রনজিৎ বাবু তাঁহার দাওয়াখানায় বসিয়া দূরদর্শনে সংবাদপাঠ দেখিতেছিলেন।বিবিধ কারনে সংবাদ পাঠে তিনি পূর্ণ মনসংযোগ ঘঠাইতে পারিতেছিলেননা।তথাপি, তাঁহার কর্ণকুহরে যখন ‘চিকিৎসক’, ‘রক্তচোষা’, ‘অমানুষ’ ইত্যকার শব্দাবলী প্রবেশ করিল, তিনি নড়িয়াচড়িয়া বসিলেন। তিনি দেখিলেন ‘মানবাধিকার কমিশন’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা উপরোক্ত শব্দাবলীযোগে চিকিৎসক সমাজের বিরুদ্ধে বিষোৎগার করিতেছেন।এইরুপ একজন ব্যাক্তির মুখ হইতে যে এইরকম খিস্তিখেউড় কিরুপে নিঃসৃত হইতে পারে, তাহা ভাবিয়া তিনি কিয়ৎকাল বাকরুদ্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। তিনি নিজে পেশায় একজন চিকিৎসক, বিধায় ঐসমস্ত শব্দবিষ্ঠা যেন সরাসরি আসিয়া তাঁহার গাত্রে আঘাত করিতে লাগিল।তাঁহার গাত্রদাহ চরমে পৌঁছিল যখন তিনি দেখিলেন, একটি চিকিৎসালয়ের পয়োঃনিষ্কাশণ ব্যাবস্থার দূরঃবস্থার জন্যও তিনি চিকিৎসকদিগকে দোষারোপ করিতে লাগিলেন। এহেন গন্ডমূর্খ, যাহার একটি চিকিৎসালয়ের প্রশাসনিক ব্যাবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নাই, তিনি কি করিয়া ‘মানবাধিকার কমিশন’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা হইয়া বসিলেন, এই ভাবিয়া তিনি চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। স্ত্রী কাননবালা এক পেয়ালা চা আনিয়া তাঁহার সম্মুখস্থ তেপায়ার উপর রাখিয়া বলিলেন, তোমাকে এমন লাগিতেছে কেন? শরীর খারাপ করে নাই তো? রনজিৎ বাবু কোন সাড়া না দিয়া স্থানুবৎ বসিয়া রহিলেন।এইরুপে কিছু সময় অতিবাহিত হইলে তিনি চাকর পরেশকে ডাকিয়া কহিলেন, গাড়ি বাহির কর, চেম্বারে যাইবার সময় হইয়াছে।
চেম্বারে আসিয়া তিনি কিছুতেই চিকিৎসাকর্মে মনসংযোগ করিতে পারিলেন না।‘চিকিৎসক’, ‘রক্তচোষা’, ‘অমানুষ’ বিবিধ শব্দসমূহ তাঁহার কর্ণকুহরে কলের গানের ন্যায় বাজিতে থাকিল।বিষাক্ত তীরের ন্যায় এইগুলো তাঁহার বক্ষপিঞ্জরে আঘাত করিতে লাগিল। চেম্বার শেষ করিয়া যখন তিনি নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন, কাননবালা তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া আঁৎকিয়া উঠিলেন। পরম মমতায় তিনি স্বামীর হস্তদুখানি ধরিয়া তাঁহাকে দাওয়ায় পিঁড়িতে বসাইলেন। স্বামীর কেশাভ্যন্তরে অংগুলি চালনা করিতে করিতে তিনি বলিলেন, কি হইয়াছে তোমার? তোমার মুখ্খানি আজ বড্ড শুকনা দেখাইতেছে।রনজিৎ বাবু কহিলেন, তোমার পিতা যে আমার নিকটে তোমাকে সম্প্রদান করিয়াছেন, তখন যদি তিনি জানিতেন যে আমি একটা অমানুষ, গরীবের রক্ত চুষিয়া খাই, তাহাহইলে কি তিনি তাহা করিতেন? কাননবালা বলিলেন, এইসব তুমি কি বলিতেছ, আমি তো কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।যেন কিছুই রনজিৎ বাবুর শ্রুতিগোচর হয়নাই, এইরুপে তিনি বলিতে থাকিলেন, এই যে ধর আমার বন্ধু কেশব রায় তাঁহার পুত্র নিখিলেশকে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি করাইয়া দিয়া আসিল, তাহা কিজন্য? সে যদি জানিত যে পাঁচটি বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়া, মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া, হাজারো রকম পরীক্ষায় পাস দিয়া ঐখান হইতে ফিবছর একদল অমানুষ আর রক্তচোষা বাহির হইতেছে, তাহা হইলে কি সে তাহার আদরের সন্তানকে ঐ অমানুষ তৈরীর কারখানায় দিয়া আসিত? এই যে চেম্বারে এত এত রুগী প্রতিদিন আমার নিকটে আসে চিকিৎসালাভের উদ্দেশ্যে, তাহারা যদি জানিতে পারে যে এই লোকটি একটা অমানুষ, তাহা হইলে তাহারা কি করিবে, কোথায় যাইবে? বলিতে বলিতে রনজিৎ বাবুর আঁখিযুগল অশ্রুরুদ্ধ হইয়া আসিল। তিনি কাননবালাকে জড়াইয়া ধরিয়া শিশুর ন্যায় হাউ মাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।কাননবালা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া স্বামীর বক্ষে মস্তক স্থাপন করিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। তিনি এইটুকু বুঝিতে পারিলেন যে, নিদারুন এক কষ্টের স্রোত তাঁহার স্বামীর হৃদয়মাঝে বাহিত হইয়া চলিয়াছে।
পরদিন প্রাতে রনজিৎ বাবু হাসপাতালে যাইবার উদ্দেশ্যে বাহির হইতেছিলেন, এমতাবস্থায় প্রতিবেশী নরেন আসিয়া তাঁহার পদযুগলে আছড়াইয়া পড়িয়া বিলাপ করিতে লাগিল, ডাক্তারবাবু আমার কেষ্টকে বাঁচান, কেষ্ট যে আর বাঁচেনা ডাক্তারবাবু, আমার কেষ্ট গাড়িচাপা পড়িয়াছে ডাক্তারবাবু।রনজিৎ বাবু নরেনকে দুই হাতে ধরিয়া উঠাইয়া কহিলেন, একটু শান্ত হও নরেন, কি হইয়াছে খুলিয়া বল দেখি। নরেন হাউ মাউ করিয়া কাঁদিয়া বলিতে থাকিল, আমার কেষ্ট হাসপাতালে ডাক্তার বাবু, আপনি একটু চলেন ডাক্তারবাবু।রনজিৎ বাবু আর কালক্ষেপন না করিয়া নরেনকে লইয়া হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হইলেন।
ঠাকুরপুর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ডাক্তার কমলেশ কেষ্টকে চিকিৎসা প্রদান করিতেছিলেন। রনজিৎ বাবু চিকিৎসাকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ক্ষতবিক্ষত দেহ লইয়া কেষ্ট বিছানায় পড়িয়া রহিয়াছে। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারনে তাহাকে বড্ড ফ্যাকাসে দেখাইতেছে।কমলেশ রনজিৎ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, স্যার, উহার প্রচুর রক্তক্ষরণ হইয়াছে, এক্ষনি রক্ত দেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু বি নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যাইতেছেনা। রনজিৎ বাবু কহিলেন, আমারও তো বি নেগেটিভ রক্ত, ক্রচম্যাচিং করিয়া দেখ। ক্রচম্যাচিং শেষে রনজিৎ বাবুর এক ব্যাগ রক্ত কেষ্টর শরীরে দিয়া উহাকে শল্যকক্ষে নেওয়া হইল। হাসপাতাল শেষ করিয়া রনজিৎ বাবু ভাবিলেন, কেষ্টকে একবার দেখিয়া যাইবেন। তিনি শল্য বিভাগে গিয়া দেখিলেন কেষ্টর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হইয়াছে, নাড়ির গতি ও রক্তচাপ প্রায় স্বাভাবিক হইয়া আসিয়াছে।তিনি শল্যবিভাগের চিকিৎসক ডাক্তার পরিমলকে কেষ্টর দিকে খেয়াল রাখিতে বলিয়া এক ধরনের আত্নতৃপ্তি নিয়া গৃহের উদ্দেশ্যে রওনা হইলেন।
মধ্যাহ্নভোজ সমাপনান্তে রনজিৎ বাবু প্রাত্যহিক অভ্যাসমত দূরদর্শনে সংবাদপাঠ দেখিতে বসিলেন।হঠাৎ একটি সংবাদ তাঁহার মনযোগ আকর্ষন করিল। তিনি দেখিলেন একজন স্বঘোষিত খুনি, যে কিনা প্রতিপক্ষের এক ব্যক্তিকে কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া নদীতে ভাসাইয়া দিয়াছিল, রাষ্ট্রপতি মহোদয় তাহার মৃত্যুদন্ড ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন। রনজিৎ বাবু বিমর্ষ চিত্তে ভাবিতে লাগিলেন, ইহা কি হইল? খুনী সরকারী দলের লোক বলিয়াই কি উহার দন্ড মওকুফ করিয়া দেওয়া হইল? তাহা হইলে মানুষ কাহার কাছে বিচার চাইবে, কি ভরসায়ই বা চাইবে? রনজিৎ বাবু উঠিয়া স্নানঘরে প্রবেশ করিলেন। স্নানঘরের আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মুখ হা করিয়া তিনি নিজের দন্তপাটি দেখিতে লাগিলেন।তিনি ছবিতে দেখিয়াছেন ভ্যাম্পায়াররা মানুষের রক্ত চুষিয়া খায়।রক্তনালী ছিদ্র করিবার জন্য উহাদের দন্তপাটিতে লম্বা, সূতীক্ষ্ণ এক প্রকারের দাঁত থাকে। তিনি সুচারুরুপে পরীক্ষা করিয়া করিয়া দেখিলেন, তাঁহার ঐরুপ কোন দন্ত রহিয়াছে কিনা। একসময় তিনি বুঝিতে পারিলেন, প্রকৃত রক্তচোষা কাহারা? ভ্যাম্পায়ারের ন্যায় ঐরুপ দন্ত তিনি দেখিয়াছেন ঐসব রক্তচোষার মুখে, তবে তাহারা ভ্যাম্পায়ারের মতই অনেক উপর দিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে।