সাইকতপাড়ায় একদিন
আমাদের তিন পার্বত্য জেলায় যতগুলো আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক আছে তাদের প্রায় সবাই বান্দরবান জেলায় বসবাস করে। তাদের সবারই রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্রপূর্ন জীবনধারা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আদিবাসীদের মধ্যে মারমা আর ত্রিপুরারা সাধারণত নদী ও ঝিলের ধারে থাকে। তেমনি বম, খুমী, ম্রো(মুরং) আদিবাসীদের গ্রামগুলো বেশ উচুঁ জায়গায় হয়। কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে উচুঁ গ্রামগুলোতে বম আদিবাসীদের বাস। বাংলাদেশের সবচেয়ে উচুঁতে অবস্থিত গ্রামের নাম সাইকতপাড়া। এটি বান্দরবান জেলার রুমা থানায় অবস্থিত। পেশাগত কারনে আমার বহু দিন এই পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান। যার কারনে ট্রেকিং আমার নতুন নেশা! পাহাড়ে ট্রেকিং-এ আমার এবারের গন্তব্য সাইকতপাড়া। আমার অপর দুই সঙ্গী অভিযাত্রী জামিল ও মাহবুব এপথে নতুন বলে অভিযানকে আকর্ষনীয় করার জন্য বগালেক ও কেওক্রাডং পাহাড় চূড়াকে এই ট্রেইলে অর্ন্তভুক্ত করি।
বেলা দু'টায় রুমা বাজারে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রয়োজনীয় কেনা-কাটা সেরে ফেলি। লাইরুনপিপাড়া দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সাফ্রু অং নামে বগামুখপাড়ার এক মারমা পুরুষের সাথে দেখা। আমাদের আজকের গন্তব্য বগামুখপাড়া। সাফ্রু অং মারমাকে আমাদের গাইড হওয়ার অনুরোধ করা মাত্রই সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল। লাইরুনপিপাড়া পার হয়ে আমরা ঝিলের ধারে চলে এসেছি। অন্ধকার হওয়ার আগেই আমাদের বগামুখে পৌঁছতে হবে। একেতো শীতের দিনের বেলা খুব ছোট, তার উপর সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলে অন্ধকার নেমে আসে। আমরা ঝিলের কাঁচের মত স্বচ্ছ পানির মধ্য দিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলাম। এখানকার প্রকৃতির রূপ দেখে জামিল ও মাহবুব বিমোহিত। রুমা বাজার থেকে দু'ঘন্টা হেঁটে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় আমরা বগামুখ পৌঁছি। পুর্বে বহুবার বগামুখ অতিক্রম করলেও কখনও এখানে রাত্রিযাপন করা হয়নি। বগামুখের তিন পাশে তিনটি গ্রাম। দু'টি মারমা ও একটি ত্রিপুরা গ্রাম। আমরা ত্রিপুরা গ্রামের পূর্ব পরিচিত সুভাষ ত্রিপুরার বাসায় উঠি। পাড়াটির নাম ভাগ্যমনিপাড়া। পাহাড়ে সাধারনত কারবারীর (গ্রাম প্রধান) নাম অনুসারে গ্রামের নামকরণ হয়। প্রায় বাইশ পরিবার এখানে বাস করে। পাহাড়ীদের আতিথীয়েতার কথা যতই বলা হোক কম হবে, তা আরেকবার প্রমানিত হল সুভাষ ত্রিপুরার ঘরে।
কথামত পরদিন খুব ভোরে সূর্য উঠার আগেই হাজির আমাদের গাইড। শীতের সকালে বগামুখকে মনোরম লাগছিল। প্রায় ঘন্টা তিনেকের পদযাত্রায় আমরা বগালেক এ পৌঁছি। বগালেকের সৌন্দর্য্যে রনি আর অম্লান মুগ্ধ। রনি বিস্ময়ে বলল, এত উচ্চতায় এত চমৎকার একটি লেক আমাদের দেশে, ভাবতেই ভাল লাগছে। বগালেকের পানিতে গোসল করতে নামার সাথে সাথে আমাদের পাহাড়ে হাঁটার কান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেল।
পরদিন ভোরে প্রায় দু'ঘন্টা হেঁটে আমরা দার্জিলিংপাড়া পৌঁছি। দার্জিলিংপাড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় উচ্চতম জনবসতি। এর উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট। এটিও একটি বম আদিবাসীদের গ্রাম। পাড়ায় ব্যাগ-প্যাক রেখে একটু জিরিয়ে আমরা পচিশ মিনিটে কেওক্রাডং চূড়ায় পৌঁছে যাই। পরদিন ভোরে দেড় ঘন্টা হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম সাইকতপাড়া। চড়াই-উৎরাই কম বলে দার্জিলিংপাড়া থেকে সাইকতপাড়া যাওয়ার পথ অনেকটা সহজ। সাইকতপাড়া সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটি বম পাড়া। আমরা পাড়ার কারবারী (গ্রাম প্রধান) সাংচুয়ান বমের ঘরে উঠি। পাড়াটি বেশ ছিমছাম ও গোছানো। এমনিতে পাহাড়ীদের মধ্যে বমরা বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। এত উচ্চতায়ও বেশ বড় একটি খেলার মাঠ আছে। সারাক্ষণই বেশ জোরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। এখান থেকে কেওক্রাডং পাহাড় চূড়া দেখা যায়। পাড়ার কারবারীর কাছ থেকে জানতে পারলাম ১৯৬১ সালে এখানে পাড়াটি স্থাপিত হয়। তলাংচাতপাড়া থেকে প্রথমে ছয়টি পরিবার এখানে এসে বসবাস শুরু করে। বর্তমানে গ্রামটিতে ৩৫টি পরিবারে প্রায় দুইশত জন লোক বাস করছে। পাহাড়ে এমনিতেই পানির সমস্যা, তার উপর এত উচ্চতায় পানি সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য। পাড়ার এক পাশে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে পানি বেরিয়ে একটি প্রবাহ বয়ে চলছে। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ একেবারে কমে যায়। পাড়ায় বেশ কিছু কমলা ও কফি গাছ আছে। পাড়ার বাসিন্দারা জানে না যে, তারা বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত গ্রামে বাস করে। এ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথাও নেই। পরদিন ভোরে যখন পাড়া থেকে ফিরতি পথ ধরলাম, তখন পাড়ার সবাই আমাদের বিদায় জানাতে এলো। মনটা একটু খারাপই হলো। এই একদিনে পাড়ার সবাই আমাদের বেশ আপন করে নিয়েছিল। তারা প্রতি নিয়ত প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে টিকে আছে। তা সত্তেও তাদের মন পাহাড়ের মত বিশাল এবং প্রকৃতির মত সুন্দর।