আজ ২রা মার্চ, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস। ৪৬ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে প্রথম উত্তোলন করা হয় সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা যা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুরো জাতিকে প্রেরণা জোগায়।
সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত - এই হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারীভাবে গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় একই রকম দেখতে একটি পতাকা ব্যবহার করা হতো, যেখানে মাঝের লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রংয়ের একটি মানচিত্র ছিল। ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়।
কারণঃ
১) পতাকার দুটি পাশ রয়েছে, ফলে একদিক থেকে মানচিত্র সঠিকভাবে দেখা গেলেও অপরদিক থেকে ভুলভাবে প্রদর্শিত হয় যা কাম্য নয়।
২) পতাকার ভেতরে মানচিত্র থাকার কারণে চিত্রশিল্পী ব্যতীত মানচিত্র সংবলিত পতাকা আঁকা সকলের কাছেই অত্যন্ত দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে।
৩) স্বল্প সময়ে এবং কম্পাস, স্কেল ইত্যাদি উপকরণ ছাড়া সঠিকভাবে মানচিত্র আঁকা সম্ভব হবে না ফলে মানচিত্রের সঠিক রূপ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে।
পতাকার মাঝে মানচিত্র আঁকার কারণ ব্যাখ্যা করে শিব নারায়ণ দাশ বলেন,
"পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা আলাদা করে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বোঝাতে মানচিত্রটি দেয়া হয় এবং স্বাধীনতার পরে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে সেটি সরিয়ে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়"।
মানচিত্র সরানোর কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন,
"পতাকা সঠিকভাবে তুলে ধরা জাতির কর্তব্য। কিন্তু মানচিত্র থাকায় পতাকাটি আঁকা অনেক কঠিন এবং বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সহজ করে পতাকা আঁকার জন্য মানচিত্রটি সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল"।
বাংলাদেশের পতাকার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- পতাকার লাল বৃত্তটি সবুজ আয়তক্ষেত্রের একদম মাঝখানে রাখার বদলে একপাশে একটু চাপানো হয়েছে।
কারণঃ
মাঝখানে না রেখে একপাশে একটু চাপানোর কারণে পতাকা তরঙ্গাকারে ওড়ার সময় বৃত্তটিকে মাঝখানে আছে বলে মনে হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে জাপান ও পালাউ নামক ২টি রাষ্ট্রের পতাকার মিল রয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাস
ডিসেম্বর ৩, ২০০৯ তারিখে দৈনিক আমাদের সময় নামক একটি জাতীয় পত্রিকায় ইউসুফ সালাহউদ্দীন আহমেদ তার 'আমাদের জাতীয় পতাকার ইতিহাস' নামক আর্টিকেলে লেখেন -
"পতাকা তৈরি নিয়ে মিটিংয়ে বসলাম আমরা ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে। এ কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রবের নামে। কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত, আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবুজ জমিন বাংলার চির সবুজের প্রতীক, লাল সূর্য রক্তে রাঙা হয়ে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য, আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ সোনালি আঁশের রঙে হবে তার পরিচয়। লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙের মানচিত্র তারই প্রতীক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়লাম। খসরু ভাই গেল তখন বলাকা সিনেমা হলের চারতলায় এক বিহারি দরজির দোকানে। বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার সূর্যের প্রতীক। এখন হলো আরেক সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হলো ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবুদার হাত ছিল ভালো। তিনি বললেন, আমি বাপু পেইন্ট করতে পারব, তবে মানচিত্র আঁকতে আমি পারব না। কী করা যায়? ঠিক করলাম হাসানুল হক ইনু আর আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপারে ট্রেস করে নিয়ে আসব। আমরা গেলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল)। উল্লেখ্য, আমি এবং ইনু ভাই উভয়েই তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিন্নাহ্ হলে ৪০৮ নং কক্ষে থাকেন এনামুল হক (ইনু ভাইয়ের কাজিন)। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিলাম। ট্রেসিং পেপারে আঁকলাম পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। নিয়ে এলাম ইকবাল হলের ১০৮নং কক্ষে। বাকি সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল। শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে। তাতে দিলেন সোনালি রঙ।"
'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র' বইয়ের ১২৮ পৃষ্ঠায় মনিরুল ইসলাম লেখেন,
"চূড়ান্ত মহড়া ৬ই জুন বিকালে শেষ হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত হয় জয় বাংলা বাহিনীর একটা পতাকা তৈরির বিষয়ে যা পরদিন (৭ই জুন) সকালের অনুষ্ঠানকে আরও তাৎপর্যমণ্ডিত করবে। সে অনুযায়ী বাদন দলের বাড়তি সৌন্দর্যের জন্য সংগৃহীত কাপড় থেকে একটা পতাকা তৈরি হয়। কালচে সবুজ জমিনের ঠিক মাঝখানে পরিমিত আকারে একটা লাল বৃত্ত। (পতাকাটি বলাকা ভবনের ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় অফিসের পাশে এক দরজির দোকান 'পাক ফ্যাশন' থেকে সেলাই করে নেয়া হয়)। পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত ও পতাকা তৈরি পর্যন্ত কাজী আরিফ (আরেফ) ছাড়া উচ্চ পর্যায়ের কারো অনুমতি গৃহীত হয়নি। কিন্তু পরদিন একটা পতাকা, তা যে নামেই হোক, প্রদর্শনের আগে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ছাত্রলীগের ৭ই জুন পালনের সকল কার্যক্রম তখন জহুরুল হক হলের নিচ তলার ১১৬ নম্বর কক্ষ থেকে পরিচালিত হচ্ছিল। ওই হলেই তিন তলার একটি কক্ষে সিরাজুল আলম খান প্রায়ই থাকতেন। স্বভাবতই, স্বাধীনতার কার্যক্রমের একজন উর্ধতন নেতা হিসেবে তার কাছে অনুমোদন নিতে যাওয়া হল। তিনি পতাকা তৈরি ছাড়া সকল কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থাকায় আগামীকালের কার্যক্রমকে আরও অর্থবহ করার জন্য পতাকা তৈরির কথা জানিয়ে তা প্রদর্শনের জন্য তাঁর অনুমতির জন্য আবেদন করা হল। সমস্ত কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন 'যে নাম দিয়েই পতাকা প্রদর্শন কর না কেন তাকে জনগণের ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বলে ভেবে নিতে কোন বাঁধা থাকবে না।' এই মুহূর্তে 'বাঙলাদেশ' ও বাঙ্গালি' নিয়ে প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের শিকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেনঃ 'বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতা বিষয়ক আন্দোলনকে অনেকেই যুক্ত বাঙলার কথা বলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই বিরুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে।' অনেক আলোচনার পর তিনি লালবৃত্তের মাঝে পূর্ব বাঙলার মানচিত্রে এঁকে প্রদর্শনের পক্ষে মত দিলেন। সোনার বাঙলার প্রতিচিত্র সুস্পষ্ট করতে তিনি ওই মানচিত্র সোনালি রঙয়ে আঁকার পক্ষে মত দিলেন। এই সব কিছুর মধ্য দিয় ৬ই জুনের রাতের দ্বিতীয় প্রহরের প্রায় শেষ প্রান্ত উপস্থিত। বলাকা ভবনে ছাত্রলীগ অফিস হওয়ার কারণে নিউ মার্কেটের পাশের কাঁচা বাজার সংলগ্ন এক রঙয়ের দোকান থেকে, দোকানিকে জাগিয়ে, সোনালি রঙ ও তুলি জোগাড় করা হল। মানচিত্রের নকশা অঙ্কন এবং রঙ করার জন্য একজন শিল্পীর প্রয়োজন দেখা দিল। সে সমস্যাও সহজেই সমাধান হয়ে গেল। সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার ফেস্টুন আঁকার জন্য কুমিল্লা ছাত্রলীগের নেতা শিবনারায়ণ দাস তখন কর্মরত ছিল। সে একজন ভাল শিল্পীও বটে। ফলে তাকে নিয়ে আসা হল কালচে সবুজ জমিনের মধ্যখানে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রঙ দিয়ে পূর্ব বাঙলার মানচিত্র আঁকার জন্য। ১১৬ নম্বর কক্ষের মেঝেতে বিছিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে পূর্ব বাঙলার সোনালি মানচিত্র আঁকা হলো"।
বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় ১৯৬২ এর নিউক্লিয়াসের সদস্য ও মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদ লিখেছেন,
"১৯৭০ সালের ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেয়ার কর্মসূচি নেয়া হয়। ঐদিন ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয় যে একটা বাহিনী গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদাণ করা হবে। এবারও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় জয় বাংলা বাহিনী। অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় আসম আবদুর রবকে। নিউক্লিয়াস থেকে বাহিনীর পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পতাকা বঙ্গবন্ধুকে ব্যাটালিয়ান ফ্ল্যাগ হিসেবে প্রদান করা হবে। ৬ জুন ৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাজাহান সিরাজ ও আসম আবদুর রবকে ডেকে আমি নিউক্লিয়াস-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই। এই ফ্ল্যাগ পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আসম আবদুর রব বলেন যে, এই পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন যে, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি। বটলগ্রিন জমিনের উপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এই নকশা 'নিউক্লিয়াস' হাইকমান্ডের অনুমোদন নেয়া হয়। তখন আমি প্রস্তাব করি যে, এই পতাকাকে পাকিস্তানি প্রতারণা থেকে বাঁচাতে হলে লাল সূর্যের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্র দেয়া উচিত। কারণ হিসেবে দেখালাম যে, প্রায়ই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভারতের হাত আছে বা ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ হচ্ছে অথবা ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ বলে প্রচারণা চালায়। তাছাড়া এই সময় ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল বা বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র নামের কাল্পনিক একটি দেশের জন্ম দেয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এই কল্পিত ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল-এর মানচিত্র তৈরি করে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্র তা বিলি করত। এই ধরনের প্রচারণা থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সোনালী আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র পতাকার লাল সূর্যের মাঝে রাখার আমার এই প্রস্তাবে সবাই একমত হন।
পতাকার কাপড় কিনে তৈরি করতে পাঠান হয় কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, মনিরুল হক, হাসানুল হক ইনু ও শহীদ নজরুল ইসলামকে। এরা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো নামক দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিংয়ের পাক ফ্যাশন থেকে তৈরি করায়। যে দর্জি এই পতাকা তৈরি করেন তিনি ছিলেন অবাঙালি এবং ইতিবৃত্ত না জেনেই এই পতাকা তৈরি করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ঐ দর্জি পাকিস্তানে চলে যান। সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালী মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এই সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাস (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নং কক্ষে। তাঁর কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হল বাংলাদেশের মানচিত্র। সোনালী রং কিনে আনা হল। শিব নারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রঙ। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের নতুন পতাকার জন্ম হল।
তৃতীয় মাত্রা, চ্যানেল আই : ২৭.০৩.২০১১ আলোচনা অনুষ্ঠানে শাজাহান সিরাজ বলেন,
"পতাকা নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে, ১১৬ বা ১১৮ হয়তো, এখন ১১৬ হয়েছে; আমি আর রব ভাই ভাই থাকতাম ওখানে। এটা হয়তো সিরাজুল আলম খানের মাধ্যমেই এসেছে, কিন্তু এমনভাবে এসেছে যে আমি যে প্রস্তাব দিয়েছি সেটা সিরাজ ভাই আমাকে বলে দেয়নি, রব ভাইকে বলে দেয়নি। কাজী আরেফ হয়তো জানে, কিন্তু উনি বলে দেননি যে এইটা করতে হবে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমি প্রস্তাব দিয়েছি লাল সূর্য। রব ভাই প্রস্তাব দিয়েছে জমিন। এর আবার মধ্যস্থতা করে দিল আমাদের মার্শাল মনি। তারপর এক্সেপ্ট হয়ে গেল। আরেফ ভাই তখন আমার কাছে উদ্ভট মনে হওয়া একটা প্রস্তাব দিল। বাংলাদেশের, পূর্ব পাকস্তানের, একটা ম্যাপ দিতে হবে। আমি বললাম যে এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। সে বললো যে কারণ আছে। যে কোন আন্দোলনকে ভারতের সাথে ট্যাগ করা হয়। আমরা অন্য কোন অংশের স্বাধীনতা চাইনা। আমরা এই অংশের স্বাধীনতা চাই। বিশ্বাস করেন, সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম। এটা দশ বারজন যে জানতো না, তা না। তারা বাইরে ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলে জানতো। ইনু হয়তো কিছু জানতো। কিন্তু সিদ্ধান্তটা আমরা চার পাঁচজনই নিয়েছি। আজকে বলা হচ্ছে শিবনারায়ণ দাস না কী এটার সবকিছু। আমারা তো উনাকে ডেকে আনলাম এটা রেডি করার পরে। কাপড় এনে, খসরু ভাইকে দিয়ে দোকান থেকে কাপড় সেলাই করিয়ে যখন আমাদের কাছে আসলো তখন প্রশ্ন উঠলো যে আর্টিস্ট পাবো কোথায়। রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। স্বপন চৌধুরীকে দিয়ে তখন হল থেকে তাকে ঘুম থেকে টেনে নিয়ে আসা হল। সে এটা এঁকে দিল। হ্যাঁ, সেও আমাদের পার্ট, যেহেতু সে এঁকেছে। কিন্তু এটা নিয়েও অনেক খেলা খেলার চেষ্টা করা হয়েছে"।
সম্প্রতি এক অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে আসম আব্দুর রব লেখেন,
"ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইকবাল হল। ১১৬ নং কক্ষে থাকতাম। এ কক্ষে বসে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা বাঙ্গালির আর এক শ্রেষ্ঠ সন্তান সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে আমি, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পতাকা তৈরির পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ আঁকতে জানে না। সবাই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন সম্ভবত শাজাহান সিরাজ জানান, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাস ঢাকায় আছে। সে ভালো পোস্টার লেখে। সবাই আলোচনা করে পতাকার কাঠামো তৈরি করেন। মানচিত্র অংকন করেন শিবনারায়ণ দাস। নীলক্ষেতের নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স (বিহারি মালিক) পতাকা তৈরি করে দেন"।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্র নেতা আ.স.ম. আব্দুর রব। তিনি সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
৩রা মার্চ ঢাকাস্থ পল্টন ৯ -এ সর্বপ্রথম জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত করেন শাহজাহান সিরাজ।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩শে মার্চ ১৯৭১ সালে তাঁর ধানমন্ডিস্থ নিজ বাসভবনে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো -
অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম আব্দুর রব (২রা মার্চ) পক্ষান্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (২৩শে মার্চ)। এক্ষেত্রে কারো ভূমিকাকে ছোট করে দেখা উচিত নয়।
১৯৭১ সালের ১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশের বাইরে সর্বপ্রথম কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের প্রধান এম হোসেন আলী বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন।
১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটূয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পতাকার পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২ অনুযায়ী জাতীয় পতাকা মাপের সুনির্দিষ্ট বিবরণ নিম্নলিখিত:
জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকিবে।
লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যরে এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। পতাকার দৈর্ঘ্যের নয়-বিংশতিতম অংশ হতে অঙ্কিত উলম্ব রেখা এবং পতাকার প্রস্থের মধ্যবর্তী বিন্দু হতে অঙ্কিত আনুভূমিক রেখার পরস্পর ছেদ বিন্দুতে বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু হবে। অর্থাৎ পতাকার দৈর্ঘ্যের বিশ ভাগের বাম দিকের নয় ভাগের শেষ বিন্দুর ওপর অঙ্কিত লম্ব এবং প্রস্থের দিকে মাঝখান বরাবর অঙ্কিত সরল রেখার ছেদ বিন্দু হলো বৃত্তের কেন্দ্র।
পতাকার সবুজ পটভূমি হবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট গ্রীন এইচ-২ আর এস ৫০ পার্টস এবং লাল বৃত্তাকার অংশ হবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ এইচ-২ আর এস ৬০ পার্টস
পতাকা ব্যবহারের মাপ
ভবনে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো—
১০ বাই ৬ ফুট (৩.০ বাই ১.৮ মিটার)
৫ বাই ৩ ফুট (১.৫২ বাই ০.৯১ মিটার)
২.৫ বাই ১.৫ ফুট (৭৬০ বাই ৪৬০ মিলিমিটার)
মোটরগাড়িতে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপ হলো—
ক) ১৫ বাই ৯ ইঞ্চি (৩৮০ বাই ২৩০ মিলিমিটার) (বড় গাড়ীর জন্য)
খ) ১০ বাই ৬ ইঞ্চি (২৫০ বাই ১৫০ মিলিমিটার) (ছোট ও মাঝারি সাইজের গাড়ীর জন্য)
আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য টেবিল পতাকার মাপ হল— ১০ বাই ৬ ইঞ্চি (২৫০ বাই ১৫০ মিলিমিটার)
ব্যাখ্যা: পতাকার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট হলে প্রস্থ হবে ৬ ফুট, লাল বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে ২ ফুট, পতাকার দৈর্ঘ্যের সাড়ে ৪ ফুট ওপরে প্রস্থের মাঝ বরাবর অঙ্কিত আনুপাতিক রেখার ছেদ বিন্দু হবে লাল বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু।
সূত্রঃ বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা ১৯৭২
সিদ্ধান্তঃ
১) বাংলাদেশের পতাকা তৈরির পরিকল্পনাকারী 'স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস' এর কতিপয় নেতাকর্মিগণ যার মধ্যে মূল পরামর্শক হিসেবে ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ এবং মার্শাল মনি। পরামর্শকে অনুমোদন দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান।
২) বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সুষ্ঠু ডিজাইনকারী বা সুষ্ঠু রূপকার পটুয়া কামরুল হাসান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পতাকার সঠিক মাপ সঠিক রং এবং মাঝের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে একটি প্রমিত রূপ দিয়েছিলেন তিনি যেটা এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। কামরুল হাসানের অবদানকে স্বীকার করতেই হবে।
৩) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের ৪০৮ নং কক্ষে থাকতেন এনামুল হক যিনি হাসানুল হক ইনুর কাজিন ছিলেন। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ইউসুফ সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং হাসানুল হক ইনু ট্রেসিং পেপারে বাংলাদেশের মানচিত্র আকেন।
৪) শিব নারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রঙ। সুতরাং শিবনারায়ণ দাশ প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পতাকার প্রথম অঙ্কনকারী। কিন্তু বর্তমানে এই পতাকা নেই অর্থাৎ মাঝের মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
৫) সেই রাতেই নিউমার্কেট এলাকার বলাকা বিল্ডিংয়ের তিন তলার ছাত্রলীগ অফিসের পাশে নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সের টেইলার্স মাস্টার খালেক মোহাম্মদী (জাতিগতভাবে বিহারী) পতাকার নকশা বুঝে কাজ শুরু করেন। তারা ভোরের মধ্যেই কয়েকটি পতাকা তৈরি করে দেন।
১-৫ পর্যন্ত উল্লেখিত সকলেরই বাংলাদেশের পতাকা পরিকল্পনা, রূপায়ন, ডিজাইন এবং তৈরিকরণে ভূমিকা রয়েছে। কারো অবদানকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। শিবনারায়ণের দাশের সঙ্গে কামরুল হাসানের তুলনা করাটাও লজ্জাজনক, উভয়ের অবদানকেই স্বীকার করতে হবে। আশা করি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিভিন্ন ব্লগে ও সাইটে লেখা বিভ্রান্তিমূলক বা পক্ষপাতিত্বমূলক লেখা থেকে সরে এসে সকলে আমার এই নির্মোহ বিশ্লেষণভিত্তিক লেখার সঙ্গে একমত হবেন। সকলকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ৭:০১