প্রায় দুইশো বছর ধরে বাংলাদেশে বাস করছে হরিজন সম্প্রদায়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৮ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে নগরের রাস্তাঘাট, নর্দমা এবং টাট্টিখানা পরিষ্কার করার জন্য তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তম থেকে তেলেগুভাষী এবং উত্তর প্রদেশের কানপুরের হাসিরবাগ থেকে হিন্দীভাষী দলিতদের পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন নগরে নিয়ে আসে। ১৯৩৩ সালে মহাত্মাগান্ধী সারা ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নাম দিয়েছিলেন- হরিজন সম্প্রদায়।
আজকের আধুনিক নগরে যে ধরনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আমরা দেখছি, সেই মধ্য ঊনবিংশ শতকে এমনটা ছিল না। তখন টাট্টিখানায় পাতি টিন থাকত, যার মধ্যে মল-মূত্র পড়ত। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হরিজন পুরুষরা ভোরবেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই মলমূত্র ভর্তি দুর্গন্ধে ভরা টিন টাট্টিখানা থেকে বের করে বাঁকে ঝুলিয়ে কাঁধে বয়ে গরু-মহিষের গাড়ির কাছে নিয়ে এসে গাড়িতে তুলতেন, তারপর নগরের বাইরে ফেলে আসতেন। কালক্রমে ইঞ্জিনচালিত গাড়ি আবিষ্কার হলে গরু-মহিষের গাড়ির পরিবর্তে মলভর্তি পাতি টিনগুলো ইঞ্জিনচালিত গাড়িতে নিয়ে নগরের বাইরে ফেলে আসতেন। নিশ্চিতভাবেই সেই টিনের মলমূত্র পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের হাতে-পায়ে, গায়ে লাগত। ভয়ানক দুর্গন্ধ আর অমানুষিক পরিশ্রম হতো তাদের। ভোর থেকে দুপুর গড়িয়ে যেত তাদের এই কাজ করতে। গুয়ের দুর্গন্ধ থেকে কিছুটা রেহাই পেতে তারা মদ পান করতেন। দুটো ভাত খেয়ে বাঁচার জন্য তারা অন্যের গু টানার মতো নোংরা কাজটি করতেন। আর রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমা পরিস্কারের কাজ তো ছিলই। রাস্তাঘাট পরিস্কার করতেন সাধারণত নারীরা। নারীদের জড়ো করা আবর্জনা পুরুষেরা গাড়িতে তুলে নগরের বাইরে ভাগাড়ে ফেলে আসত। সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষ তো বটেই, নিন্মবিত্ত মানুষেরাও তাদের ঘুণা করত। তাদেরকে কেউ স্পর্শ করত না, তারা কোনো হোটেলে খেতে পারত না, স্কুলে তাদের ছেলে-মেয়েদের পাশে কেউ বসত না, তাদের চুল কাটতে চাইত না নরসুন্দররা। মানুষের স্বস্তির জন্য নগর পরিস্কারের কাজের বিনিময়ে তারা নগরের মানুষের ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলা নিয়ে বেঁচে থাকত। এখন এই একবিংশ শতাব্দীতেও অনেক জায়গায় তারা এই ধরনের অমানবিক আচরণের শিকার হয়।
আমার মনে পড়ছে ভীমদার কথা। ভীমদা আমাদের রাজবাড়ী সরকারী কলেজের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন। এখনও আছেন কি না জানি না, থাকারই কথা। ভীমদা সপ্তাহে দু-দিন আমাদের হলের টয়লেট পরিস্কার করতেন। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, প্রায় শ্যামলা গায়ের রঙ, মেদহীন মজবুত স্বাস্থ্য তার। টয়লেট পরিস্কার করার সময় তার গায়ে শার্ট কিংবা টি-শার্ট আর পরনে লুঙ্গি থাকত। তবে বিকেল বেলায়-ই ভীমদাকে আর চেনা যেত না! গায়ে পরিস্কার একটা শার্ট কিংবা পলো শার্ট, পরনে জিন্স, পায়ে কেডস। নাকের নিচে পুরু গোঁফ, কামানো গাল। একদম দক্ষিণ ভারতের সিনেমার হিরো! হোস্টেলের রাস্তা দিয়ে হেঁটে সে যেতেন বাজারে। আমার মাঝে মাঝে মনে হতো- ভীমদা যদি হরিজন সম্প্রদায়ে না জন্মে আমাদের সমাজে জন্মাতেন, লেখাপড়ার সুযোগ পেতেন, তাহলে ভালো চাকরি পেতেন, সুন্দর একটা জীবন হতো তার। শুধুমাত্র জন্মগত কারণে তাকে মল-মূত্র পরিস্কার করতে হচ্ছে, তবু যদি লেখাপড়ার সুযোগটা পেত, জীবন কিছুটা অন্যরকম হতো। ভীমদাকে আমাদের বিভাগের কোনো শিক্ষকের চেয়ারে বসিয়ে দিলে, অপরিচিত কেউ তাকে দেখে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারত না যে তিনি শিক্ষক নন। আমি মনে মনে ভীমদার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতাম এই জন্য যে, ভীমদার কারণেই সকালবেলা পরিচ্ছন্ন টয়লেটে গিয়ে প্রাতঃকার্য সারতে পারতাম। আজ আবার স্মরণ হলো ভীমদার কথা, নত মস্তকে তার প্রতি শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র বারবার তার নাগরিককে উচ্ছেদ করেছে, এখনও করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে- ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বি মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু।
এই হিন্দুরা কিন্তু বাংলাদেশের ভূমিপুত্র। পাকিস্তান সরকার শত্রুসম্পত্তি আইন করে হিন্দুদের ঘরবাড়ি-সম্পদ অধিগ্রহণ করে, এর পাঁচ বছর পরই কিন্তু পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়, কিন্তু মহান জাতির জনক হিন্দুদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেননি। তার পরের আর কোনো সরকারই হিন্দুদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়নি। বরং সব সরকারের আমলেই হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মদতে প্রভাবশালী মুসলমানরা এই সম্পত্তি দখল করেছে, রাষ্ট্র নির্বিকার থেকেছে, মনের দুঃখে হিন্দুরা দেশত্যাগ করেছে। পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের মতো সর্বগ্রাসী অমানুষ সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে, যারা হিন্দুদের জমি দখল করেছে, এখনও করছে। সাথে নানারকম নির্যাতন-নিপীড়ন তো আছেই।
শুধু হিন্দুদের সঙ্গেই নয়, এই দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণের সঙ্গেও একইরকম আচরণ করেছে এই রাষ্ট্র, এখনো করছে। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির সময় ৬৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়, যার মধ্যে ছিলো ২২ হাজার একর চাষাবাদযোগ্য জমি। যা পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট চাষাবাদযোগ্য জমির প্রায় ৪০ শতাংশ। কাপ্তাই লেক নির্মাণে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে, ১ লক্ষ মানুষ তাদের আবাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই চাকমা জনগোষ্ঠী।
বুঝলাম যে চাকমাদের প্রতি পাকিস্তান শাসকের কোনো দয়া-মায়া ছিল না। কিন্তু এই জনপদে যারা রাজনীতি করতেন তারা কেন কাপ্তাই বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করতে পারলেন না? মওলানা ভাসানীর লংমার্চ ফারাক্কা বাঁধ চিনলো, আর কাপ্তাই বাঁধ চিনলো না? আমি বিশ্বাস করি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কাপ্তাই বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করা যেত। তাহলে জীববৈচিত্রের যেমনি ক্ষতি হতো না, তেমনি অসংখ্য চাকমা ও অন্যান্য অধিবাসীদের ভারতের অরুণাচল ও অন্যান্য জায়গায় উদ্বাস্তু হয়ে থাকতে হতো না।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পরও আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও তাদের ভূমি দখল বন্ধ হয়নি। অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসক মেজর জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে, মুসলমান বাঙালী সেটেলার ঢুকিয়ে পাহাড়ে চিরদিনের মতো অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। আজও নির্বিচারে চলছে পাহাড়ীদের ভূমি দখল। রাস্তা তৈরির নামে, অবকাশযাপন তৈরির নামে, সেনা-বিজিবির ক্যাম্প তৈরির নামে, মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরির নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে ভূমি দখল করছে। বনবিভাগ নানা ছলে-বলে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করছে। বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানও আদিবাসী উচ্ছেদে অংশ নিয়েছে। এসব নিয়ে গণমাধ্যমেও খুব বেশি খবর প্রকাশ করা যায় না। খবর প্রকাশ করলেই সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লোকেরা গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের ফোন দিয়ে ভদ্র ভাষায় চোখ রাঙায়!
এখন আবার চলছে দুইশো বছরের পুরনো বাসিন্দা হরিজন সম্প্রদায় উচ্ছেদ। ঢাকার বংশালে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের হরিজন সম্প্রদায়ের মিরনজিল্লা পল্লিতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কোনো সম্প্রদায় দুইশো বছর একটি জায়গায় বসবাস করলে, সেই জায়গায় তাদের অধিকার জন্মায় না? গত দুইশো বছরে এই অঞ্চলের বহু বন-বাঁদাড়, পাহাড়, নদীর চর দখল করে বাঙালীরা নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। সে-সব সম্পত্তি এখন তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত। সাধারণ মানুষের (বেশিরভাগই হিন্দু) এবং রাষ্ট্রীয় জমি দখল করে যত্রতত্র মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়েছে। খোদ এই ঢাকা শহরেই অনেক বৈধ মসজিদ-মাদ্রাসা আছে। মিরপুরের ৬০ ফুট রোডে, ভাষানটেকে রাস্তার সীমানায় বৈধ মসজিদ আছে। মেয়র তথা সরকারের বুকের পাটায় জোর আছে অবৈধ মসজিদ-মাদ্রাসা উচ্ছেদের? নেই, কারণ সেখানে আছে বৃহৎ সম্প্রদায়ের শক্তি। উচ্ছেদ করতে গেলে সরকারের পতন ঘটিয়ে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলবে রাষ্ট্রের পরিচালকদের।
১৯৪৭ সালে বিহারীরা এলো এই দেশে, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করলো, শুধু বিরোধীতা করলো না, পাকিস্তানীদের দোসর হয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালীদের হত্যাযজ্ঞে অংশ নিল। সেই বিহারীরা ঢাকার বড় একটি অংশে বসবাস করছে। সরকার উদ্যোগ নিয়েছে কেরানীগঞ্জে বিহারীদের জন্য সাড়ে পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের।
মিয়ানমারের আরাকানের রোহিঙ্গারা এসে আমাদের কক্সবাজারের শত শত একর জমিতে বসতি গড়ে তুলেছে, যাদেরকে আমরা আর কখনোই দেশে ফেরত পাঠাতে পারব না। ওই জমি চিরকালের জন্য তাদের হয়ে তো গেলই, উপরন্তু তাদের জনগোষ্ঠী বাড়লে তারা আশপাশের আরও জমি দখল করে সেখানে বসতি গড়ে তুলবে।
অথচ দুইশো বছর ধরে হরিজন সম্প্রদায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করে আমাদের নগরগুলো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখছেন, নগরের মানুষের মলমূত্র পরিষ্কার করছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তারা অবদান রেখেছেন এবং অনেকে শহীদ হয়েছেন; সেই জায়গার প্রতি হরিজন সম্প্রদায়ের অধিকার জন্মাবে না? সেই জায়গা তাদের নয়? রাষ্ট্র তাদের উচ্ছেদ করবে সামান্য একটা মার্কেট তৈরির জন্য? দুইশো বছর ধরে সেবা দেবার এই প্রতিদান? গাজায় ইসরায়েলী হামলা ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে বাংলাদেশ প্রতিবাদ করে, সেই বাংলাদেশই কেন বারবার তার দেশের মানুষকে উচ্ছেদ করে? এ কেমন দ্বিমুখী নীতি?
হায় বাংলাদেশ, তুমি গণতন্ত্রের মুখোশ পরা ভয়ংকর অমানবিক এক রাষ্ট্র!
ঢাকা
১৩ মে, ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২৪ সকাল ৭:০৮