somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে-ই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি

১৫ ই মে, ২০১৮ রাত ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শৈশব মানেই আমার কাছে অদ্ভুত আনন্দময় স্মৃতির ভান্ডার। আমাদের ছিল বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা কাচ্চা ভর্তি বিশাল এক পরিবার। আমাদের সমবয়সী আপন চাচাতো, ফুফাতো ভাইবোন ছাড়াও লুৎফা ফুফু (আমার দাদীর পালিত কন্যা) দুই ছেলে সহ থাকতেন আমাদের বাসায়। মিঠু ভাই আর নয়ন। মিঠু ভাই বয়সে আমাদের বড় ছিল, বেশ রাগী আর গম্ভীর টাইপ। কিন্তু নয়ন ছিল আমার সমবয়সী প্রিয় বন্ধু আর স্বভাবে ভীষণ দুষ্টু। আমাদের সমবয়সী পাঁচ ছয়জনের গ্রুপের স্বঘোষিত লিডার ছিল নয়ন। মারামারি, ঝগড়াঝাটি সারাক্ষণ লেগে থাকলেও আমরা সবাই ছিলাম একে অন্যের জান প্রাণ।

দাদীর সবচেয়ে আদরের নাতনি হিসাবে আমি ছিলাম সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী আর আহ্লাদী স্বভাবের। একদিন বিকালে খেলা শেষে বাসায় এসে আমরা হাতমুখ ধোবার সময় নয়ন এক বালতি পানির মধ্যে ঢুকে বসে রইলো আর গলা বের করে আমাদের ভেঙ্গাতে লাগল। আমিও সাথে সাথে আব্দারসহ কান্না শুরু করলাম এভাবে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে পানিভর্তি বালতিতে বসার জন্য। আমি একটু সেনসিটিভ ছিলাম, অল্পতেই অসুখ করতো। তাই সন্ধ্যাবেলা এমনটা করার প্রশ্নই আসেনা। আমার আব্দার দেখে শেষমেশ দাদী আমাকে একমগ পানি আর একটা মোড়া এনে ওয়াশরুমের দরজার সামনে বসিয়ে দিল। আমি ডান হাতের কব্জি সেই মগ ভর্তি পানিতে ডুবিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম আর নয়নকে ভেংচি কাটলাম।
ফলাফল : সেই রাতে আমার একশো তিন ডিগ্রি জ্বর এলো। আর পরদিন সকাল থেকে সারাদিন আমার সমবয়সী সব ভাই-বোনেরা নয়নের নেতৃত্বে আমাকে দেখামাত্রই ভেংচি কাটল।

আরেকদিনের কথা। বিকালে ছাদে উঠে আমরা খেলা করছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম পশ্চিম আকাশে ডিমের কুসুমের মত টলটলে সূর্যটা কতখানি নিচে নেমে এসেছে! একটু দূরের এক তিনতলা বাসার ছাদে উঠলেই সূর্যটাকে ধরতে পারবো আমরা। আমরা পাঁচ ছয়জন ভাই-বোন মিলে হৈ হৈ করে দিলাম দৌড় সূর্য ধরবো বলে। এক দৌঁড়ে ঐ বাড়ির তিনতলার ছাদে গিয়ে উঠলাম। ওমা! একি! সূর্য দেখি আরো দূরে সরে গেছে। মনেহল, আরেকটু দৌঁড়ে সামনের পুকুর পাড়ে গেলেই এবার ঠিক সূর্যটাকে ধরতে পারবো আমরা। আবার দলবেঁধে দিলাম দৌঁড়। মাঝপথেই ভেসে এলো মাগরিব এর আজান। আমরা সবাই মন খারাপ করে থমকে দাঁড়ালাম। মাগরিব এর আজানের পর বাসার বাইরে থাকার অনুমতি ছিলোনা আমাদের। মন খারাপ হলেও বাসায় ফেরত যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। কিন্তু নয়ন হল নির্ভিক আর নাছোড়বান্দা। সূর্য না ধরে সে আজ কিছুতেই বাড়ি ফিরবেনা। যাইহোক, বাসায় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আমরা সবাই পড়তে বসলাম আর মনে মনে নয়নের ফেরার অপেক্ষা করছি। অনেকক্ষণ পর বীরদর্পে নয়ন বাসায় ফিরতেই আমরা ওকে ঘিরে ধরলাম। কেমন লাগল সূর্য ধরতে? নয়ন খুব অহংকারী ভাব নিয়ে তাচ্ছিল্ল সহকারে বলল, " এক্কেবারে নরম, ঠান্ডাআআআ আর তুলতুইল্ল্যা! কিন্তু ধরলে আাবার ভাইঙ্গা যায়না, কেমুন জানি পিছলাইয়া যায়"। সেদিন সূর্য নিজ হাতে ধরতে না পারার শোকে আমাদের কোন ভাই-বোনেরই আর পড়া হল না। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত এমনকি এরপর অনেকদিন পর্যন্ত নয়নকে আমরা খুব সমীহ করে চললাম। আমাদের মধ্যে সেইতো একমাত্র বন্ধু যে কিনা আকাশের সূর্য নিজ হাত দিয়ে ধরেছে! (ব্যাপারটা তখন এত বেশি বিশ্বাস করেছিলাম যে,পরে আরেকটু বড় হয়ে বিজ্ঞান বইয়ে পড়া সূর্য সম্পর্কিত তথ্যগুলো মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হতো)

পাশের বাসার লোপা আপু আর রুমকি, ওরা দুই বোন ছিল আমাদের খেলার সাথী। পুতুল খেলা, কুতকুত খেলা, বউ চি, কানামাছি সব কিছুতে ছিল লোপা আপু আর নয়নের দৌরাত্ম। সবচেয়ে খারাপ লাগত সংসার সংসার খেলায়। লোপা আপু মা হতো, নয়ন হতো বাবা। আমি আর রুমকি ছেলে-মেয়ে। ঘর গোছানো, রান্না করা সব মজার খেলা আপু খেলতো। আর বিভিন্ন ধরনের পাতা ছিঁড়ে, ফুল তুলে, বালি, কচুরীপানা তুলে নয়ন বাজার করে আনত। আমি আর গোবেচারা রুমকি কে খেলার মাঝেও বই নিয়ে পড়তে হতো আর চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে থেকে খেলা থেকে বঞ্চিত হতে হতো। লোপা আপুকে অনেক রিকোয়েস্ট করতাম, আমাদের কাজের বুয়া হিসাবে রাখতে যেন তাতে খেলার ছলে একটু হাড়ি-পাতিল, পুতুল নিয়ে খেলা করতে পারি। কিন্তু লোপা আপু কোনদিন আমাদের একটু সুযোগও দেয়নি।(লোপা আপু ছিল আমাদের শৈশব কালের সন্ত্রাস)

আরেকটা মজার স্মৃতি খুব বেশি মনে হয়। সবাই মিলে বিকেলবেলা মাঠে খেলা করছি, এমন সময় আমার নড়বড়ে একটা দাঁত পড়ে গেল। লোপা আপু রীতিমতো ফতোয়া দিল দাঁতটা জলদি কোন ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে নাকি আমার আর নতুন দাঁত উঠবে না। আর কোন কাক বা চিল যদি আমার ফোঁকলা দাঁত দেখে ফেলে তাহলেও আর কোনদিন দাঁত উঠবে না আমার। আমিতো এগুলো শুনে দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেই শুরু করলাম চিৎকার করে কান্না। আমার ভাই-বোন আর খেলার সাথীরা সবাই খেলা ফেলে ইঁদুরের গর্ত খোঁজা শুরু করল। কিন্তু কেউ আর ইঁদুরের গর্ত খুঁজে পায়না। এদিকে হঠাৎ কোথা থেকে একটা কাক উড়ে এসে মাঠের পাশে একটা গাছের ডালে বসলো। আর এতে আমার কান্না আরো দ্বিগুন বেড়ে গেল। নয়ন তখন আমার কষ্ট দেখে বলল, "বইনা, কান্দিস না। তোর দাঁত লুকাইন্যা জায়গা খুঁইজ্যা পাইসি"। কথাটা বলেই আমার হাত থেকে দাঁতটা নিয়ে সবার সামনে ওর মুখে ঢুকিয়ে টুপ করে গিলে ফেললো। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে ওয়াক ওয়াক শুরু করলেও আমার আবার সুন্দর দাঁত উঠবে এই খুশিতে আমি ঘৃণা আর কান্নাকাটি ভুলে আমার প্রিয় ভাই আর সাহসী বন্ধু নয়নকে পরম আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম।

আহারে ছোটবেলা! কতসব নির্মল বন্ধুত্ব! এখনকার বাচ্চাদের মত এত স্মার্ট হয়ত: ছিলাম না তবে খুব রঙ্গীন, নির্ভেজাল আর আনন্দ ঝলমলে ছিল আমাদের সেইসব দিনগুলি।



ছবিসূত্র : ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৮ রাত ১০:১৩
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×