‘‘কে অই শুনালো মোরে
আজানের ধ্বণি”
সাকিব মুস্তানসির
রাতের আঁধার ধীরেধীরে কেটে যেতে থাকে, পশ্চিমাকাশ একরাশ আলোকবর্তিকা নিয়ে রাত্রির ঘনকালো আর অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে দেয় রক্তিম আলোকচ্ছটায় ।ইথারে ইথারে কাঁপা সুরে ভেসে আসে সত্যের আহ্বান । আঁধার কেটে আলোয় , মিথ্যাকে পেছনে ফেলে সত্যের পৃথিবীতে স্বাগত জানানোর আহ্বান ।অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীকে আলোয় আলোকিত করার আহ্বান । রাত জাগা ভোরের পাখি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার বড়ত্ব ।একত্ববাদের বানী ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে । কি মধুর সেই আহ্বান !মন প্রাণ আকুল হয়ে মসজিদের পানে ছোটে চলে একদল সত্যের সন্ধানী । মহাকবি কায়কোবাদ আজানের সুরের মুদিরায় মাতওয়ারা হয়ে গেয়ে উঠেছেন-
‘‘কে অই শুনালো মোরে
আজানের ধ্বণি
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইলো প্রাণ বাজিল ধমণী
কি মধুর আজানের ধ্বণি!’’
আহা! কি মধু মায়াময় সেই আহ্বান । সুজলা সুফলা বাংলার মাঠ-ঘাট, নদ-নদী, খাল-বিল ফুল-পাখি সবাই প্রতিদিন নির্ঘুম রাত্রি জাগে এই অলৌকিক আহ্বানের অপেক্ষায় । দিনের সূর্য রাতভর অন্তহীন অপেক্ষা করে থাকে কখন আলোয় আলোয় ভরে দিবে আমার দেশের সবুজ শ্যামলিমা । এ এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ! আল্লাহর বড়ত্বের গান গাইতে গাইতে পশ্চিমাকাশে উদিত হয় দিনের আলোর মিনারা তাইতো আমার দেশের রাখাল বালক অজান্তেই গেয়ে উঠে –
“এদেশে আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য উঠে,
এদেশে আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য ডুবে”
নদীর কলতানে , বিহঙ্গের কুহূতানে ,ভ্রমরের গুঞ্জনে সেই সুর । বাঁশবনে মৃদুলয়া বাতাসের দুলুনিতে , গরীব দুঃখীর ভগ্ন কুটীরে , বৃত্তশালীর আকাশ ছোঁয়া অট্রালিকায়, কুল কুল ঝর্নার শব্দ আর মেঘের আনাগোনায়,হাওর-বাওর, পাহাড়- উপত্যকায় এই বানী ছড়িয়ে পরে নিমিষেই ।যে হৃদয় স্রষ্টার আহ্বান শুনতে পায় সে হৃদয় অনির্বাণ এক জগতের সন্ধান পেয়ে গেছে, এতে সন্দেহ নেই । আজানের বিস্ময়কর একটা কারিশমা হচ্ছে , প্রতিমুহুর্তে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে এই স্বর্গীয় আহ্বান ।
“‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ,
মোহাম্মদ রাছুলুল্লাহ’
মোয়াজ্জিন মিনারে উঠে,
ফুকারে যখন।”
সেই আজানের ধ্বনি যখন ‘মর্মে বাজিয়া উঠে সুমধুর’, তখন ধরণীর তাবৎ সংশয়ী মন চিন্তিত হয়। ভাবনা জাগে, কেমন করে একটি শব্দগুচ্ছ মর্মে বেজে উঠে ‘ধমণি আকুল করিয়া’ তোলে! ভক্তির সাগরে বান ডাকে প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নিবায়ু ’ বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাই এই ডাকে সারা না দিয়ে পারে না ।কবির ভাষায়-
ভাই মুয়াযযিন আল্লাহর নামে রাজে সে কি কুহুক
এই নামেই ডাকো তুমি ঝরে এত সুধা এত মধু
নাচে জলে ভর ভর জলধি এত তরঙ্গ এত লহরী
এমনি যে মঁজু সুখে ভাসালে মো'মিনের শিরা ধমনী।
কী এ অপরূপ সুরে শোনাও মোরে আযানের বাণী।
এই বানীর মায়াময়তা মুগ্ধতা মানুষের মনে প্রাণে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে তাঁর আহ্বানেই পঙ্গপালের মত সারা দিয়ে মুমিনের দল মহান প্রভুর পদতলে সিজদা করে ।সত্যের পথে দুঃসাহসী অভিযানের আমন্ত্রণ খুঁজে পায় সত্যের সন্ধানী । পাপ পঙ্কিলতায় ভরপুর পৃথিবীর সকল জঞ্জাল সাফ করে এক আল্লাহর পদতলে মাথা নোয়াতে বাধ্যকরে । অবিশ্বাসের শিকড়ে কুঠারাঘাত করে বিশ্বাসের পতাকা উঁচু আরো উঁচু হয়ে উঠে তাইতো বিদ্রহের কবি , গানের কবি প্রাণের কবি জাতিয় কবি, কবি নজরুল ইসলাম মৃত্যুর পরও এই আহ্বানে অহর্নিশ সারা দিতে চান । তাঁর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে এই সুরে , এই আহ্বান প্রাণে ধারণ করে কবরগাহে কিয়ামততক মায়ায় ভিজতে চেয়ে গেয়ে উঠি আমরাও -
“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোর থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৩