আজ আকাশে তাকিয়ে উড়তে মন চাচ্ছে। যেন কোন বাধা নেই। শিশিরজলের সাথে সূর্যের আলো মিশে চকচক করছে রস্তার দুপাশের ঘাস। এই মাঘের আকাশে কে আবার ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ায়।
চারপাশে কারা এত হৈ-হুল্লর করছে? কান পেতে শুনতে হবে। দুটো বাচ্চা ছেলে বাজারের দিকে যাচ্ছে। একজন বলছে, ‘‘আইজকা আমার স্বাধীন। আমাগো বিজয় অইছে।’’
আরেকটা বাচ্চা বলছে, ‘‘আইচ্ছা স্বাধীন হেইডা আবার কিরে? আর বিজয় মানে কী?’’
‘‘স্বাধীন অইল গিয়া আজকে আমাগো যুদ্ধ শেস। আর বিজয় মানে হইল যারা ভয় না পাইয়া সব করতে পারে।’’
‘‘তাইলে আমরাও কি বিজয় রে?’’
‘‘হঁ। আমরা বিজয়। আমাগোও তো ভয় নাই।’’
বাচ্চা ছেলে দুটির কথা অস্পষ্ট হতে লাগল। তারা বেশ দূরে চলে গিয়েছে।
আবার একটু পর একদল বালক গায়ের জামা খুলে হাত নিয়ে উড়িয়ে হৈ-হৈ করে দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে— ‘‘বিজয় আমাগো বিজয়!’’ কথাটা আমার বুকে ভিতরে শিহরিত করে দিল। শরীরের সমস্ত লেম দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। চোখের কোণে পানি আসতে গিয়েও আটকে গেল। তাহলে সত্যিই কি আমাদের বিজয় হল–নাকি আবার ভুয়া কোন খবর।
আকাশে এখন একটি থেকে দুটি ঘুড়ি। ঘুড়ি দুটই পলিথিনের। একটা লাল পলিথিনের আরেকটা নীল পলিথিনের। ঘুড়ি উড়ছে আর ঘুড়ির বিশাল লেজগুল স্বাধীনভাবে সরীসৃপের মত এঁকেবেঁকে বাতাসে দুলছে অবিরাম। রাস্তার পাশের আম গাছটায় মুকুল ফুটেছে।
একজন কিশোরী রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বিষণ্ণ মনে আম গাছের মুকুলগুলর দিকে কয়েকবার অন্যমনস্ক অবস্থায় তাকাল। এমন সময় মেয়েটাকে পিছন থেকে ডাক দিল, ‘‘সালমা! সালমা! মা আমি আইয়া পড়ছি। আমি গাজী মা।’’ বলতে বলতে লোকটির দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল চোখের জমাট অশ্রুতে।
লোকটির মাথায় লাল গামছা বাধা, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলানো, সেন্টু গেঞ্জি পরা। এত শীতের মাঝেও তার কালো বাহু থেকে গরগর করে ঘাম পড়ছে। সালমা নামের মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে জরিয়ে ধরে বলল, ‘‘বাবা তুমি ফিরা আইছ।’’ মেয়েটার চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছে নিশ্চই তা আনন্দের কান্না, বাবাকে ফিরে পাওয়ার কান্না। হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত এটা সুখের কান্না। মাঝে মাঝে খুব আনন্দে আমিও ঠিক এমনভাবে কাঁদি। বাবা-মেয়ে ধরাধরি করে বাড়ির দিকে চলে গেল।
রাস্তার পাশে খালটা পেরিয়ে সর্ষেগুল উত্তরা বাতাসে এমনভাবে দোলা দিয়ে উঠল যেন হলুদের ঢেউ খেলছে। আমগাছ থেকে কয়েকটা মুকুল বাতাসের ঝাপটায় নিঃশব্দে ঝড়ে গেল।
দূর থেকে দেখা গেল তিনজন লোক একটা কাপড়ে দুলিয়ে দুলিয়ে কি যেন নিয়ে আসছে। সামনে আসতেই বোঝা গেল একটা মানুষকে কাপড়ে রেখে তার দুই মাথায় দুইজন আর মাঝখানে একজন হাঁপাতে হাঁপাতে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষটার সম্ভবত চেতনা জ্ঞান নেই, হয়তবা মৃত। তার পিছনে একজন মহিলা শাড়ীর আচলকে মাথায় পেঁচিয়ে তার এক কোণায় কামড় দিয়ে ধরে রেখে কান্না করতে করতে ছুটছে।
আমি আরেকটু ভাল মত দেখার চেষ্টা করলাম এই পথ দিয়ে আর কেউ আসছে কিনা। দেখলাম চার-পাঁচজন জেলে লুঙ্গি গোছা দিয়ে মাথায় বড় ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে যাচ্ছে।
পিছনের একজন জেলে সামনের জেলেকে বলল, ‘‘হুনলাম আজকে নাকি ঐ শালা পাকিস্থাইন্নারা আত্মসমর্পণ করছে আমাগো দেশের যৌথবাহিনীগো কাছে।’’
সামনের জেলেটে বলছে, ‘‘হঁ ভাই। আজকে থেইক্কা আমাগো উপর আর নির্চাতন চলব না। কত ভয়ে ভয়ে, খারাপ অবস্থায় ছিলাম এই কয়ডা মাস।পোলাপাইনগুলা ইস্কুলেও যাইতে পারে নাই। আমাগোও না খাইয়া মরার অবস্থা অইছিল। দ্যাশের ভিত্রে কি যে একটা আতঙ্ক শুরু অইছিল। মাইনষে বাইচ্চাও মইরা আছিল এতদিন। আর কতজনতো অ্যার ভিত্রে মরছেই খালি খালি।’’
পিছনের জেলেটা বলে উঠল, ‘‘যাক! আমাগো বিজয় অইল।’’
আমি কান খাড়া করে শুনছিলাম। আমার শান্তি হতে লাগল তাহলে দেশটা স্বাধীন হল।
আরেকটা শহরের শিক্ষিত ছেলের ভাব-বেশের মতই একজনকে দেখা গেল সাথে গ্রাম্য বেশের আরেক যুবক। শহুরে ছেলেটি তাকে বলছে, ‘‘রেসকোর্স ময়দান আমাদের বাসা থেকে একটু সামনে ওখানেই আজকে আত্মসমর্পণ লিপিতে স্বাক্ষর করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। আজকে ১৬ ডিসেম্বরকে দেখিস একদিন বিজয় দিবস পালিত হবে।’’ তারপর গ্রাম্য ছেলেটা বলল, ‘‘ঝামেলাতো শেস তাহলেতো তোরা ঢাকা যাইতে পারবি। এখন আর কোন চিন্তা নাই।’’ শহরের ছেলেটা বলছে, আফসস আম্মুর জন্য যুদ্ধে যেতে পারিনি। প্রাণটা গেলেওতো মানুষ জানত দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছি। ছেলেগুল অনেকদূরে চলে গেল।
একদল ন্যাংটা ছেলেপুলে দৌড়ে এসে খালের পানিতে ঝাপ দিল। হৈ-হুল্লর করতে করতে তারা কচুরিপানার সামনে এসে পড়ল। একি! একজন চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘‘আব্বারে ডাক দে তাড়াতাড়ি! এই কস্তুরির ভিতরে একটা মরা মানুষ। তারপর লোকজন ভিড় হতে লাগল। রাস্তার পাশের আমগাছটার ঠিক নিচে খাল। সেখানে বড় বড় কচুরির নিচে আমার দেহটা ছিল। শুধু মাথাটা কচুরির মাঝের ফাঁকে ভেসে ছিল আর বাকি শরীর কচুরির নিচে। আমার মরা দেহটা তুলে নিয়ে এল। কেউ নাক চেপে আছে, কেউ বলছে–ও নিশ্চই মুক্তিযোদ্ধা। কবে হয়ত মেরে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে মিলিটারিরা।
এখন আমাকেও তারা এই রাস্তা দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে? আমি এই খালেই ভেসে থাকতে চাই। রাস্তাদিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলর মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাই। খোলা আকাশে ঘুড়ি উড়ার দৃশ্য দেখতে খুব বেশি পছন্দ করি। আর ঐ মিষ্টি আমের মুকুলের গন্ধ, গাছের পাতার স্বাধীন দোলা। আর কখন যে আবার আরেক বাবা এসে তার সন্তানকে এই রাস্তায় জড়িয়ে ধরে বলে, আমি ফিরে এসেছি বাবা। আমি সব লুকিয়ে খালে কচুরির আড়াল থেকে দেখব। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা–আমিতো এখানেই থাকতে চাই।
আমায় বাড়ির উঠনে রাখা হল, চেহারাগুল সব পরিচিত। সবাই কান্নায় লুটে পড়ছে। আস্তে আস্তে চিনতে পারলাম– একজন আমার মা, একজন আমার বোন, একজন আমার বাবা, একজন আমার ভাই।
------
বিজয় আমাগো বিজয় (ফিকশন গল্প)
লেখাটি ১৭-এর বিজয় দিবসে লিখেছিলাম। আজকেই প্রথম প্রকাশ।
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:১০