নুপি লান: মনিপরী ইতিহাসে নারীদের গৌরবময় প্রতিরোধ সংগ্রামের নাম
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
তারিখ: ০২ অক্টোবর, ২০১৩
মিঠুন চাকমা
(প্রথম মনিপুরী নারী সংগ্রাম বা নুপি লান। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মনিপুরী নারীরা দরবার হল ঘিরে রেখেছে।)
ছবি সৌজন্য: ইপাও.নেট
নুপি লান একটি মনিপুরী শব্দগুচ্ছ। এর অর্থ হচ্ছে নারীদের সংগ্রাম। মনিপুরী মহারাজ ও ব্রিটিশ সরকারে বিরুদ্ধে মনিপুরী নারীরা এই সংগ্রাম সংঘটিত করে। মনিপুরে এ সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলো মি. জিম্পসন(১৯৩৩-১৯৪৫)। মনিপুরী সরকারের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শোষনমূলক নীতির বিরুদ্ধে মনিপুরী নারীরা এই সংগ্রাম করেছিল। এই সংগ্রামের কারণে শেষপর্যন্ত মনিপুরী সরকার শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। এই সংগ্রাম মনিপুরের ভবিষ্যত লড়াইকেও প্রভাবিত করেছিল। মূলত ভারতের চাল ব্যবসায়ী মারোয়ারীদের স্বার্থে ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক চাল মনিপুর রাজ্যের বাইরে রপ্তানীর কারণে এবং এই সময় কৃত্রিমভাবে মনিপুরে চাল বা খাদ্যের সংকট শুরু হওয়ায় মনিপুরী নারীরা এই সংগ্রাম করতে বাধ্য হয়েছিল।
মনিপুরী সমাজে নারীদের অবস্থান
নুপি লান বা নারীদের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনার আগে মনিপুরী সমাজে নারীদের অবস্থান বা গুরুত্ব নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। মনিপুরী সমাজে মনিপুরী নারীরা অনেক আগে থেকেই উৎপাদিত দ্রব্য বা খাদ্যদ্রব্য বিক্রয়ের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলো। সমাজে খাদ্যদ্রব্য ও কাপড়চোপড়ের ব্যবসাসমূহ নারীরাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার কারণে সমাজের মধ্যে তাদের জীবনযাপনের স্বাধীনতাও রয়েছে। খইরাম্বাদ বাজার যা ইমা কেইথেল নামে সমধিক পরিচিত, এই বাজারের ব্যবসা বাণিজ্য বা ক্রয়-বিক্রয়ের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ নারীদেরই হাতে। মহারাজা খাগেমবা ১৫৮০ সালে এই বাজারটির প্রতিষ্ঠা করেন।
যুদ্ধসংঘাত ও তার কারণে মনিপুরী সমাজে নারীদের ভূমিকা
মনিপুরে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৮১৭ সালে বার্মার শাসকরা মনিপুর রাজ্য আক্রমণ করে। প্রায় ৭ বছর ধরে এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধের কারণে মনিপুরের অনেক যোদ্ধা মারা যায়। এতে মনিপুরী সমাজে পুরুষের সংখ্যা কমে যায়।
এরপর ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মনিপরীরা সংগ্রাম করে। এতেও অনেক মনিপুরী পুরুষ মারা যায়। ফলে মনিপুরে পুরুষের সংখ্যা কমে যায়, এবং নারীর সংখ্যা বেশি বেড়ে যায়।
এতে নারীদের ভূমিকা বাড়তে থাকে। ব্যবসাসহ নানা কাজে নারীরা জড়িয়ে পড়তে থাকে। এই সময় মনিপুরে সামাজিকভাবে বহুপত্নীক বিবাহ প্রথা সিদ্ধ হয়।
মনিপুরী ইতিহাসের কিছু অংশ
১৮৯১ সালে মনিপুরী রাজ্য ব্রিটিশ রাজের পদানত হয়। এই বছরের ২৫ এপ্রিল খোংজাম এলাকায় ব্রিটিশের সাথে মনিপুরী মহারাজার যুদ্ধ শুরু হয়। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিনদিন ধরে যুদ্ধ চলার পরে মহারাজা কূলচন্দ্র সিংহ-এর বাহিনী ব্রিটিশদের হাতে পরাস্ত হয়। এ সময় তিনি ২০০ অনুচর নিয়ে চীনে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন। রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎও এ সময় আটক হন। পরে ১৩ আগস্ট ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ সরকার তাদের ফাঁসিতে ঝোলায়।
১৯০৭ সালে চুরাচান্দ নামে এক বালককে মহারাজা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মনিপুর রাজ্য শাসন করার জন্য ব্রিটিশ রাজ দরবার নামে প্রশাসনিক-রাজনৈতিক প্লাটফরম গঠন করে। এতে ব্রিটিশ রাজ তার মনোনীত ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন প্রশাসক নিয়োগ করতেন। এই দরবারের উপরই মূলত মনিপুর রাজ্য পরিচালনার ভার দেয়া হয়।তবে মাহরাজারও নিজস্ব ক্ষমতা ছিলো।
ব্রিটিশ রাজ মনিপুরের ক্ষমতায় আরোহনের পরে মনিপুরী সৈন্যদের উপর নানা ধরণের নিবর্তনমূলক আইন জারি করে। ব্রিটিশ সৈন্যদের রসদ বহন করার কাজে তাদের নিয়োগ করা হয়। যদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে মনিপুরী জনগণের কাছ থেকে মাথাপিছু কর ধার্য করে। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ রাজ মনিপুরীদের কাছ থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আদায় করে।
ব্রিটিশ রাজের আমলে মনিপুর থেকে চাল রপ্তানী
নুপি লান বা নারী সংগ্রামের পূর্বলগ্ন সংঘটিত হতে থাকে
ব্রিটিশ রাজ ক্ষমতায় আসার পরে মনিপুর থেকে চাল রপ্তানী শুরু হয়। রাজ্যে ফ্রি ট্রেড পলিসি চালু করা হয়।
এই পলিসির আওতায় মনিপুর থেকে বছরে ৩৫ হাজার মন চাল রপ্তানী করা হয়। কিন্তু এই রপ্তানীর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ থাকে মারোয়ারী নামক ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাতে। এই সময় তারা মনিপুরের তুলা ব্যবসা, হস্তশিল্প সামগ্রীর ব্যবসায়ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম করে।
চাল রপ্তানীর খতিয়ানে দেখা যায় ১৮৯৭-৯৮ সালে মনিপুর থেকে চাল রপ্তানী করা হতো প্রায় ২৫ হাজার মন। ১৯২২-২৩ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৮০ হাজার মনে। ১৯৩১-৩২ সালে ২ লাখ ৭৭ হাজার মন চাল রপ্তানী করা হয়। ১৯৩৭-৩৮ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৩ লাখ ৭২ হাজার মনে।
এরপর ১৯৩৯ সাল আসে। এসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামাও বাজতে শুরু করে। মনিপুর রাজ্যে এই বছরে প্রচন্ড খরা দেখা দেয়। এছাড়া ফসল তোলার সময় শিলাবৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এবং ফসলের উৎপাদন কমে যায়।
মনিপুরী জনগণ যেহেতু অধিকাংশই কৃষি সংশ্লিষ্ট পেশায় জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাই তারা এতে অর্থকষ্টে ভুগতে থাকেন।এই সুযোগে মারোয়ারীরা চালের মজুদ গড়ে তোলে।যেন কমদামে চাল বিক্রয় করতে বাধ্য হয় সে ধরণের ব্যবস্থা তারা করে। মনিপুর রাজ্যজুড়ে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হয়। চাল বাইরে রপ্তানী করার কারণে মনিপুরে চালের সংকটও দেখা দেয়।
এই অবস্থার দিকে খেয়াল রেখে মনিপুরী দরবার প্রশাসন ১৯৩৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর চাল রপ্তানীতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু তারপরও চুক্তি অনুযায়ী তৎকালীন আসাম রাজ্যের কোহিমায়(বর্তমানে নাগাল্যান্ড রাজ্যের অন্তর্গত) অবস্থিত ব্রিটিশ সেনা ব্যারাকে চাল রপ্তানী করতে বাধ্য হয়। এদিকে মহারাজার ব্যাপক চাপের ফলে চাল রপ্তানী আবার শুরু হয়ে যায়।
লগ্ন এসে গেল নুপি লান বা নারী সংগ্রামের!
এখানে বলা দরকার মনিপুরে নারীদের লড়াই যেন স্বাভাবিক এক বিষয়! এই লড়াইয়ে অনেক ক্ষেত্রে নারীরাই প্রথমে শুরু করেছিল। এবং তা জারি রেখেছিল তারাই।
১৯৩৯ সালের নুপি লান হচ্ছে মনিপুরী নারীদের দ্বিতীয় নারী সংগ্রাম। এর আগে তারা ১৯০৪ সালে একবার একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। চালের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে এই সংগ্রাম শুরু হয়েছিল।
মনিপুরের প্রথম নুপি লান বা প্রথম নারী সংগ্রাম নিয়ে কিছু কথা
১৯০৪ সালের ৬ জুলাই বুধবার সকাল। খইরাম্বাদ বাজারের নারী ব্যবসায়ীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা ২৮টি দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর আগে ওই বছরের ১৬ মার্চ দিবাগত রাতে মনিপুরীরা মহারাজা চুরাচান্দ-এর শিক্ষক ক্যাপ্টেন নুথাল এবং মনিপুরের সহকারী রাজনৈতিক এজেন্ট ডানলপের বাংলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এরপর আগস্টের ৪ তারিখ ভোররাতে আবার আরেকটি বাংলো পুড়ে যায় বা পুড়িয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে মনিপুরী জনগণ ব্রিটিশ শাসন মেনে নিতে পারছিলো না। এছাড়া মনিপুরী রাজবংশের লোকজন ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক নিয়োগকৃত বালক রাজা মহারাজ চুরাচান্দকেও মেনে নিতে পারছিলোনা।
এসব ঘটনা কারা ঘটিয়েছিল তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। এই ঘটনাগুলোতে যারা জড়িত ছিলো তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে সরকার ৫০০ রুপি বা টাকা পুরস্কার দেবে বলে ঘোষনা দেয়। কিন্তু তারপরও সরকার কোনো কুলকিনার করতে পারেনি।
বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদানের নির্দেশনামা
মনিপুর রাজ্যের সুপারিন্টেন্ট মি. এইচ ম্যাক্সওয়েল ৩০ সেপ্টেম্বর এক নির্দেশনামা জারি করে।এতে বলা হয় ইম্ফলের মনিপুরীদের বাধ্যতামূলক শ্রমের মাধ্যমে উক্ত বাংলোগুলো নির্মাণ করে দিতে হবে। এতে মনিপুরের ইম্ফলের ১৭ থেকে ৬০ বছর বয়সী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে ৪০ দিনের মধ্যে ১০দিন বিনা পারিশ্রমিকে বাংলো তুলে দেয়ার জন্য শ্রম দিতে হবে বলে নির্দেশ প্রদান করা হয়। মনিপুরী রাজ পরিবার এই সিদ্ধান্ত বাদ দেয়ার আবেদন করে। কিন্তু তা নাকচ হয়।
এই সময় নারীরা লড়াইয়ের ময়দানে সামনে আসে। এই বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদানের প্রতিবাদে নারীরা ০৫ অক্টোবর ম্যক্সওয়েলের বাংলো ঘেরাও করে। এতে প্রায় ৫ হাজার নারী যোগদান করে। আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ রাজ বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদানের নির্দেশ বাতিল করতে বাধ্য হন। এটাই মনিপুরের ইতিহাসে প্রথম নারী সংগ্রাম বা প্রথম নুপি লান নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় নুপি লান, ১৯৩৯
এই দ্বিতীয় নুপি লান বা দ্বিতীয় নারী সংগ্রামই মনিপুরী ইতিহাসে বেশি বিখ্যাত হয়ে আছে।
এই লড়াই কেন শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে উপরের আলোচনায় বলা হয়েছে। নিচে আমরা আন্দোলনের সাধারণ বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি।
দ্বিতীয় নুপি লান শুরু হলো-
১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৯
চাল রপ্তানী বন্ধ করার দাবি জানিয়ে মনিপুরী নারীরা মাঠে নামে। তারা মনিপুর দরবারের প্রেসিডেন্ট এবং তার কর্মকর্তাদের দরবার এলাকায় অবরুদ্ধ করে রাখে। এই অবরোধ কর্মসূচিতে হাজারের অধিক নারী অংশ নেয়।
এ সময় তারা চাল রপ্তানী বন্ধ করার জন্য দাবি জানিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। পেছনের দরজা দিয়ে দরবারের অন্য সদস্যরা পালিয়ে যায়। কিন্তু দরবারের প্রেসিডেন্ট মি. শার্পে পালিয়ে যেতে সক্ষম হননি। প্রেসিডেন্ট শার্পে এ সময় আন্দোলনকারী নারীদের বলেন যে, মহারাজা এখন রাজ্যের বাইরে অবস্থান করছেন। তার অনুমতি ছাড়া চাল রপ্তানী বন্ধ করা সম্ভব নয়। তখন নারীরা তাকে টেলিগ্রাম অফিসে নিয়ে যায়। তারা প্রেসিডেন্ট শার্পেকে দিয়ে মহারাজাকে টেলিগ্রাম পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এবং মহারাজার উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে। মহারাজা এই সময় নবদ্বীপে অবস্থান করছিলেন। অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর না আসা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করে।
এসময় আসাম রাইফেলের সৈন্যরা প্রতিবাদকারী নারীদের উপর আক্রমণ করে। এতে ২১ জন নারী ও একজন সৈন্য আহত হয়।
একইমাসে তেরা কেইথেল বা তেরা বাজারে অরিবম চাওবিতোন নামে এক নারীর নেতৃত্বে রপ্তানীর জন্য যে চাল নেয়া হচ্ছিলো তা আটক করা হয়।এভাবে জানুয়ারি,১৯৪০ পর্যন্ত ১৫০ গাড়ি চাল আটক করে রাখা হয়।
এ সময় তারা বাজার বয়কট কর্মসূচিও পালন করে।
মনিপুর রাজ্য থেকে যাতে কোন চাল রপ্তানী করা না যায় সেজন্য মনিপুরের বিভিন্ন বাজারের দোকানদার নারীরা আন্দোলনে যোগ দেয়। যেসকল বাজার(মনিপুরী ভাষায় কেইথেল) আন্দোলনে যোগ দেয় সেগুলো হলো- খইরামবান্দ কেইথেল, মোইরংখম কেইথেল, পুলিশ লাইন কেইথেল, সিংজামেই কেইথেল, হেইরাংগোইথং কেইথেল, কোংবা কেইথেল, লামলং কেইথেল, তেরা কেইথেল এবং ক্যকেইথেল।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৯
চাখার থেকে মনিপুরী কম্যুনিস্ট নেতা হিজাম ইরাবত সিং-এর আগমন এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক রূপের গুণগত পরিবর্তন
মনিপুরে নারীদের নেতৃত্বে চাল রপ্তানীর প্রতিবাদে যখন লড়াই চলছিলো তখন তা শুধুমাত্র নারীদেরই সংগ্রাম ছিলো।এতে পুরুষের অংশগ্রহণ ছিলো না। এই সময়ে মনিপুরে নিখিল মনিপুরী মহাসভা নামে যে সংগঠন ছিলো সে সংগঠনও প্রথমে নারীদের এই লড়াইকে সমর্থন দেয়নি।মনিপুরের তৎকালীন যুব নেতা এল. কানহাই ও টি. ইবোতোমবি নারীদের এই আন্দোলন নিয়ে নিখিল মনিপুরী মহাসভায় জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন।
এই সময়ে ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সময়ের অন্যতম মনিপুরী নেতা হিজাম ইরাবত সিং মনিপুরে আসেন। তিনি এসেই ‘মনিপুরী প্রজা সম্মেলনী’ নামে একটি সংগঠন গঠন করে নারীদের এই সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সমর্থন দিতে থাকেন। তিনি মনিপুরী নারীদের এই আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন জায়গায় গণজমায়েতের আয়োজন করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯৪০ সালের ৯ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে অপরাধ ছিলো তিনি উস্কানীমূলক বক্তব্য রাখছেন। তাকে তিন বছর জেলে আটক রাখা হয়। হিজাম ইরাবত গ্রেপ্তার হবার পরেও তার অনুসারীরা নারীদের এই আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা করে যান।
তারা আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং সরকারকে ও সামন্তীয় অধিপতিকে ট্যাক্স প্রদান বন্ধের আন্দোলন করেন।
১৪ জানুয়ারি, ১৯৪০
আন্দোলন জঙ্গি রূপ নেবার চেষ্টা করে
আন্দোলনের এক পর্যায়ে আন্দোলনের নেতারা নারীদেরকে তৈরী হয়ে প্রতিবাদে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। নেতারা প্রতিবাদের সময় নারীদেরকে মনিপুরী ভাষায় তেম{(চাকমা ভাষায় বিওঙ)একধরণের গাছের তৈরী লম্বা কাঠি যা ঐতিহ্যবাহী কাপড় বুনতে ব্যবহৃত হয়} সঙ্গে আনতে বলেন। এছাড়া ফেনাক বা তাদের পরিধানের কাপড় ডাবল করে ভালোভাবে পরে আসতে বলেন। অর্থাৎ, এক পর্যায়ে আন্দোলন জঙ্গি আকার ধারণ করে।
১৪ জানুয়ারী নারীদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে ব্রিটিশ সৈন্যরা আক্রমণ করলে এতে মোট ৪০ জন নারী আহত হয় এবং অনেক পুরুষও আহত হয়।
নুপি লান নারী সংগ্রাম আরো কয়েকমাস ধরে চলে
মনিপুর রাজ্যের বাইরে চাল রপ্তানীর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছিল মনিপুরের নারীরা।এই আন্দোলনে তারা কিছুটা সফলও হয়। ১৯৪০ সালের গ্রীস্মকাল পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে। তাদের বাজার বয়কট আন্দোলনকে সরকার নানাভাবে বন্ধ করার চেষ্টা করে।এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার খালি থাকা বাজারগুলো বিক্রি করার হুমকি পর্যন্ত দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার এই কাজটি করেনি।
তবে সরকার আন্দোলনকারী ৪ নারী নেত্রীকে গ্রেপ্তার করে।
আগস্ট মাসের দিকে এসে মনিপুরী নারীদের প্রতিনিধিরা সরকারের কাছে একটি পিটিশন প্রদান করে। এতে স্বাক্ষর করেন কুমারী, রজনী, মাইপাকপি, সানাতোনবি, নাঙঅবা। তারা নিচের বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন-
. দরবারের সদস্যরা যোগ্য নয়্
. পুলিশ সদস্যরা যোগ্য নয়।
. পুলিশের ইন্সপেক্টরের বেআইনী কাজ নিয়েও তারা পিটিশনে উল্লেখ করেন।
. ৪ নারী নেত্রীকে আটকের প্রতিবাদ করা হয়।
. জানুয়ারী মাসের ১৪ তারিখে নারী সমাবেশের উপর হামলার প্রতিবাদ করা হয়।
নুপি লান বা নারী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেত্রীদের কয়েকজনের নাম নিচে যোগ করা হলো-
. বামোন চাওবিতন দেভি।
. লোইতাম ওঙবি তোমমিাচা দেভি।
. খামবি দেভি।
. মোংজাম ইবেমাহল দেভি।
. ওয়াহেংবাম ওংবি তুঙ দেভি
. কাবোকেলেই আচোবি দেভি।
.
নুপি লান বা নারী সংগ্রাম পরিণত হয়েছিলো প্রশাসনিক অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে
প্রথমে এই লড়াই শুধুমাত্র চাল রপ্তানীর বিরুদ্ধে নারীদের প্রতিরোধ ছিলো। কিন্তু আন্দোলনের এক পর্যায়ে এই লড়াই রূপ নেয় দরবার বা মনিপুরের প্রশাসনকে পরিবর্তন করার দাবি আদায়ের আন্দোলনে। এই আন্দোলন মনিপুরের অর্থনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সংস্কারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হবার ফলে মনিপুরে আবার যুদ্ধের দামামা বাজতে থাকলে যুদ্ধের ভয়ে ইম্ফলের বেশিরভাগ জনগণ পালিয়ে বিভিন্নস্থানে চলে যায়। ফলে এক পর্যায়ে আন্দোলন থমকে যায়। কিন্তু মনিপুর রাজ্যের ইতিহাসে নারীদের এই সংগ্রাম এক গৌরবময় পর্বকে মনে করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র:
. Nupi Lan- the Women’s War in Manipur, 1939:An Overview; Ibotombi Longjam
. Nupi Lan – Women’s War of Manipur, 1939: e-pao.net
. Nupi Lan : The Great Second Women Agitation of Manipur, 1939-40; part- 1,2.
. মাইবামসাধন ব্লগ(সামহোয়্যাইনব্লগডটনেট)
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন