আমার সাদামাটা চিন্তা ভাবনাগুলো শেষপর্যন্ত আর সাদামাটা রইলো না কিংবা বলা যায় আমি হয়তো নিজের অজান্তেই কোনো বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অপেক্ষায় ছিলাম বলে আমার জীবনটা রঙিন হয়ে উঠেছিলো। নাহ্ এ কথাটাও মনে হয় ঠিক না। আমি আসলে ধীরে ধীরে আমার ভেতর জেগে উঠছিলাম সবুজ হবার জন্য, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য। কিন্তু সে প্রক্রিয়াটা এতো ধীর গতির ছিলো যে আমার দীর্ঘ সাতটি বছর লেগে গেলো নিজের এই রূপান্তর টের পেতে।
এমনিতে আমি কথা বলতে দারুন ভালোবাসি। ইনফ্যাক্ট আমার প্রফেশনের কারণে আমাকে রোজ প্রচুর কথা বলতে হয় বিভিন্ন ক্লায়েন্ট এবং বায়ারের সাথে, ব্যক্তি প্রয়োজনে এবং বন্ধু মহলেও। বিশ্ববিদ্যালয়য় জীবনে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে ভালো বক্তা হিসাবে সুনামও কুড়িয়েছিলাম। সে যদিও এখন অতীত। কিন্তু যার কথা বলতে এতো ভূমিকার পাঁয়তারা সে কথাটিই বলতে পারছি না। কারণ তার কথা বা তার নামটা মুখে আনতে গেলেই আমি আমার আশ্চর্য রূপান্তরটা টের পাই। তার নামটা অনেক আদরে-সোহাগে আমার একেবারে ভেতর থেকে উচ্চারিত হয়ে হয়ে যখন আমার ঠোঁট পর্যন্ত এসে পৌঁছায়, তা তখন আর কোনো নাম বা সম্বোধনে পরিণত হতে চায় না। আমার ঠোঁট গলে তা যেন ফুলরেণু হয়ে হাওয়ায় উড়ে উড়ে বেড়ায়। মিতুল নাম নিয়ে সে তার পরিবারে বেড়ে উঠলেও আমার কাছে তার নাম ছিলো ' যোজনগন্ধা'। কী আশ্চর্য আমি ছিলো বলছি কেন! সে এখনো আছে একই ভাবে, একই নামে। বলা যায় তাকে আমার জীবনে একান্ত করে পাওয়াটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত রকমের, তাই হয়তো আমার ঘোর কাটে না তাকে নিয়ে। যদিও মাঝে মাঝে আমার ঘোর কাটাবার জন্য সে চিমটি কাটতে চায় কিন্তু আমি বলি
সোহাগ করো, চোখের পাতায় বুলিয়ে দাও জাদুর কাঠি, ঘুম পারিয়ে দাও আমায়! প্রত্যুত্তরে আমার কানে বাজতে থাকে তার উদ্দাম হাসি। একটানা বেজেই চলে সে হাসি ছন্দের মতো, মোহমায়ার মতো।
তার সামনে এলে আমি খুব বেশি কথা বলতে পারি না। আসলে তার ছোট ছোট এতো কথা, এতো ঘটনা, এতো হাসি-কান্নার গল্প জমে থাকে যে আমার আর নিজের কথ আবলা হয়ে ওঠে না। যদিও এটা একটা অজুহাতের কথা বললাম। সত্যি কথা বলতে কি সে যখন থেকে আমার যোজনগন্ধা হয়ে উঠেছিলো, তাকে নিয়ে আমার বিভোর হবার ব্যস্ততাও বাড়ছিলো। নাহ্ এটাও আরেকটা অজুহাতমূলক কথা যদিও তা মিথ্যে নয়। সত্যি কথা হলো তার সামনে গেলে আমি কথা বলার জন্য শব্দের অভাব অনুভব করতাম। পৃথিবীর নাম না জানা, না শোনা শব্দগুলোকে মুঠোবন্দী করার জন্য তীব্র আকুলতা বোধ করতাম কারণ যেনতেন শব্দ ব্যবহার করে তার সাথে কথা বলাটা আমার জন্য অসম্ভবই ছিল। মূলত আমার যোজনগন্ধা একজন গল্পকার, একজন কবি। হয়তো আমি নতুন মনে করে কোনো একটি নামে তাকে সম্বোধন করলাম কিংবা মনের ভাব প্রকাশ করতে কোনো রূপক ব্যবহার করলাম আর ওদিকে সে তখন হেসেই খুন। কি লজ্জার ব্যাপারই না হবে তখন! এসব ভেবেই আমার আর কথা বলা হয়ে উঠতো না যোজনগন্ধার সামনে। বরং ওর কণ্ঠের সুরেলা শব্দেই বিমুগ্ধ থাকতাম, এখনো হচ্ছি প্রতিনিয়ত। আর সে খুব হাসতে পারে। যখন তখন হাসে। কাঁদতে কাঁদতেও হাসে, চোখ মোছে, কথা বলে তারপর আবার হাসে। এজন্য তাকে আমি মনে মনে স্মিতা নামেও ডাকতাম। মাঝে মাঝে আমি তার কথায় এতোটাই বুঁদ হয়ে থাকতাম যে সে আমার সাড়াশব্দ না পেয়ে তার তর্জনির টোকায় আমার গালে প্রশ্ন এঁকে দিতো ' কি ভাবছ ?' আমি তাকে আনমনে 'স্মিতা' বলে ডেকে উঠতাম। আমি খুব অবাক হয়ে ভাবতাম সে কেমন ভাষায় লেখে, কেমন ভাবনায় ভাবে, কেমন অনুভবে সে শব্দকে ভালোবাসে! আমি কেন তার শব্দ হয়ে যাই না । তার সবসময় তার ভাবনাকে ছুঁতে চাইতাম, আমি তার চোখের নাম না জানা, অচেনা জায়গাটার কল্পনা হতে চাইতাম, আমি তার হৃদয়ের নিভৃততম বিষণ্ণতার মূর্তিটা তুলে এনে দেখতে চাইতাম আমার যোজনগন্ধা, আমার স্মিতার আড়ালে আর কোন সত্ত্বাটা আমার দৃষ্টিগোচর হয়ে আছে যেখানে আমার অনুভূতির পরশ পাওয়া তার জন্য বাকি রয়ে গিয়েছে কিনা!
আফসোস, আমি তার সামনে এলেই কথা হারিয়ে ফেলতাম। এখনো হারিয়ে ফেলি। ঐ তো সে আমার কাছেই বসে আছে। অতি মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। মাঝে মাঝে সে বইয়ের কোনো একটা পাতা খুলে আমার সামনে দিয়ে বলে ' এটুকু পড়ো। দেখো কি অদ্ভুত সুন্দর করেই না লেখক এ অংশটা লিখেছেন!' আমার সামনে জলজ্যান্ত একজন সাহিত্যিক থাকতে আমি কিনা পড়বো অন্যের লেখা! সাহিত্য চর্চা করা বা পড়া, চিঠি লেখালেখির অভ্যাস আমার তেমন নেই। মানে কোনো কালেই ছিলো না। অবশ্য চিঠি লেখার অভ্যাস একেবারেই ছিলো না এটা বললে আংশিক ভুল বলা হবে। আঁখি পীড়াপীড়িতে তাকে আমার বেশ কয়েকবার চিঠি লিখতে হয়েছিলো। কলেজ জীবনের নতুন প্রেমের আবেগে খুব সহজেই পাতার পর পাতা দৈনন্দিন কথার ফুলঝুড়িতে আঁখিকে লিখতে পারতাম 'আজ আমার হাত ধরেছিলে বলে বাসায় ফিরে আজ খেতেই বসিনি, তোমার হাতের স্পর্শ ঢাকা পড়ে যাবে বলে!' তখন কি আর জানতাম হৃদয়ের স্পর্শের চেয়ে বড় ভাষা আর অনুভব হতে পারে না ! তাই বলে তখনকার সে অনুভবটাও মিথ্যে ছিলো তা কিন্তু নয়। সেসব শুনে যোজনগন্ধা কৌতুকমাখা চোখে তাকিয়ে থেকে আমাকে বলেছিলো
' তাই নাকি ! তবে আমাকেও একটা চিঠি লিখো !'
যোজনগন্ধা আমার কাছে কিছু চেয়েছে কিন্তু তাকে আমি দেইনি, সেরকম দুর্ঘটনা আমার জীবনে এখনো আসেনি। তবে এটাও সত্যি, আমি আজো দীর্ঘ সাত বছরে যোজনগন্ধাকে চিঠি লিখে উঠতে পারিনি। যে নারী আমার সমস্ত ক্লান্তি, শঙ্কা, অস্থিরতা, ব্যর্থতা থেকে এক নিমিষেই শান্তির পরশ দিতে পারে, অসহনীয় সময়গুলোকেও সে অনিন্দ্যময় করে তুলতে পারে, সে নারীকে চিঠি লেখা, নিজের সবটুকুকে তুলে ধরার কাজটাকে আমার এতো সহজ মনে হয় না। অবশ্য যোজনগন্ধা আমার কাছে একবারই চিঠি চেয়েছিলো। এমনিতে ব্যবসায়িক কারণে বা দেশের বাইরে থাকা বন্ধুদের, এমনকি সময় সুযোগ পেলে ইমেইলেইও যোজনগন্ধাকে হাই হ্যালো বলেছি। কিন্তু সে জানিয়েছিলো সেসব নাকি চিঠি হয়নি। সাথে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস! আমি তার এরকম নরম, বিষণ্ণ সুর চিনি। সে অনুচ্চ বা উচ্চ কোনোভাবেই আমার সাথে কথা বলে না, অনুযোগ বা অভিযোগ নেই। শুধু তার চোখের ভাষাটা বদলে যায়। সে সময় আমার যোজনগন্ধা খুব নীরব হয়ে যায়। উচ্ছ্বাসহীন, বর্ষার মেঘমালার মতো ধূসর, শব্দহীন পৃথিবীর মতো। তার নীরবতাকে আমার বড্ড ভয়। আমার তখন অসহ্য রকমের কষ্ট হয়। আমি যোজনগন্ধার মতো কবি বা গল্পকার না, তা না হলে হয়তো আমিও বোঝাতে পারতাম আমার সে সময়ের ক্ষরণ কতোটা তীব্র হয়ে আমাকেও আচ্ছন্ন করে রাখে তার মতো গুমোট মেঘে। সে নিজের মাঝে একবার গুটিয়ে গেলে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনাটা আমার কাছে পৃথিবীর জতিলতম কাজ মনে হয়। আমি তখন খুব ক্লান্ত, অবসন্ন আর নিঃসঙ্গ অনুভব করি যোজনগন্ধার অধরা হাসির পেছন পেছন ছুটে। তুমি কি জানো প্রিয়তম নারী, তোমাকে চিঠি লেখা আমার জন্য কতোটা দুঃসাহসিক একটা কাজ !
মাঝে মাঝে আমার এখনো মনে হয়, আদৌ কি যোজনগন্ধা আমার হৃদয়ের ভাষা বোঝে কিংবা আমি কি আসলেই ওর একান্ত আমিটাকে ছুঁতে পেরেছি ? শুনে ও হাসে। বলে -
' এই যে অতৃপ্তি তোমার মাঝে, এই যে আরো ভালোবাসতে চাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা তোমার মাঝে এটাই তোমাকে সারাজীবন উজ্জীবিত করতে আমাকে ভালোবাসতে! একজন মানুষের সবটুকু আমিকে কে কি কখন ছোঁয়া যায় ! '
কি জানি তার কথাই হয়তো ঠিক। এমনিতে তো আমি তার সামনে শব্দের কাঙাল কিন্তু বড্ড ভয় হয় মাঝে মাঝে ঠিক যখন আমাকে তার প্রয়োজন, যেভাবে আমাকে তার প্রয়োজন সেভাবে কখনো যদি আমার নিজেকে তার সামনে মেলে ধরতে না পারি, ছুটতে ছুটতে তার কাছে আসতে না পারি, আমি তাকে হারিয়ে ফেলবো না তো , সে হারিয়ে যাবে না তো ? তার বরাবরের রহস্যময় উত্তর -
' হারিয়ে গেলে খুঁজে বের করবে। আমি জানি তুমি ঠিক ঠিক আমাকে খুঁজে আনতে পারবে!'
তার কথায় আমার বুকের ধুকপুকানি বাড়ে। তাকে আমি শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি। সে সুতীব্র আবেগে তার নাক আমার বুকে ঘষে ঘষে আমার আমির গন্ধ নেয়। এ যাবত পর্যন্ত তাকে আমার বলা হয়নি আমার স্বপ্নের কথা, আমার প্রাপ্তির কথা কিংবা তাকে ঘিরে আমার ভালো লাগার অনুভবের কথা। শুধু একদিন তাকে ভরদুপুরে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। তাও তাকে স্পষ্ট করে কিছুই বলিনি। তার সাথে পরিচয়ের দীর্ঘ সাত বছরে আমার শুধুমাত্র একটি বেদনার তীব্র স্পর্শ তাকে অনুভব করাতে চেয়েছিলাম। হয়তো বা সেদিন দুপুরে যোজনগন্ধার হৃদস্পন্দনও কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিলো। একজন পুরুষের তীব্র সমর্পণ নাকি এটাই কাউকে জড়িয়ে ধরে কান্না, অব্যক্ত কষ্ট, ভালোবাসা স্পর্শের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়াতে - যোজনগন্ধা তার সেই চিরচেনা উদ্দাম হাসিতে আমার ভেতর গলে পড়তে পড়তে আমাদের বিয়ের রাতে সে কথা বলেছিলো। সেদিন ভরদুপুরে আমার সমর্পণ, কান্না শুষে নিতে নিতে সে তার দু'বাহুতে আমাকে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো -
কাউকে বিয়ে করার মানে কি এই আমি একেবারে চলে যাচ্ছি তোমাকে ছেড়ে ? আমি তো সবসময়ই আছি তোমার সাথে। বন্ধুর মতো, আগে যেভাবে ছিলাম !'
আমার দু'বাহুর বন্ধনও প্রত্যুত্তরে যোজনগন্ধার কোমল পিঠে আরো তীব্র হয়ে চেপে বসেছিলো। সেদিন দুপুরে সে তার ভাবী স্বামীর কথাই আমাকে শোনাচ্ছিল। আসন্ন বিয়ে উপলক্ষ্যে তার কেনাকাটার গল্প, তার ভাবী স্বামীকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করার প্ল্যান করছিলো আমাকে নিয়েই। আগেই বলেছি আমি যোজনগন্ধার কোনো চাওয়াকেই না করতে পারি না। তার সেদিনের চাওয়াকেও না করতে পারিনি। জানিয়ে দিলাম তানভীর ভাইকে আনতে আমিও তার সাথে এয়ারপোর্ট যাবো। আমার ভেতরটা সেদিন ভেঙেচুরে গেলেও শুধুমাত্র তার খুশী খুশী মুখটার দিকে তাকিয়ে তার চাওয়াকে পূরণ করতে রাজি হয়েছিলাম।
আমার মাঝে অন্য পুরুষ মানুষকে ঘিরে ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা কখনোই কাজ করতো না। হোক সেটা প্রফেশনাল বা ব্যক্তি পর্যায়ে। কিন্তু আমি যত আমার যোজনগন্ধার মাঝে হারাচ্ছিলাম বা ডুবছিলাম ততই বোধহয় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে উঠছিলাম। তার মুখে অন্য কোনো পুরুষের নাম বা বন্দনা শুনলে আমার ভেতরটা জ্বলে যেতো প্রবল ঈর্ষা বোধে। যোজনগন্ধার হাসিতে হাসিতে যেসব পুরুষের নাম লেখা হতো, তাদের প্রত্যকেকেই যে আমি কতো শতবার খুন করেছি তা যদি সে জানতো ! আসলে তার রাশিটাই এমন, অন্যকে তীব্রভাবে কাছে টানে। তুলারাশির জাতিকা!
যোজনগন্ধা ক্যারিয়াস্টিক হলেও সে ছিলো সে ছিলো প্রচণ্ড হোমসিক ধরণের একজন মানুষ। তাকে দেখে অবাক হতাম কতোটা তীব্র অনীহা নিয়ে সে বছরের পর বছর কর্পোরেট লাইফ মেন্টেইন করে যাচ্ছে। হয়তো তার জীবনের তীব্র কোনো ঝড় থেকে বাঁচতেই সে ক্যারিয়ার সচেতন হয়েছিলো। কিন্তু সে শুধুই কিছু করতে হবে, ব্যস্ত থাকতে হবে এসব কারণে। তার মূল ফোকাসের জায়গা আসলে ছিলো তার লেখক সত্ত্বা যা নিয়ে সে ছিলো খুব অলস। কিন্তু এতোটা হাসি মুখ নিয়ে সে কী করে পারে এভাবে জীবন কাটাতে সে কথা জিজ্ঞেস করাতে সে জানিয়েছিলো -
সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার একটা ঘর লাগবে।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না ঘরটা সে ঠিক কার কাছে চাইতো। কিন্তু এ চাওয়া থেকেই এর তীব্রতা বাড়তে বাড়তেই একদিন এই কর্পোরেট জগৎ থেকে নৈঃশব্দ্যের এক নিভৃতকোণ খুঁজে নিয়ে আমার স্মিতা, আমার যোজনগন্ধা হারিয়ে যেতে বসেছিলো তার চিরচেনা লোকালয় থেকে। সে আমার সামনে থেকেও যেন সামনে ছিলো না। আসলে রোজ রোজ যে দৃশ্যমান, তাকে হয়তো আমরা দেখেও সেভাবে খেয়াল করে দেখি না, অনুভব করি না এই ভেবে ' সে তো আছেই!' যোজনগন্ধার সাথে আমার কখনোই হৃদয়ঘটিত কথা হতো না বা কখনো সুযোগ পেয়েও তাকে আমার মনের কথা বলা হয়ে ওঠেনি, সে কথা আগেও বলেছি। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন টের পেলাম সে আমাকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে, একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাবে, সে ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল অবিশ্বাস্য, তীব্র আতংকের অনেকটা নিজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবার মতোই কিংবা অনেক উঁচু থেকে মাটিতে পতনের মতোই কিংবা বলা যায় নিজের আমিত্বের মৃত্যু। যোজনগন্ধাহীন জীবন মৃত্যুসমতুল্যই আমার কাছে। অবশ্য এখানে একটু সংশোধনী প্রয়োজন, ঐ যে একটু আগে বললাম না ‘ আমাকে ছেড়ে যোজনগন্ধা অনেক অনেক দূরে চলে যাবে’, আসলে সে তো কখনো বলেনি আমার কাছেই সে ছিলো কিংবা সে আমার। তাছাড়া কোনো কিছু নিয়েই সে আমার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো না। তাই সে তার জীবনের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারেই ছিলো স্বাধীন। কিন্তু আমি জানতাম আমাকে শেষ পর্যন্ত তার সাথে সাথেই থাকতে হবে।
বস্তুত সে আমাকে তার রোজনামচা মনে করে তার নিত্যকার ঘটনাগুলো বলে যেতো। কখনো তার অফিসের কথা, তার খিটখিটে মেজাজের ব্যসের কথা, কখনো নতুন কেনা সালোয়ার কামিজের গল্প, আজিজ থেকে কেনা কবিতা বা গল্পের বইয়ের কথা, কখনো গল্পের বইয়ের চরিত্রদের তার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠার গল্প অথবা তার পাড়ার কোণ লোকটা হঠাৎ ফুঁড়ে এসে মজনু সেজে তার সামনে দাঁড়াতো অথবা তার পাণিপ্রার্থী চন্দন, রিপন, তারেক ভাই কিংবা ব্যাংকের গাজি ভাইয়ের কথা। সে কখনো খেয়াল করেছিলো কিনা জানি না, তার জীবনে চলার পথে এসে পড়া অনাকাঙ্ক্ষিত সব মানুষের ভিড়ে কেমন খাবি খেতাম, তালগোল পাকিয়ে ফেলতাম নিজের মাঝেই কেমন বেদনাক্রান্ত হয়ে পড়তাম কিন্তু টুঁ শব্দটি করতাম পাছে সে বিরক্ত হয় কিংবা কষ্ট পায়। সে সময় আমি মনে মনে যোজনগন্ধাকে চিঠি লিখে যেতাম। সেসব অতীতের কথা হলেও চিঠির ব্যাপারটা বর্তমানের, এখনো বহমান, চিঠিটা আমি এখনো লিখে যাচ্ছি। যোজনগন্ধা এখন আর কারো অধিকারে নেই। সে এখন আমার। নাহ্ এভাবে বলা হয়তো ঠিক হচ্ছে না বরং বলা যায় আমি এখন পুরোপুরিই যোজনগন্ধার, আমরা দুজনে এখন এক সত্ত্বার। জীবিকার তাগিদে এক শহরে, এক ছাদের নিচে থেকেও আমরা দুজনেই প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি। সারাটাদিন ছুটোছুটি করেই কাটে আমাদের দুজনের। যোজনগন্ধা তার লেখালেখি, পত্রিকার কাজ, তার গল্পের চরিত্রের সন্ধানে কতো জায়গাতেই না ঘুরে বেড়ায়! হঠাৎ হঠাৎ বিনানোটিশে আমাকে তার সফরসঙ্গী হতে হয়। আমার অফিসে এসেই বলে –
‘ চলো আজ বেরোবো।’
আমি সেসময়টায় উচ্ছ্বসিত হতাম নিঃসন্দেহে, এখনো হই। তবে যোজনগন্ধার সমস্ত উচ্ছ্বাসের কাছে আমার উচ্ছ্বাস, চাওয়া, প্রাপ্তি বা ক্ষেত্রবিশেষে বেদনা নতজানুই থাকে। আমি এভাবেই খুশী থাকি। এই যেমন আজকের কথাই ধরা যাক, তীব্র দাবদাহের পর নগরীতে আজ তুমুল বর্ষণ। কাজের প্রয়োজনে আমি তখন ভালুকায়। হঠাৎ করে বিকেলের দিকে যোজনগন্ধার ক্ষুদে বার্তা এলো –
‘ তুমি কোথায় ? বাইরে কি দারুণ বৃষ্টি দেখেছো ? কখনো থেমে থেমে কখনোবা মুষলধারে। তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছ ?’
আমি জানি কিংবা বলা চলে আমি জানতাম, আমার যোজনগন্ধা কি চায় । আমি তাই প্রাণপণে চাচ্ছিলাম বাইরে বৃষ্টিটা ঝরতে থাকুক অবিরাম, থেমে যেন না যায়। তাকে নিয়ে এই বৃষ্টিতে আজ আমি বেরোবো। ও হ্যাঁ আমি চিঠিটাও প্রায় শেষ করে এনেছি তার জন্য, আজই তাকে দিতে হবে। শুধুমাত্র তার চোখের অভিব্যক্তিটা দেখার ইচ্ছে আমার, শোনার অপেক্ষায় আছি সে বলবে –
‘সত্যিই আমাকে লিখেছো!’
এতক্ষণ শুধু তার কথাই বলে গেলাম, আমার কথা কিছুই বলা হলো না। আমার কথা না হয় আমার যোজনগন্ধার কাছেই জেনে নেবেন। বড্ড তাড়ার মাঝে আছি এখন। বৃষ্টি থামার আগেই আমাকে তার কাছে পৌঁছাতে হবে।
সমাপ্ত
উৎসর্গ - যোজনগন্ধার স্বামীকে