আমি দীর্ঘদিন ধরে কিছু শারীরিক সমস্যায় ভুগছি। ব্যক্তিগতভাবে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা পছন্দ করি না। দীর্ঘমেয়াদি হলেও হোমিওপ্যাথিতে ফললাভ করেছি। তাই হোমিওপ্যাথিই আমার কাছে বেস্ট। গত একবছর ধরে এক মাস পরপর ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঔষধ আনতে হয়। গত ১২ তারিখ দুপুরে যাত্রাবাড়ী মিরহাজিরবাগ মাদ্রাসা রোডে আমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে ঔষধ নিয়ে বের হই। ঠিক একটু এগোতেই শুনতে পেলাম ‘‘আল্লাহ–আল্লাহ–আল্লাহ’’ প্রথমেতো ভেবেছিলাম কোন মসজিদে জিকির হচ্ছে। পরে ভাবনার ছেদ কাটল। এক স্বরে জিকির এই জোহরের সময়? সামনে তাকিয়েই দেখি এক প্রতিবন্দি মহিলা বয়স আনুমানিক ২৫, গলায় সাউন্ড সিস্টেম আর মাথার সাথে হেডফোনের মাউথ গাল বরাবর মুখের উপরে। তাহলে এই জিকিরের উৎস ছিল।
মাথায় তখনি ভাবনারা গোলাগুলি শুরু করল, এই মহিলা তার কতটা ক্রিয়েটিভ চিন্তা। হাঁটছেতো, বলতেও পারছে, সমস্যা হয়ত পায়ে লাঠি ভর দিয়ে খুরিয়ে হাঁটছে। চোখের সান্ডগ্লাসটা ভাল মত পর্যবেক্ষণ করলাম। না যদি অন্ধ হত তাহলে রাস্তা চিনে হাঁটতে পারত না। সবশেষে বোঝা গেল শুধু মাত্র পায়েরই সমস্যা। মেয়ের বাবা-মা নেই? স্বামী নেই? ধূর, থাক বা না থাক। তবে ভিক্ষাবৃত্তি কেন? ঠিক এই মহিলার চেয়ে খারাপ অবস্থা আমাদের বাড়িওয়ালাদের কাজের মহিলার। ডান পায়ের হাঁটুতে হাত দিয়ে ধরে প্রায় নিচু হয়ে হাঁটে, স্বামী খেতে দেয় না, বাবা-মা গ্রামে। জেনেছি কাজ করে বাবা-মাকেও টাকা পাঠায়। কই–সেতো এর মত ভিক্ষা করে না।
মাস কয়েক আগে আমাদের এলাকার নতুন মুখের এক ভিক্ষুকের দেখা মিললো। ছাতা মাথায় গলির মুখ থেকে একটু আগে বসে থাকে সকাল থেকে রাত। এরতো কোন সমস্যা নেই, শুধুমাত্র বার্ধক্য ছেয়েছে শরীরে। বয়সতো আমার দাদার থেকে অনেক কম হবে। দাদা গত আড়াই মাস আগে ঢাকার ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। দাদার বয়স পূর্ণ হয়েছিল আশিতে। দুইবার হার্ট স্ট্রোক করে, দুইবার ব্রেইন। চোখের কার্যক্ষমতা প্রায় লোপ পেয়েছিল। প্রথম ব্রেইন স্ট্রোকে শরীরের বা পাশ খানিকটা কার্যক্ষমহীন হয়ে যায়। সাথে স্মৃতিশক্তির অনেকটা হেম্পার হয়। মৃত্যুর দুইমাস আগেও প্রতিদিন সকালে ২ কিলো হেঁটে যেতেন আবার ২ কিলো হেঁটে আসতেন। পথ হারিয়ে যেত মাঝেমাঝে। পুকুরে জাল ফেলে মাস সেঁচে খেত। নিজের কাজ নিজে করত। তিনি যদি এই বয়সে এই পরিস্থিতিতে এতটুক পরিশ্রম করতে পারে তবে কেন এলাকার ভিক্ষুকটি অন্যকিছু করতে পারবে না! কেন ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তিতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কারণ এদেশে তাদের কর্মসুযোগ দেয়া হয় না। অনেক বুড়ো দেখেছি রিক্সা চালিয়ে খায়, স্যালুট তাদের।
আজকাল মিডিয়ার প্রতিবেদনে দেখা যায় ভিক্ষুকদের নাকি প্রশিক্ষণ করিয়ে ভিক্ষুক সংঘ থেকে তাদের ভিক্ষার এলাকা নির্ধারিত করে দেয়া হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় ভিক্ষুককে নিয়ে। বাড্ডায় যে ভিক্ষুক ৫ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দেয়। তার প্রতিদিন বাহন খরচ ১২০ টাকা, রিক্সা ভাড়া। শুধু মাত্র ভিক্ষার স্থানে আসতে আর যেতে। তার মাসিক খরচ ২০ হাজার টাকা আর যার সম্পূর্ণটাই ভিক্ষা হতে উপার্জিত। বিভিন্ন প্রতিবদনে ও পরিসংখ্যানে উল্লেখ্য আছে বাংলাদেশে ভিক্ষা করে যা উপার্জন হয় তাতে দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষেরও এক তৃতীয়াংশ উপার্জন হয় না। বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যানে দেশে এখনো ১২ লাখেরও বেশি ভিক্ষুক রয়েছে বলে জানা যায়। তবে প্রকৃত হিসেব নেই। অথচ দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখেরও বেশি।
ভিক্ষার অন্তরালে বাণিজ্য করছে কিছু শ্রেণীর লোক। এদিকে প্রকৃত ভিক্ষুক লাঞ্চনা হচ্ছে আরেক সংঘের লোকেদের কাছে। সোনার বাংলার দেশে এ রকম অরাজকতা চলছেই। শিক্ষা কী ভিক্ষার কথা বলে? আমাদের উচিৎ শারীরিক সমর্থযোগ্যদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের কর্মমুখী করা। উচিত সামাজিক সংস্থাগুলকে এগিয়ে আসা, সাথে সরকারেরও নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া। ভিক্ষুক মুক্ত দেশে হলেই না, তবে হবে সোনার বাংলা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:৪৮