কিভাবে শুরু করব বুঝতেছি না। তবে একটি ছবি ভেসে আসছে স্মৃতিপটে।কিছুতেই যেন তাকে ঘটনায় রূপ দিতে পারছি না।মনের ফ্রেমে বাধাই করা ছবিটা আজ অনেকটা ধুসর হয়ে গিয়েছে, এখানে সেখানে তার তুলির টানগুলো কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে। অথচ এখনও কত সতেজ তার অনুভূতি। চোখ বন্ধ করলেই যেন তার সুঘ্রান পাই।
একটি দোতলা বাড়ি,
একটি জানালা,
নীল পর্দায় ঢাকা একটি জানালা,
একটি বরই গাছ,
কত সাধারন একটি ছবি!
তবুও আমি তাকিয়ে থাকতাম। আমার ভাল লাগত।
আমার বয়স তখন কতইবা হবে? ১২-১৩ বছর হবে হয়ত। এই বয়সের একটি কিশোর কতইবা বুঝে?
তবুও আমি তাকিয়ে থাকতাম।
তাকে এক পলক দেখার জন্য হলেও আমি তাকিয়ে থাকতাম, সারাদিন, সারাক্ষন।
আমার কপাল যেদিন ভাল থাকত, জানালায় একটি দুষ্টু মেয়েকে দেখতে পেতাম। মেয়েটা পর্দার আড়াল থেকে শুধু উকিঝুকি মারত। তার চাহনি দেখে মনে হত, সে জানালা দিয়ে অবাক পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে।আড়চোখে আমার দিকেও মাঝে মাঝে তাকাত। আমার চোখে চোখে চোখ পড়লেই মুখে ভেংচি কেটে পালিয়ে যেত। আমার তৃষিত হৃদয়ের চাহিদা এতেই যেন পুর্ণ হয়ে যেত।
আমি প্রতিদিন মনে মনে অপেক্ষা করতাম কখন তার দেখা পাব! যেদিন দেখা পেতাম সেদিন খু…ব ভাল লাগত।ছাদে ঘুড়ি উড়ানোর ভান করে উঠে বসে থাকতাম। আড়চোখে খেয়াল রাখতাম।
এভাবে কতদিন যে কেটে গিয়েছে আমার মনে নেই। তবে….
একদিন দেখি একটি ট্রাক ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাল-পত্র তোলা হচ্ছে ট্রাকে। সবাই খুব ব্যস্ত।সেই দুষ্টু মেয়েটি তার বাবা-মার সাথে গাড়িতে উঠে চলে গেল।আমার স্পষ্ট মনে আছে মেয়েটি সেদিন লাল রঙের জামা পড়ে ছিল। চলে যাবার ঠিক আগে মেয়েটা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছিল।আমি খুব নির্বিকার ভংগিতে সব দেখে গেলাম।যেন খুব স্বাভাবিক একটা দৃশ্য।আমার কি আসে যায় তাতে? আনমনে জানালার সামনে এসে দাড়াই। দেখি আমার খুব প্রিয় সেই ছবিটা আর আগের মত নেই। বরই গাছটা ঠিক আগের মতই আছে, কিন্তু নীল পর্দার আড়ালে আজ কেউ উকিঝুকি মারছে না।আজকে কেউ দুষ্টামি করে পালিয়ে গেল না।গভীর এক শূন্যতা সেখানে। একটা হারাবার বেদনা আমাকে তাড়া করতে লাগল।গভীর এক বিষাদে মনটা ছেয়ে গেল।মনে হল খুব মুল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছি।
এরপর আর তার দেখা নেই।অনেকটা সময় পার হয়ে গেল।অনেক পালাবদল আসল জীবনে।
প্রায় ৪-৫ বছর পর।তখন কলেজে পড়ি।বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছিলাম সব।
হঠাৎ এক বিয়ে বাড়িতে দুষ্টু মেয়েটির দেখা।ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বলি…
আব্বুর এক কলিগের মেয়ের বিয়ে।কোন এক জরুরি কাজের কারনে আব্বুর সেদিনই ঢাকা যেতে হবে।তাই আমার উপর মহা দায়িত্ব পরল বিয়ে খেতে যেতে হবে।আমি আবার সহজে না বলতে পারি না।তাছাড়া বিয়ে বাড়িতে প্রচুর বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।চোখের ভাল ব্যায়াম হয়।আমাকে যেতে হবে বন্ধন কমিউনিটি সেন্টারে।জটিল ভাবে মাঞ্জা মেরে বিয়ে খেতে গেলাম।
আমার মনে হল আমি বেহেস্তি জায়গায় চলে এসেছি। আসে-পাশে হুরপরীর দল।নাহ, আজকে চোখের ব্যায়াম বেশী হয়ে যাচ্ছে।
আমি বেছে বেছে এমন একটা টেবিলে গিয়ে খেতে বসলাম, যে টেবিলে হুরপরীরা বসে আছে।
খাওয়া শুরু করার বেশ কিছুক্ষন পড় আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম।ডানদিক থেকে শুরু করে চার নম্বর মেয়েটা আমাকে অনেক্ষন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে।মেয়েটার তাকানোর মধ্যে কিছু একটা ছিল। অদ্ভুত কিছু একটা ছিল। আমার গলায় চরম বিষম লেগে গেল।হুরপরীরা হাসতে শুরু করল আমার অবস্থা দেখে।
বিষম তাড়ানোর জন্য ঢক ঢক করে গ্লাসের সব পানি খেয়ে ফেললাম।নিজেকে সামলে নিলাম দ্রুত।
খুব শান্ত ভঙ্গিতে এইবার মেয়েটার দিকে তাকালাম।চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটা অন্য দিকে তাকাল। বুঝতে পারছি কিছু একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু ধরতে পারছি না। স্মৃতিপটে যেন আসি আসি করেও আসছে না।
কবিগুরুর একটা চরণ মনে পড়ে গেল,
“দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে”
স্মৃতির অনেক গভীরে হাতরে কিছু দৃশ্য মেলাবার চেষ্টা করছি। যে চোখে এক সময় বালিকার দুষ্টামি খেলা করত, সেই চোখে আজ আমি এক নারীর রহস্যময়তা দেখে অবাক হলাম। সেই চোখ, সেই ঠোট, সেই চিবুক সব কিছু ঠিক আগের মত আছে।খাওয়া শেষে চলে যাবার সময় আবার তার সেই মিট মিট করে দুষ্টু হাসি। আমি যেন খুজে পেলাম তাকে, সেই চিরচেনা দুষ্টু বালিকাকে।একটা সময় ছিল, যাকে এক পলক দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম।
এর সাথে যোগ হয়েছে স্বভাবসিদ্ধ নারীর মোহনিয়তা।
আমার মনের ফ্রেমে বাধাই করা ছবিটা মুহুর্তেই যেন রঙ্গিন হয়ে উঠল।
চলবে………