ভারতের আন্তঃনদী সংযোগের পরিণাম
০ ব্রহ্মপুত্র নদের ৬০ শতাংশ পানি কমে যাবে, গঙ্গার পানি তলানিতে ঠেকবে
০ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকিতে পড়বে
০ ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবন
কাওসার রহমান ॥ ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়াবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের ৬০ শতাংশ পানিই তুলে নেয়া হবে। সেই সঙ্গে গঙ্গা থেকেও আরও পানি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে চালান করা হবে। এতে পুরো যমুনা নদীর নাব্য হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। মিঠা পানির অভাবে সারা দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকার ভূতল জীব ও জনজীবন ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়বে। সমুদ্রের লবণাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ, মধুমতীর কামারখালী, ধলেশ্বরীর মানিকগঞ্জ এবং মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে।
এই অপরিণামদর্শী বিশাল আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প শুধু বাংলাদেশের পানি ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাবে না, উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যসহ পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার নিয়ে ভারতের মোট নয়টি রাজ্যের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ওই রাজ্যগুলোর লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদের শিকার হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের (২০১১) সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ বৈঠকে প্রথমবারের মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, দুই দেশ অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা করবে। এখন ভারত ইচ্ছে করলেই একতরফাভাবে অভিন্ন নদীগুলোর ওপর আন্তঃনদী সংযোগের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না।
যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০ সালের ১৭ থেকে ২০ মার্চ নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে তারা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না। তাদের মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে না জানিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হলে তা হবে অনাকাক্সিক্ষত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার প্রতিবাদ জানাবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ওই তথ্যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের সত্যতা পাওয়া গেলে বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়া জানাবে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ে পড়বে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী ও ঢাকার বেশিরভাগ এলাকা।
এ প্রকল্পের কারণে সবচেয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থা। মূলত ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের নদী বলে আর কিছু থাকবে না। বর্ষা মৌসুমেও তিস্তা, মহানন্দা, ধরলা ও দুধকমার নদীতে কোন পানি প্রবাহ থাকবে না। কারণ মেচে নদীর মাধ্যমে এ সকল নদীর উজান থেকে পানি প্রত্যাহার করে ফুলহার নদীতে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে বাংলাদেশের অর্ধেক এলাকায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে মধুমতি, ধলেশ্বরী, পদ্মা ও মেঘনা নদীর পানি লবণাক্ততা এসে গ্রাস করবে। যে ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ পানির চাহিদা মেটায় সেই ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী নাব্য হারিয়ে ফেলবে। এছাড়া গড়াই, মধুমতি, নবগঙ্গা, ইছামতি, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ, মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরনো ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ ও তুরাগ নদীর প্রবাহ সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ভারতের একটি পুরনো পরিকল্পনা। টিপাইমুখও এ পরিকল্পনার অংশ। ২০০২ সালে এ প্রকল্প নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে বাংলাদেশ ভারত ও নেপালে আন্দোলন শুরু হয়। কারণ এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ভারতের নয়টি রাজ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের নয়টি রাজ্য মাটি, পানি ও পরিবেশ হারাবে। ফলে দুই দেশের উদ্যোগে যৌথ প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন ভারত সরকার পিছু হটে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, ওই সময় আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার হিমালয়ভিত্তিক নদীগুলোর কাজ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাদের নিজস্ব নদীগুলোর আন্তঃসংযোগের কাজ অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে এ সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ভারত দেশের অভ্যন্তরে প্রায় সাত শ’ বাঁধ নির্মাণ করেছে।
তিনি বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি নিতে হলে উত্তর-পূর্ব ভারত ও মধ্য ভারতে দুই দফায় পাহাড়ের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত করতে হবে, যা খুবই ব্যয়বহুল। এ কারণে ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ প্রকল্পের পানি না নেয়ার ঘোষণা দেন। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের খরা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ওই এলাকার পানির সমস্যা দূর হয়েছে। বরং আগে যে সময়ে খরা হতো এখন সেই সময়ে ওই অঞ্চলে বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলে এই নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
আবদুল মতিন বলেন, ভারতের সুপ্রীমকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছে। এখন ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে কি করবে না তা সরকারের বিষয়। তবে যাদের জন্য পানি নেবে সেই এলাকার কৃষকরা এত দামী পানি নিতে আগ্রহী হচ্ছে না।
এদিকে সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশনার পর গত ২৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্য সরকার সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ওমেম চন্ডি বলেছেন, কেরালা এই নদী সংযোগ কার্যক্রম চায় না। কারণ এই প্রকল্প রাজ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেছেন, উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনা কেরালার জন্য প্রযোজ্য নয়। ওই নির্দেশনা সেই সকল রাজ্যের জন্যই প্রযোজ্য যারা মনে করে তাদের প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশের মিঠা পানির তিন ভাগের দুই ভাগই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে ওই নদীর ৬০ ভাগ পানি উজান থেকে চলে যাবে। এমনিতেই চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা করছে। তার ওপর এই ৬০ ভাগ পানি প্রত্যাহার হয়ে গেলে বাংলাদেশ ও ভারতের নয়টি রাজ্যের জন্য এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
পুরনো ঘটনার নতুন সূত্রপাত
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হচ্ছে একটি পুরনো পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। ২০০৪ সালে দুই দেশের পরিবেশবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে যায়। যদিও ভারত ইতোমধ্যে তার নিজস্ব নদীগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ করে ওই পরিকল্পনার কিছু অংশ বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু ওই সময় প্রতিবাদের মুখে আন্তর্জাতিক নদীগুলো থেকে পানির প্রত্যাহারের কাজ বন্ধ রেখেছিল। সম্প্রতি ভারতের সুপ্রীমকোর্টের এক রায়ের কারণে আবার সেই বিতর্কিত প্রকল্পটি আলোচনায় উঠে এসেছে।
ভারতের সুপ্রীমকোর্ট গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে সমগ্র দেশবাসীকে এর সুফল দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। কোর্ট বলেছে, বিশেষ কমিটি প্রতি দুই বছর পর পর এ সংক্রান্ত রিপোর্ট কেন্দ্রে দাখিল করবে, যার ভিত্তিতে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে। এ রায় দিয়ে কোর্ট বলেছে, এটি একটি জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়নের বিষয়। আমরা কোন কারণ দেখি না, কেন রাজ্যগুলো নদী সংযোগ প্রকল্পটি সফলতার জন্য পিছিয়ে থাকবে, যখন এই প্রকল্প খরায় পীড়িত মানুষকে ক্ষুধামুক্ত করবে ও বন্যায় পীড়িতদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্ত করবে।
ভারতীয় সুপ্রীমকোর্টের এই রায়কে কেন্দ্র করে এ প্রকল্প নিয়ে আবার নড়েচড়ে বসবে কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্যোগ নেবে এই বিরাট প্রকল্প বাস্তবায়নের। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জনগণের কাছে একটি গুরুতর অশনিসংকেত ছাড়া কিছুই নয়। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত যদি এখন বৃষ্টিপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পানি খাল কেটে সরিয়ে নিয়ে পশ্চিম ভারতে দেয়ার কাজ এগিয়ে নিয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে। উল্লেখ্য, উত্তর-পূর্ব ভারতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত হয় তিন হাজার ৫০০ মিলিমিটার। আর পশ্চিম ভারতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত হয় মাত্র ৭০০ মিলিমিটার।
এ প্রসঙ্গে পানি ও পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারী গবেষণা সংস্থা জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ভারতও যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বস্তির মধ্যে থাকবে তা নয়। কারণ ভারতের আন্তঃনদী প্রকল্পটি অসম থেকে উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রাজস্থান, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের জনগণকে লাভবান করাবে। আবার এতে পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি হবে। শুধু বাংলাদেশই নয়, আসাম থেকে উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ইতিহাস
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভারতের পরিকল্পনাবিদরা দেশব্যাপী আন্তঃনদী সংযোগের প্রস্তাব করেন। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইনডাস ওয়াটার্স ট্রিটি স্বাক্ষরিত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য গঙ্গা নদীর পানি নিয়ে কোন সমঝোতা বাদেই ভারত গঙ্গার ওপর ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৭৫ সালে এই ব্যারাজ চালু করে পানি প্রত্যাহার শুরু হলে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৭৭ সালের প্রথম পানি বণ্টন চুক্তিতে পানির যে ভাগাভাগি হয় তা ভারতের কাছে চূড়ান্তভাবে প্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ ওই চুক্তিতে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সরবরাহের গ্যারান্টি দেয়া ছিল। এর পরই ভারত ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি এনে গঙ্গা নদীতে ফেলা তথা আন্তঃনদী সংযোগ প্রস্তাব করতে থাকে। ভারতের প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে একটি খাল কেটে ফারাক্কার উজানে ফেলতে হবে। কিন্তু এতে লাখ লাখ মানুষকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে হতো এবং পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটত। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। ফলে চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর পার হলে আর নতুন চুক্তি হয়নি।
পাকিস্তান আমলের শুরুতে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে শুকনো মৌসুমে গঙ্গা নদীর ঐতিহাসিক গড়প্রবাহ ছিল প্রায় এক লাখ কিউসেক। ১৯৭৭ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ন্যূনতম ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি সরবরাহের গ্যারান্টি ছিল। ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে সর্বনিম্ন ২৭ হাজার ৬৩৩ কিউসেক পানি দেয়ার কথা বলা হলো কিন্তু কোন গ্যারান্টি দেয়া হলো না। এরপর ১৯৯৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এলে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনাটি নিয়ে পুনরায় তৎপরতা শুরু হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অখ- ভারত ও হিন্দুত্বের জিগির এবং দক্ষিণ ভারতের বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহে পরিকল্পনাটি অচিরেই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২০০২ সালে ভারতে তীব্র খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বাজপেয়ী সরকার আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ঘোষণা দেয়। এজন্য গঠন করা হয় একটি টাস্কফোর্সও। ওই সময় এ প্রকল্প নিয়ে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এ প্রকল্পের বিরোধিতা করেন বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক রাজ্যের জনগণ ও বুদ্ধিজীবীরা। কারণ ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যাবে। মোট ৩০টি ক্যানেল সিস্টেমের এই পরিকল্পনায় তাদের তো কোন উপকার নেই-ই, বরং কোটি কোটি মানুষ উচ্ছেদ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হবে। বাংলাদেশেও মরুকরণের পাশাপাশি নদী ব্যবস্থা, কৃষি ও পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।
কিভাবে হবে নদী সংযোগ
এটি মূলত বৃষ্টিপ্রধান উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পানি খাল কেটে পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি খাল কেটে রাজস্থান, গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতের নিয়ে যাওয়া হবে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, যা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটালেও ওই এলাকার কৃষকদের খুব একটা উপকারে আসবে না।
ভারতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬টি সংযোগ খাল দিয়ে ভারতের ৩৮টি নদ-নদীর মধ্যে আন্তঃসংযোগ ঘটানো হবে। পাশাপাশি ছোট-বড় ৩৪টি এবং ৭৪টি বড় জলাধার নির্মাণ করা হবে। সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান ও তামিলনাড়ু এলাকায়। এতে গঙ্গায় যে পানি সঙ্কট হবে তা পূরণ করা হবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দিয়ে। এভাবে মোট ১৭৪ বিলিয়ন কিউসেক পানি পশ্চিম ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে ওই ভারতের ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া হবে। এসব জমিতে সব রকম ফসল ফলানো সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের ব্যয় হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি রুপী।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের শুরু হবে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। এই নদের পানি অন্যত্র সরাতে হলে গুয়াহাটি অথবা গোয়ালপাড়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্যারাজ নির্মাণ করতে হবে। এই ব্যারাজ আসামের বন্যার পানি দ্রুত সরে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে পরিস্থিতি আরও খারাপ করবে। তা ছাড়া পানি সরাতে সংযোগ প্রকল্পের ১৪ নম্বর খালটির মাধ্যমে অসমের বরপেটা, কোকড়াঝাড় ও ধুবড়ি জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা ওই এলাকার কোন উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষের উচ্ছেদ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটবে।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের এক নম্বর খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চল দিয়ে নিতে হলে প্রায় ১০০ মিটার উঁচুতে তুলে ডুয়ার্সের উচ্চভূমি দিয়ে পার করতে হবে। এটি অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর ও মালদহ জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা ওই এলাকার কোন উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং ওই অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটবে।
ব্রহ্মপুত্র থেকে গঙ্গায় আনা পানি ১০ নম্বর সংযোগ খালের মাধ্যমে বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জেলাগুলোর ওপর দিয়ে খাল কেটে দক্ষিণ ভারতে নেয়া হবে, যা ওই এলাকার কোন উপকারে তো আসবেই না, বরং লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ হবে ও পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তা ছাড়া দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সংগৃহীত পানির সিংহভাগই বাষ্পীভবন হয়ে উবে যাবে।
বিহারের নদীগুলোতে যে পানি আছে, তা ওই এলাকার জন্য যথেষ্ট। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ১২, ২ ও ৩ নম্বর খালের মাধ্যমে মেচি ও কোশি নদীর পানি বিহারের তরাই অঞ্চল দিয়ে এবং গ-ক নদীর পানি সমভূমির ওপর দিয়ে গঙ্গায় ফেলা হবে। এতে এসব নদীর অববাহিকার জেলাগুলোতে নদীর মতো খাল কাটতে হবে, যা এই এলাকার কোন উপকারে তো আসবেই না, বরং সেই লাখ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে এবং পরিবেশ বিপর্যয় হবে।
বাংলাদেশে প্রভাব
বাংলাদেশে শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে, যার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের কৃষি ও জীব পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এর একটি বিরাট অংশ ভারতের পশ্চিমে চালান করলে বাংলাদেশে পরিবেশের বিশাল বিপর্যয় হবে। সমুদ্রের লবণাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ, মধুমতীর কামারখালী, ধলেশ্বরীর মানিকগঞ্জ এবং মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে। সমগ্র যমুনা নদীর নাব্য হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। মিঠা পানির অভাবে সারা দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকার ভূতল জীব ও জনজীবন অভূতপূর্ব বিপদের মুখে পড়বে। মোহনা এলাকার জীববৈচিত্র্য, মৎস্য ও জলসম্পদ বিপর্যস্ত হবে।
যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা যায়, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ভারত নেপালের কোসি ও মহাকালী নদীর পানির উৎসস্থলে যে বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করছে তা হিমালয় অববাহিকার আওতাভুক্ত। এ অববাহিকায় বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলো রয়েছে। এখানে বাঁধ দেয়া হলে অবধারিতভাবেই বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলোতে প্রভাব পড়বে। অভিন্ন নদীতে ভারত বাঁধ দিয়ে সেচ কাজ ও বিদ্যুত উৎপাদন করছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিকভাবেও পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশ ভায়বহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ভারত বর্তমানে সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তা নদীর গজলডোবা ব্যারাজের কাছে আসা তিন হাজার ৫০০ থেকে চার হাজার কিউসেক পানির সিংহভাগ সরিয়ে নিচ্ছে। তিস্তার পানি সরিয়ে নেয়ার কারণেই আমরা ভাটিতে দোয়ানীর কাছে মাত্র এক হাজার থেকে ৪০০ কিউসেক পানি পাচ্ছি।
তিনি বলেন, তিস্তার পানি মহানন্দা নদীর মাধ্যমে চলে যাচ্ছে বিহারের মেচি নদীতে, সেখান থেকে ফুলহার নদের মাধ্যমে ফারাক্কার উজানে। ভারত মেচি নদীতে একটি ব্যারাজ নির্মাণ করছে। ফলে উত্তরবঙ্গ ও বিহারে তার আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার অনেকটা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। এছাড়া ভারত ফাঁসিদেওয়ার কাছে একটি জলবিদ্যুত কেন্দ্র করেছে, যা তিস্তার ক্যানেলের পানি দিয়ে চালানো হচ্ছে এবং ওই পানি শেষমেশ বিহারের মেচি নদীতে চালান করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সমুদ্রের লবণাক্ততা পদ্মার গোয়ালন্দ, মধুমতীর কামারখালী, ধলেশ্বরীর মানিকগঞ্জ এবং মেঘনার ভৈরব ছাড়িয়ে যাবে। সমগ্র যমুনা নদীর নাব্য হারিয়ে যাবে। সারা দেশের নদী ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমির প্রায় অর্ধেক এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান তিন নদী। অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ পানি বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি কোন বাধার মুখে পড়েনি। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এ নদীটি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই যে কোন উপায়ে হোক এ নদীটিকে অক্ষত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, চুক্তি থাকার পরও গঙ্গার পানি তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে অবাধে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এখন এ নদীতে আরও বাধ দিয়ে পানি পশ্চিমে ঠেলে দেয়া হলে বিপর্যয় আরও বাড়বে।