বেশ দীর্ঘ একটা ছুটি পাওয়া গেল। কোথায় যাই কোথায় যাই করছি। বসন্তকাল ঋতুটি গল্পে কবিতায় বেশ সুন্দর তবে ভ্রমণের জন্য খুব একটা উপযুক্ত বলে মনে হয় না। প্রকৃতি থাকে ন্যাড়া হয়ে। নদী ও ঝিলের জল শুকিয়ে গিয়ে খা খা অবস্থা। হ্যা, ফুলের একটা বাহারি সাজ সাজ রব থাকে বটে তবে সবুজের অভাবে সেটা তেমন মনে ধরতে চায় না। তাই বলে তো আর থেমে থাকা যায় না। আবারও পাহাড় দেখার ইচ্ছে হল। পাহাড় বলতেই আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টতগ্রাম আর সিলেট । কিন্তু ময়মনসিংহ বিভাগেও বেশ কিছু পাহাড়ময় অঞ্চল আছে। জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ সদরের হালুয়াঘাট-ধোবাউরা আর নেত্রকোনার সীমান্ত ঘেষাঁ দূর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায়। স্কুলবন্ধুরা মিলে এক সময় দাপিয়ে বেড়াতাম সেই গারো পাহাড়েরর যায়গাগুলো।
আসল কথায় আসি। ২১ শে ফ্রেবুয়ারি, প্রভাতফেরির পর্বটা শেষ করেই বন্ধুরা বেরিয়ে পরি …বসন্তে সীমান্ত ভোজ করার উদ্দেশ্যে। আমরা যাবা সাত শহীদের কবর ও কিছু ছোট ছোট পাহাড় দেখতে। সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদের বহনকারী গাড়িটি শম্ভুগঞ্জ সেতু পার হয়ে যখন শম্ভুগঞ্জ বাজারের কাছে তখন দেখি স্কুল-কলেজ ও নানা বয়সের মানুষ ২১ শে এর পদ যাত্রায় স্থানীয় শহীদ মিনারের পথে। বাজার পার হয়ে গ্রামিন রাস্তা ধরে নেত্রকোনার দিকে অগ্রসর হচ্ছি পথে পথে ২১ শের নানা আয়োজন। রাস্তার দু'পাশ জুড়ে সবুজ আর সবুজ, তার মাঝে অল্প দূরে দূরেই কলা গাছ রঙিন কাগজে মুড়িয়ে বানানো শহীদ মিনার। গুনে শেষ করা যাবে না । যে কটা ছোট বাজার পরে সবকটাতেই জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা। বাঙালির হৃদয়ে ২১ শে ফেব্রেুয়ারির প্রভাব কতটা তা বুঝতে পারবেন এই পাড়া গাঁয়ের একুশ আয়োজনের মহাযজ্ঞে।
আমাদের উদ্দেশ্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা সাত শহীদের সমাধি। সেই সাথে কিছু পাহাড় আর গণেশ্বরী নদী। পথে পথে ২১ শের বর্ণাঢ্য আয়োজন দেখতে দেখতে শ্যামগঞ্জ বাজারে চলে আসি। চা বিরতি আর বসন্তে সীমান্ত ভোজের টুকটাক কেনাকাটা সেরে আবারও ছুটে চলা। নেত্রকোনা পার হয়ে কলমাকান্দার পথে। খুব বেশি রাস্তা না। রাস্তাও ভাল। কলমাকান্দা এসে আরও একজন বন্ধু আমাদের সাথে যোগ দেয়। আরও কিছুক্ষণ চা-আড্ডা দিয়ে লেঙ্গুরার দিকে ছুটে চলা। কলমাকান্দা থেকে লেঙ্গুরা ২৫ কিলোমিটার । যাবার রাস্তাটিও বেশ, দু’পাশে গাছের সারি আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ।
অবশেষে লেঙ্গুরা। নেত্রাকোনা জেলার সবচেয়ে উত্তরে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া উপজেলার নাম কলমাকান্দা। আয়তন ৩৭৭.৭১ বর্গ কি মিঃ। উপজেলা শহরটি ২ টি মৌজা নিয়ে গঠিত। এই উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে নেত্রকোনা সদর উপজেলা পুবে সুনামগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিম দিকে দুর্গাপুর উপজেলা। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার একটা ইউনিয়ন হচ্ছে লেঙ্গুরা। এখান থেকে সীমানার ওপারে ভারতের মেঘালয়। লেঙ্গুরা বাজারের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে গণেশ্বরী নদী । অনেকে একে লেঙ্গুরা গাং ও বলে থাকে। (যদিও কলমাকান্দার উল্লেযোগ্য নদী হচ্ছে গুমাই, সোমেশ্বরী, বাকলা, মঙ্গস্বরী। এছাড়া পাকাটা, উবধাখালী, বাহার বিল উল্ল্যেখযোগ্য। তবে মেঘালয়ে গণেশ্বরী নামে নদী আছে।) এখন প্রায় জল শূন্য। তার উপর কিছুটা উজানে বাধঁ দিয়ে চাষাবাদের জন্য নদীর জল ধরে রাখা হয়েছে। বিশাল একটা ঝিলের মত মনে হয়। আমরা আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলাম, তারপর একটা পাহাড়। যাক অবশেষে পাহাড় পাওয়া তো গেল। পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি রেখে আমরা ছুটলাম সীমান্তের আরও কাছে। শুকনো নদীর ধার ধরে মাটির রাস্তাটি আপনাকে নিয়ে যাবে সাত শহীদের সমাধিতে। সমাধির পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে গণেশ্বরী, যার অর্ধেক আমাদের আর বাকি অর্ধেক ভারতের। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ বীর যোদ্ধাদের কবর এখানে। সমাধিক্ষেত্রেটির তিনদিকেই ভারতীয় সীমান্ত। বিজিবি সদস্যছাড়া কবর পর্যন্তও যেতে পারবেন না। কাছেই দেখতে পারবেন মেঘালয়ের পাহাড়। কিছুটা আফসুসও হবে আমাদের ভাগে ছোট গুটিকত টিলা ছাড়া আর কিছু নেই। সমাধিক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে পাশেই একটা গারো বাড়িতে আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন শুরু করি। এই বাড়িটির বৈশিষ্ট্য হল এর অর্ধেক বাংলাদেশে বাকী অর্ধেক ভারতে। বাড়িটা একটা ছোট পাহাড়ের উপর। বাড়ির পিছন দিকে বাঁশবন কিছুটা উপরের দিকে উঠে গেছে। সেটা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পাহাড়ের ছোপের আড়ালে দেখতে পাবেন সীমানা পিলার। এখান থেকে অল্প দূরেই পাহাড়ের গায়ে বিএসএফ এর বিশাল স্থাপনা ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। অচেনা একটা পাখি অনবরত ডেকেই চলেছে। মিষ্টি একটা হাওয়া আর সেই সাথে কুয়াশা আর রোদের মিশেল প্রভাব। আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাড়ির সামনে চলে আসি। কেননা বেশিক্ষণ বাড়ির পিছনে অবস্থান করলে বিএসএফ সমস্যা করে।
দুপুরের খাবার শেষ করে ফেরার সময় লেঙ্গুরা পাহাড়ে উঠে গণেশ্বরী নদীর ইউ টার্ন এর অর্পূব কিছু দৃশ্য দেখে নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি খাবার উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩০