somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং .........

০৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। সনাতন ধর্মাশ্রয়ী হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন বহু পূর্ব থেকেই তান্ত্রিকতাবাদে বিশ্বাসী। যুগযুগ ধরে কৃষিই হাজংদের একমাত্র পেশা। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে হাজং সম্প্রদায়কে সুসং জমিদারদের হাতি ধরার কাজে নিয়োজিত করায় তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ইতিহাসে সে আন্দোলন 'হাতিখেদা বিদ্রোহ' নামে খ্যাত। তেমনি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশে সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে বহেরাতলী গ্রামে এক কৃষিজীবী হাজং পরিবারে কুমুদিনী হাজং-এর জন্ম। কুমুদিনীর বাবা অতিথ চন্দ্র একজন হাতিখেদা বিদ্রোহী ছিলেন। কুমুদিনী হাজং এর জন্ম সন তিনি নিজেও বলতে পারেন না। তবে তিনি তাঁর বয়স অনুমান করেন ৭৩/৭৪ বছর।
কুমুদিনী হাজং এর জন্মের দু'বছর পরেই বাবা অতিথ চন্দ্র রায় হাজং ও মা জনুমনি হাজং মারা যান। মামার কোলে পিঠেই বড় হন কুমুদিনী হাজং (অনেক চেষ্টা করেও কুমুদিনী হাজং মামার নাম স্মরণ করতে পারেন নি। তিনি জানান মামার নাম ধরে কেউ ডাকতো না বলেই মামার নাম মনে নেই)৷ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার না থাকায় সে সময় বহেরাতলী গ্রামসহ পাশ্ববর্তী অঞ্চলে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। সে কারণেই কুমুদিনী হাজং কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। এছাড়া সে সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এমন সচেতনতাও হাজংদের মধ্যে ছিল না।




সাংসারিক জীবন

কুমুদিনী হাজং-এর মামা ছিলেন চিরকুমার। সে কারণেই ভাগ্নীর দায়িত্ব বেশি দিন নিতে পারেন নি। ১১/১২ বছর বয়সেই বেহেরাতলী মাইঝপাড়া গ্রামের দুর্গাদাস হাজং এর ছোট ছেলে ১৫ বছর বয়সের কিশোর লংকেশ্বর হাজং-এর সঙ্গে কিশোরী কুমুদিনী হাজংকে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুমুদিনী হাজং-এর পিতার রেখে যাওয়া চার আড়া (১শ ২৮ শতকে ১ আড়া) জমি ও বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে লংকেশ্বর হাজংকে ঘরজামাই করে নেন।
পারিপার্শ্বিক সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে লংকেশ্বর হাজং তার বাবা দুর্গাদাস হাজং, মা সোমেশ্বরী হাজং ও বড় তিন ভাই রাজেন্দ্র হাজং, ইসলেশ্বর হাজং, গজেন্দ্র হাজংকে তার শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরিবারের সকলে মিলে কখনো নিজের জমিতে কখনো অন্যের জমিতে দিন মজুর হিসেবে কাজ করে পরিবার চালাতো।




আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া

হাজং সম্প্রদায় বরাবরই সুসং জমিদারদের ভগবান তুল্য গণ্য করতো। এরপরও গারো পাহাড়ি অঞ্চলে জমিদার, মহাজনদের সৃষ্ট টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুসারে টংকের ধান জমিদার-মহাজনদের দিতেই হতো। সহজ কথায় হাজং সম্প্রদায়ের শ্রম কেড়ে নেওয়ার জন্য জমিদাররা টংক প্রথা নামে ফাঁদ পেতেছিল। এতে হাজংরা ক্রমেই জমি বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে।
এ সময় সুসং দুর্গাপুরের জমিদারদের ভাগ্নে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহ-এর নেতৃত্বে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ব, জোত স্বত্ব, নিরিখ মতো টংক জমির খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবি নিয়ে টংক আন্দোলন শুরু হয়। হাজং সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থেই টংক আন্দোলনের সংগে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। সে সূত্রেই কুমুদিনী হাজং এর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর তিন ভাই টংক আন্দোলনের সংগে জড়িয়ে পড়েন। বহেরাতলীসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামে লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর বড় ভাই রাজেন্দ্র হাজং, ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজং টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য হাজংদের মাঝে সাংগঠনিক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতো। এছাড়া গোটা পরিবারটি কমরেড মনি সিংহর সাথেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে চলতো। সে কারণেই জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনীর কু-দৃষ্টি পড়েছিল লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের উপর।

সুসং দুর্গাপুর হাই স্কুল মাঠে দ্বিতীয় পর্যায়ে টংক প্রথা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি সভার পরেই ব্রিটিশ শাসকদের কু-দৃষ্টি আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা জানুয়ারি দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে। বিরিশিরির সেই ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী হাজংদের দমন করতে চেষ্টা চালানো হতো। বিভিন্ন গ্রামের হাজং পরিবারগুলো প্রতিদিনই সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচারের শিকার হতো।

১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০ টার দিকে বিরিশিরি থেকে ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে বহেরাতলী গ্রামে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি দল লংকেশ্বর হাজংএর বাড়িতে হানা দেয়। টংক আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের গ্রেফতার করাই ছিল সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্য। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর বহেরাতলীর দিকে আসার সংবাদ পেয়েই লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর তিন ভাই আত্নগোপন করে আড়াপাড়ায় মনি সিংহের গোপন আস্তানায় চলে যায়।

লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের ধরতে না পেরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে লংকেশ্বর হাজং এর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখে সশস্ত্র সেনারা লংকেশ্বর হাজং কোথায় আছে জানতে চায়। টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং সঠিক উত্তর না দিয়ে '"জানিনা" বলে জবাব দিয়ে দেন। এতে সেনারা আরো ক্ষিপ হয়ে উঠে। স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দির কথা ও অশুভ ইঙ্গিত দিয়ে কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যায় বিরিশিরি সেনা ছাউনিতে।

কুমুদিনী হাজং এর বাড়ির জনৈকা মহিলা পাশের বাড়িসহ অন্যান্য বাড়িতে দৌঁড়ে গিয়ে কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পৌঁছায়। এ সংবাদ হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে শতাধিক হাজং নারী পুরুষ সশস্ত্র হয়ে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর পথরোধ করে দাঁড়ায় ও কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিতে বলে।

ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সেনারা হাজং গ্রামবাসীর কথা কর্ণপাত না করে বিরিশিরির দিকে যেতে থাকে। গ্রামবাসীর মধ্য থেকে মধ্যবয়স্কা রাশিমনি নাম্নী এক হাজং মহিলার নেতৃত্বে দিস্তামনি হাজং, বাসন্তি হাজংসহ ১২ জনের এক মহিলা সশস্ত্র দল কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সশস্ত্র সেনারা নৃশংসভাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায়। এতে রাশিমনি হাজং গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে পেছনের পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমনিকে ধরতে গেলে তাঁকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অন্যান্য হাজং নারী পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের উপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। তাঁদের হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দু'সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকি সেনারা দৌঁড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।

কৃষক নারীদের মধ্যে শহীদ হিসেবে হাজং রাশিমনির নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হলো। রাশিমনি হাজং শহীদ হওয়ার এক মাস পরেই স্ত্রী বিয়োগে কাতর বগাউড়া গ্রামের রাশিমনির স্বামী পাঞ্জী হাজং আগুনে আত্মাহুতি দেয়। নিঃসন্তান হয়েও হাজংদের অধিকার ও নারী সংগ্রামের প্রতীক রাশিমনি হাজং সম্প্রদায়ে হাজং মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন আর কুমুদিনী হাজং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের প্রেরণার উত্‍স।

ওই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে গ্রামবাসীরা বহেরাতলীর অদূরে গভীর পাহাড় ঘেরা আড়াপাড়া অরণ্যে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মনি সিংহ-এর গোপন আস্তানায় নিয়ে যায়। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন কুমুদিনী হাজং এর স্বামী ও ভাসুররা। আড়াপাড়া আস্থানায় দীর্ঘ সময় শুশ্রষার পর সন্ধ্যায় কুমুদিনী হাজং জ্ঞান ফিরে পান।

এ ঘটনায় সরকার হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সরকার বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করে। মামলায় কমরেড মনি সিংহ, লংকেশ্বর হাজং তাঁর তিন ভাই ও কুমুদিনী হাজংসহ অনেক হাজং টংক আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়।

সে সময় সুসং অঞ্চলের প্রায় সকল হাজং পরিবারকেই পুলিশের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে ফেরারী জীবন যাপন করতে হয়েছিল। কুমুদিনী হাজং পুলিশের অত্যাচার ও গ্রেফতার এড়াতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার লক্ষ্মীকুড়া গ্রামে বলেশ্বর হাজং এর বাড়িতে আত্মগোপন করেন। পুলিশসহ অন্যকোন লোকই যেন কুমুদিনী হাজংকে চিনতে না পারে সেজন্য বলেশ্বর হাজং এর পরামর্শে কুমুদিনী হাজং এর নাম পরিবর্তন করে সরস্বতী নামে ডাকা হতো। সে কারণেই প্রমথ গুপ্তের 'মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী', সুপ্রকাশ রায়ের 'মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক' ও 'ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম' পুস্তকে কুমুদিনী হাজং-এর নাম সরস্বতী বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

বহেরাতলী গ্রামসহ পাশের গ্রামগুলোতে পুলিশের অত্যাচারে গৃহহারা হাজংদের মারমূখী হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। তাই তারা গোপনে গোপনে সাংগঠনিক তত্‍পরতা জোরদার করে। সে সময় কুমুদিনী হাজং হালুয়াঘাটের লক্ষ্মীকুড়াসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিরোধ আন্দোলন ও টংক প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্ম তত্‍পরতা চালান।

সরকারের দায়ের করা হত্যা মামলা বেশ ক'বছর চলার পর নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এরপরও কুমুদিনী হাজং এর স্বামী ও ভাসুরদের বিনাদোষে প্রায় এক বছর হাজত বাস করতে হয়েছিল। কুমুদিনী হাজং আত্মগোপন করে হাজত বাস থেকে রেহাই পান।

বহেরাতলী গ্রামের সেদিনের ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করতে জ্যোতি বসু, ব্যারিস্টার স্নেহাংশু আচার্য ও সাংবাদিক প্রভাত দাসগুপ্ত গারো পাহাড় অঞ্চলের হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আসেন। কিন্তু ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেস্টিন তাঁদের বহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করতে দেননি। এতে এম.এল.এ জ্যোতি বসু বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং 'রেইন অব টেরর ওভার দ্য হাজংস অ্যা রিপোর্ট অব দি এনকোয়ারি কমিটি' নামে একটি নথি জওহরলাল নেহেরুর কাছে প্রেরণ করেছিলেন।

টংক আন্দোলনের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে কুমুদিনী হাজং ও তাঁর স্বামী টংক প্রথার বিরুদ্ধে গারো পাহাড় অঞ্চলের হাজংদের গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাংগঠনিক কর্ম তত্‍পরতা চালান। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের চক্রান্তমূলক আশ্বাসের ফলে সাধারণ হাজংরা নিজ নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করে এতে আন্দোলনে অনেকাংশে ভাটা পড়ে যায়। নূরুল আমীনের প্রহসনের মূল কাজ শুরু হয় পরবর্তী ১৯৬৪ সালে। সে সময় হাজংরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার থাবায় পড়ে। গ্রামে গ্রামে বাঙালী মুসলমানরা প্রবেশ করলে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সে দাঙ্গার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হাজংরা দলে দলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সে সুযোগে সরকারের ইন্ধনে মুসলিম সেটেলররা হাজংদের জমি বাড়িসহ সকল সম্পদ দখল করে নেয়। তেমনিভাবে কুমুদিনী হাজং-এর ৪ আড়া জমিসহ বাড়িঘর সেটেলরদের হাতে চলে যায়। পরবর্তীতে সরকারের আশ্বাসে অন্যান্য হাজংদের সংগে কুমুদিনী হাজং ও লংকেশ্বর হাজং দেশে ফিরে এলেও বাড়ি জমি ফেরত্‍ পাননি।

সে সময় থেকেই নিঃস্ব কুমুদিনী হাজং ও তাঁর স্বামী লংকেশ্বর হাজং বহেরাতলী গ্রামের গারোপাহাড়ের বন বিভাগের একটি টিলার উপর কুড়েঘর বেঁধে বসবাস শুরু করেন।




একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুমুদিনী হাজং তাঁর পরিবার নিয়ে ভারতের বাঘমারা শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে এসে শুধু ভিটে ছাড়া কোন ঘরবাড়ি পাননি। চরম দরিদ্রতায় মানুষের বাড়ি কামলা খেটে তাঁকে জীবন ধারণ করতে হয়। জরাজীর্ণ জীবনযাপন করে কুমুদিনী হাজং এর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ২০০০ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।



পরিবার

কুমুদিনী হাজং এর তিন ছেলে। বড় ছেলে রমেন্দ্র হাজং সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পে বাস করেন। দ্বিতীয় ছেলে অর্জুন হাজং বিজয়পুর সাদামাটি প্রকল্পে দিন মজুরি করে তার পরিবারসহ মা কুমুদিনী হাজং এর আহার যোগান। তৃতীয় ছেলে সহদেব হাজং ১৯৭৫ সালে দেশের পট পরিবর্তনের পর কাদেরীয়া বাহিনীতে যোগদান করে। পরবর্তী সময় কাদের সিদ্দিকীসহ তাঁর সঙ্গীরা দেশে ফিরে এলেও তিনি আর ভারত থেকে ফিরে আসেন নি। বর্তমান সে দেশে একটি মিশনারী বিদ্যালয়ে চাকরি করেন।
কুমুদিনীর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। ছোট মেয়ে অঞ্জলি কমরেড মনিসিংহের ছেলে দিবালোক সিংহের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারী সংস্থা ডি.এস.কে তে চাকরি করেন।




পুরস্কার ও সংবর্ধনা

ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তি সংগ্রামে অবদানের জন্য কুমুদিনী হাজংকে অনন্যা শীর্ষদশ, ২০০৩ (আন্দোলন) নির্বাচিত করে। আনুষ্ঠানিকভাবে সাপ্তাহিক অনন্যা কুমুদিনী হাজংকে একটি ক্রেস্ট ও নগদ ১৫০০ টাকা প্রদান করেন। এছাড়া কুমুদিনী হাজংকে বসবাসের জন্য একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে দেয়। ২০০৫ সালে স্বদেশ চিন্তা সংঘ কুমুদিনী হাজংকে ড.আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার প্রদান করে।
কুমুদিনী হাজং-এর স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে তে-ভাগা কৃষক আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন কমিটি ময়মনসিংহ, ২৫ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে সংবর্ধনা প্রদান করেছিল। অতীত স্মৃতি ও মানুষের ভালবাসাকে সম্পদ মনে করে বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত কুমুদিনী হাজং তৃপ্ত।

গবেষক : আলী আহম্মদ খান আইয়োব


৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×