নিরব পাঠক হয়ে পড়ছি উর্বশীর লেখা বইখানা। ছাপার অক্ষরে এই প্রথম তার বই। অল্প সময়ের মাঝে সমালোচনায় বইটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নবীন লেখিকাকে অভিনন্দন জানাতে বই মেলাতেই পাঁচটি বছর পর তার সাথে দেখা করলাম। চিনতে পারেনি আমাকে। না চিনারই কথা দাঁড়ি গোঁফ কিছুটা কামিয়ে নিলে হয়তো চিনতে পারতো। পাঠকদের কাছে আমি আগুন্তুক মনে হলেও তার লেখা বইয়ের একটি বড় চরিত্র।
‘‘শোভার মৃত্যু’’ বইটির নাম। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লীলাবতীর মৃত্যু বইটির ‘‘লীলাবতীর মৃত্যু’’ লেখাটির অন্যপ্রাণ ‘‘শোভার মৃত্যু’’। শোভা আমার মেয়ে। ভালবাসার গভীরতা মাপতে গিয়ে উর্বশীকে যৌন সম্পর্কে লুব্ধ করি। অনিরাপদ সঙ্গমের ফলে তার গর্ভে জীবন্ত হয়ে উঠে আমার ভ্রুণ। ধীরে ধীরে মানবশিশুটি লেখিকার অজ্ঞাত অবস্থায় বেড়ে উঠে। লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় তার শারীরিক পরিবর্তনে। খাওয়ায় অরুচি, অবসাদ, বমি ভাব, পেট ফোলা। উর্বশী বিষয়টি জানতে পেরে আমাকে জানালো। আমি তাকে আশ্বস্ত রেখে নিজে অনেক ভাবনার পড়ে গেলাম। আমার পাপের ফল যদি সত্যিই তার গর্ভে বেড়ে উঠে তাহলে নিশ্চয়ই বিপদের কথা। জানাজানি হলে হয়তো ভদ্র মুখোশটা একেবারে মাটির সাথে পঁচে গলে মিশে যাবে।
ইন্টারনেট থেকে একজন চিকিৎসকের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে তাকে কল করি। সিনটমগুল সম্পর্কে ডাক্তার নিশ্চিত করে বলে দিলেন, সে গর্ভবতী। বাজারের আধুনিক লেডি চেকার দিয়ে ইউরিন পরীক্ষা করে উর্বশী নিশ্চিত হলো আমিই এর হবু বাবা। লেখিকা হলেও সে ছিল বড় অধের্যশীল! বাচ্চা পেটে এসেছে জানতে পেরে সে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাকে অধৈর্য করে তুলল বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। ‘‘কী করতে হবে এখন? হায় ভগবান এখন কী হবে? বাসায় জানতে পারলে আমি শেষ? আমার পিরিয়ডস বন্ধ হয়ে গেছে আম্মু বুঝতে পেরেছে’’– এমন আরো অমূলক কথা বলতে বলতে আমাকে দোষী করে তুলতো। ‘‘শুধু তোর জন্য; তোর প্রতি ভালবাসা প্রমাণ করতে গিয়েই আজকে এই অবস্থা; আমি জানি না এই বাচ্চা কী করবি! হয় এখনি আমাকে তোর বাসায় নিয়ে উঠা নয়তো পৃথিবী থেকে উঠিয়ে দে।’’ রাগে গজগজ করে উঠে আমার শরীর। প্রায়শ্চিত্ত আর কত করতে হবে। যা সব কথা আমাকে শোনাচ্ছে তার চেয়ে বড় প্রায়শ্চিত্ত আর কী আছে! তাছাড়া দিন-রাত আমি ভেবেই মরছি এখন এর পরিণতি কী হবে? আগের মতো উর্বশীকে আর ভাল লাগে না, ভালবাসতে ইচ্ছে করে না। সতী প্রমাণ পাওয়ার পরও মনে আনন্দ না জেগে ইদানিং খুব বিরক্তি লাগতো। পানির কল ছেড়ে যখন সেটাকে আঙ্গুল দিয়ে চেপে গতি রোধ করার চেষ্টা কর হয়, তখন সেটা আরো গতিশীল হয়ে ছুটতে চায়৷ আমি উর্বশীকে ছেড়ে তেমন বেগেই ছুটতে চাচ্ছি। আমার গতিশীলতা আটকে রেখেছে তার গর্ভের প্রাণ পাওয়া মাংস খন্ডটি।
অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার মাস আড়াই পর অ্যাবর্শন করানোর সিদ্ধান্ত নেই। উর্বশী অনেক কান্নাকাটি করলো, ‘‘অন্য কোন উপায় নেই?’’ আমি বরাবর বলে দিয়েছি, ‘‘আর একটু আগে জানতে পারলে অন্য উপায়ে করা যেত। এখন এটাই শেষ উপায়।’’ ‘‘একটা ফুটফুটে তুলোর মতো বাচ্চাকে এভাবে মেরে ফেলব? আচ্ছা বলো না ও কী ছেলে না মেয়ে?’’ আমি বললাম, ‘‘জানি না।’’ ‘‘প্লিজ ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখবে একটু।’’
‘‘আল্ট্রাসাউন্ড করে বোঝার উপায় নেই।’’
উর্বশী অন্তঃসত্ত্বা জানার পরই সহসা যেন পাল্টে যেতে লাগল। নির্ঘুম থেকে থেকে চোখের নিচে ছাইরঙা প্রলেপ তৈরি করে ফেলেছে। আমার সাথে দেখা হলেও তাকে উন্মনা লাগত। দেখা করাও কমিয়ে দেয়। অ্যাবর্শন করানোর এক সপ্তাহে আগে যেদিন আমাদের দেখা হয় সেদিন তার চোখ দুটো জলে কেমম ছলছল করছিল। বুঝি উত্তাল ঘূর্ণিঝড় এখনি নিজ সৃষ্টিস্থল ছেড়ে উপকূলে ছড়িয়ে পড়বে। আমার শার্ট দুই মুঠে চেপে ধরে বুকের মাঝে ছলছল জলের ঝরনায় আমার শার্ট ভিজিয়ে দিল। তারপর তার মুখখানি আলতো করে আগলে ধরে বললাম, কী হয়েছে। কান্নার রেশ থামার উপক্রম না করেই বলল, জানো আজ স্বপ্নে দেখলাম আমার গর্ভে একটি ফুটফুটে মেয়ে। ভোরের স্বপ্ন নাকি মিথ্যে হয়; না? আমি সান্ত্বনার স্বরে বললাম, ওসব কুসংস্কার। ভুলে যাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।
স্বপ্নে উর্বশীর মেয়ে হবে জানার পর থেকেই সে বলেই চলছে ‘‘মেয়ে! আচ্ছা বাচ্চাটা নষ্ট করার কী দরকার? প্লিজ তোমার বাসায় বোঝাও। তেমার বাবা মাকে নিয়ে এলেইতো আমার বাবা-মা মানবে।’’ আমি জানতাম ক্যারিয়ার গড়ার আগে কখনোই বাবা-মাকে জানাতে পারব না। সেই মুখ আমার নেই। কারণ পরিবারে ছিল না তেমন স্বচ্ছলতা। আমি অনেকভাবে রাজি করিয়ে তাকে অ্যাবর্শনে পাঠাই। অ্যাবর্শন শেষ হলে সে আমাকে বলল, ‘‘আমার মেয়েকে দেখেছি। এখন টুকরো কিছু মাংসপিণ্ড হয়ে গেছে। জানো আমি মনে মনে ওর নাম রেখেছিলাম শোভা।’’ আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অবশেষে চিন্তার অবসান, তবে সত্যি বলতে কিছুটা মায়াও লাগছিল উর্বশীর জন্য।
তারপর উর্বশী নিজ থেকেই ধীরে ধীরে আমার জীবন থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। প্রায়শই সে নাকি স্বপ্নে সেই শোভার ছায়া দেখতো। শোভার চেহারা শুধুই মলিন হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকতো।
জীবনের তাগিদে চলে যাই চট্রগ্রাম। চিত্রশিল্পী, ভাস্কর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলি। জীবনে না না দৃষ্টিভঙ্গি, কল্পনা মিশিয়ে দেখাই যেন শিল্পীর স্বার্থকতা। হঠাৎ গতিশীল জীবনে এক মধ্য রাতে স্বপ্নে শোভার অবয়ব দেখে আমার ঘুম গেল। ততদিনে উর্বশীকে প্রায়ই ভুলতে বসেছিলাম। মস্তিষ্ক থেকে শোভা নামটাও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। উর্বশীর বলা স্বপ্নই যে অবিকল দেখলাম তাতে লেশমাত্র সন্দেহ নেই।
এইতো এই বইমেলার প্রারম্ভেই ঢাকা এসেছি। বইমেলায় অনেক বিশেষ মানুষেরই যাতায়াত থাকে। তবে এবারের বইমেলায় আলোচিত উর্বশী রায়ের নামটা আমি শিল্পকলা একাডেমিতে বিশেষ কাজে না আসলে জানতে পারতাম না। সহকর্মীর মুখ বলেই ফেলল, চলুন না দাদা। যাওয়াই যাক। শুনলাম এবার উর্বশী রায় বেস্ট-সেলার রাইটার, তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। চলুন নবীন লেখিকাকে আজকে গেলে দেখে আসা যাবে। লেখিকার নাম যদি উর্বশী রায় না হতো, তাহলে হয়তো আমার যাওয়াই হতো না। কারণ এই নামে জড়িয়ে আছে আমার নিগূঢ় অতীত। শিল্পকলা থেকে আর বইমেলার দুরত্বই বা কত। যাওয়াই যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। সহকর্মীর সাথে চলে যাওয়া।
ভীড় ঠেলে বই মেলায় ঢুকেই উর্বশী রায়ের প্রকাশনী স্টল খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে যখন সূর্য লুকাবার সময় তখন তার স্টলটি খুঁজে পেলাম। একটি বই হাতে নিয়ে তার লেখা ছুইয়ে দেখলাম। পাঠকরা তারপর তো জানেন নিশ্চয়ই। লেখিকাকে অভিনন্দন জানানো। ভাস্কর হিসেবে একটি শুভেচ্ছা কপি পেয়ে আবার পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম। লেখক পরিচিতিতে চোখ বুললাম। লেখিকার নামের পরেই তার স্বামীর নাম। অর্থাৎ সে বিবাহিতা? তবুও কেন আমার জীবন নিয়ে গল্প বুনেছে? আগ্রহ শতগুণ বেড়ে যেতে লাগলো। আমি লেখিকাকে স্টলের ভিতর থেকে ডেকে আনলাম। তারপর তার চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘‘অবশেষে শোভার খুনির শাস্তি কী দিলেন?’’
লেখিকা মুচকি হেসে বলল, ‘‘কখনো তার সাথে আগে মুখোমুখি তো হই?’’
আমি দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, ‘‘হ্যাঁ আমি শাস্তির জন্য প্রস্তুত।’’
‘‘আমার প্রাণ আজ নিস্তেজ। শাস্তি দেয়ার মতো মনোবল নেই। ভাস্কর তো নিপুণ হাতে ভাস্কর্য তৈরি করেন। আজকে পাঁচ বছর পর শোভা দেখতে কেমন হতো একটি ভাস্কর্য তৈরি করে দেখাতে পারবেন?’’
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৫০