আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
… হুমায়ুন আজাদের লেখা “ আমাদের মা ” এটা আমার ভীষণ প্রিয় একটা কবিতা। মা তো শুধু মা নন, একজন নারীও। প্রাসঙ্গিক কারণেই এতো বড় কবিতাটা এখানে দেয়া সম্ভব হলো না কিন্তু কতটা গভীর এবং সূক্ষ্ম মানবিক বোধ থাকলে একজন মা’কে নিয়ে, একজন নারীকে নিয়ে এমন ভাবে ভাবা যায়, এমন ভাবে লেখা যায়! ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বিষয় নিয়ে সরাসরি না লিখে বরং কবিতা দিয়ে শুরু করলাম একজন নারীর অবস্থান নিয়ে। কতটা পরিবর্তন হয়েছে তার অবস্থানের; সেই আদি থেকে বর্তমান অবধি? জানি সেটা লিখে বা বলে ফুরোবার নয়।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে নিম্নতম মজুরি আর মানবেতর কর্মপরিবেশের বেড়াজাল থেকে নারীর উত্পাদনশীল কর্মক্ষমতাকে মুক্ত করতে এবং মজুরি বৈষম্যমুক্ত, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ও সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের দাবিতে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলেও ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব ইতিহাস এবং প্রথানুযায়ী ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশও এ দিবস উদযাপনে পিছিয়ে নেই।
আমার শুধু নিজেকে যাচাই করেই নয় সার্বিক ভাবে জানতে ইচ্ছে করে আমাদের দেশের নারীরা কতখানি ভালো আছেন, কতটা স্বস্তিতে আছেন? আমরা বাংলাদেশে শুধু নারী দিবসই নয়, বেগম রোকেয়া দিবস, শিশু কন্যাসন্তান দিবস ইত্যাদি অনেক দিবসই পালন করি। কিন্তু এসব দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা কেন এসেছে সেটা একটু ভাবলেই আমরা পেয়ে যাই। কোনো মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেই প্রতিবাদ করতে চায়, রুখে দাঁড়াতে চায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সেখান থেকে কথা ওঠে ন্যায্য অধিকার এবং সম্মানের, প্রয়োজন দেখা দেয় আলাদা করে দিবস উদযাপনের।
আজকাল প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে, অনেকেই নারী অধিকার নিয়ে, নারী পুরুষের পারস্পারিক সহাবস্থান নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন, চান কথা বলতে। যারা লিখতে চান, তারা লিখে বোঝাতে চান তারা সহনশীল এবং সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। কিন্তু আমি মনে করি আজকে নারীর অধিকার, দাবী, নারী নির্যাতন রোধ যা কিছু নিয়েই আমি লিখতে চাই বা বলতে চাই না কেন, হোক সে নারী গৃহিণী বা কর্মজীবি, সবার আগে দরকার উন্নত চেতনা। নারীর কাজ করা বা না করার সাথে এই চেতনা সম্পর্কযুক্ত নয়। কুসংস্কার, পুরাতন রীতিনীতি ও আচরণের পরিবর্তন দরকার, আরো দরকার মানবিক আবেগ ও মানবিকতার জয়। মানবতা হলো নিজের কথা চিন্তা করে অন্যের প্রতি উদার হবার ক্ষমতা। যে মানুষ অন্যের প্রতি উদার হতে পারে না, সে তার নিজের প্রতিও উদার না।
আমরা অনেক সময় ভুলে যাই বা মেনে নিতে পারি না আজ সামনের দিকে আগাতে চাইলে নারী-পুরুষকে একত্রে কাজ করতে হবে। তবে অনেকেই বলে থাকেন, নারী আর পুরুষ সমান হতে পারে না, কারণ নারী দুর্বল। ব্যাপারটা শুধু এই যুগে এসে কেন, অতীতের ক্ষেত্রেও একটা অগ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসেব উপস্থাপিত হতে পারে। উর্দু সাহিত্যের লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর “ লাইসেন্স” নামক গল্পে জনৈক নারীর স্বামী মারা যাবার পর তার ঘোড়ার গাড়ির লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়। জীবিকার উপায় হিসেবে তাকে বলা হয় বাজারে বসতে। সভ্যতার মুখোশ পরা এই আমরাই যে বেশ্যাবৃত্তিকে সমর্থন করে ফেলি অজান্তেই এই বোধ কি আমাদের আছে?
একজন মেয়ে যখন বড় হতে শুরু করে, শিক্ষাজীবনে পদার্পন করে, সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পরবর্তী অধ্যায় কীভাবে শুরু করবে, তার লক্ষ্য ঠিক করে নেয়। আমি মনে করি এখানে তার চিন্তাচেতনায় শিক্ষার ভূমিকাই মুখ্য হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক বাবা-মা’ই তাদের সে সন্তানটিকে চিন্তা করেন ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবেন। এটা যে শুধু গ্রাম পর্যায়ের চিন্তা তা নয়, শহুরে তথাকথিত আধুনিক সমাজেও এ মনোভাব বিদ্যমান। কিন্তু ভালো ছেলে বলতে আমরা কি বুঝি, ভালো ছেলে বা ভালো পুরুষ বা ভালো স্বামীর সংজ্ঞা কি ? দেখতে ভালো, ভালো আয় এবং বাড়ি গাড়ি থাকলেই অনেক বাবা-মা তাকে ভালো ছেলে, ভালো পাত্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। কিন্তু একবারও ভাবেন না যেখানে মেয়েটাকে তারা সংসার করতে পাঠিয়েছেন সেখানে তাদের মেয়েটি, তার সন্তানটি কেমন আছেন কিংবা ভাবলেও ‘ মেয়ে মানুষের বিয়ে কয়বার হয়। এক স্বামীর সংসারই করুক যত সেখানে কষ্টে থাকুক। ’ যেখানে পরিবারেই একজন নারীর সময়ে অসময়ে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, সে হিসেবে আমি মনে করি পরিবার থেকেই প্রথমে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে এবং অবশ্যই সবার আগে মা’কে শিক্ষিত হতে হবে। অন্তত ন্যূনতম শিক্ষাটা তার থাকা দরকার। তবে নারীর প্রতি নির্যাতন শুধু শারীরিকই নয়, মানসিকও। এই মানসিক নির্যাতন নিজের পরিবার এবং শ্বশুর বাড়ি থেকেও একজন নারীকে মুখোমুখি হতে হয় মাঝে মাঝে।
এখানে আমি আরও কিছু কথা বলতে চাই। নারী কি শুধু পুরুষ দ্বারাই অধিকার বঞ্চিত বা নির্যাতিত হয়? নারী নিজেই কি মাঝে মাঝে আরেক নারীর সাফল্যের পেছনে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে না? আমি নিজে নারী হয়ে সফলতা পাইনি বলে আরেক নারীর সফলতা দেখে কেন আমি ঈর্ষাপরায়ণ হবো? কেন আমার মাঝে এই চিন্তা কাজ করবে না যে আমিও সফল হবো, আমিও স্বপ্ন দেখবো এবং সেটা বাস্তবায়নও করবো? তাই আমাদের নারীদেরও দৃষ্টি ভঙ্গীর পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। হয়তো বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রতিটা মেয়ে কর্মক্ষেত্রে জড়াতে পারে না বা সুযোগ হয়ে ওঠে না। দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক কাঠামো ইত্যাদি নানা কারণই এর পেছনে কাজ করতে পারে।আবার দেখা যায় অনেক শিক্ষিত নারীও আছেন যারা গৃহিণী হয়েই থাকতে পছন্দ করেন, ঘর দেখাশুনা এবং সন্তানের লালন পালন করেন। আমি বলছি না এটা খারাপ কিন্তু ঘরে থাকবে বলেই কেন তাদের চিন্তাভাবনা টিভি সিরিয়াল, শাড়ি গয়নায় আবদ্ধ হয়ে যাবে! চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে বের হতে হবে, নিজের সচেতনতা বাড়াতে হবে যাতে নিজের করণীয় কাজ গুলো বুঝে নিতে পারে, দৃষ্টির প্রসারতা বাড়াতে হবে।
নারী জীবনে কতখানি সফল সেটা নিরূপণের মাপকাঠি সময়ই বলে দিবে, বলে দিবে তার কর্ম। যে নারী আজ সংগ্রামী, পরিবারের অন্য উপার্জনক্ষম সদস্য থাকতেও যাকে তার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে পরিবারের দায়িত্ব, তাকেই জীবিকার প্রয়োজনে অনেকের সাথে চলতে হয়, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামলাতে হয় বা নিজের কাজের জায়গাটিকে নিজের সুবিধা মতোই চলতে দিতে হয়। এ চিত্র আধুনিক শিক্ষিত সমাজে যেমন আছে, তেমনি আছে খেটে খাওয়া তৃণমূল নারীর সমাজেও। সারাদিন কাজ শেষে তাকে যখন সন্ধ্যায় বা একটু রাত করে বাড়ি ফিরতে হয় তখন আশেপাশের আমরাই হয়তো তার নামে কানাঘুষা করি। কিন্তু একবারও কি আমরা তার বেদনার তীব্রতা অনুভব করি, তার শ্রমের ঠিক ভাবে মূল্যায়ন করছি?
আসলে একজন নারীকে সবার আগে নিজের অধিকারবোধ বুঝে নিতে হলেও শিক্ষিত হতে হবে। সাথে সাথে শিক্ষিত হতে হবে পুরুষকেও। সন্তানদের মাঝে ভেদাভেদের বীজ রোপণ পরিবার থেকেই বন্ধ করতে হবে। তাদের অনুভব দিতে হবে যে সে একজন ছেলে/ মেয়ে শিশু না। সে একজন মানুষ। ইউনিসেফের সহায়তায় নির্মিত শিক্ষামূলক “মিনা”কার্টুনে যে মেসেজটি জনসাধারণের মাঝে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো সেটা বোঝার মানসিকতা আমাদের পুরোপুরি থাকাটা জরুরী মনে করছি।
আমার নিজের জীবনের একটা উদারহণ দেই আমার মা’কে নিয়ে। আমিও মা দিবস, নারী দিবস এলে আমার মা’কে ছোটখাটো কিছু উপহার দিয়ে থাকি। তখন মা খুব অবাক হয়ে উপহারের উপলক্ষ জানতে চান এবং উপলক্ষটা শুনে মাঝে মাঝে বলেন – “তোদের যে এখন কতো কতো দিবস পালন করতে হয়, এই দিবস উদযাপন করে আমরা সবাই কি ভালো থাকতে পারছি কিংবা কী দরকার ছিলো আবার এই উপহার দেবার!” এই কথার পেছনে হয়তো আমার মায়ের মতো অন্যান্য নারীরও অনেক দীর্ঘশ্বাস লুকোনো ছিলো বলে মনে করি।
প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও অনেক আয়োজন করে নারী দিবস পালিত হবে। কিন্তু নারী দিবস পালনের পেছনে যে সত্যিকারের আন্তরিক অনুভূতি তা যেন শুধু মুখের বুলিতেই সীমাবদ্ধ না থাকে, তা যেন সত্যিই কার্যকর হয় এ চাওয়া অন্যান্য সচেতন মানুষের মতো আমারও চাওয়া। গত বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল— Time for action to end violence against women অর্থাৎ ‘নারীর প্রতি সব ধরণের সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।’ উন্নয়নমূলক সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং অনুপ্রেরণা প্রদানে এ বছর নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে— ‘Inspiring change’ অর্থাৎ ‘পরিবর্তনকে অনুপ্রাণিত করা’। এ পরিবর্তন আমাদের চেতনায়ও ধারণ করতে হবে, বাস্তবায়নের ইচ্ছেও থাকতে হবে।
একজন নারীকে মা, বোন, স্ত্রী এই পরিচয়ের বাইরেও আমাদের আসলে ভাবতে শেখা উচিত সেও একজন মানুষ। তারও আছে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের অধিকার। কেননা নারী ঘরে বা বাইরে যা করছে তার পরিবারের জন্য তা কোনো অংশেই একজন পুরুষের চেয়ে কম নয়। বরং আমরাই নারীকে দুর্বল করে রেখেছি। আমরাই আনতে পারি সে সমাজ যেখানে আমরা নারী-পুরুষ সকলে সকলকে মানুষ বলে ভাবতে শিখবো, আনন্দ বেদনায় থাকতে পারবো একে অন্যের পাশে।
শুধু নারী দিবস বলেই একটি নির্দিষ্ট দিনে আমরা নারীদের নিয়ে ভাববো, তাকে সম্মান দিবো তা নয়। আসুন আমরা নারীকে তার যথাযথ সম্মান দেই, তাকে দেই তার সদিচ্ছা পূরণের অধিকার, তাকে ভাবতে শিখি স্বতন্ত্র একজন মানুষ হিসেবে ।