ইসলাম ধর্মের মাওলানারা শিল্প-সাহিত্যের বিরোধীতা করেন; গান-বাজনা করা, নৃত্য কিংবা অভিনয় করা, প্রেম-কাম-প্রকৃতি বিষয়ে কবিতা কিংবা গল্প-উপন্যাস ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ বলে তারা ঘোষণা করেন এবং এই বিষয়ে কোরান-হাদিস থেকে উদ্বৃতিও দেন। কিন্তু যে-সব মুসলমান গান-বাজনা করেন, অভিনয় করেন, কবিতা-উপন্যাস লেখেন তারা আবার মাওলানাদের কথা বিশ্বাস না করে বলেন যে মাওলানারা কোরান-হাদিসের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন; অথবা তারা মাওলানাদের কথা বিশ্বাস করলেও তা উপেক্ষা করে নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা যদি মাওলানা বা মুসলমান কবি-শিল্পীদের কথায় কান না দিয়ে সরাসরি কোরান-হাদিস পড়ি, তাহলে সত্যি সত্যিই সেখানে দেখতে পাই যে মাওলানাদের কথাই সত্য, অর্থাৎ ইসলামে গান-বাজনা, নৃত্য-অভিনয়, প্রেম-কামের সাহিত্যচর্চা হারাম বা নিষিদ্ধ। কিন্তু কেন? কেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ গান-বাজনা, নৃত্য-অভিনয় বা প্রেম-কামের সাহিত্য ইত্যাদি মনোজগতের ক্ষুধা মিটানোর মতো নান্দনিক-সৃজনশীল বিষয়ের প্রতি এতোটা বিরাগভাজন ছিলেন? তার রাগটা আসলে কোথায় বা কাদের ওপর? সেই ইতিহাস খুঁড়ে দেখা যাক।
তথাকথিত নবুয়তির পর মুহাম্মদ নিজেকে আল্লাহ প্রেরিত নবী দাবী করে মক্কার পৌত্তলিক কোরাইশদেরকে তাদের ধর্ম ত্যাগ করে তার নতুন ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন, কিন্তু কোরাইশরা মুহাম্মদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কোরাইশদের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক, আজকের দিনেও তো নানান ধর্মের ধর্মীয় নেতা নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ঈশ্বর প্রেরিত প্রতিনিধি বলে দাবী করেন, কিছুদিন আগে সৌদি আরব প্রবাসী এক বাংলাদেশী মুস্তাক মুহাম্মদ আরমান খান নিজেকে ‘ইমাম মাহাদী’ বলে দাবী করেছেন, মানুষ তাকে বিশ্বাস করেনি, বরং ভণ্ড বলেছে। এমনকি রমনা মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ফেইসবুকে গতবছর একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, সেখানে দেখা যায় এক তরুণ নিজেকে আল্লাহ প্রেরিত রসুল ঈসা নবী দাবী করছে এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাকে মিনিট দেড়েক জিজ্ঞাসাবাদের পর উত্তমমধ্যম দিচ্ছে। সুতরাং একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ভবিষ্যতে যে-ই নিজেকে ইমাম মাহাদী কিংবা ঈসা নবী দাবী করুক না কেন, তার কপালে ভাল কিছু জুটবে না। মক্কার কোরাইশরাও মুহাম্মদকে আল্লাহ প্রেরিত নবী হিসেবে অবিশ্বাস করেছিল। কিন্তু মুহাম্মদ নাছোড়বান্দার মতো মানুষের পিছে লেগে থাকতো; পথে পথে, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে, কাবা মন্দিরে (তখন কাবাঘরে মূর্তিপূজা করা হতো) গিয়ে মানুষকে বোঝাতে চাইতেন যে তিনি আল্লাহ প্রেরিত নবী এবং তার নতুন ধর্ম ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম। মানুষ তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হতো, কেউ তাকে পাগল ভাবতো। মক্কার অদূরে তখন ‘ওকাজের মেলা’ নামে বিশাল এক মেলা হতো, আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিল্পীরা আসতেন তাদের শিল্পকলা প্রদর্শনের জন্য। নৃত্যশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, যাদুশিল্পীরা সারাবছর অপেক্ষায় থাকতেন ওকাজের মেলার জন্য; আর তাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পনৈপূণ্য প্রদর্শন করতেন ওকাজের মেলায়। পুরস্কারও পেতেন। কবিতার প্রতিযোগিতা হতো, কবিগণ আসতেন তাদের সেরা কবিতাটি নিয়ে পাঠের জন্য, বিজয়ী কবিকে পুরস্কার প্রদান করা হতো। বিজয়ী কবির কবিতা সোনালী পাতে লিখে কাবা মন্দিরের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো। আরবের মানুষ এতোটাই কাব্যপ্রেমী ছিল এবং কবি ও কবিতাকে ভালবাসতো। মুহাম্মদ ওকাজের মেলায় যেতেন ইসলাম প্রচার করতে, সঙ্গত কারণেই মানুষ তাকে পাত্তা দিতো না, পাগল বা উন্মাদ ভেবে তাকে এগিয়ে চলতো। মুহাম্মদ যখন দেখতেন যে তার ইসলাম ধর্ম কেউ গ্রহণ করছে না, তাকে কেউ পাত্তাও দিচ্ছে না, অথচ মানুষ সংগীত শুনছে, নৃত্য-অভিনয়-যাদু দেখছে, কবিতার আসরে মানুষের ভিড় লেগে আছে, কবি-শিল্পীদের মানুষ কদর করছে; তখন হয়তো তার রাগ-ক্ষোভ জন্মাতো কবি-শিল্পী এবং তাদের শিল্পকলার ওপর। আর এ কারণেই হয়তো তিনি শিল্পকলার প্রতি বিষোদগার করতেন, কোরানে আল্লাহ’র বানীর নামে আসলে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।
আল কোরান, সুরা নজম (৫৩:৬১) এ বর্ণিত আছে-
‘তোমরা কি এ কথার (কোরান শরীফ-এর) উপর আশ্চর্য্যান্বিত হচ্ছো ও হাস্য করছো এবং ক্রন্দন করছো না, অথচ তোমরা সঙ্গীত বা গান-বাজনা করছো?’
এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে তাফসীরে ইবনে জারীর, ২৭ খণ্ড, ৪৩/৪৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ‘হযরত কাতাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে রেওয়ায়েত করেন, মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম ‘সামিদুন’ (সামুদ ধাতু হতে উৎপন্ন হয়েছে) এর অর্থ সঙ্গীত বা গান-বাজনা, যখন কাফিরেরা কোরান শরীফ শ্রবণ করতো, সঙ্গীত বা গান-বাজনা করতো ও ক্রীড়া কৌতুকে লিপ্ত হতো, এটা ইয়ামেনবাসীদের ভাষা।’
আল কোরান, সুরা বনি-ইসরাইল: (১৭:৬৪) এ বর্ণিত আছে-
‘এবং (হে ইবলিস) তুই তাদের মধ্য হতে যাকে পারিস নিজের শব্দ দ্বারা পদস্খলিত কর।’
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে জারীর-এর ১৫/৭৬ পৃষ্ঠায় আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, ‘শয়তানের শব্দ অর্থ হচ্ছে ক্রীড়া ও সঙ্গীত বা গান-বাজনা।’
আল কোরান, সুরা লোকমান: (৩১:৬) এ বর্ণিত আছে-
‘আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে।’
এছাড়া হাদিসেও শিল্পকলার প্রতি মুহাম্মদের প্রতি রাগ এবং ক্ষোভ দেখতে পাই-
নবী মুহাম্মাদ বলেছেন- ‘গান শোনা গুণাহের কাজ, গানের মজলিসে বসা ফাসেকী এবং গানের স্বাদ গ্রহণ এবং প্রশংসা করা কুফরী।’ এবং ‘আমি “বাদ্য-যন্ত্র” ও “মুর্তি” ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।’-আবু দাউদ
অন্য হাদিস এ নির্দেশ আছে- ‘পানি যেরূপ জমিনে ঘাস উৎপন্ন করে “গান-বাজনা” তদ্রুপ অন্তরে মুনাফেকী পয়দা করে।’ (বায়হাক্বী ফী শুয়াবিল ঈমান)
‘জামিউল ফতওয়া’ কিতাবে উল্লেখ আছে-‘গান-বাজনা শ্রবণ করা, গান-বাজনার মজলিশে বসা, বাদ্য-যন্ত্র বাজানো, নর্তন-কুর্দ্দন করা সবই হারাম, যে ব্যক্তি এগুলোকে হালাল মনে করবে সে ব্যক্তি কাফির।’
‘যে ঘরে কুকুর থাকে আর প্রাণির ছবি থাকে সে ঘরে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না।’(সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ২৯৯৮- ইফা)
‘(কিয়মতের দিন) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি বানায়।” [সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদিস নং ৫৫২৬-ইফা)
‘হাশরের দিন সর্বাধিক আজাবে আক্রান্ত হবে তারাই, যারা কোনো প্রাণির ছবি আঁকে।’ (বুখারি : ৫/২২২২)
এছাড়াও মুহাম্মদ তার উম্মতের বিপথগামীদের সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন-
‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে যারা ব্যভিচার, সিল্কের কাপড় পরিধান, মদ্যপান ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে।’ (বুখারী, হাদীস-৫৫৯০)
একবার মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা মদিনা থেকে আশি মাইল দূরের আরজ নামক এক পল্লীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন কবি এসে তাদেরকে কবিতা শোনাতে থাকেন, কবিতা শুনে মুহাম্মদ তার অনুসারীদের বলেন, ‘এই শয়তানটাকে আটক করো। কবিতা দিয়ে পেট ভরার চেয়ে পুঁজ দিয়ে ভরা ভাল, যে পুঁজ তার যকৃতে পচন ধরায়।’
কবি নদর বিন আল-হারিস হত্যা
বদর যুদ্ধে মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা কবি নদর বিন আল-হারিসকে বন্দী করে। নদর একসময় আল হিরার লাখমিদ রাজদরবারের রাজকবি ছিলেন। ফেরদৌসি নামের একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন তিনি। কোরানের আদ-সামুত-লুতের বর্ণনার চেয়ে আরো সুন্দর করে পারস্যের রুস্তম-ইসফানদার এর রাজকীয় ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী বলতে পারেন, এমন দাবী তিনি করেছিলেন। নবী নদরের শিরোচ্ছেদ করার নির্দেশ দিলে সাহাবী আল-মিক্বদাদ বিন আমর বলেছিলেন, ‘এই লোক আমার বন্দী। তাই সে আমার গণিমতের মাল হিসেবে বিবেচ্য।’ আল-মিক্বদাদ চেয়েছিলেন নদরের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে তাকে ছেড়ে দিতে। তখন মুহাম্মদ মিক্বদাদকে বলেন, ‘নদর পূর্বে কোরানের আয়াত নিয়ে যে-সব কটুক্তি করেছে, তা কি ভুলে গেছ?’
অতঃপর নবীর নির্দেশে কবি নদর বিন আল-হারিসের শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হয়।
কবি ওক্ববা বিন আবু মোয়াইত হত্যা
বদর যুদ্ধে বন্দী কবি ওক্ববা বিন আবু মোয়াইতকে মুহাম্মদের সামনে আনা হলে তিনি তার সাহাবী আসিম বিন সাবিতকে মোয়াইতের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। সাবিত মোয়াইতকে হত্যা করতে উদ্যত হলে মোয়াইত কাঁদতে কাঁদতে মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি মারা গেলে আমার সন্তানদের কী হবে?
মুহাম্মদ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘জাহান্নমের আগুন।’
অতঃপর কবি ওক্ববা বিন আবু মোয়াইতের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কবি কাব ইবনে আল-আশরাফ হত্যা
বদরযুদ্ধে কোরাইশদের পরাজয় এবং তাদের অনেককে হত্যার খবর দিযে মুহাম্মদ তার দুই অনুসারী জায়েদ ইবনে হারিসাকে পাঠান দক্ষিণ মদিনায় এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওহাকে পাঠান উত্তর মদিনায়। এই খবর শুনে বনু নাবহান গোত্রের কবি কাব ইবনে আল-আশরাফ বলেন, ‘এসব সত্যি? এই দুজন লোক যেসব নাম বলছে, তাদের মুহাম্মদ সত্যি সত্যি হত্যা করেছে? এরা হলো আরবদের মধ্যে খানদানি লোক, রাজবংশের সন্তান। মুহাম্মদ যদি তাদের হত্যা করে থাকেন, তাহলে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
তিনি যখন কোরাইশদের মৃত্যর ব্যাপারে নিশ্চিত হন, তখন মদিনা ছেড়ে মক্কায় যান। মক্কায় গিয়ে আল-মুত্তালিব ইবনে আবু ওয়াদার বাড়িতে ওঠেন। তিনি আল-মুত্তালিব এবং তার স্ত্রী আতিকার কাছে হত্যাকারী মুহাম্মদের সমালোচনা করেন এবং বদরে নিহত কুরাইশদের নিয়ে তার লেখা কবিতা আবৃত্তি করে শোনান-
বদরের কারখানা তার মানুষেল রক্ত টেনে নিয়েছে,
বদরের মতো ঘটনায় তোমাদেরিউচিৎ চিৎকার করে ক্রন্দন করা।
জলাধারের চারপাশে হত্যা করা হয় সেরা লোকদের,
যুবরাজেরও ওখানে পড়ে থাকায় বিস্ময়ের কিছু নেই।
যত সুদর্শন মানুষ,
গৃহহীনের আশ্রয় নিধন হলো।
আকাশ বৃষ্টি না দিলে তারা দরাজ দিল হতো,
অন্যের বোঝা টানতো তাতা, শাসন করতো,
ন্যায্য পাওনা বুঝে নিত।
কারও কারও ক্রোধে আমি খুশি হই,
তারা বলে, ‘কাব ইবনে আল-আশরাফ বড় মনমরা হয়ে গেছে।’
ওরা যথার্থই বলে। ওদের হত্যার সময়
ধরণী দ্বিধা হয়ে গ্রাস করেছিল তার লোকজন,
যে খবর রটিয়েছে তাকেও বিদ্ধ করা হয়েছে
অথবা মূক বধিরে পরিণত করা হয়েছে।
শুনেছি বানুল মুগিরাকে অপমান করা হয়েছিল
আবুল হাকিম ও রাবিয়ার দুই ছেলের মৃত্যুর পর
নিহতদের সমান সম্মান পায়নি মুনাব্বিহ ও অন্যরা।
শুনেছি আল-হারিস ইবনে হিশাম
সৈন্যবাহিনী তৈরি করছে,
সেনাদল নিয়ে ইয়াসরিব যাবে সে-যাবে কারণ শরিফ সুদর্শন মানুষই কেভল
উচ্চ সুনামের কদর রাখতে জানে।
তারপর কাব ইবনে আল-আশরাফ মদিনায় ফিরে আসেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে মুসলমান নারীদের নিয়ে অপমানজনক প্রেমের কবিতা রচনা করার। মুহাম্মদ তার অনুসারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই ইবনুল আশরাফের যন্ত্রণা থেকে কে মুক্তি দেবে আমাকে?’
মুহাম্মদ ইবনে মাসসালা নামে এক অনুসারী বলে, ‘আপনার জন্য আমি ওকে দেখে নেব, হে রাসুলুল্লাহ। আমি ওকে হত্যা করবো।’
মুহাম্মদ বলেন, ‘যদি পারো তা-ই করো।’
এরপর মুহাম্মদ ইবনে মাসসালা কাব ইবনে আল-আশরাফের পালিত ভাই আবু নায়লা এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মতো এক রাতে আবু নায়লা কাব ইবনে আল-আশরাফকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দুজনে কথা বলতে থাকে, আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা মুহাম্মদ ইবনে মাসসালা এবং অন্যরা কাব ইবনে আল-আশরাফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছুরি দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে।
কবি আবু আফাক হত্যা
আবু আফাক ছিলেন ইয়াসরিবের (বর্তমান নাম মদিনা) একজন কবি, ইহুদী ধর্মাবলম্বী, তাঁর বয়স ছিল একশো বিশ বছর। বদরযুদ্ধের পর ইয়াসরিবের মানুষ মুহাম্মদের কঠোর সমালোচনা করেন অন্যায়ভাবে যুদ্ধ এবং কোরাইশদেরকে হত্যা করার জন্য। ফলে সমালোচনাকারী কিছু মানুষকে খুনের পরিকল্পনা করেন মুহাম্মদ, তার আদেশে তার অনুসারীরা রাতের অন্ধকারে মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করতে শুরু করেন। আল হারিস ইবনে সুবায়দ ইবনে সামিত নামক এক ব্যক্তিকে হত্যা করার পর কবি আবু আফাক এই হত্যার প্রতিবাদে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
অনেক দেখেছি জীবনে, কিন্তু মানুষের
এমন জমায়েত দেখিনি কখনো
কর্মের ও মিত্রের কাছে এমন কৃত সংকল্প
আহ্বান করলে, কায়লার সন্তানদের চেয়েও
উত্তম তারা একত্র হলে;
এইসব মানুষ পাহাড় টলায়, মাথা নত করে না।
এক সওয়ারি এসে ওদের দুটি ভাগ করলো,
বললো, ‘হালাল’ ‘হারাম’ ইত্যাদি সব।
গৌরব কি রাজত্বের বিশ্বাস করো যদি
তাহলে তুব্বা অনুসরণ করো।
কবি আফাক এই প্রতিবাদী কবিতা লেখার পর মুহাম্মদ তার অনুসারীদের বলেন, ‘আমার হয়ে কে শায়েস্তা করতে পারবে এই বদ লোককে?’
সালিম ইবনে উমায়ের নামে মুহাম্মদের এক অনুসারী প্রতিজ্ঞা করে বলেন, ‘আমি এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করছি যে, হয় আমি আবু আফাককে খুন করবো অথবা তার আগেই মরবো।
গরমের রাত্রে আফাক বাহিরে খোলা আকাশের নিচে খাটিয়ায় ঘুমিয়ে ছিলেন। সালিম ইবনে উমায়ের এই সুযোগটাই কাজে লাগায়, সে ঘুমন্ত কবি আফাকের পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে চাপ দিতে থাকে যতোক্ষণ না তলোয়ারের মাথা শরীর ফুঁড়ে শয্যা পর্যন্ত না পৌঁছোয়। একশো বিশ বছরের বৃদ্ধ কবি আফাককে এভাবেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় নবী মুহাম্মদের নির্দেশে।
কবি আসমা বিনতে মারওয়ান হত্যা
বৃদ্ধ কবি আবু আফাককে হত্যার প্রতিবাদে এবং মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের নিন্দা করে নারী কবি আসমা বিনতে মারওয়ান কবিতা লিখেছিলেন-
ঘৃণা করি আমি বনু মালিক আর আল-নাবিতকে
ঘৃণা করি আউফ আর বনু খাজরাজকে।
এক আগন্তুককে তোমরা মানো
যে মুরাদ কিংবা মান্ধিজের নয়।
তোমাদের সরদারদের নিধন করার পর
কী ভালো তোমরা আশা করো তার কাছে,
হত্যা করেছে যে খাবারের সামনে ক্ষুধার্তের মতো?
সম্মানী মানুষ একজনও কি নেই যে আচমকা
ওর ওপর আঘাত হেনে তাদের সব আশা নির্মূল করবে?
এটা খুবই স্বাভাবিক যে একজন বৃদ্ধ কবিকে হত্যার পর হত্যার নির্দেশদাতা এবং হত্যাকারীর সমালোচনা হবে, তা নিয়ে লেখালেখি হবে, এটা যে-কোনো সচেতন সমাজেই হয়, আমাদের সমাজেও হয়, মদিনাতেও তাই হয়েছিল।
কিন্তু আসমা বিনতে মারওয়ানের প্রতিবাদী কবিতা শোনার পর ক্ষুব্ধ মুহাম্মদ তার অনুসারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘মারওয়ানের মেয়ের হাত থেকে আমাকে কে বাঁচাবে?
তখন তার কথা শুনেছিলেন উমাইর ইবনে আদিই আল-খাতাম, সেই রাতেই সে আসমার বাড়িতে যায়, আসমা তখন তার পাঁচ সন্তানকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন, সবচেয়ে ছোট সন্তানকে দুগ্ধ পান করাচ্ছিলেন। উমাইর আসমার বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে তাকে হত্যা করে। হত্যার পর ভোরবেলায় সে মুহাম্মদের কাছে গিয়ে আসমাকে খুনের কথা জানায়। মুহাম্মদ বলেন, ‘হে উমাইর, তুমি আল্লাহ ও তার নবীকে সাহায্য করেছো।’
উমাইর তখন মুহাম্মদের কাছে জানতে চান যে তার এই কর্মের ফলে কোনো অমঙ্গলের সম্ভাবনা আছে কি না?
মুহাম্মদ বলেন, ‘দুটো ছাগলও তার জন্য মাথা নাড়বে না।’
মুহাম্মদ ঘাতক উমাইরের কর্মকাণ্ডে খুশি হয়ে তাকে বসির (চক্ষুষ্মান) উপাধি দেন। তারপর উমাইরকে সঙ্গে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন।
ফারহানা ও কারিবা হত্যা
মক্কা বিজয়ের পর আবদুল্লাহ ইবনে আল-খাতাল এবং তার দুই ভৃত্য সংগীতশিল্পী ফারহানা ও কারিবাকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন মুহাম্মদ। ফারহানা এবং কারিবা’র অপরাধ ছিল তারা মুহাম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গান গাইতো। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকা হয়, গান গাওয়া হয়, পথ নাটক করা হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্ম ব্যতিত অন্য কোনো ধর্মের মানুষ এই ধরনের কাজের জন্য কোনো শিল্পীকে হত্যা করে না। আমরা জানি যে কয়েক বছর আগে মুহাম্মদের কার্টুন আঁকার জন্য শার্লি এবদোর বারোজন কার্টুনিস্টকে হত্যা করে মুসলমান জঙ্গিরা।
এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মুহাম্মদের সময়কালেও ব্যাঙ্গাত্মক গান বা নাটকের প্রচলন ছিল, যাদের কাজ সমালোচিত হতো, তাদেরকে নিয়ে হয়তো ব্যাঙ্গাত্মক গান বা অভিনয় করা হতো। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে সেই সময়ে মুহাম্মদের কর্মকাণ্ড কেবল বিতর্কিত বা সমালোচিতই ছিল না, নিশ্চিতভাবেই তা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। আর সেই কারণেই ফারহানা এবং কারিবা তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক গান গেয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদ প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে দুই নারী সংগীতশিল্পীকে হত্যার নির্দেশ দেন।
*মুহাম্মদ আরো কোনো কবি বা শিল্পীকে হত্যা করেছেন কিনা আমার জানা নেই। পরে এই ধরনের হত্যার তথ্য পেলে সংযুক্ত করা হবে।
সহায়ক গ্রন্থ:
১. সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) (মুহাম্মদের প্রথম বিশদ জীবনী)
মূল: ইবনে ইসহাক; অনুবাদ: শহীদ আকন্দ; প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
২. আল কোরান-ইসলামী ফাউন্ডেশন সম্পাদিত
৩. সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড
৪. সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড
৫. ইসলামের অজানা অধ্যায় (দ্বিতীয় খণ্ড)-গোলাপ মাহমুদ
৬. আবু দাউদ
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২১ রাত ১০:১৬