তাকিয়ে দেখি রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে সরু একটা পাথুরে সিঁড়ি ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। বাংলো ধরণের বাড়ি। রাস্তার ওপর থেকে গলা উঁচিয়ে পান্নু বলে, আন্টি বেলে চাপ দিয়েন না। শক্‌ খাইবেন। আমার চাচায় কিপটা, বেল ঠিক করায় নাই। দরজায় জোরে জোরে ঘুষা মারেন। চাচী হইলো বয়রা, জোরে শব্দ না হইলে সে আবার কানে শোনে না।

আপু, পান্নু ছেলেটাকে কিন্তু আমার ভালো মনে হচ্ছে না। খেয়াল করেছেন ও কি রকম অসম্মান দিয়ে বড়দের সম্পর্কে কথা বলে? তখনো আমি তালুই এর সাথে কথা শেষ করতে পারলাম না, আমার হাত থেকে ফোনটা কীভাবে কেড়ে নিলো! বেয়াদব ছেলে একটা।

এদিকে আমি চিন্তা করছি জোরে জোরে ঘুষি মেরে দরজা ধাক্কালে ব্যথা পাবো। বাড়ির বাইরে ইন্টারকমে চাপলেই তো ভেতর থেকে কারো ফোন রিসিভ করার কথা। ততক্ষণে পান্নুর নাসিম চাচা গেট খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে এসে বসতে বলেন -

আসেন ভাবী আসেন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

আমার খুব অস্বস্তি লাগে নাসিম ভাইয়ের মুখ থেকে ভাবী ডাক শুনতে। তাই আমাকে সিমিন নামেই ডাকতে বললাম।

কি যে বলেন না ভাবী, রাশেইদ্যার সাথে আপনার বিয়ে হয়নি তো কি হয়েছে,আপনাকে ভাবী বলেই মনে জায়গা দিয়েছি। আমাদের এই এলাকাটায় আবার তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে। আপনাকে আর দেরী না করাই। কষ্ট করে যদি কাগজটা সাইন করে দিতেন খুব ভালো হতো। বলে উনি আমাকে কাগজ আর কলম ধরিয়ে দেন। পান্নুর দেয়া খামের মতোই দেখতে এই খামটাও। আমি কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি অপরিচিত ভাষায় লেখা চার -পাঁচ পৃষ্ঠার কাগজ বিভিন্ন শর্তাবলীর ফর্দ কিংবা দাবী উঠিয়ে নেবার ফর্দ হতে পারে। এক ঝলক দেখে আসলে তেমন বুঝেও উঠতে পারি না। কাগজের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নাসিম ভাইয়ের কাছে জানতে চাই -

আসলে আপনারা কি চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। পান্নু কি সব হেঁয়ালি কথাবার্তা বলে আমাকে অফিসের সামনে থেকে নিয়ে এলো। বললো আপনি নাকি ভালো জানেন। বলেন তো পুরো ব্যাপারটা কি!

ব্যাপারটা তেমন কিছু না। রাশেইদ্যা বিয়া করবো তো, তাই আপনার কাছে ডিভোর্স পেপার চায়।

আমি কিছু বলার আগেই মুন কেমন হই হই করে ওঠে। ঐ মিয়া আপনিও কি আপনার ভাতিজার মত পাগল হয়ে গেছেন নাকি ? আপনাদের রাশেইদ্যার সাথে কবে সিমিন আপুর বিয়ে হইছে? যত্তোসব ফাউল টক !

মুনের কথা শুনে নাসিম ভাই একটুও না রেগে হেসে হেসেই বললেন -

ডিভোর্স পেপার না আসলে দায়মুক্তির কাগজ চায়। স্লিপ অব টাং। কিছু মনে করবেন না। আসলে ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের অবাক হবারই কথা। মনে করেন আমরা এখন যা চিন্তা করি, যা ভাবি বা যেটা মুখ ফুটে উচ্চারন করি কিংবা কারো কাছে কিছু নিয়ে শপথ করেছি, সবই যে আমাদের ক্ষমতাময় সার্ভারে সেইভ হয়ে গেছি তাতো আমরা কেউ জানতাম না। আবার মনে করেন জায়গায় জায়গায় আগুন লেগেছে কিংবা সুন্দর কোনো শিল্পকর্ম মানে ভাস্কর্য ভেঙে পড়লো, রাস্তায় বা দেয়ালে ফাটল ধরলো! আমাদের এলাকার আশেপাশে এসব বেশি হচ্ছে ইদানিং। অন্যদের খবর জানি না, আমি আমার ঘরকে পাপমুক্ত রাখতে আপনার সাহায্য চাই ভাবী, হাত জোর করে নাসিম ভাই আমার কাছে কাকুতি করেন।

মুন আবারো চিৎকার করে ওঠে, আপনি আসলে কি বলতে চান? এইগুলি আমার সিমিন আপু করছে? ঐ আপু ওঠো তো, এরা চাচা-ভাতিজা মিল্যা আমাদের পাগল বানানের বুদ্ধি করছে।

নাসিম ভাই মুনের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলতে থাকেন, তো ভাবী আমি যা বলতে চাচ্ছিলাম, আমরা আমাদের পরিণত বয়সে এসে যা যা সব চিন্তা করি, কাজ করি বা শপথ করি আর সেগুলো যদি রক্ষা না করি তাহলে আমাদের সার্ভারের কন্ট্রোল প্যানেলে ইনফো গুলো থেকে যায়। আর পাপের সংখ্যা বা পাপের চিন্তার পরিমাণও যদি বেড়ে যায় কিংবা অন্য এলাকা থেকে কোনো অপরাধী এসে আমাদের এই এলাকায় বসবাস শুরু করে , সেখানেও এসবের প্রতিক্রিয়া পড়তে থাকে কিংবা অপরাধীকে যারা তাদের বাসায় জায়গা দিবে,তাদেরকেও অপরাধী হিসেবে গন্য করা হবে অপরাধীকে আশ্রয় দেবার ঠিক দুই মাস পর থেকে। এই দুই মাসের মধ্যে তার সমস্ত অপরাধের সংখ্যা মুছে ফেলতে হলে তার মেজর পাপগুলো আগে সর্ট আউট করতে হবে। এর মাঝে প্রধান হলো শপথ ভঙ্গ করা, স্বপ্ন দেখানো, মিথ্যা বলা এবং বাটপারি।

কখন যে নাসিম ভাইয়ের স্ত্রী কফি নিয়ে ঘরে ঢুকেছে টের পাইনি। এটাও তো বললা না , নিজেরে অহংকারী আর সমস্ত চিন্তায় নিজেই সঠিক, শুদ্ধ মনে করা আর মনের মাঝে প্রবল কাম ভাব নিয়ে ঘোরা নিজের ফিয়ন্সে বা স্ত্রী থাকার পরেও, সেটাও মেজরিটি পাপের অংশ। নেন ভাবী, কফিটা খান বলে আমার দিকে কাপ বাড়িয়ে দেয়।

মুন যে একটু ছটফটে আর অস্থির স্বভাবের আগেই বলেছি। ও নায়লা ভাবীকে শুনিয়েই বললো, পান্নু আমাদের বলেছে আপনি নাকি কানে শোনেন না, এটা সত্যি?

নায়লা ভাবী বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে ওঠেন, কথা সত্য। কিন্তু যাদের পাপের পরিমাণ বেশি আর যারা সদ্য মিথ্যে বলা শিখছে,শুধুমাত্র তাদের কথাই কানে শুনি না। আর বাকি সবকিছু আমার স্বাভাবিকই আছে।

নাসিম ভাই, আমি কাগজে লেখা এই অপরিচিত ভাষাটা আসলে বুঝতে পারছি না। আমি ফর্মে কীভাবে সিগনেচার করবো আর সার্ভারে আমার মতামত ইনপুট করবো, বলেন? আপনার ভাইকে নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেইন নেই আসলে। কোনো ভয়েস রেকর্ডের সিস্টেম থাকলে বলেন, আমি না হয় সেভাবেই বলে দিচ্ছি।

সিমিন ভাবী, বাংলা,ইংরেজি পড়তে জানলে এই অপরিচিত ভাষাও পারবেন। রাশেইদ্যা আপনারে এই পর্যন্ত কয়টা স্বপ্ন দেখিয়েছে সেটা বলেন তারপর আঙুল দিয়ে ফর্মের একটা কলাম দেখিয়ে বলে,এখানে সংখ্যা লিখেন। কতবার ধমক দিয়েছিল, কতবার রাগ করে সম্পর্ক ভাঙতে চেয়েছিল, কতবার আপনাকে সন্দেহ করেছিলো এসব একে এক লিখেন আর আপনিও ওকে মাফ করে দিয়েছেন এই মর্মে তারপর সিগনেচার করে দিয়েন ।

নাসিম ভাই, আমিও তার সাথে অনেক রিয়েকশন দেখিয়েছিলাম। এখন এসব নিয়ে দেনাপাওনা চুকে গেছে,বাদ দেন না। তাহলে তো আমারও কনফেস করতে হবে।

নায়লা ভাবী বলেন, আরে সিমিন আপনি এখনো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেন নি। আপনার এলাকার স্বাভাবিক অবস্থা কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যার আগেই কি শহরে সন্ধ্যা নেমে আসে, পাথর বৃষ্টি হয়? কত অস্বাভাবিক অবস্থা আমাদের শহরের আপনাকে বোঝানো সম্ভব না। এসবই হচ্ছে আমাদের শহরে অপরাধীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে!

আমি আর কথা না বাড়িয়ে একে একে তাদের অনুরোধ অনুযায়ী ফর্ম ফিলাপ করি। তখন মৃদু স্বরে নাসিম ভাই বলেন, আপনার গলার আর বুকের মাঝ বরাবর অনেকগুলো কষ্ট জমে ছিল,সব এখনই ঝরে পড়বে। আপনি শান্ত হয়ে বসেন, চোখ বন্ধ করে অনুভব করেন আপনি সব দাবী উঠিয়ে নিয়েছেন।

আমি চোখ বন্ধ রাখলেও ঠিকই শুনতে পাই নায়লা ভাবী আর মুনের কুটকুট করে কথার আওয়াজ।

আমাদের শহরে তো বিয়ে না করলে এক সাথে থাকা সম্ভব না। রাশেইদ্যা যাকে বিয়ে করবে সেই মেয়েটাকে নিয়ে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে ঢুকেছে বুঝলা? নিজের দেবর তো, ফেলতেও পারি না। আর যে মেয়েটাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে সেই মেয়েটাও ওর মত অপরাধী। মনের মাঝে আজেবাজে যত সব কুচিন্তা। আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি ঠিকই কিন্তু তাকে গালি দিয়ে কথা বলি।

মুন জানতে চায়, কি গালি ?

ঐ যে শুনলে না, রাশেইদ্যা বলি! কারো নামকে বিকৃত করে ডাকাটাও অপরাধের শামিল কিন্তু ও নিজেই যেহেতু অপরাধী, তাই আমাদের অপরাধ এখন কাউন্টেবল না।

মুন হাসতে হাসতে বলে, বাহ্‌ আপনাদের দারুণ সিস্টেম তো! কিন্তু এতো তাড়াহুড়া করে বিয়ে করতে চাচ্ছে কেন আপনার দেবর? কোনো সমস্যা ?

সমস্যা মানে মহা সমস্যা। দেবরের বয়স এখন ঊনপঞ্চাশ চলছে। পঞ্চাশ হয়ে গেলে ওর যৌন ক্ষমতা থাকলেও ওর বউ আর বাচ্চা কন্সিভ করতে পারবে না আর যদি কন্সিভ করেও সে সব বাচ্চাগুলো ওর মতোই অপরাধী হয়ে বেড়ে উঠবে। আমরা চাই না আর কোনো বাজে কাজ আমাদের শহরে বা পৃথিবীর কোথাও ঘটুক।

হুম তা বেশ বলেছেন ভাবী।

হঠাৎ করেই আমার কেমন নির্ভার লাগতে থাকে। মনে হয় নীলচে রঙের কিছু আমার ভেতর থেকে শব্দ করে বেরিয়ে গেলো। নাসিম ভাই, আপনাদের বাসায় ঢোকার আগে মনে হলো বাড়ির পেছনেও কোনো গার্ডেন আছে। আমার খুব অক্সিজেনের সমস্যা হচ্ছে। আমি একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসতে চাই।

শিওর ভাবী শিওর। কিন্তু সাবধানে যেয়েন। তাড়াতাড়ি ফিরবেন। আপনাদের আবার সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে ফিরে যেতে হবে। নায়লা ভাবী কেমন আমতা আমতা করেন। আমার হাত ধরে থেকে বলেন যাবেননননন... খুব সাবধান। আশেপাশে খারাপ কিছু ঘুরঘুর প্রতিনিয়ত। আপনার পাশেই।

আমি ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে থাকি। প্রথম দেখায় যা গার্ডেন বলে মনে হয় ,আসলে ভালো মত খেয়াল করে দেখলাম জংলা একটা জায়গা। ঝাঁঝালো বুনো ফুল-ঘাস-লতা-পাতার মাদকময় গন্ধে ভরপুর। পুরনো ভাঙা বাড়ির মত ছোট একটা ঘরের মতোও চোখে পড়লো। ঘরের চারপাশে কাঠের দেয়ালে ঘেরা হলেও দরজাটা আধা স্বচ্ছ কাঁচের। কেন যেন দরজাটা আমাকে পায়ে পায়ে কাছে ডাকতে থাকে। আমার মনের আরেকটা অংশ আমাকে সাবধান করতে থাকে -

সিমিন যেও না, সিমিন যেও না।

দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ হলেও বোঝা যায় আবছা ছায়ামত ভারী শরীরের কেউ ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে আসছে আমাকে স্বাগত জানাতে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি সেখান থেকে পালাতে কিন্তু অশরীরী কেউ যেন দরজার কাঁচ ভেঙে আমাকে ধরতে হাত বাড়িয়ে দিতে থাকে।

সমাপ্ত



সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:১৪
৪৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×