অন্যরকম ঈদ
মজিদ ৮ রাকাত নফল নামাজ মানত করে ছিল । কিন্তু খুশিতে সে ১২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে ফেলল । সে একটু পরপরই আপন মনে " আলহামদুলিল্লাহ্ - আলহামদুলিল্লাহ্ " বলে উঠছে । খুশি খুশি মুখ নিয়ে সে সবাইকে সালাম দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে তার বাসার দিকে । মজিদের এত আনন্দের কারণ, আজ ঈদের চাঁদ দেখা যায় নাই , মানে কাল ঈদ হচ্ছে না । ঈদের আগে আরেকদিন সময় পাওয়া গেল ; ছেলে মেয়েদের জন্যে কিছু কেনার । কাল আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করেই দেবেন ।
মজিদ একজন রিক্সা চালক । তার নিজের রিক্সা নাই । রোজ ১৮০ টাকা ভাড়ায় হাফিজের গ্যারেজ থেকে রিক্সা নিয়ে চালায় । খাটতে পারলে ভাড়া দেবার পরও ২০০ টাকা থাকে । যে দিন কম হয় সেদিনও ১০০ টাকা থাকবেই । গত সপ্তাহ খানেক সে জ্বরে ভুগেছে । নইলে ছেলে মেয়েদের কেনাকাটা অনেক আগেই শেষ করে ফেলত । শহরের একটু বাইরে ভেরি বাঁধের বাইরে চরে তার বাসা । জোয়ারের সময় ওখানে যাবার রাস্তায় পানি হাঁটুরর উপরে উঠে যায় । রাস্তা নিচু হলেও তাদের বাসা যেখানে সে জায়গাটা বেশ উঁচুই বলা যায় । বছর খানেক হয় সে এখানে বাসা করেছে । এর মধ্যে আল্লাহর রহমতে একবারও পানি ঘরে ঢোকে নাই ।
মজিদের পরিবার বলতে তার দুই সন্তান আর সে নিজে । মেয়ে দিনা সামনের বছর ফোরে উঠবে । ছেলেটাকেও সামনের বছর ভর্তি করবে , মজিদ ইদানীং ছেলেটার নাম প্রায়ই মনে করতে পারে না ; এইযে এখনও মনে পরছে না ; খুবই অসস্থিকর । তাদের মা গত বছর গ্রামে থাকতে কি এক রোগে মারা গেল । বয়স থাকলেও মজিদ আর বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছে ।
ভেরি বাঁধের ছোট দোকানটায় দিনা তার ভাইকে নিয়ে বাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল । মজিদ আস্তেই তারা দু’জন উঠে দাঁড়াল । দিনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় , কিন্তু সাহস পাচ্ছে না ।
মজিদঃ কিছু বলবি ? [ সন্তানদের সাথে মজিদ যথাসম্ভব শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করে , এতে তাদের ভাষাও সুন্দর হবে ]
দিনাঃ ইছুফ মেয়ার খিদা লাগছে । একটা রুডি চায় ।
মজিদের এখন সব মনে পরছে । তার স্ত্রী ছেলের নাম রাখছিল ইউসুফ । ছেলে দেখতে অনেক সুন্দর তাই ইউসুফ নবীর নামে নাম ।
মজিদঃ রুডি কি? ক রুটি । আর তোমার ভাইর নাম ইউসুফ মিয়া । বল ভাইর নাম কি ?
দিনাঃ ইছুফ মেয়া ।
দোকানে বসে থাকা এক বুড়া ফিক করে হেসে দিল । মজিদের অনেক রাগ হলেও সে কিছু বলল না ।
ছোট হলেও দোকানটায় চা থেকে চাল সবই পাওয়া যায় । মজিদ ১ কেজি চাল , আধা কেজি আলু , ৫টাকার মরিচ আর একটা ৩ টাকার রুটি কিনে সন্তানদের নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল ।
বাসায় গিয়ে মজিদ রান্নার যোগাড় করতে বসল । দিনা আর ইউসুফ রুটি ভাগ করে খাচ্ছে ।
সন্তানদের নিয়ে রান্না শেষে ভাল , আলুভর্তা খেয়ে মজিদ শোবার যোগাড় করতে লাগল । ঘরে একটা ছোট চৌকি সেখানে দিনা আর তার ভাই গুমায় । মজিদ মেঝেতে ই ব্যবস্থা করে নেয় ।
মজিদ এশার নামাজ শেষ করে মেঝেতে পাটি বিছচ্ছে এমন সময় দিনা উঠে শোয়া ঠেকে উঠে বসল ।
মজিদঃ কিরে ? এখনও খুমাও নাই ?
দিনাঃ ইছুফরে ঈদে এক জোড়া স্যান্ডেল দিয়েন ।
মজিদঃ তোর কি লাগবে ?
দিনাঃ মেন্দির প্যাকেট দিয়েন একটা ।
মজিদঃ জামা লাগবে না ?
দিনাঃ পারবেন ?
মেয়ে বাবার আর্থিক সামর্থ্যের প্রতি সন্দেহ করছে ! মজিদ অবাক হল , রাগও হল একটু । কিন্তু একটু পরেই সে বুঝল , অভাবের ঘরে থাকতে থাকতে ছোট দিনাও আজ বাস্তবতা শিখে গেছে । মজিদের চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে লাগল । অন্ধকারে সে অশ্রু দিনা দেখল না । মজিদও অশ্রু থামাবার কোন চেষ্টাই করল না । দিনা আবার নীরবতা ভাঙ্গল ।
দিনাঃ আব্বা ?
মজিদ কোন উত্তর দিচ্ছে না । সে তার কান্নার শব্দ গোপন করতে ব্যস্ত । কিন্তু দিনা কিভাবে যেন টের পেয়ে গেল ।
দিনাঃ আব্বা আমনের কি শরীল খারাপ করছে ? কি হইছে ?
বলতে বলতে সে কেরোসিনের কপিটা জ্বালাল...
মজিদ খুবই অপ্রস্তুত অন্য দিন ফিরে দিনাকে ধমক দিল,
মজিদঃ ল্যাম জ্বালাইছ ক্যা? নিবা ।
দিনা সাথে সাথে কপি নিভিয়ে ফেলল ।
দিনাঃ আব্বা , আমার কিছু লাগবে না । খালি ইছুফের এক জোরা…
দিনার কথা থামিয়ে মজিদ বলে উঠল
মজিদঃ তোর লাগবে না মানে ? অবশ্য লাগবে । কতা বেশি হিকছ তুই । ঘুমা । [ রাগলে মজিদের শুদ্ধ বলার হুস থাকে না ]
মজিদ উঠে বাইরে ওজু করতে গেল , নামাজ পরে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে । তিনিই একটা ব্যবস্থা করে দেবে ।
পর দিন সকালে বাচ্চাদের জন্য রান্না করে মজিদ হাফিজের গ্যারেজের দিকে রওনা দিল । কাল সেহেরী খাওয়া হয় নি তার । তবুও সে রোজা ছারে নি ।
রিক্সা নিয়ে সে যখন বের হল তখন সকাল প্রায় ৮ টা । লঞ্চঘাটের দিকে যাচ্ছে সে , একটু পর লঞ্চ আসলে ওখানে একটা নিশ্চিত ট্রিপ পাবে এই আশায় । কিন্তু তার আগেই এক তরুণ তার দিকে হাত তুলে ইশারা করল ; তরুণের পাশে সুন্দরী এক তরুণী দাঁড়ানো । মনে হচ্ছে তারা স্বামী স্ত্রী ।
তরুনঃ চাচা , বিকাল পর্যন্ত ঘুরাবেন । পারবেন তো ?
মজিদঃ পারোন না পারোন আল্লাহর হাতে । উনি চাইলে পারমু , নাইলে পারমু ক্যামনে ?
তরুনঃ তা ঠিক , নিবেন কত ?
মজিদঃ ঈদের আগে ! দিয়েন বিবেক কইরা ।
তরুণ দম্পতী রিকশায় চাপিয়ে মজিদ প্যাডেল দেয়া শুরু করল ।
ঘণ্টা খানে চালানোর পরই মজিদ ক্লান্ত হয়ে পরল । এমনি তো রোজা , তার মধ্যে রোদের তাপও কম না ।
- চাচা , একটি নদীর দিক চলেন তো ।
মজিদ রিক্সা নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে । রিক্সায় তরুণ তরুণী নানা বিষয়ে আলাপ করছে , হাসছে , রাগ করছে । মজিদের হঠাত তার স্ত্রীর কথা মনে মনে পরল । তারও ঘোরার খুব সখ ছিল ।
আসবের দিকে মজিদ তাদের বাসায় নামিয়ে দিল । মজিদও মনে মনে খুশিই । অন্তত ২৫০ টাকা তো দেবেই । এতে ইউসুফের জুতা আর দিনার মেন্দি কেনা তো যাবেই । মজিদ বসে আছে বাসার সামনে , ছেলেটা টাকা আনতে বাসায় ভিতরে গেছে ।
তরুনঃ চাচা , খুচরা নাই । পুরোটাই রেখে দিন ।
বলতে বলতে ছেলেটি একটি ১০০০ তাকার নোট তার দিকে বারিয়ে দিল ।
মজিদ পুরই স্তব্ধ হয়ে গেল । সে নোটটা হাতে নিয়েই বলে উঠল আলহামদুলিল্লাহ্ । খুশি , অনেক খুশি । কথা গুল বলার সময় সে চকচকে নোট দিকে তাকিয়েই ছিল কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছিল তার সন্তানদের ঈদ । সে রওনা করল মসজিদের দিক । আসরের নামাজের পর সে দিনার জন্য জামা , মেন্দি ; ইউসুফের জন্য জুতা আর জামা প্যান্ট । নিজে একটা লুঙ্গী কিনতে চেয়েছিল । কিন্তু তাইলে ঈদের দিনও ডাল , আলু ভর্তা খেতে হবে ভেবে তা আর কেনা হল না । সন্ধ্যায় ইফতারের পর কেজি খানে চাষের কৈ আর ১ কেজি পোলাওর চাল কেনে নিলো । ছেলে মেয়ে দুটি ভাল খাবার খায় না অনেক দিন ।
কাল ঈদ , মজিদ হাসি মুখে সন্তানদের সামনে বসে আছে । দিনা জামা পেয়ে খুবই খুশী । সে বার বার জামার উপরের প্রজাপতির দিক তাকিয়ে “ কি সুন্দর , কি সুন্দর” বলে উঠছে । ইউসুফ জুতা পরে গজরে বার বার চক্কর দিচ্ছে , তার মুখে মিচকি মাসি মাখা । মজিদ মুগ্ধ চোখে সন্তানের আনন্দ দেখছে । মজিদের চোখে পানি এসে যাচ্ছে । সে উঠে অজু করতে গেল । আল্লাহ্র কাছে সুক্রিয়া আদায়ের জন্য শোকরানা নামাজ পরবে সে । ভেরি বাঁধের উপরে এক দল ছেলে মেয়ে চ্যাঁচামেচি করছে । দিনা ও সে দিকে যাচ্ছে । তার ভাইও তার পিছন পিছন যাচ্ছে । ছেলে মেয়ে রা “ ঈদ ঈদ” বলে চেঁচাচ্ছে । কাল ঈদ ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:৪২