১।
আমার এক ডাচ বন্ধু সেদিন আমাকে বলছিল, বিশ্বকাপ দেখতে বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছার কথা। বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডের ম্যাচ চট্টগ্রামে হবে। ইংল্যান্ডের ম্যাচও চট্টগ্রামে হবে। পাহাড়-বন-সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রামের সৌন্দর্যের কথা সে গুগলে সার্চ করে পেয়েছে। তো সে চাইছিল এই সুযোগে খেলা দেখার পাশাপাশি কক্সবাজারে সমুদ্র ঘুরে আসবে। কিন্তু সে যাবে না। আমি কারণ জানতে চাইলে সে বলল, “তোমাদের দেশে খেলা দেখার জন্য কোন বিশেষ ‘ট্যুর প্যাকেজ’ নেই। আমি আমার পরিবার নিয়ে তো শুধু খেলাই দেখতে যাবো না। ঘোরার জন্য গাইড প্রয়োজন। সেজন্য নাগপুরে খেলা দেখতে যাবো। তাদের অনেকগুলো ‘ট্যুর প্যাকেজ’ আছে। আমি চিন্তায় আছি কোনটা বেটার জানার জন্য।” আমি বিশাল ধন্ধে পরে গেলাম। গত কয়েকদিন ধরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে অনেক কিছু পড়েছি। কিন্তু এই ব্যাপারটা ভাবিনি। সে আমাকে একটা বিজ্ঞাপনী ম্যাগাজিন দেখালো। সেখানে ভারত-শ্রীলঙ্কা তো বটেই, এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ নেপালেরও বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে বিশেষ ট্যুর প্যাকেজ আছে। বিশ্বকাপ শেষে দেশ ফেরত দর্শকদের জন্য স্বল্পমূল্যে হিমালয় দেখানোর ব্যবস্থা। আর ভারত-শ্রীলঙ্কার কথা তো বাদই দিলাম। বিভিন্ন কোম্পানী কত আকর্ষণীয়ভাবে ট্যুরিস্টদের কাছে নিজেদের এলাকাকে প্রদর্শন করবে সে নিয়ে অবিশ্বাস্য সব অফার! কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, অনেক খোঁজার পরও বাংলাদেশের কোন একটি ট্যুর প্যাকেজও সেই ম্যাগাজিনে খুঁজে পেলাম না। গুগ্ল করলাম। বাংলাদেশি কোন ট্যুর ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানীর কোন খবর নেই। শুধু ক্রিকইনফোর কল্যাণে যেসব জায়গায় খেলা হচ্ছে সেসব জায়গার কিছু হোটেলের বর্ণনা দেয়া আছে। কিন্তু কোন বিশেষ প্যাকেজ নেই ট্যুরিস্টদের আকর্ষিত করার জন্য। আমি বাংলাদেশ পর্যটন মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইটে গেলাম। বিশ্বকাপ বলে যে একটা কিছু বাংলাদেশে হচ্ছে তার কোন খবরই নেই। http://www.mocat.gov.bd/
আমরা এই বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে এত গর্ব করি?? আমাদের দেশটা অনেক ছোট একটা দেশ। কিন্তু ছোট্ট এই দেশটাকে প্রকৃতি কি কম কিছু দিয়েছে?? বরং সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বলে দুহাতে ভরিয়ে দিয়েছে। পর্যটন মন্ত্রনালয় বসে বসে কোন চুলটা ছিড়ছে? জনগনের টাকায় এই মন্ত্রণালয়ের দরকারটাই বা কি? বিসিবি কি পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাথে এই বিষয়ে একটা বৈঠকও করেছে? আমাদের প্রাইভেট ট্যুরিজম কোম্পানী গুলোই বা কি করল? Natural 7 wonder এর কথা আমরা সবাই জানি। সুন্দরবন শেষ ২৮ এর লিস্টে রয়েছে। আমাদের কি সুযোগ ছিল না আরো একবার সুন্দরবনকে পুরো বিশ্বের কাছে তুলে ধরা? আমার যে ডাচ বন্ধুটির কথা বললাম তার মতো আরো অনেকের কাছে কি কক্সবাজারকে তুলে ধরা যেত না? আমাদের কি জাফলং, মাধবকুন্ডু নেই? একটি বিশ্বকাপ আয়োজন শুধু খেলা আয়োজন নয়। বরং একটি দেশের পরিচয়, সংস্কৃতি পুরো বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে বড় উপায়। আমরা এই উপায়টা আগে কখনো পাইনি, ভবিষ্যতে কখনো পাবো কিনা তা জানিনা। এই সুযোগটা আমরা এভাবে হেলায় হারালাম কেন? আমরা শুধু খেলা আয়োজন বাদে আর কি করছি? উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও আমাদের না, ট্যুরিস্টদেরও কিছু করতে পারলাম না। বিশ্বের কাছে নিজেদের পরিচয়ও করাতে পারলাম না। তাহলে বিশ্বকাপ বাংলাদেশে করাটারই বা কি দরকার ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষমতা কি ওই লোটা, বিসিবির কর্মকর্তা আর সংস্কৃতি, পর্যটন মন্ত্রনালয় আছে?
২।
আজকে প্রথম আলোতে পুরোপুরি কনফার্ম হলো যে, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভারতীয়রাই করছে!! এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, "ভারতীয় শিল্পীদের পাশাপাশি বাংলাদেশি, শ্রীলঙ্কার শিল্পীরা পারফর্ম করবে।" আমি বুঝি না, এটা কিভাবে সম্ভব। বাংলাদেশের মাটিতে "ভারতীয়দের পাশাপাশি বাংলাদেশীরা পারফর্ম করবে" নাকি "বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয়রা পারফর্ম করবে?"
একটা ব্যাপার সবাই এড়িয়ে যাচ্ছি। অনুষ্ঠানটা হচ্ছে ১৭ ফেব্রুয়ারি। ২১ এ ফেব্রুয়ারির মাত্র ৪ দিন আগে!! যেই উর্দুর বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস", সেই মাসে পুরোপুরি হিন্দী সংস্কৃতি নিয়ে আমরা আমাদের ঢাকা স্টেডিয়ামে মাতা মাতি করব??? বাহ!!! কয়েকদিন আগে বিজয়ের মাসে শাহরুখকে দিয়ে কনসার্ট করলাম। সেখানে স্টেজে উঠে সবাই ভুল বাংলা, ভুল ইংরেজি, ভুল হিন্দীতে ভাঁড়ামি করল। বাইরের দেশের মানুষ জানলো হিন্দীও বাংলাদেশের একটি ভাষা!! ওটা নাহয় একটা ইন্টারন্যাশনাল স্টারের কনসার্ট বলে চুপ থাকা গেল। কিন্তু এটার সাথে যে সরাসরি দেশের ইজ্জত, ভাষা-সংস্কৃতি সব জড়িত!!!
প্লিজ ১৭ ফেব্রুয়ারিতে এই হিন্দী অনুষ্ঠান করে ২১ ফেব্রুয়ারির, ভাষার মাসের মর্যাদা ভুলন্ঠিত করবেন না!! যারা স্টেডিয়ামে গিয়ে হিন্দীর সাথে মাতামাতি করবে তাদের মধ্যে যারা আবার শহীদ মিনার যাবে তাদের মতো হিপোক্রেট কি আর পাওয়া যাবে??
ব্যক্তিগতভাবে আমার হিন্দীর প্রোগ্রাম নিয়ে কোন সমস্যা হয়তবা হতো না। ৯০ মিনিটের অনুষ্ঠান। যদি ৩০ মিনিট করে তিনটি দেশকে ভাগ করে দেয়া হয়। তাহলে কোনই সমস্যা নাই। সেক্ষেত্রে সিংহলিজ ৩০ মিনিট পাবে, বাংলা ৩০ মিনিট পাবে, হিন্দী ৩০ মিনিট পাবে! যেহেতু তিন দেশ আয়োজক সুতরাং কারোই কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ব্যাপারটা সেভাবে ঘটছে না!! ওখানেই সমস্যা। বাংলাদেশিরা, শ্রীলঙ্কানরা হয়তোবা একটু সুযোগ পাবে কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানটাই ভারতীয়দের। এটিএন রেকর্ডসের লোকেরা ২০০ ভারতীয় শিল্পীকে দাওয়াত দিয়ে এসেছেন। ২০০ জন মানুষ মিলে মাত্র ৩০ মিনিট অনুষ্ঠান করবে?? এখানে রিয়ানাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে। উদ্বধনের কিছু ফর্মাল ব্যাপার আছে। এতসব কিছুর পর বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার জায়গাটা কোথায় কেউ কি বলবে? আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কি শুধুই নাচ-গানের ব্যাপার? একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পুরো দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি তুলে ধরার ব্যাপার। এ ব্যাপারটা ঘটছে না বলেই আপত্তি।
দরকার হলে অনুষ্ঠানটা পুরোপুরি ভারতে করুন কিন্তু ফেব্রুয়ারিটাকে অন্তত ফেব্রুয়ারির মতো থাকতে দিতে হবে। শুধু একটা ব্যাপার ভাবুন। ঢাকার অনেক জায়গায় নাকি জায়ান্ট স্ক্রিনে পুরো অনুষ্ঠানটা দেখাবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও জায়ান্ট স্ক্রিনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানো হবে। ধরুন আপনি বইমেলায় হাতে একটা বই নিয়ে, অথবা বাংলা একাডেমী মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছেন। এমন সময় আপনার কানে কোন এক হিন্দী গান ভেসে এলো। ব্যাপারটা কেমন হবে??
এখন সময় পুরোপুরি ঝাপিয়ে পড়ার, কোনভাবেই মানিনা, মানবো না!! এটিএন রেকর্ডস এর এই অপপ্রয়াস রুখতে হবে।
আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের মিডিয়া এ ব্যাপারে পুরো নিরব। জানিনা কেন? আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না মিডিয়ার নিরব থাকার রহস্যটি। কেন কোন কলাম লেখক এ ব্যাপারে একটা কথাও বলছেন না??
লেখাটা শুরু করেছিলাম পর্যটনের ব্যাপারটি কেন্দ্র করে। পরে জল অনেকদূর গড়িয়ে দিয়েছি। এখন পর্যটকেরা তাদের সব পরিকল্পনা করে ফেলেছে। সব টিকেত কেনাও শেষ। পর্যটন মন্ত্রণালয় ঘুমিয়ে ছিল। সেখানে কিছুই করার নেই। এখন অন্তত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা বাঁচাই।
সাকিব, তামিম, মাশরাফি তোমাদের উপর আমরা সবাই অনেক ভরসা করি। এখন মনে হয় তোমরাই পারো এই অপপ্রয়াস রুখতে। সাকিব তুমি শুধু একবার বলো যে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটায় ভারতীয়দের বেশি অংশগ্রহণ থাকলে তোমরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করবে। আমি কথা দিচ্ছি আমরা সব জায়গা থেকে তোমাদের পিছনে থাকবো। ক্রিকেটে দেশকে সবসময় বিশ্বের কাছে উঁচু করে তুলে ধরছো। নির্লজ্জের মত সংস্কৃতি বাঁচানোর জন্যেও তোমাদের সাহায্য চাচ্ছি। প্লিজ ওই লোটার কাছে যাও, ওই বাটিছাঁট, অশিক্ষিত মাহফুজের কাছে যাও, শুধু একবার বলো, তোমরা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করছো। বাকিটুকু আমরা করব। সত্যিই করব!! আমি জানি অনেকেরই সাকিব, তামিমদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে। কেউ কেউ তাদের দাওয়াত করে খাওয়াতেও চায়। একজনও কি এই মেসেজটা ওদের কানে পোঁছাতে পারে না?
১৯৫২ এর ফেব্রুয়ারিতে আমরা ভাষা বাঁচিয়েছিলাম, ২০১১ এর ফেব্রুয়ারিটা হোক সংস্কৃতি বাঁচানোর বছর!
(পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য পাওয়ার পর এডিট করা।)
অনেকেই বলছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা গুজব। ভারতীয়রা নাকি উদ্বোধনের আগে এবং পরে অনুষ্ঠান করবে। এটিএন রেকর্ডস নাকি তাদের ১৬ আর ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান করার জন্য ডেকেছে।
প্রচণ্ড ক্ষোভ আর আবেগ থেকেই এটা লেখা। সাধারণত আমি কখনো এতটা Aggressive mood এ থাকি না। কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন ব্লগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে পড়ছিলাম, খুব খারাপ লাগছিলো, কিন্তু কিছু লিখিনি। যখন আমার ওই ডাচ বন্ধুটি চোখে আঙুল দিয়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা- এমনকি নেপালের সাথে আমাদের চরম অব্যবস্থাপনার তুলনাটি দেখিয়ে দিলো, সেটি খুব গায়ে লেগেছে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে অন্য একটি দেশের লোকের সামনে খুব অপমানিত বোধ করেছি। আমার ওই বন্ধুটি মুখে বলেনি, কিন্তু তার চোখে মুখে আমি এক ধরনের তাচ্ছিল্য দেখতে পারছিলাম। ভাবটা এমন ছিল, "তোমরা কি দেশ, যে একটা বিশ্বকাপ আয়োজন করছো, অথচ কোন পর্যটন সুবিধা নেই?" সত্যি কথা, একজন বাংলাদেশি হিসেবে খুউব লজ্জা পেয়েছি। এখন একেবারেই সময় নেই বলে আমরা এই খাতে লক্ষ লক্ষ বৈদেশিক মুদ্রা হারালাম।
যাই হোক, জানিনা কোন খবরটা সত্যি? ভারতপ্রধান অনুষ্ঠান নাকি বাংলাদেশপ্রধান অনুষ্ঠান? তবে চাওয়া হচ্ছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা যেন আমাদের বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারি। আমি যেন এখানে আমার অন্য বিদেশি বন্ধুদের এই অনুষ্ঠানটা দেখিয়ে বলতে পারি এই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। যেটা মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু হয়েছে, যেটার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে, যেটার এত সুন্দর প্রকৃতি আছে। যেটা শুধুই লন্ডনে জঙ্গি ধরা পড়ার দেশ না, শুধুই দারিদ্র্য আর দূর্যোগের দেশ না।
যদি তা না পারি, তাহলে আবার আমাকে লজ্জায় পড়তে হবে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে একা একা বারবার লজ্জায় পড়তে ভালো লাগে না। সত্যিই ভালো লাগে না।
--জানুয়ারি ৫, ২০১১
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র