গত ৩রা মার্চ আমার বাবার সৌদি আরব থেকে ছুটিতে বাংলাদেশের আসার কথা ছিল। কত কিছু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা পরিবারের সবাই। কত পরিকল্পনা আরও কত কিছু। সৌদি আবর টাইম ভোর ৩টায় বিমান ছাড়ার কথা ছিল। উনি উনার সব পাসপোর্ট ভিসা আর লাগেজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন রিয়াদ এয়ারপোর্টে। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল বিমানে উঠার প্রস্তুতি। উনার মনে কত আনন্দ। দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাস পরে দেশে আসছিলেন। লাগেজ আগেই নিয়ম অনুসারে ট্যাগিং হয়ে যায়। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় ধরা পড়ে একটা মারাত্বক ভুল উনার ভিসাতে। সম্প্রতি উনি ডিজিটাল পাসপোর্ট করেছিলেন। সেই পাসপোর্টের সাথেই ছিল উনার পুরাতন পাসপোর্ট। উনার ভিসাতে নতুন পাসপোর্টের জায়গায় পুরাতন পাসপোর্টের নাম্বার প্রিন্ট হয়েছিল ভুলবশতঃ। (ভুলটা ছিল উনার হাসপাতালের। উনি একজন চিকিৎসক ছিলেন দীর্ঘ ১৬ বছর যাবত সৌদিতে কাজ করছেন)।
উনাকে ইমিগ্রেশন থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বলা হয় ওমুক অফিস থেকে ঠিক করে নিয়ে আসেন তবে পরবতী ফ্লাইটে আবার ঢাকা যেতে পারবেন। উনি খুবই নরম হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। এয়ারপোর্টের এমাথা থেকে ওমাথা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন যদি কোনভাবে ঠিক করা যায় যদি কাউকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক করা যায়। কিন্তু পারলেন না। কারণ সৌদিআরবের নিয়ম কানুন কেমন তা যারা সৌদিআরবে যান বা থাকেন তারাই জানেন।
এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশ সময় সকাল সাতটায় আমাকে ফোন করে বললেন সব আর বললেন খুব কষ্ট নিয়ে, “বাবা আমার বোধহয় আর দেশে যাওয়া হলো না।” (কথাটা শুনেই আমার মনটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলে যদিও তাকে বুঝতে দেইনি) কিন্তু ততক্ষণে উনার সব লাগেজ নিয়ে বিমান উড়াল দিয়েছে বাংলাদেশের পথে। উনি এটাও জানতেন না। বসে ছিলেন লাগেজ ফেরত পাওয়ার জন্য। পরে অবশ্য জানতে পারেন। তারপর অফিসের গাড়িতে করে রওনা দিয়ে পৌঁছালেন উনার কর্মস্থলে। ভীষন মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন উনি। যদিও কোম্পানী দুঃখ প্রকাশ করে ২/১ দিনের মধ্যেই সব ঠিক করে দিবেন বলেন আশ্বস্ত করেছিলেন। সেই মত কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল ভুলটা সংশোধন করার কিন্তু উনার মন মানেনি। উনি উনার রুমে চলে যান এবং বিশ্রাম নেন। সারাদিন কয়েকবার আমাদের সাথে ফোনেও যোগাযোগ হয়। রাতে স্কাইপেতে ভিডিও ফোন হয় প্রতিদিনের মত। বলেন, “আমার মনটা খুব খারাপ আর শরীরটাও ভালো লাগছে না।” আমরা তাকে সাহস দেই। ধৈর্য্য ধরতে বলি।
পরেরদিন অর্থাৎ ৪ঠা মার্চ সকাল থেকে ফোনে কোন কথা হয়নি আর উনিও করেননি। উনার শরীর খারাপ লাগায় উনি ওনার চেম্বারে যান এবং অন্য ডাক্তার কলিগদের সাথে অসুস্থতা নিয়ে আলাপ করেন। তখন তারা তাকে ঐ ক্লিনিকেই ভর্তি করে নেন। পরে অবস্থা একটু খারাপ হলে পাশের আরেকটা ক্লিনিকে স্থানান্তরিত করেন উনার কলিগেরা। সেখানে ধরা পড়ে হার্টে মাইল্ড ষ্টোক করেছেন ডিপ্রেশন থেকে। আইসিইউতে নেয়া হয়। খবর দেয়া হয় আমার খালুকে যিনিও ঐ রিয়াদে আরেকটি হাসপাতালের ডাক্তার। ছুটে যান তিনি সেখানে। তারপর একটু সুস্থ্যবোধ করলে বাসায় আম্মাকে ফোন করে বললেন যে, “একটু এসিডিটির পেইন হচ্ছে”। কিন্তু এরপর আমি কয়েকবার অফিস থেকে ফোন দিয়ে উনাকে পাইনি। মোবাইলে রিং হয় কিন্তু রিসিভ করে না। দুঃচিন্তায় পড়ে যাই। তারপর হঠাৎ বিকাল ৩.১৫ মিনিটে অর্থাৎ সৌদি টাইম ১২.১৫ মিনিটে আমার মোবাইলে উনি ফোন করে বলেলেন, “বাবা আমি এখন ভালো আমার খুব ভালো লাগছে। আমি আইসিইউ থেকে কথা বলছি আস্তে আস্তে, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে। সিষ্টার আমার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে। আমি খুব রিকোয়েষ্ট করে ফোনটা নিয়েছি। তুমি অফিসে খেয়েছো বাবা? আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। ওরা আমাকে ভাত, তরকারি আর ডাল দিয়েছে আমি এখন খাবো বাবা।” এছাড়াও উনি বললেন উনার রুমের কোথায় কি কি মূল্যবান জিনিসপত্র রেখেছেন। আর বললেন এটা তোমার খালুকে বলে দিও। বাবা ভালো থাকো। অফিস করো। (মাঝখানে আমি বললাম তুমি আমাকে ফোন না দিয়ে চুপ করে এসএমএস দিও। আমিও এসএমএস দিবো। তাহলে কেউ জানতে পারবেনা।) উনি বললেন, “ঠিকআছে বাবা তুমি ভালো থাকো আমি বাসায় একটু ফোন করে সবার সাথে কথা বলি।” ফোন রেখে দিলো আমার সাথে কথা হলো চার মিনিট পনের সেকেন্ড। তারপর বাসায় ফোন করে সবার সাথে কথা বলেছেন। আহা......., ওটাই আমার বাবার সাথে আমার শেষ কথা। আমি কত দুর্ভাগা আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু উনি ঠিকই বুঝলেন যে উনি চলে যাবেন।
এরপর অফিস থেকে বাসায় ফিরি। কেন যেন বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় বার বার মনে হচ্ছিল আল্লাহ আমাকে তুলে নিয়ে আমার বাবাকে সুস্থ্য করে দিক। যথারীতি বাসায় আসি কিছুক্ষণ পরে দেখি সব আত্মীয় স্বজন বাসায় ভীড় করছে। অনেক ঘটনা আর তাদের আমতা আমতা কথাবার্তায় জানতে পারলাম সৌদি টাইম বেলা ২.৩০ মিনিটে বাংলাদেশে টাইম বিকাল ৫.৩০ মিনিটে বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন।
পরদিন ৫ই মার্চ শুধুই চিন্তাভাবনা উনাকে বাংলাদেশে আনা হবে নাকি ওখানেই দাফন করা হবে। আম্মা বললেন, “বাবা বলে গিয়েছিলেন যদি কর্মরত অবস্থায় সৌদী আরবেই উনার মৃত্যু হয় তবে যেন ওখানেই উনাকে দাফন করা হয়।” আমাদের ভাইবোনদের মন মানেনা আমরা বাবাকে কাছে পেতে চাই। যেকোন একটি জন্যই অনেক কাগজের লেনদেন করতে হবে বাংলাদেশ থেকে সেটাও সময় সাপেক্ষের ব্যাপার। ওদিকে আমার বাবা ঘুমিয়ে আছেন হিমঘরের ড্রয়ারে।
তারপর সিদ্ধান্ত নেই আমার বাবার ইচ্ছা অনুয়াযীই উনাকে সৌদি আরবেই দাফন করা হবে। ওখানে দাফন করতে হলেও তার হাসপাতাল এবং এম্বাসীতে কাগজ পাঠাতে হবে ফ্যাক্স করে কাউকে অথারাইজেশন দিয়ে। সময় পার হয় আমরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করি কাগজ পত্র তৈরী করার জন্য। এখান থেকে ওখানে ঘুরি। কাজ হয় না। শেষে নোটারী পাবলিক করে এফিডেফিট করে কাগজ ফ্যাক্স করা হলো। কাগজও পাঠালাম কিন্তু তার আগেই আল্লাহর রহমতে সব ভাবে জট খুলে গেলো।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সৌদী সরকার এবং রিয়াদ থানা মৃতদেহর ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিলো আমার খালুকে মৃতদেহ হ্যান্ডওভার করে দিলেন। সৌদিতে দাফনের পারমিশনও সেইদিনই হয়ে গেলো। এগুলো এতই জটিল কাজ যে দেখা গেছে অনেকের বেলায় দুইমাসও পার হয়ে যায়। তারপর হয়ত লাশ দাফন হয় বা দেশে ফেরত আসে। দাফন হলো রিয়াদের মুনসুরিয়া গোরস্থানে। অনেক বড় গোরস্থান।
খালুর কাছে শুনলাম আমার বাবার জানাজাতে এত লোক হয়েছিল যে কল্পনা করা যায় না। উনি আমাদের চোখের অগোচরে এত প্রিয় একটা মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন হয়ত সেটা তিনিও জীবনদশায় বুঝতে পারেননি। কয়েকশত কিলোমিটার দুর থেকে লোকজন এসেছে তার জানাজায় আর দাফন কার্যক্রমে। দাফনের পরেও অনেক মানুষ দল বেঁধে এসেছে জিয়ারত করতে। ৪ঠা মার্চ তার মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের খবরেও নাকি প্রচার করা হয়েছে এবং সারারাত টিভির হটনিউজ স্ক্রল হয়েছে। সেই চ্যানেল পরিবার থেকে শোক জানিয়েছে।
আমার এবং আম্মার ফোনে অনেক সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী, সৌদিয়ান, ইন্ডিয়ান, পাকিস্থানী, সুদানী, মিশরী, ইন্দোনেশিয়ান আরো অনেকে ফোন করে শোক প্রকাশ করেছেন, কেঁদেছেন এবং তার জন্য দোয়া করেছেন। আমরা তাদের কাউকেই চিনিনা। আমাদের নাম্বার তারা কিভাবে জোগাড় করেছে তাও জানিনা। সৌদিতে বাংলাদেশ এম্বাসীর পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে। এবং সেই সাথে একটা অনুমতি পত্র তারা দিয়েছেন যার দ্বারা আমি, আমার মা, আমার পরিবার এবং আমার বোন এবং আমাদের ছেলে-মেয়ে যেকোন সময় সৌদী যেতে পারবো এবং তার কবরে গিয়ে জিয়ারত করতে পারবো যতবার খুশি। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। কারণ আমার জানামতে সৌদি আরবে বিদেশীদের জন্য আইন খুব কড়া। হজ্জ বা ওমরা করতে গেলে অন্য কোন কাজের জন্য ঐ দেশের অন্যকোথাও যাওয়া যায় না। এটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার।
সবচেয়ে কষ্ট একটাই। সেটা হলো। উনার সবকিছুই ঠিকঠাক হলো। একটা ভুলের জন্য উনি দেশে আসতে পারলেন না। উনার লাগেজও দেশের চলে আসলো উনাকে ছাড়া কিন্তু উনি মানুষটা ওখানে আটকে গেলেন মাত্র কয়েকটি ঘন্টার জন্য। তারপরও তো মারাই গেলেন। আল্লাহ উনাকে ওখানে রেখে দিলেন হয়ত উনার ইচ্ছা পূরণ করানোর জন্যই! যাতে রাসুলের দেশে কবর হয়!! কি আশ্চর্য্য!!!
এখন সবকিছু শেষ। সব চুপচাপ। আর কেউ ফোন করে বলবেনা যে, “বাবা তুমি খেয়েছো, বাবা তোমার শরীরটা কি ভালো? শরীরের যত্ন নিও। আজকে অফিস থেকে আসতে দেরী হলো কেন? রাস্তায় কষ্ট হলো নাকি?”
আমার বাবার মত সৎ এবং পরহেজগার লোক আমি আর দেখিনি। উনি জীবনে সৎ থাকার জন্য অনেক লোভনীয় অফারের সাথে আপোষ করেননি। উনি যেখানেই কাজ বা চাকুরী করেছেন সেখান থেকে বিদায় নেবার সময় সবাইকে ভালোবাসায় কাঁদিয়ে বিদায় হয়েছেন। আমি জানি আমার বাবা নিঃস্পাপ। আমি সবার কাছে দোয়া চাই, আল্লাহ যেন আমার বাবাকে জান্নাতবাসী করেন।
কোনভাবেই বাবাকে অন্যকারো সাথে তুলনা করতে পারিনা। আমি এ অভাব পূরণ করবো কিভাবে? মহাশূন্যের মত একটা টানেলের মধ্যে আমার এখন অবস্থান। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার!!!