মূল লেখাটি লৌহিত্য মানসের। লেখকের অনুমতি নিয়ে ধারাবাহিক দেয়া হচ্ছে-
...
ভোরে আলো ফুটার আগেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সাহেব তাঁবু ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন। দু-তিন জন এখনও পাথরের চাইয়ের উপর কুণ্ডলি দিয়ে ঘুমুচ্ছে। কুয়াশার মতো মেঘ ঢেকে দিয়েছে সব কিছু। কেবলি ঝিরির জলের শব্দ। এ বেলার পাট চুকিয়ে দলটি আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে। আরও এক দিনের পথ। পথে ছোট-খাট পাহাড়, ঝিরি আর জঙ্গল তো থাকবেই। সাহেব তাঁবু থেকে একটু দূরে হাঁটতে গিয়ে দেখা পেলেন দুটো হরিণ জল পান করতে এসেছে। আহা সেকি যুগল! হরিণ দুটোর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা আগুন্তুকের অবস্থান ঠাহর করতে পারেনি। সাহেব ঠাঁই দাঁড়িয়ে গেলেন। জল পান শেষে হরিণ দু’টো লাফাতে লাফাতে বনের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যায়। এমন দৃশ্য শত বছরের দুঃখকেই কাবু করে দেয়। সাহেব ফিরে এসে চায়ের কাপ হাতে হরিণের গল্প করেন। সাহেব বন্য প্রাণী দেখে যতটা বিষ্মিত হন ঠিক ততটাই বিষ্মিত হয় দলের লোকেরা সাহেবকে দেখে। পাকা আঙুরের মতো গায়ের রং, পাট করা হাল্কা সোনালি চুল, শক্ত চোয়াল, দীর্ঘকায় গঠন আর চোখের ভাষা সেতো সবারই দৃষ্টি কাড়ে। দলের থেকে একজন এগিয়ে এসে বলতে শুরু করে, একবার হাতির একটা দলের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। দলটিতে ১০০টির মতো হাতি ছিল। কিভাবে হাতির দলটিকে পাশ কাটিয়ে সে গ্রামে ফিরে এসেছিল। সেই গল্প নানা অঙ্গভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলে খুমী যুবকটি। সত্যি বলতে অরণ্যচারী এই মানুষগুলোর সাথে নিত্য সাক্ষাৎ হয় বন্য প্রাণীকূলের। কি মানুষ-কি প্রাণী সকলেই অদৃশ্য এক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে শত বছর ধরে ভাগাভাগি করছে এই অরণ্য। হায় সভ্যতা, তুমি কেড়ে নিলে সেই সব সোনালি দিনগুলো।
পাহাড় পেরিয়ে, ঝিরি পথে বুক অব্দি জলে ডুবে, পিচ্ছিল পাথর গলে, হাঁটু সমান কাদা আর ঘন বাঁশ বন সেই সাথে গিবন, লেমুর, হলদে পেট কাঠ বিড়ালী, বাদামী কাঠ বিড়ালী, বুনো গয়াল, নকূল, দানব অজগরের সাক্ষাৎ শেষে দলটি যখন বড় নদীর কাছে এসে পৌঁছায় তখন সন্ধ্যা হয় হয়। কারও মুখে কথা নেই। কালাদান বেশ বড় নদী। নদী থেকে খানিকটা দূরেই তাঁবু খাটানো হল। দলটির সঙ্গে আরও পাঁচজন খুমী যুক্ত হয়েছে। তারা গ্রাম সর্দারের নির্দেশে নৌকা নিয়ে এসেছে। আগুন জ্বেলে সকলেই বৃত্তাকারে বসে আছে, সাহেব নানা গল্প আর অভিজ্ঞতার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছেন। শুক্লা নবমীর সেই রাতে ‘সেমুল’ গাছের রেজিন হতে জ্বালানো আগুনে সাহেবকে ওরা দেবদূতই হয়তো ভেবে ছিল। কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর হতে চলেছে তার খেয়াল কারো নেই। হোক রাত, যাকনা সময়…। ভোরে বাক্স-পেটরা নৌকায় তোলা হল। দুটি নৌকা। একটিতে সাহেবসহ সাত জন। অন্যটিতে মালসামানাসহ বাকীরা। নদী ধরে ঘন্টা তিনের পথ। তারপর তিয়্যানওই (Teynwey) এর গ্রাম।
নদী ছেড়ে ছোট একটি খাল ধরে এগিয়ে চলে নৌকা। পাহাড়ের ফাঁক গলে খালটি বয়ে চলেছে। দু’ পাশের পাহাড় বেশ খাড়া আর ঘন জঙ্গল। অল্প কিছু দূর যাবার পর খাড়া পাহাড়গুলো পিছনে পরে আর সামনে ধরা দেয় অপেক্ষমান মানুষের জটলা। নৌকা দু’টি সাবধানে পাড়ে ভিড়ে। শিশু, নারী, যুবক, বৃদ্ধ সকলেই কৌতুহলী চোখে দেখে নৌকা থেকে নেমে আসছেন সাহেব। তিয়্যানওই ততক্ষণে উঁচু পাড় হতে জলের কাছাকাছি চলে এসেছে। দু’হাত সামনে বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে একে অপরকে। নদী ছেড়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ ধরে সাহেবকে সাথে নিয়ে সকলেই পা বাড়ায় গ্রামের পথে। ছোট একটি জঙ্গল পার হয়ে যে পাহাড় পরে তার উপর থেকে অল্প দূরেই চোখের সামনে ধরা দেয় গ্রামটি। এ যেন গহীন অরণ্যে লুকায়িত মনিমাণিক্য, ঠিক যেমনটি ঝিনুক মুক্তা পুষে রাখে তার বুকের ভিতর। গ্রামটির চারপাশেই পাহাড়। ঘরগুলো মাটি থেকে চার-পাঁচ ফুট উঁচুতে মাচাংয়ের উপর। বাঁশ, আস্ত গাছের খুঁটি আর শনের ছাউনি দিয়ে তৈরি। গ্রামে ঢুকার সাথে সাথেই দু’ একটি কুকুর চিৎকার করে এগিয়ে আসে, পরক্ষণেই গ্রামের লোক দেখে থেমে যায়। সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হয় তিয়্যানওই এর ঘরে। ঘরের সামনে উন্মুক্ত মাচাংয়ে গাছের গুড়ি কেটে বানানো কেদারায় সাহেব বসে আছেন। প্রস্তুতি চলছে একটি অনুষ্ঠানের। আজ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবেন সাহেব আর তিয়্যানওই।
গ্রাম থেকে অল্প দূরে নদীর ধারে যতসামান্য সমতল যতটুকু জায়গা আছে সেখানে শক্তপোক্ত একটি খুঁটি পোঁতা হয়েছে। নির্দিষ্ট তালে ঢোল বেজেই চলেছে। সেই শব্দটা এমনই যেনো মোহাবিষ্ট হতে হয়, বার বার কেবলি কাছেই ডাকবে, গায়ে কাটা দিয়ে উঠবে প্রথমে তারপর যতই শুনতে থাকবে ততই মোহাবিষ্ট হবে। এ যেন সেই প্রাচীন যুদ্ধের দামামার শব্দ। সাহেব বুট জুতো ছেড়ে পরে নিলেন এক প্রস্থ কাপড়। অনেকটা ধূতির মতো করে কুচি দিয়ে পরে নগ্ন পায়ে এগিয়ে গেলেন সেই স্থানের দিকে। একে একে হাজির হলো গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আর যুবকেরা। সকলেই নগ্ন পায়, পরনে নেনালিচি নেংটি আর মাথায় সাদা লুপ্যা পেঁচানো। সাহেব ও অন্য আরও সর্দারগণ সকলেই উপস্থিত। প্রধান সর্দার ইয়্যাঙ যুদ্ধে ব্যবহার হয় এমন একটি দা হাতে সেই খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে। সারিবদ্ধভাবে যুবক ও গ্রামের পুরুষেরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কারও হাতে বর্শা, ঢাল ও লাঠি। মেয়েরা অনেক দূরে নগ্ন বক্ষ, পরনে নেনা। চুলে খোপা করে তাতে লুপ্যা পেঁচানো। বাহুতে পিতলের বালা, কারও কানে রূপোর বড় দুল কেওবা কানের ফুটোতে আস্ত ফুল গুজে আছে। পায়ে খাড় আর কোমরে বিছা। দু’জন যুবক গয়ালের একটি বাছুরকে নিয়ে আসে। কে জানে গয়ালটি হয়তো বুঝতে পারে কি হতে চলেছে, তাই পা সামনে বাড়াতে তার অনীহা। কিন্তু পেশিবহুল দুই যুবকের শক্তির কাছে তাকে পরাজিত হতে হয়। গয়ালটির ঘাড় টেনে কিছুটা নিচু করে বেশ আটসাঁট করে সেই খুঁটির সাথে বাঁধা হয়। যাতে খুঁটিটি মাথা ও দেহের মাঝখানে থাকে এবং রশির একটি অংশ সাহেবের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। অপর একটি রশি দিয়ে গয়ালের পিছনের পা দুটি বেঁধে একটি অংশ ধরে থাকে তিয়্যানওই ও অন্যান্য সর্দারা। ইয়্যাঙ দা হতে এগিয়ে আসে। চোখ রাখে সাহেবের চোখে তারপর তিয়্যানওইয়ের চোখে। এরপর পাশের হাড়িতে রাখা ‘সিপাহ্’ মুখ ভরে নিয়ে ছিটিয়ে দেয় সাহেবের উপর। তারপর তিয়্যানওই ও তার সঙ্গীদের উপর। সবশেষে আরও একবার সিপাহ্ নিয়ে ছিটিয়ে দেয় গয়ালটির উপর। গয়ালের গা থেকে খামছে এক মুঠো লোম তুলে আনে এবং সেই লোম বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বায়ু ও জলের দেবতাকে উচ্চস্বরে আহ্বান করে। সেকি আহ্বান! বুকে কাঁপুনি ধরে সেই আহ্বানে। ঢোলের বাদ্য থেমে যায়, তারপর যুদ্ধের দা’টি বার-কয়েক ঘুরিয়ে মাথার উপর তোলে এক কোপে মুন্ডচ্ছেদ। সাথে সাথে হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠে চরাচর। পাহাড়ের কাছে গাছ থেকে এক ঝাঁক পাখি শব্দ করে উড়ে যায়। উষ্ণ রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসে। কাটা মুণ্ডটি গড়িয়ে পড়ে। চোখ তখনও খোলা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পা ছুড়তে থাকে মুণ্ডহীন দেহটি। তারপর ধীরে ধীরে সব শান্ত হয়ে আসে। কেবলি আলুং, আতু ,প্লং আর ঢোলের শব্দ ধীরে ধীরে গাড় হতে থাকে। হাত দিয়ে উষ্ণ রক্ত কপালে আর পায়ে মেখে নেয় উপস্থিত সকলেই। তারপর বিরবির করে শপথ করে- যে উদ্দেশ্যে এই উৎসর্গ করা হল, এখানে উপস্থিত কেউ যদি তা ভঙ্গ করে বা মিথ্যে অভিনয় করে তবে তাকেও সঙ্গীরা ঠিক এভাবেই হত্যা করবে। সাহেব আজ সাহেবি পোষাক খুলে এই অরণ্যভূমিতে বুনো আদিমতায় অভিসিক্ত। মাটির গন্ধ, শিকারের গন্ধ তার চোখে মুখে। বলি দেয়া গয়ালটির পা জোড়া করে বেঁধে তার ভিতর শক্তপোক্ত একটি বাঁশ দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে গ্রামের দিকে ছুটছে ছয় খুমী যুবক। কাটা মুণ্ডটাও একজন খামছে ধরে আছে, সেটা হতে তখনও দুই-এক ফোটা রক্ত ঝরছে।
সমস্ত লেখাটি এক সঙ্গে পড়তে নিচের লিঙ্কে যান
কল্প লোকের গল্প নয়
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:০২