সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার চিকসা গ্রামে গানবাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে গ্রামের মাতব্বররা। গ্রামে কেউ গানবাজনা করলে তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এই সংবাদে অনেকে অবাক হচ্ছেন। এটা অবাক হবার মতো বা নতুন কোনো সংবাদ নয়। ২০১৮ সাল থেকে আমার তাহিরপুর উপজেলায় যাতায়াত। উপন্যাসের রসদ খুঁজতে গত ছয় বছরে তাহিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম চষে বেরিয়েছি কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাইকে, কখনও ভাড়া করা বাইসাইকেলে, কখনওবা ট্রলারে। টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর, যাদুকাটা নদী, বাউলাই নদীর পাড়ের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে লোকজনকে একটা কমন প্রশ্ন করেছি আমি, ‘আপনাদের গ্রামে বাউলগান, যাত্রা বা বিচারগান এসব হয়?’
কেউ বলেছেন, ‘গান-বাজনা ভালো জিনিস না, হারাম।’ কেউ বলেছেন, ‘হুজুররা গান-বাজনা হইতে দেয় না।’
এইসব গ্রামে গান-বাজনার জায়গা দখল করেছে ওয়াজ। দেখেছি ওয়াজের পোস্টারে ছয়লাব ঘরের বেড়া, গাছের কাণ্ড, বিদ্যুতের খুঁটি! দেখেছি ব্যাঙের ছাতার মতো মসজিদ আর মাদ্রাসা। তরুণদের দেখেছি মোবাইলে ওয়াজ শুনতে, দোকানের স্পিকারে উচ্চস্বরে বাজে ওয়াজ আর কোরান তেলাওয়াত।
এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ আবাদী, মানে বহিরাগত। বৃহত্তর ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ থেকে গিয়ে ওখানে বসতি গড়েছে। এদের ভাষাও স্থানীয়দের ভাষার থেকে আলাদা, মানে এরা যে অঞ্চল থেকে গিয়েছে সেই অঞ্চলের ভাষা। তাহিরপুরে আগে অনেক হাজং এবং গারো জনগোষ্ঠী ছিল। আবাদীদের অত্যাচারে, এবং ক্ষেত্র বিশেষে স্থানীয় মুসলিমদের অত্যাচারে হাজং ও গারো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই মেঘালয়ে চলে গেছে। এখনও কিছু হাজং ও গারো গ্রাম আছে, কিন্তু প্রতিনিয়ত তারা নানারকম বৈষম্য ও জুলুমের শিকার হয়। এইতো বছর দুয়েক আগেও বারিক্কাটিলার পাশের আনন্দপুর টিলার গারোদের খেলার মাঠটি দখলের চেষ্টা করেছিল আবাদী মুসলমানরা। এদের মানসিক গঠনই দখলপ্রবণ। মুলত এই আবাদীরাই মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়েছে এই অঞ্চলে। এরাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ থেকে এদের পরিচিত মাওলানাদের ভাড়া করে নিয়ে যায় ওয়াজ করানোর জন্য। এই অঞ্চলের অনেক গ্রাম থেকে বাঙালির সংস্কৃতি একদম শিকড় থেকে উপড়ে ফেলেছে এরা।
শুধু তাহিরপুর উপজেলা নয়, সুনামগঞ্জের অন্যান্য উপজেলাতেও কমবেশি মৌলবাদের বিস্তার আছে। শাহ আবদুল করিম ছিলেন দিরাই উপজেলার মানুষ, গান গাওয়ার কারণে তাকে কাফের আখ্যা দিয়ে নিপীড়ন করে গ্রামছাড়া করেছিল মৌলবাদীরা। এইতো কয়েক বছর আগে শাহ আবদুল করিমের শিষ্য রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর ও বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। বাউলদের আখড়া ও বাদ্যযন্ত্র পোড়ানো বা ভেঙে দেয়া এই বাংলার চিরায়ত এক চিরায়ত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে! কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বগুড়ায় প্রতিনিয়ত বাউলরা কট্টরপন্থী মুসলমানদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হন, তাদের আখড়া ও বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়, চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়।
শুধু সুনামগঞ্জ নয়, সারাদেশে প্রচুর গ্রাম আছে যেখানে গান-বাজনা নিষিদ্ধ এবং মোটামুটি তালেবান শাসন চলছে। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নে পীর শায়েখ আব্দুল্লাহ’র সম্মানে টেলিভিশন ও গান-বাজনা নিষিদ্ধ, মানিকগঞ্জের গোবিন্দল গ্রাম একটি তালেবান গ্রামে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলের কাওয়ার চর থেকে উত্তর-পূর্বের জাদুকাটা নদীর পাড়, সর্বত্র মৌলবাদীরা শিল্প-সংস্কৃতির গলা চেপে ধরেছে।
আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মৌখিকভাবে গান-বাজনা নিষিদ্ধ করেছিল হুজুররা। এখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শতভাগ মৌলবাদবান্ধব আমেরিকার পুতুল শাসক পেয়ে সালিশ বসিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গান-বাজনা নিষিদ্ধ করছে মাতব্বররা। চিকসা গ্রাম শুরু করেছে মাত্র, একে একে চৌষট্টি জেলার আরও বহু গ্রাম গান-বাজনা নিষিদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে, যে গ্রামগুলোতে অনানুষ্ঠানিকভাবে আগে থেকেই গান-বাজনা নিষিদ্ধ। যে আঙিনা একদিন বাউল গান, ধামাইল, পালাগানে মুখরিত থাকত; সেই আঙিনা এখন মুখরিত ওয়াজের কর্কশ সুরে! বাউলের আঙিনা এখন মাওলানার দখলে!
১৯ আগস্ট, ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০২৪ দুপুর ১:৫৭