মূল লেখাটি লৌহিত্য মানসের। লেখকের অনুমোতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে দেয়া হবে।[/sb
(জল রঙয়ে আকাঁ একটি চিত্র থেকে পুরো ঘটনার একটি কল্পিত গল্প বলার প্রয়াস। গল্পের মূল বিষয়বস্তুটি বাস্তব তবে সেই বিষয়বস্তুর সঙ্গে আরও কিছু ব্যঞ্জন যুক্ত করে দিলে পুরো চিত্রটি ফুটে উঠতে পারে চোখের সামনে। জল রঙে আকাঁ চিত্রটি তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার টি এইচ লুইনের অঙ্কিত। চিত্র সম্পর্কে অল্পবিস্তর বর্ণনাও তাঁর লেখায় উল্লেখ রয়েছে। তবে তাতে তো মন ভরে না। মনে হয় তাঁর মুখ থেকে পুরো গল্পটি যদি জানা যেতো! সেই প্রয়াস এখন আর নেই। চিত্রটি লুইন একেঁ ছিলেন ১৮৬৬ সালে। হয়তো ঘটনাটি তারও কিছু দিন আগে ঘটে থাকবে। যাহোক, সেই ঘটনাটির পূর্বাপর আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা নিশ্চয়ই আছে, নিশ্চয়ই তাঁর যাত্রা পথের অসাধারণ চিত্র আছে, আছে সেই সময়ের সেই অধিবাসিদের নানা সুখ, দুখ আর আনন্দের কথাও। আমার প্রয়াস সেই সব অজানা ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে কল্পনায় এবং পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পুরো গল্পের একটি মালা গাঁথা।)
সুউচ্চ পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে দলটি। সাহেব হ্যাট খুলে উচ্চতা পরখ করে নিচ্ছেন। সাথের সঙ্গীদের উচ্চতার চেয়ে সাহেবের প্রতি আকর্ষণ বেশি। সাহেবের প্রতিটি চাল চলনই তারা বেশ আগ্রহ ভরে দেখে। এ মুহূর্তে সাহেবের দৃষ্টি পাহাড়টায় আর সঙ্গীদের তাঁর প্রতি। নৌকা থেকে প্রয়োজনীয় বাক্স-পেটরা নামাতে ব্যস্ত হয়ে গেল কয়েকজন। সাহেবের দলটায় নয় জন মানুষ। তাদের চার জন খুমী, তিন জন ত্রিপুরা, একজন মারমা আর একজন বাঙালি। পাহাড়ি নদী ধরে বেশ অনেকটা পথ উজানে আসতে হয়েছে। দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সর্দার গোছের একজন খুমী সাহেবের দিকে এগিয়ে আসে। নিজের ভাষায় জানতে চায় এখন কি করবো। সাহেব বলে দেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম আর চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে। সাহেব শক্তপোক্ত একটি বাক্সের উপর বসে কোটের আস্তিন হতে ঘড়ি বের করে সময়টা দেখে নেন। আগুন জ্বালানো হয়েছে আর তাতে চায়ের পানি ফুটানো হচ্ছে। একটি বাক্স হতে কিছু শুকনো খাবার বের করে সাহেবের সামনে দেয়া হলো। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সাহেব আবার পাহাড়টি দেখেন। অন্যরা বাঁশের চোঙায় চা পান করছে। কেউ কেউ নিজের সাথে বয়ে আনা কলা পাতায় মুড়ানো স্থানীয় খাবার হতে একটু আধটু খাচ্ছে। সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাদের খাবার খাওয়ার দৃশ্যটি দেখতে থাকেন।
দলটি জঙ্গল ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পা চালানোর পর দলটি দাঁড়ায়, এখান থেকে চড়াই ভাঙতে হবে। বাক্স-পেটরাগুলো দলের লোকেরা পিঠে বেঁধে নিয়েছে। খাবার যোগ্য পানির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবে সেই পানি কেবল সাহেবের জন্য। অন্যরা ঝিরি কি নদীর পানি দেদারছে পান করতে পারে। ওতে তাদের কোন অরুচি নেই। বড় বড় গাছের ফাঁক গলে উপরে উঠতে থাকে দলটি। রাস্তা বলতে যা বুঝায় তা এখানে নেই। দু’জন দা হাতে ঝোপ-ঝাড় কেটে পা ফেলার মতো জায়গা তৈরি করে রাস্তা বের করতে ব্যস্ত। সাহেব দলটির ঠিক মাঝেই। মাথায় হ্যাট, পায়ে গাম বুট, গায়ে ছোট কোট আর চুস্ত প্যান্ট পরে সাহেব দিব্যি চড়াই ভেঙে উপরে উঠে চলেছেন। পারেনও বটে! সত্যিই তো সাত সমুদ্র দূর থেকে কোথায় চলে এসেছেন! যদিও কাজের জন্যই আসা। এরই নাম হয়তো চাকুরি। সাহেবের সাথে সাথেই কিছুটা সামনে হাঁটছে একজন খুমী। সাহেবের কখন কি প্রয়োজন হয় তা জোগান দেয়াই তার কাজ। সাহেবের ঠিক পিছনেই বাঙালি লোকটি। তার কাজ মূলত দোভাষীর মতো। ক্ষণে ক্ষণে সাহেবের এই প্রশ্ন সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে সে ভাঙা ইংরেজিতে। যতই উপরে উঠছে জঙ্গল ততই ঘন হতে থাকে। এক ঝাঁক টিয়া দূরে কোন গাছে বসে অবিরাম ডেকে চলেছে। কখনও বুলবুলি, ফুটকি, খঞ্জন, হরিয়ালের ডাক কানে ভেসে আসছে। হঠাৎ বেশ শব্দ করে এক জোড়া রাজ ধনেশ উড়ে গেল। সাহেবের সেকি উচ্ছাস। সত্যিই তো পথের ক্লান্তি ছাড়া এ যেনো একটুরো স্বর্গ। পিছন ফিরে তাকালেই পায়ের তলায় দূরে মেঘেদের আনাগোনা। অনেকটা পথ উঠে আসার পর ছোট ঝর্নার মতো একটা জলধারা পাওয়া যায়। পাহাড়ের ফাটল গলে সুমিষ্ট শীতল পানি নেমে আসছে আর বলছে, হে পথিক আমার বুক চেড়া জলে তৃষ্ণা মিটাও। দলটি কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়। যে যার মতো করে জল পান করে নেয়। এরপর বেশ খাড়া। দড়ি বেঁধে তারপর উঠতে হবে এমন জায়গাও আছে। কিছু কিছু জায়গায় পাহাড়ের ফাটল এমন যে, তাতে বাঁশ কেটে সাঁকো তৈরি করে পাড় হতে হচ্ছে। এই জঙ্গলে বাঁশের অভাব নেই। এখানকার মানুষের যাপিত জীবনে বাঁশ অপরিহার্য উপাদান। বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি, জমির উর্বরতার জন্য বাঁশ পোড়া ছাই, ঘরের আসবাব, জল খাবার পাত্র, বাঁশের পাতা ও উপরের মসৃণ ত্বকের মতো অংশটি দিয়ে মাদুর, ফসল তোলা ও রাখার পাত্র, কাপড় বুননের যন্ত্র, আগুন জ্বালাতে, ফাঁদ তৈরি করতে এমনকি রাতে ঘুমনোর জন্য বাঁশ বালিশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জন্ম থেকেই পাহাড়িদের জীবনে বাঁশ মিলেমিশে থাকে আর সেই বন্ধন ছিন্ন হয় মৃতের সৎকারে বাঁশের ব্যবহারের মাধ্যমেই।
অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে অবেশেষে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছতে পারে দলটি। বেশ ক্লান্ত, কারও কারও শরীরের কাঁটার আঘাতের চিহ্ন। সাহেব রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে হাতের ইশারায় বিশ্রামের নির্দেশ দেন। দলটিও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচে। বাক্স-পেটরা পিঠে বয়ে নিয়ে এমন দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সকলেরই জলের তৃষ্ণা পেয়েছে। তবে সাহেবের জল ভিন্ন আর কারও কাছে জলের ব্যবস্থা নেই। সাহেবের জলের ভাগ তো আর চাওয়া যাবে না। তাই দলের থেকে একজন ত্রিপুরা ও খুমী যুবক কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়। পাহাড়ের ঢালের জঙ্গল হতে বেশ মোটা কুন্ডলি পাকানো কিছু লতা নিয়ে আসে। সেকি অদ্ভুত কাণ্ড! এই লতার ভিতরেই আছে পান যোগ্য জল। তবে সে জল পেতে হলে লতাটি বেশ কায়দা করে কাটতে হয়। সাহেব দুই যুবকের জল সংগ্রহের এই কায়দাটি দেখে যার পর নাই বিষ্মিত হয়েছেন। নিজেও সেই লতার জল পান করে প্রাণ জুড়িয়েছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ সর্দার গোছের সেই খুমী মানুষটি আর সাহেব পাহাড়ের উপর হতে পরবর্তী পথের দিশা খোঁজ করছেন। দূরে যত দূর দৃষ্টি যায় কেবলি মেঘ আর মেঘ, তার ভিতর পাহাড়ের সবুজ চূড়াগুলো উঁকি দিয়ে আছে গগন পানে। হাতের ইশারায় খুমী লোকটি সাহেবকে বুঝিয়ে দিল- সেই যে উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে তার পরেই বড় নদী আর সেই নদীর ধারেই যে গ্রাম সেটাই তাদের গন্তব্য। বলতে যতটা কাছে মনে হয়, পথ তার থেকেও অনেক দূর। আরও দিন দুয়েকের পথ। পাহাড় থেকে নেমে আজকে রাতে থাকার মতো ব্যবস্থা করতে হবে। তাই সময় নষ্ট করা যাবে না। বয়োজ্যেষ্ঠ খুমীর তাড়ায় সকলেই ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। এবার নেমে যাবার পালা। এরজন্য পাহাড়ের শিরদাঁড়া বরাবর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে হবে। পথটা সহজ নয়। সরু রিজ ধরে পিঁপড়ের সারির মতো চলতে থাকে ওরা। একটা সময় থমকে দাঁড়ায়। এখান হতেই নেমে যাবার রাস্তা খোঁজ করতে হবে। অনেকটা খাড়া, তাই দড়ি ব্যবহার করে প্রথম ধাপটা নেমে আসে দলটি। তারপর গাছের গুড়ি আঁকড়ে ধরে সাবধানে অবরোহণ করতে করতে পায়ে হাঁটার ট্রেইলটা পেয়ে যায়। এখানে জঙ্গল অনেক ঘন। স্যাঁতসেঁতে আর ঝিঝি পোকার ডাকে কান তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। তার উপর ডাস মাছির মরণ কামড় আর জোকের উপদ্রপও বেড়েছে। নতুন আগুন্তুকের অবস্থান টের পেয়েই একদল লেমুর ও ছোট বানর সঙ্গীদের সর্তকবার্তা পাঠাতে থাকে। গাছ থেকে গাছে হুড়াহুড়ি পড়ে যায়। তাদের চিৎকারে গোটা বনটাই যেনো আরও সর্তক হয়ে উঠে। একদল কাঠ বিড়ালী দলটির চলার পথেই পাহাড়ী ফল নিয়ে খুনসুটিতে ব্যস্ত। আগুন্তুকদের পায়ের আওয়াজ তাদের খুনসুটিতে ব্যত্যয় ঘটায়। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে পরমুহূর্তেই চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায়। দলের খুমী চারজনের এই পথটুকু ভালই চেনা। সাহেবকে নিজেদের গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে তাদের গ্রাম প্রধানের নিমন্ত্রণে।
গভীর বন পেরিয়ে পথের শেষে ছোট একটা নদী। নাম পীখ্যং। ঠিক নদী হয়তো নয় অনেকটা খালের মতো তবে জলের স্রোত আছে। দলটি যতক্ষণে নদী পার হয়ে আসে ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে। সুবিধে মতো একটা জায়গা বেছে নিয়ে সাহেবের তাঁবু খাটাতে লেগে যায় দলের তিন জন। বাকিরা কেউ রান্নার আয়োজনে। দু’জন পাশের ঝিরিতে মাছের সন্ধানে চলে যায়। তাঁবু খাটাতে যে সময়টুকু লাগবে সে সময়টুকু বসে না থেকে সাহেবও ঐ দু’জনের সঙ্গী হন। খুমী ছেলে দুটো সাথে করে নিয়ে এসেছে বিশেষ একধরণের লতা গাছ । ঝিরির একটা জায়গায় পাথর দিয়ে তারা বাঁধের মতো তৈরি করে। যাতে অনেকটা ছোট ডোবার মতো তৈরি হয়। তারপর সেই জলে লতাগুলো ভিজিয়ে দেয় এবং বাঁশের হুকুও তামাক খেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সাহেব ঝিরির পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরার কৌশল দেখছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জলের ভিতর মাছেদের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। তারও কিছু পরে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় একটি-দু’টি করে ভেসে উঠে পানির উপরে । প্রয়োজন মতো মাছ নিয়ে ফিরে আসতে আসতে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে। সাহেবের তাঁবুর সামনেই আগুন জ্বলছে সেই সাথে রান্নার কাজও। সাহেবই শুধু তাঁবুতে ঘুমাবেন আর বাকীদের খোলা আকাশের নিচে। দু’জন পালা করে তাঁবু পাহাড়া দিবে। বলা তো যায় না-এই বনে ভাল্লুক, বন বিড়াল এমনকি বাঘেরও দেখা মেলে। আহার পর্ব শেষ করে সাহেব বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে তাঁবুতে চলে যান। কাছেপিঠেই পাথরের একটা বড় চাইয়ের মতো, ওখানটাতে বাকীদের ঘুমের আয়োজন। রাতচোরাসহ আরও কিছু পাখি সারা রাত ধরেই অবিরাম ডেকে চলেছে। কি যেনো কোন অজানা বিরহে বিবাগী প্রেমিক পাখির হাহাকার। এমন রাতে সত্যিই মনের ভিতরটা হুহু করে উঠে, ঘুম আসতে চায় না। তাঁবুর ভিতরে শুয়ে থেকে কতো কথা মনে পড়ে সাহেবের। এই নির্জন চরাচরে সকলেই যখন নিদ্রায় তখন রাত জাগা পাখির সাথে জেগে থাকে আরও একটি মানুষ । তাঁবুর ভিতর ক্ষীণ আলোতে সাহেব তাঁর দিনপুঞ্জির খাতায় আপন মনে লিখতে থাকেন নিত্যকার কথাগুলো।
সমস্ত লেখাটি এক সঙ্গে পড়তে নিচের লিঙ্কে যান।
কল্প লোকের গল্প নয়
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৫০