আজ ১৭ মার্চ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহাস্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী তথা জাতীয় শিশু দিবস। ১৯২০ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
আজ এই বিশেষ দিনে বঙ্গবন্ধু নিয়ে এদেশের যুবসমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দ্বারা সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া একটি মিথ্যে প্রচারণা প্রসঙ্গে আলোচনা করবো। এই গোষ্ঠী অভিযোগ তোলে যে, বঙ্গবন্ধু নাকি ইসলাম বিরোধী/ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন ! আসলেই কী তাই ?
প্রকৃত সত্যঃ
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান বেতারে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন -
"আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই, একথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসূলে করীম (সা)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র"।
ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে ১৯৭২ সালের ৪নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে বলেন -
"ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার - এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না"।
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পাদনাঃ ডঃ মিজানুর রহমান মিজান পৃষ্ঠা ১১৬
১৯৭৪ সালের ১৮ই জানুয়ারিতে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন -
"রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে, সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছে, তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন, তিনি রাব্বুল আলামীন, রাব্বুল মুসলেমীন নন। হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান। সেই জন্যই এক মুখে সোশ্যালিজম ও প্রগতির কথা এবং আর এক মুখে সাম্প্রদায়িকতা পাশাপাশি চলতে পারে না। একটা হচ্ছে পূর্ব আর একটা হচ্ছে পশ্চিম। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাও"।
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পাদনাঃ ডঃ মিজানুর রহমান মিজান পৃষ্ঠা ১৫৭
১৯৭২ সালের ৯ই মে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেন -
"আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তাঁর ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না। পশ্চিমারা ২৩ বছর ইসলামী ট্যাবলেট দেখিয়ে আমাদের লুটেছে। আপনারা জানেন ? খবর রাখেন ? এই বাংলা থেকে ২৩ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে"।
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পাদনাঃ ডঃ মিজানুর রহমান মিজান পৃষ্ঠা ৬৬
১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ই জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেন -
" চতুর্থত বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়।...এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না"।
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পাদনাঃ ডঃ মিজানুর রহমান মিজান পৃষ্ঠা ৭৮
১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন -
"আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা - ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।...রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাঘাত করবে - এ বিশ্বাস আমি করি"।
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পাদনাঃ ডঃ মিজানুর রহমান মিজান পৃষ্ঠা ১০৫
আরেকটি ব্যাপার হলো -
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাও শেখ মুজিবুর রহমান। বাকশাল গঠন করার পর একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ পাকিস্তান আমলে গঠিত বায়তুল মুকাররম সোসাইটি ও ইসলামিক একাডেমি ঢাকা-কে একীভূত করে "ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ" গঠন করা হয়। এরপরেও শেখ মুজিবুর রহমানকে ধর্মবিরোধী/ধর্মহীন বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়।
এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পুস্তিকা থেকে জানা যায় -
"জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহৌরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা সমুন্নত হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সাথে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে"।
সূত্রঃ ইসলামের প্রচার-প্রসারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যচিত্র : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ২০১৩।
উক্ত পুস্তিকার সূত্রে বঙ্গবন্ধুর ইসলামের প্রচার ও প্রসারের তালিকা নিম্নরূপঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ সীরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠা, হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা, সমুদ্রপথে হজ যাত্রীদের জন্য জাহাজ ক্রয়, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন, বেতার ও টিভিতে কুরআন তিলাওয়াত প্রচার, পবিত্র ইদে মিলাদুন্নবী (সা) শবেকদর শবেবরাত উপলক্ষে সরকারি ছুটি, মদ জুয়া হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ এবং শাস্তির বিধান, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধকরণ, বিশ্ব এজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারি জমিজায়গা বরাদ্দ, কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জমি বরাদ্দ, রাশিয়াতে প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা এবং আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধে আরব-বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ ইত্যাদি।
এখান থেকে সিদ্ধান্ত টানা যায় যে,
১) বঙ্গবন্ধু ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না বরং তিনি মনে প্রাণে একজন মুসলিম এবং পাশাপাশি একজন ন্যায়বিচারক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সকলের সমানাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে 'সর্বধর্মবাদ/প্যানথেইজম' এ বিশ্বাসী ছিলেন।
২) ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের ইসলামই বঙ্গবন্ধুর অনুসরিত আদর্শ ছিলো।
৩) তুচ্ছ রাজনৈতিক স্বার্থ বা স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভণ্ডরা ইসলামকে সুকৌশলে যেভাবে ব্যবহার করে এবং ইসলামের অবমাননা করে - বঙ্গবন্ধু তার চরম বিরোধী ছিলেন।
৪) বঙ্গবন্ধুই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকৃত ইসলামের প্রচার এবং প্রসারের পক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
৫) ধর্মনিরপেক্ষতার শব্দটির মধ্যে একটা দ্ব্যর্থকতা বা Double Meaning আছে যেটাকে মুজিব বিরোধী সাম্প্রদায়িক তথা ধর্মান্ধ চক্র খুব সুকৌশলে ব্যবহার করে তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষ/ধর্মহীন/ইসলাম বিরোধী বলে প্রতিপন্ন করতে চায়। এমনকি এসব করার জন্য তারা তাকে হিন্দু বলেও অপপ্রচারে রত হয় যেখানে বাস্তবতা হচ্ছে ১২০৪ সালে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী আসার আগে ১৮কোটি বাংলাদেশীর পূর্বপুরুষদের সকলেই হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ ছিলেন, ১জনও মুসলিম ছিলেন না।
পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে হয় -
"যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান"।
কবিঃ অন্নদাশঙ্কর রায়
রচনাঃ ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
সকলকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:১২