সকালে ঘুম থেকে ওঠার কোনো বাধ্যবাধকতা রিয়াজের নেই বলেই ও বেশ বেলা পর্যন্তই ঘুমায়। অবশ্য সব দিন যে ও সকাল নয়টা দশটা পর্যন্ত ঘুমায় তা নয়। জাজিম তোষকের সাথে মাথার নিচে বালিশ হলে না হয় একটা কথা ছিলো,তাহলে ও সারাদিনই বিছানায় গড়াগড়ি করতো। তবে ওর ইচ্ছে আছে টাকা-পয়সা জমাতে পারলে আর নিয়মিত কাজের ব্যবস্থা করতে পারলে সবার আগে ও একটা ঘর ভাড়া নিবে,একটা চৌকি আর জাজিম- তোশক,ফুল-পাখি আঁকা বেডকভার আর মোটা দেখে দুটো কোলবালিশ বানাবে। বড়লোক মানুষ দুই পাশে দুটো কোলবালিশ নিয়ে ঘুমায় এই দৃশ্য কী করে রিয়াজের কিশোর মনে আঁকা হয়েছে তার সঠিক কোনো হিসেব নেই ওর কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের রাস্তা,কার্জন হলের দালানের বারান্দা,কখনোবা শহীদ মিনারের চত্বরেও দেয়াল ঘেঁষে,আড়াল খুঁজে নিয়ে রিয়াজ শুয়ে থাকে। রাতটা এভাবে পার করে দিতে খুব একটা সমস্যা হয় না ওর কিংবা ওর মতো অসংখ্য ভাসমান মানুষের যারা নাড়ির টান ছেড়ে ভাসতে ভাসতে ঢাকা শহরে এসে ভিড় করেছে। শিক্ষিত মানুষের কাছে রিয়াজরা অবশ্য ছিন্নমূল শিশু,পথশিশুর মতো আরও কী কী সব নাম আছে,ওসব নামেই পরিচিত। টিএসসি,চারুকলার সামনে,শাহবাগ আরও কতো কতো জায়গায় মিটিং এ এসব শুনেছে রিয়াজ,মাইক নিয়ে কতো মানুষই বিভিন্ন দাবী-দাওয়া পূরণের পাশাপাশি ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন নিয়ে বক্তৃতাও দিয়েছে। এইসব দাবী- দাওয়া কার কাছে করা হয়েছে রিয়াজ এসব বোঝেনি। সরকারের কাছে নাকি যারা দামী দামী গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায় ঢাকা শহরে, আলিশান বাড়িতে যারা থাকে তাদের কাছে? এসব শুনে অবশ্য ওর বা ওদের মতো মানুষের জীবনযাত্রায় খুব একটা পরিবর্তন যে এসেছে তা বলা যাবে না। তাই এসব নিয়ে রিয়াজ মাথাও ঘামায় না এখন।
আজকে ঘুমের মাঝে রিয়াজ স্বপ্ন দেখছিলো বোধ হয়। চোখে সানগ্লাস পড়ে, দামী জুতো পায়ে মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চুল গুলো ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসে বাতাসে উড়তে উড়তে জানান দিচ্ছে শহরবাসীকে এটা রিয়াজ যাচ্ছে। বাংলা সিনেমার নায়ক রিয়াজকে ওর দারুন পছন্দ,ওর মায়েরও পছন্দ বলেই ওর নামটা জন্মের পর রিয়াজই রেখেছিলো। যদিও রিয়াজের চুল এমন ঘাড় পর্যন্ত না তবুও স্বপ্নে কী করে লম্বা চুলওয়ালা হয়ে গেলো সেটা বুঝতে পারছিলো না। রিয়াজ লম্বায় প্রায় সানি বসের সমান। সানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র,কী যেন রাজনীতির বিষয় নিয়ে পড়ে। তার চেহারাটা নায়কের মতো, তাই রিয়াজ 'বস' বলে ডাকে। রিয়াজদের বয়সী অনেককেই সানি বসের দরকার হয় মিছিলে যাবার জন্য। মিছিল শেষে দশ বিশ টাকা করেও পায়। মিছিল কখনো ক্যাম্পাসের ভেতরেও হয় আবার 'রাজপথেও' হয়। ক্যাম্পাস, রাজপথ, গণতন্ত্র, অধিকার আরও অনেক শব্দই রিয়াজ এই ঢাকা এসেই শিখেছে। কিন্তু 'একশন,একশন,ডাইরেক্ট একশন' বলতে বলতে যখন ওরা মিছিল নিয়ে যায় রিয়াজের তখন খুব ভালো লাগে। শরীরের ভেতর কেমন যেন একটা ভাব হয়, মনে হতে থাকে রক্ত টগবগ করে ফুটছে। সানি বসকে রিয়াজ ওর এই ব্যাপারটা বলেছিলো, শুনে উনি বলেছিলেন - এটাই দেশপ্রেম বুঝলি? নিজেদের অধিকারটা এভাবেই আস্তে আস্তে বুঝে নিতে হবে। জবাবে রিয়াজ জিজ্ঞেস করেছিলো -
কার কাছে অধিকার বুইঝ্যা নিমু ? হাসিনার কাছে নাকি ম্যাডামের কাছে?
ওর মুখে ম্যাডাম শব্দটা শুনে সানি সহ ওদের অন্যান্য বন্ধুরা সবাই হেসে উঠলে রিয়াজ বুঝে নেয় ও খুব দামী একটা কথা বলেছে। তা না হলে পার্থ ভাই কেন বলবেন -
রিয়াজ, তুই আবার বল তো এই কথা গুলি,আমি ভিডিও করে রাখি।
এরপর উনি তার মোবাইল বের করে রিয়াজের মুখ থেকে এসব কথা আবার বলিয়ে নেন। মাঝে মাঝেই পার্থর সাথে দেখা হয়ে গেলে রিয়াজ ওর সেইদিনের ভিডিওটা দেখতে চায়।
সকাল সকাল এই বিল্লালটা আজ ডাকাডাকি করে রিয়াজের ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দেয়। সকালের দিকে ঘুমটা অনেক গাঢ় থাকে রিয়াজের। বিল্লালও রিয়াজের মতোই এক ভাসমান মানুষ। বয়স চৌদ্দ পনেরো হতে পারে। একবার নিজের বয়সের সাথে তুলনা দিতে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো -
তোর বয়স কতো রে?
রিয়াজের কথা শুনে বিল্লালের সে কী হাসি! আমার মায় কইতে পারবো, আমি কী জানি? আমাগো আবার বয়স আছে নি? কী অদ্ভুত কথা যে ও বলতে পারে। রিয়াজের বয়স এখন তেরো বছর চলছে।
ঐ রিয়াইজ্যা,উডস না? আইজকা বাপী ভাই গো মিছিল আছে, যাবি নি? দুফুরে বিরানি খাওয়াইবো,একটা মজো দিবো আর বিশ টেকা কইরা দিবো। ল যাই।
পাতলা একটা চাদর দিয়ে রিয়াজের মাথা ঢাকা। সকালে রোদ এসে চোখে পড়ে ঘুমাতে সমস্যা হয় বলে ও পুরো মাথা চাদরে ঢেকে ঘুমায়। বিল্লাল চাদরটা সরিয়ে দিলে রিয়াজ চোখের উপর হাত ঢেকে শোয়। বিরক্ত হয়ে বলে -
- না যামু না। তুই যা।
- আরে ল যাই। খবর পাইছি আইজ বাপ্পী ভাইরা মিছিলে গণ্ডগোল করবো। বোমা-বুমা আনাইছে শুনছি। অনেক মজা হইবো ল যাই।
- আরে না। হেরা হুজুর গো লগে তাল দেয় ভিত্রে ভিত্রে। আর উপরে দিয়া বিএনপি করে
- এহ বালের কথা মারাইস না। হেরা যা খুশী করুক গা। আমাগো আম্লীগ,বিম্পি-জামাত বুইঝ্যা এতো কাম নাই।
দুফুরে খামু,টেকা পামু! জুইত পাস না তো ,একটা ভালো খবর দিলাম তোর ভাল্লাগে না
- বেশি প্যাচাল পারিস না তো। ঘুমাইতে দে। বলে রিয়াজ ফের চাদরটা দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলে
- চুদির ভাই পিনিকে আছস মনে হয়? ড্যান্ডি খাইছস লাগে ! বলে হে হে হে করে বিল্লাল হাসে।
অন্য সময় হলে রিয়াজও ওর হাসির সাথে তাল মিলাতো। আজকে ওর ঘুমে বারবার চোখে জড়িয়ে আসছে। একটু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আপু-ভাইদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। বেশিক্ষণ অবশ্য এখানে শুয়ে থাকাও যাবে না। আজকে রিয়াজ শুয়েছিলো কার্জনের গেটের পাশে যে সিমেন্টের বেঞ্চি আছে, সেখানে। একপাশে দেয়াল থাকায় ঘুমের তালে নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর ঠিক পাশেই কয়েকটা গাছ থাকায় জায়গাটা মোটামুটি ঠাণ্ডাই। ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় মাথা ঝিমঝিমের সাথে কেমন মাতাল মাতাল একটা অনুভব ওর শরীর জুড়ে। যদিও শরীর জুড়ে না ওর মগজের ভেতর জুড়ে ও বুঝে উঠতে পারে না। ড্যান্ডি খেলেই ওর এমন হয়। কেমন ঝিম মেরে থাকতেই ভালো লাগে। হাঁটতে গেলে মনে হয় হাঁটছে না, উড়ছে। রাজশাহী থেকে ঢাকা শহরে রিয়াজ এসেছে দুই বছর আগে। বলা যায় ঘরে খাবার অভাব, এতোগুলো ভাইবোন, বাবার স্বল্প আয় - সব মিলিয়েই একদিন স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়ে বসে ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় এসে পথ-ঘাট চেনা হয়ে যায় অল্প দিনেই। পথ-ঘাট মানে এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিল্লালের সাথে পরিচয় এখানে এসেই। ডাস্টবিনের ময়লার ফাঁকে ফাঁকে বিক্রয়যোগ্য কোনো জিনিস খুঁজতে গেলে সেসবের গন্ধও নাকে আসে না। বিল্লালই একদিন দুপুরে বাদশাহ মামার হার্ডওয়্যারের দোকানে নিয়ে যায় ওকে । সেসময় পেটে ওর সে কী ক্ষুধা। সেদিনই ও জেনেছিলো ড্যান্ডি খেলে ক্ষুধা লাগে না, রোজ রোজ ভাত খেতে হয় না। শহরের অজস্র টোকাই ছেলে-মেয়েরা এসব খেয়েই নাকি থাকে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত আপু- ভাইয়ারাও খায়। দামেও সস্তা। কলা ভবনের সানাম আপুরে কতদিন পলিব্যাগে মুখ ডুবিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ও বলতে শুনেছে তার বন্ধুকে -
মাম্মা কঠিন জিনিস! গাজার চেয়েও সেরা!
- পকেটে টেকা আছিলো না। খামু কী! চাংখারপুলে কালকা বাদশা মামার লগে দেহা হইছিলো। একলগেই বইয়া বইয়া ড্যান্ডি টানছি। ঘুম ঘুম স্বরে রিয়াজ বলতে থাকে বিল্লালকে
- হালার পুত তুমি থাকো ভাবের জগতে। কামের খোঁজ আইন্যা দিলে তোমার বিচি বিষ করে। ক্যা আমাগো লগে ভাঙ্গারি টোকাইতে যাইতে পারো না ? তাও তো খাওনের টেকাটা হইয়া যায়। আরও দু'চারটা গালি খুব নির্বিকার মুখেই বিল্লাল চালিয়ে যেতে থাকে রিয়াজের মাথার পাশে বসে। এবার শোয়া থেকে ও উঠে বসে বিল্লালকে বলে -
- ড্যান্ডি তোর বাপের পয়সায় খাই রে হমুন্দির পুত? রিয়াজ ওর গায়ের কোঁচকানো শার্ট হাত দিয়ে টেনে সোজা করতে করতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিল্লালের পেছন দিকে ফিরে জলবিয়োগ করে। বিল্লালের বাবা নেই। এই সকাল বেলা ওকে বাপ নিয়ে গালি দেয়াটা ঠিক হয়নি বোধ হয়। বিল্লাল কেমন উদাস চোখে আকাশ দেখে জারুল গাছের ফাঁক দিয়ে। রিয়াজ ওর একমাথা রুক্ষ উশকুখুশকু চুল নিয়ে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিল্লালের পাশে বসে বলে
- এক কাপ চা পাইতাম যুদি !
- এহ জমিদারের পুত আইছে! বিল্লালের কথায় এবার আর রিয়াজের রাগ হয় না। ওর দিকে তাকিয়ে বলে -
- কী বইয়া রইছস ক্যান ? আইজ কামে যাবি না ?
- নাহ ! হোটেলের কাম শেষ! কাস্টমাররে স্যুপের বাটি দিতে গিয়ে দুই তিন চামচ চুরি কইরা খাইছিলাম। বদমাইশ পলাইশ্যা মালিকের কাছে কইয়া দিছে। ওরে পাইয়া লই খাড়া ওর গোয়া দিয়া রড হান্দামু বলে একটা অশ্লীল ভঙ্গী করে ও।
খসখস করে ঝাড়ুদার খালাটা ঝাড়ু দিচ্ছে রাস্তাটা। সকালবেলা ঝাড়ু দেয়া শেষে অনেক পাতা জড়ো করে নিয়ে যায় সে। কী করে এতো পাতা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো রিয়াজ।
- কী করুম আবার ? মাডির চুলায় রানতে গেলে এডিও লাগে!
খালার সাথে তার চার বছরের ছোট মেয়েটাও থাকে। ফুটপাতে বসে থাকে। কখনো মেয়েটাও ঝাড়ু দেয়ার ভঙ্গী করে তার মায়ের মতো। মেয়েটার নাম মায়া। ঘাড় ঘুরিয়ে রিয়াজ তাদের দেখতে থাকে দেয়ালের গায়ের নকশাদার ফুলের ফাঁক দিয়ে। ওর প্যান্টের গোপন পকেটে তিনশো পঁচাত্তর টাকা আছে,সেখানে হাত পড়তেই হঠাৎ করেই বিল্লালকে বলে -
ল কমলাপুর যাই।
বিল্লাল জিজ্ঞাসু চোখে রিয়াজের দিকে তাকালে ও বলে -
রাজশাহী যামু। আমাগো বাইত্তে ...
সমাপ্ত