somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নহীন

১২ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিজের কাজের মাঝে গভীর মনোসংযোগের কারণে প্রথমে বুঝতে পারিনি আমাকে উদ্দেশ্য করেই কেউ কিছু বলছে। হঠাৎ করে এই বোধটা এলো কেউ বুঝি আমাকে কিছু বলছে, বলেই যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। পাশের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখি কখন যে নিয়াজ ভাই উঠে গেছে টেরই পাইনি। নিয়াজ ভাই , আমার সহকর্মী। খুব আড্ডাবাজ হলেও কাজের ব্যাপারে তেমনই দায়িত্বশীল ধরনের মানুষ। দুর্নীতিদমনের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে কুয়ালালামপুরে একটা ওয়ার্কশপের উদ্দেশ্যে বেশকিছু ডকুমেন্ট এবং অন্যান্য কাজ গুছিয়ে হাঁফ ছাড়ার মত সময়ও অফিসে পাইনি গত দুইদিনে। ছুটির সময় পার হবার পরেও নিয়াজ ভাই আর আমার দুজনেরই আসন্ন ওয়ার্কশপের কাজ গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা রাত ন'টা পেরিয়েছে। রাত পেরোতে না পেরোতেই শেষবারের মতো প্রস্তুতি নিয়ে অফিস থেকে সোজা এয়ারপোর্টে এসেছি সকালের নাস্তাটা বাসা থেকে কোনোরকমে সেরে। এয়ারপোর্টে সময় কাটাবার জন্য মানুষ দেখাটা আমার কাছে আকর্ষণীয় কিছু নয়।কিছুক্ষণ আগেও নিয়াজ ভাই এক দম্পতিকে দেখে সম্ভাব্য সব ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কথা বলছিলেন। উনার চোখে সবই অনেক আকর্ষণীয় মনে হয় এবং সব ব্যাপারেই তার প্রবল কৌতূহল। আমার নিরাসক্ততা তাকে অবশ্য দমাতে পারে না।

- বুঝলেন শামীম ভাই, জীবনের সব ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু শেখার আছে !চোখ কান বন্ধ করে দিনরাত ল্যাপটপ পড়ে থাকলে তো জীবনের অনেক আনন্দই আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে। হাহহাহা !

- মানুষ দেখার মাঝে আনন্দের কি আছে আমি তো খুঁজে পাই না । আপনি কি খুঁজে পান আপনিই জানেন, বলি আমি।

- আচ্ছা ,আপনি ল্যাপিতে মুখ গুঁজে থাকেন। ফ্লাইটের সময় হবার আগে আমি একটু চক্কর মেরে আসি আশেপাশে ।

এরপরেও উনি আমাকে সেধেছিলেন বোধ হয় উনার সাথে একটু হাঁটাহাঁটি করে বোরিং সময়টা পার করার জন্য। কিন্তু আমার কাছ থেকে উনি হু হা জাতীয় শব্দ ছাড়া আর কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে কোন ফাঁকে উনি উঠে গেছেন পাশ থেকে টের পাইনি। তবে হঠাৎ করে কেউ একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে এমন মনে হওয়াতে একবার দুইবার আশেপাশে তাকিয়েও আবার ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি।

জি আপনাকেই বলছিলাম !

এবার পেছন থেকে কথা বলার শব্দ একটু জোরেই শুনতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতেই দেখি আমার পেছনের সীটের ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তার পরিচিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকা হাসি মুখ আমি অবশ্য মনে করতে পারি না আগে উনাকে কোথাও দেখেছিলাম কিনা । তাই অস্বস্তি এড়াতেই জানতে চাই -

- আমাকে বলছেন কিছু ?

- আসলে বিমানবন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জে একা একা সময় কাটানো একঘেয়ে ব্যাপার কিনা তাই ভাবলাম আপনাকে একটু সঙ্গ দেই। বলতে বলতে গলাবন্ধ ধরণের স্যুট পরিহিত এই ভদ্রলোক উনার হাতের ছোট ব্যাগটা প্রায় বুকের কাছে চেপে ধরে আমার পাশের সীটটায় এসে বসেন, কিছু সময় আগে যেখানটায় নিয়াজ ভাই বসেছিলেন। একা একা সময় কাটাতে যে আমার একঘেয়ে লাগছে না সে কথা জানাবার আর সুযোগ পেলাম না আমি।


লোকটার আমার পাশের সীটে এসে বসার আয়েশি ভঙ্গি আর তেলতেলে ধরণের হাসি দেখে মনে হচ্ছে আমার সাথে তার গল্প বলার প্রস্তুতি নেহায়েত অল্প সময়ের জন্য নয় ; বরং দীর্ঘ। অনুমানে বুঝি লোকটির বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করে গেছে, প্রায় ষাট এর কাছাকাছি হবে বা কমও হতে পারে। কারো কারো পোশাক-আশাক, কথা , হাঁটা-চলার ভঙ্গি দেখে নিয়াজ ভাই কেমন করে যেন সে ব্যক্তির সম্পর্কে কাছাকাছি অনেক কিছুই অনুমান করতে পারেন। এমনকি কারো গ্রামের বাড়ি নিয়ে করা অনুমানও অনেক সময় তার নির্ভুল হয়। আমার এসবে তেমন আগ্রহ নেই। আর এ মুহূর্তে অচেনা কারো সাথে গল্প করার মুডও পাচ্ছিলাম না।


আমার পাশে বসা ভদ্রলোকটি যে সুস্থির ধরণের মানুষ না সেটা আমি ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলেও তার ছটফটে ভঙ্গিটা আমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিলো না। এরই মাঝে উনি উনার নাম জানিয়েছেন আমাকে। নেয়ামত কবির , পেশা শিক্ষকতা। ভদ্রতা করে আমাকেও নিজের নাম বলতে হয়েছে। তবে আমার পেশা সম্পর্কে জানাবার আগেই উনি বললেন –

- শিক্ষকতা একটা বোরিং পেশা আপনার এই মতের সাথে সহমত জানাতে পারছি না আমি , শামীম সাহেব।

বলা যায় উনার কথা শুনে আমি রীতিমত অবাকই হই। সদ্য পরিচিত এই লোকটির সাথে আমার তো তেমন কথাবার্তাই হয়নি , এমন অদ্ভুত তথ্য কোথায় পেলেন উনি কে জানে ! আমার বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টি দেখে উনি আমার কৌতূহলের অবসান করেন এই বলে –

- ঐ যে কিছুক্ষণ আগে কম্পিউটারে আপনার বন্ধুকে বলছিলেন না আপনি যে শিক্ষকতা একটা বোরিং পেশা ? তার সূত্র ধরেই তো বললাম আমি কথাটা। এরই মাঝে ভুলে গেলেন। আপনার বন্ধুর নামটা দেখে ঠিক বুঝলাম না উনি নারী না পুরুষ । শাওন নামটা আসলে বিভ্রান্তিমূলক।

লোকটার কথা শুনে আমি শুধু অবাকই হলাম না , বিরক্তিতেও আমার মনটা ভরে গেলো নিমিষেই। নিয়াজ ভাই পাশ থেকে উঠে যাবার পর ফেসবুকে লগিন করেছিলাম ফ্রেন্ডদের সাথে হাই হ্যালো করতে আর এতক্ষণ আমার চ্যাটিং হিস্ট্রি উনি পেছনে বসে বসে ফলো করেছেন ! মানুষের তো ন্যূনতম একটা ভদ্রতা জ্ঞান থাকা উচিত যে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনুমতি ছাড়া নিজ থেকে জড়ানো ঠিক না। আশ্চর্য ধরণের মানুষ।

- তা আপনিও বুঝি শিক্ষক ? ভালোই হলো এখানে এসে ওয়েটিং লাউঞ্জে একই পেশার কাউকে পেয়ে যাবো ভাবিনি। আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া ! বলে নেয়ামত সাহেব প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে পা দু’টো ভাঁজ করে চেয়ারে বসার চেষ্টা করেন। মনে হচ্ছে প্যান্টের কারণে বসতে পারছেন না ঠিকমতো।

আসলে লুঙ্গির মতো আরামদায়ক আর কিছুই হতে পারে না – কি বলেন ? বলে আমার মতামত জানতে প্রশ্ন করেন নেয়ামত সাহেব। তবে আমি আমি উত্তর না দিলেও উনার কথা চালাতে সমস্যা হবে না এতক্ষণে বুঝে গিয়েছি তার যেচে এসে কথা বলার অভ্যাস দেখে।

এই ভদ্রলোকের গন্তব্য স্থল কোথায় কে জানে । জিজ্ঞেস করাটাও বিপদজনক। আবার কোন গল্প ফেঁদে বসবে ঠিক নেই। আর কপাল খারাপ হলে দেখা যাবে হয়তো একই ফ্লাইটে উনি আমাদের যাত্রাসঙ্গী হয়েছেন।

- তো শামীম সাহেব, বললেন না তো আপনি কোথায় পড়াতেন ? মানে কোথায় আছেন , স্কুলে না কলেজে ?

শিক্ষকতা পেশা যে শুধু স্কুল ,কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়ানোর মাঝেই সীমাবদ্ধ এই ধারণাটা কী করে যে বেশীরভাগ মানুষের মাথায় গেঁথে গেছে তা এক রহস্যই বটে। রিসার্চ সংক্রান্ত কাজও যে এর আওতায় পড়তে পারে , শিক্ষা বিভাগের আরও রিলেটেড কাজও যে থাকতে পারে সেটা নিয়ে কেউ যেন ভাবেই না , এমনই মনে হচ্ছে অন্তত নেয়ামত সাহেবের কথা শুনে।

- আপনার এমনটা মনে হলো কেন নেয়ামত সাহেব যে আমি স্কুলে বা কলেজে শিক্ষকতা করতে পারি ? একান্তই কথা না বললে অভদ্রতা দেখায় বলে আমি উনার কাছে জানতে চাই।

- যাক , আপনি তাহলে কথাও বলতে পারেন ! আমি এদিকে ভাবছিলাম শিক্ষক মানুষ অমন গোমড়া মুখো হলে কি চলে ? ছাত্রছাত্রীদের সাথে হাসি – খুশী ব্যবহার না করলে , আন্তরিক না হলে শিক্ষকদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো হবে কি করে বলুন! ঐ যে কাকে যেন বললেন না শিক্ষকতা নাকি বোরিং পেশা , সেজন্যই তো জানতে চাইলাম।

আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে উনার অযাচিত হস্তক্ষেপ নিয়ে উনাকে দু’চার কথা শুনিয়ে দিবো কিনা এমন প্রস্তুতি নিতে নিতেই উনি জানালেন –

- আমাকে সবাই স্কুলে কবির স্যার নামেই ডাকে, বুঝলেন ? আপনিও এ নামেই ডাকতে পারেন আমাকে।

আমি উনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। বড়জোর আমি উনার নামের দ্বিতীয় অংশ ‘ কবির ’ এই নামটিকে ভদ্রস্থ রূপ দিতে কবির সাহেব বলে ডাকতে পারি , তাই বলে আমাকেও উনার ছাত্র স্থানীয় ভেবে ‘ কবির স্যার’ বলতে বলাটা রীতিমত জুলুম মনে হতে থাকলো আমার।

- চৌগাছাতে গেলে শুনবেন কবির স্যারের কত নাম ডাক। এক নামে চেনে সবাই আমাকে।
- তাই ? বেশ ভালো তো ! বলি আমি। উনার সাথে এই আলাপচারিতা ভালো লাগছিলো না বলেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে অযথাই সদ্য লোড করা কিছু সফটওয়্যার নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে থাকি এটা বোঝাতে যে আমি এখন ব্যস্ত! নিয়াজ ভাইকে ফোন করে ডেকে আনবো কিনা ভাবি একবার। তাতে অন্তত চৌগাছার শিক্ষক নেয়ামত কবিরের গল্প শোনার বিড়ম্বনা পোহাতে হবে না আমাকে।

গত ক’দিনে অফিসের কাজে এতো বেশি সময় আর শ্রম দিতে হয়েছে যে বাড়ি ফিরে মারিয়ার সাথেও কথা বলার পর্যাপ্ত সময় বা সুযোগ কোনটাই হয়নি শুধু চোখের দেখাটা ছাড়া। খেয়ে-দেয়ে টিভি দেখতে দেখতেই কখন ঘুমে তলিয়ে যেতাম বুঝতেই পারতাম না। শোবার ঘরে এ কারণেই মারিয়া টিভি রাখা পছন্দ করে না। আমাকে ক’দিন ধরেই ওয়ার্নিং দিচ্ছিলো টিভিটা বাড়ির বাইরে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে। টিভিটা শোবার রুমে না থাকলে সারাদিনের সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো অন্তত আমার সাথে আলোচনা করতে পারতো এমনটাই মনে করে মারিয়া। এই তো আজকে যখন তাড়াহুড়া করে নাস্তার টেবিলে খাচ্ছিলাম ও তো বলেই বসলো –

- এতো কাজ কাজ করলে কবে না জানি নিজের বৌয়ের চেহারাটাই ভুলে যাও !
নিয়াজ ভাইকে ফোন করে ডেকে আনার চেয়ে মারিয়াকে ফোন দিলেই বরং ভালো। ইহকালে সংসারটা টিকিয়ে রাখাটাই মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ হবে আমার জন্য। ঘরে শান্তি তো সব জায়গায় শান্তি!

- কি বিশ্বাস করলেন না তো ? শুধু চৌগাছা না , সমগ্র বাংলাদেশে আমি স্কুল পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষকও নির্বাচিত হয়েছি গত বছর। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সনদ আর ক্রেস্ট পাওয়াটাও বলতে পারেন বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। সেই সনদ লেমিনেটিং করে আলমিরাতে রেখে দিয়েছি। বলা তো যায় না যেখানে সেখানে রাখলে যদি অরিজিনাল কপি হারিয়ে যায়! দাঁড়ান আপনাকে ফটোকপিটা দেখাই, বলে উনার বুকের কাছাকাছি ধরে রাখা ব্যাগ থেকে মহামূল্যবান সনদটা বের করতে উদ্যত হলে উনাকে আশ্বস্ত করি যে উনার সব কথাই আমি বিশ্বাস করেছি। পরবর্তী কয়েক মিনিট উনার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হবার ঘটনা এবং চৌগাছা থেকে বাস, ফেরি পার হয়ে ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ ইত্যাদি যাবতীয় সব খুঁটিনাটি শুনতে গিয়ে আমার আর মারিয়াকে ফোন করা হয়ে ওঠে না। উনি চাইলে একা একাই ঢাকায় আসতে পারতন কিন্তু করিমুল্লাহর পীড়াপীড়িতে এতো দীর্ঘ ভ্রমণে তাকেও সঙ্গী করতে হয়েছিলো পথে নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত এ কথা জানাতেও উনি ভোলেন না।

উনি এমনভাবে করিমুল্লাহর কথা বললেন যেন নাম শুনেই আমি বুঝে নেবো করিমুল্লাহর সাথে উনার কি সম্পর্ক। আর করিমুল্লাহর সাথে উনার সম্পর্কের রহস্যভেদ করতেও আমি তেমন ইচ্ছুক ছিলাম না কারণ এরই মাঝে খেয়াল করেছি উনার গৌরবময় শিক্ষক জীবনের ইতিহাসে মূল কথার চেয়ে শাখা- উপশাখার বিস্তার আরও বেশি।

- আমি আমার শিক্ষক জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্লাস নিয়েছি বাংলা আর ইংরেজি ২য় পত্রের। কেন জানেন শামীম সাহেব ?

নেয়ামত সাহেব শুধুমাত্র কথা বলার খাতিরেই প্রশ্নের অবতারণা করেন, উত্তর শোনার আশায় নয়। যেহেতু না চাইলেও উনার কথা শুনতেই হবে তাই হু হা জাতীয় শব্দে মাথা নাড়িয়েই আমার কথা আমার সীমাবদ্ধ রাখি।উনি বলতে থাকেন

- রচনা, প্যারাগ্রাফে পরীক্ষার সময় ছাত্র-ছাত্রীরা ‘এইম ইন লাইফ’ নিয়ে যখন লেখে আমার পড়তে ভীষণ ভালো লাগে , বুঝলেন। ঐ প্রশ্ন গুলো আমি নিজেই করি আর খাতাও খুঁটে খুঁটে দেখি। কিন্তু জানেন খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই লেখে তারা জীবনে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিজেদের জড়াতে চায়। আফসোস ! জীবনে পড়াশুনার কোনো বিকল্প নেই এই সহজ আর মূল্যবান সত্যটা কবে যে এরা বুঝবে! উনার ব্যথিত মুখ দেখে মনে হয় এই বুঝি উনি এখনই কান্না করে দেবেন।


তা আপনার এইম ইন লাইফ কি ছিল শামীম সাহেব ? আপনিও নিশ্চয়ই শিক্ষক হতেই চেয়েছিলেন? বেশ ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জীবনে। উনার কথার ভঙ্গিতে মনে হয় এখনি বুঝি এসে প্রশংসায় আমার পিঠ চাপড়ে দেবেন এমন একটা পেশায় নিজেকে জড়িয়েছি বলে।


নেয়ামত সাহেবের মাথায় কেন যে ঢুকেছে আমিও তার মতোই একজন শিক্ষক কে জানে! সময় কাটাবার জন্যই একটু অনলাইনে এসেছিলাম ফেসবুকে কাউকে পেলে গল্প-গুজব করবো। শাওনের সাথে কথার এক প্রসঙ্গে টিচিং প্রফেশন নিয়ে কথা উঠেছিলো এই নেয়ামত সাহেবের পাল্লায় পড়ে ফেসবুকে চ্যাটিং বন্ধ করতে হয়েছে বন্ধুর কাছে বিদায় না নিয়েই। বন্ধুটা আমার কি ভাববে কে জানে।


আমার এইম ইন লাইফ নিয়ে নেয়ামত সাহেবকে কিছু জানাতে ইচ্ছে করছে না। আসলে বলার কিছু নাইও। পড়াশুনার প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে গিয়ে ভালো কোনো সাবজেক্টে , ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি আর রেজাল্টের চিন্তায়ই তো সময় পার হয়ে গেলো। ভাববার সময় পেলাম কোথায় কি হতে চেয়েছিলাম কিংবা যা হতে পেরেছি সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা !


- আপনার কি শুরু থেকেই এই পরিকল্পনা ছিলো যে আপনি শিক্ষকই হবেন? এর বাইরে কি আর কিছু ভাবতেই পারেন নি ? আমি নেয়ামত সাহেবকে অনেকটা শ্লেষ নিয়েই জিজ্ঞেস করি।


আমার প্রশ্ন শুনে নাকি বলার ভঙ্গিতে উনার দু’চোখের নদীতে আষাঢ়কালের উন্মত্ত প্লাবনের আনাগোনা দেখা যায়। এ কথা বলে উনাকে কোন স্মৃতি মনে করিয়ে দিলাম কে জানে। হয়তো এখনই আরেকটা গল্প ফাঁদার সুযোগ পাবে , নিজের অভাবী পরিবারে কীভাবে সংগ্রাম করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন ইত্যাদি নানান কথা ! উফ নিজের বোকামিতে নিজের উপরেই কেমন রাগ লাগছে। এই নিয়াজ ভাইটা যে কি না, সেই কখন এখান থেকে গিয়েছে এয়ারপোর্টের ভেতরটা চক্কর মেরে দেখার জন্য এখন পর্যন্ত আসার নামই নেই। আমাদের ফ্লাইটের সময়ও প্রায় ঘনিয়ে এলো। এবার তাকে ফোন দেয়া দরকার। আমি অনেকটা অসহিষ্ণু হয়েই বসা থেকে উঠে দাঁড়াই, নিয়াজ ভাইকে ফোন করার উদ্দেশ্যে না যতটা তারচেয়েও বেশি সম্ভবত নেয়ামত সাহেবের প্রশ্নের উত্তর এড়াতেই আমি কেমন বিরক্ত হয়ে উঠি ভেতরে ভেতরে যার প্রকাশ আচরণেও ছাপ ফেলে।


তার এতো কথা শোনার আর আমার এইম ইন লাইফ জানাবার মতো এতো সময় কই আমার! কুয়ালালামপুরে দুর্নীতিদমনের উপরে আসন্ন মিটিং নিয়ে জার্মান কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সেখানে বক্তৃতা দেয়া আমার জন্য কম পরিশ্রমের কাজ নাকি! বাংলাদেশ কোনো একদিন স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে হঠাৎ করেই তাও দুদকের হস্তক্ষেপে এমনটা ব্যক্তিগতভাবে আশা না করলেও নিদেনপক্ষে চকচকে কিছু সম্ভাবনাময় কারণ নিয়ে তৈরি করা এসাইনমেন্টে আরও কোনো ফাঁকফোকর রয়ে গেলো কিনা এসব শেষবারের মতো দেখে নেয়া, প্রেজেন্টেনশটা স্মার্টলি হ্যান্ডেল করতে পারবো কিনা ইত্যাদি আরও জরুরি কাজের ভিড়ে আমার উদ্দেশ্যে করা নেয়ামত সাহেবের প্রশ্নটা একরকম চাপাই পড়ে যায়।

ধ্যাত এখন পর্যন্ত মারিয়াকেই ফোন করা হলো না। মিটিং শেষে ফেরার পথে আমাকে ওর জন্য কিছু আনতে বলেছিলো কিনা এ মুহূর্তে মনে করতে পারি না। ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে দেখি সদা হাস্যময় নিয়াজ ভাই আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন।

নিয়মের খাতিরে বা সময়ের প্রয়োজনে আমাকে ওয়েটিং লাউঞ্জ ছেড়ে পা বাড়াতে হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। প্লেনের আরামদায়ক সীটে গা এলিয়ে দেবার পর কেমন এক গ্লানিতে ভেতরটা ছেয়ে যাচ্ছিলো। সে কি নেয়ামত সাহেবকে সারাটা সময় উপেক্ষা করার কারণে নাকি অন্য আরও কোনো কারণ সেখানে মিশেছিলো নিজের কাছেই নিশ্চিত হতে পারি না। প্লেনের জানালায় চোখ রেখে আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। এ শুধুই বাইরে তাকিয়ে থাকা, নির্দিষ্ট কিছু দেখা নয়। বাইরের নীল আকাশ আর সাদা মেঘের আড়ালে বাংলাদেশটা আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হতে থাকে মাটি থেকে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থান করার কারণে।

আমার ভেতরে একটা অনুরণন হচ্ছে আমি টের পাই। নিজেকে নিজেই শুনিয়ে বলতে থাকি – আমার এইম ইন লাইফ আসলে কি ছিলো ? উত্তরটা দিতে কেমন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি আমি বিবিধ চাহিদা আর সম্পর্কের ভেতর। আমি আসলে জীবনে কিছুই হতে চাইনি নেয়ামত কবির সাহেব। এই যে কবির স্যার, শুনছেন ? জোরে জোরে একই কথার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে আমার কাছ থেকে নেয়ামত কবিরের উদ্দেশ্যে।

( সমাপ্ত )



সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৩:১৪
৫১টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×