somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শহুরে জীবনের কহর

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


—কাকি, বাসায় আসতেছি ।
—রাতে খাবা?
অনিবার্য প্রশ্ন । এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো হিম্মত ছিলো না বলে বেশিরভাগ সময় না-ই বলতে হতো । কারও বাসায় খেতে যাচ্ছি বলাটা যে পরিমাণে অস্বস্তিকর, তার থেকে ‘না’ বলে না খেয়ে থাকা অনেক ভালো ।

এই কারণে কিন্তু কাকিকেও দোষ দেয়া যায় না । তিনি শহরে থাকেন । এখানে গ্রামের মতো অঢেল ধান-চাল-পানি ও তরি-তরকারির সরবরাহ নেই । দু’টাকার ধনে পাতাও কচকচে কাগজের টাকায় কিনে খেতে হয় । তা ছাড়া অযথা রান্না করে খাবার বাসি করার মানে হয় না। কে খাবে? কাকে দেবেন তিনি? গ্রামের বাড়িতে যেমন চাইলেই পাশের বাড়ির নান্নুর মাকে ডেকে পান্তা খাইয়ে ঘরটা লেপা-পোছা করে নেয়া যায়, এখানে তার জো নেই । এই শহরে কাকির কাজের মাসির মাইনে তিন হাজার টাকা । তাকে পান্তা খেতে সাধলে ঘোরতর অপমান বোধ করেন তিনি । বাসার ছেলে-মেয়েকে বাসি খাবার খাওয়ানো যাবে না, অসুখ করলে ভোগান্তি বাড়বে ।

কাকার কাছে একবার শুনেছিলাম, তার কোম্পানির এমডি স্যার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের বিয়ের আগের রাতে এক এক করে ফোনকল করে জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন— আপনি কি কাল আমাদের অনুষ্ঠানে আসছেন? তারপর তিনি খাবারের এস্টিমেট কনফার্ম করেছেন ।

এই জিজ্ঞেস করাটা তার কাছে খুবই জরুরি । কেননা, ধরুন— পাঁচশ’ জনকে দাওয়াত দেয়া হলো । সে-হিসাব ধরে রান্না-বান্না হয়েছে । তারপর দেখা গেলো, পঞ্চাশ জন আসেন নি । এতগুলো মানুষের খাবার নষ্ট হবে । কে খাবে এই খাবার? তা ছাড়া এভাবে খাবারের অপচয় করারও তো কোনো অর্থ নেই ।

একবার নাখালপাড়া এক আত্মীয়ের বাসায় গেছি । জুমাবার । বাসায় বিরানি রান্না হয়েছে । জুমার নামাজে গিয়ে রহিম মেটাল মসজিদের সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেলো পুরাতন এক বন্ধুর সাথে । নামাজের পরে বন্ধুকে নিয়ে হোটেলে বসেছি । ওর খাওয়াটাও হলো, আলাপটাও সারলাম— এই ভেবে । ওয়েটারকে অর্ডার করেছি একজনের খাবারের । যেহেতু বাসায় আমার জন্যে রান্না হয়েছে, সেটা না খেলে নষ্ট হবে । আবার বলা-কওয়া ছাড়া চট করে একজনকে নিয়ে আত্মীয়ের বাসায় ওঠা যায় না। বিশেষ করে দুপুরের খাবারের সময় । তা ছাড়া হিসেব করে খাবার রান্না হয় এই বাসায় । ঘন্টাখানিক পরে বন্ধুকে বিদায় দিয়ে যখন বাসায় পৌঁছলাম, দেখি আমাকে দেখে সবাই থ হয়ে গেছে । বাসার খাবারের পাট উঠে গেছে ততক্ষণে । আমার আসতে দেরি দেখে নাকি সবাই ধরে নিয়েছে— এ দুপুরে আমি আর খাচ্ছি না । তাই আমার ভাগের বিরিয়ানিটা অন্যরা ভাগ করে খেয়ে নিয়েছে ।

এটা অবশ্য কোনো সমস্যা না । চাইলে হোটেলে গিয়ে একপ্লেট বিরিয়ানি খেয়ে আসা যায় । সমস্যা হলো, আমরা হলাম জন্মসূত্রে কুলীন । তাই মিথ্যা ঢোক গিলে বলতে হলো— আরে আমি তো খেয়েই এসেছি । বন্ধু জোর করে বিরিয়ানি খাইয়ে দিয়েছে... এই .. সেই..।.... সুতরাং সে দুপুরটা গ্লুকোজ বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দিতে হয়েছে ।

জন্মগত কুলীন । আব্বার চাকরির সুবাদে থাকতে হয়েছে মফস্বলে, নয়তো আধা শহর আধা গাঁয় । তবু সবসময়ই দুই-দশজনের খাবার হাড়ির তলায় পড়ে থাকা দেখে দেখে বড় হয়েছি । গ্রামে বেড়াতে গেলেও দেখেছি, আমাদের নিয়ে বড় চাচার ও দাদার ঘরে কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে । সকালের হাড়িভরা পান্তাভাতের সাথে চাচি দুটা শুকনো মরিচ আর একটা ডিম ভাজা সমান ভাগ করে দিয়েছেন আটজনের পাতে । অমৃতের মতো স্বাদু সেই খাবার খেয়ে মহানন্দে চাচার সাথে ক্ষেতে গেছি ধান কাটা দেখতে, কিংবা নিড়ানিতে চাচাকে একটু এগিয়ে-পিছিয়ে দেবার লোভে । তাই এইসব শহুরে হিসাব-নিকাশ দেখলে আমাদের চোখ বড় টাঁটায় ।

শহুরে এই হিসাব-নিকাশকেই সম্ভবত বলা হয়— শহরের কহর । এখানে সবার চোখে-মুখে অভাবের লেখাজোখা যেনো বানান করে পড়া যায় । কেউ কাউকে দাওয়াত দিতে ভয় পায় শহরে । খরচ বাঁচানোর জন্যে চারটি করে পুঁটি মাছ ভাগ ভাগ করে পলিথিন পেঁচিয়ে তুলে রাখা হয় ফ্রিজে । সপ্তাহে একদিনের বেশি মাংস খাওয়া যাবে না, অতিথি এলেও না । কাউকে রাতে থাকতে দেয়ার জন্যে একটা ছোট তোশক, একটা বালিশ কিংবা একটা হাত পাখার ব্যবস্থা রাখতে গিয়ে হিমশিম খায় মেজাবান । পয়সার অভাব নেই, তবু যেনো দুর্ভিক্ষ লেগে আছে ঘরে ঘরে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের কিনারে কিনারে কহরের বরফ জমে আছে আইকার মতো শক্ত আঠা হয়ে ।

নিয়তির কী নির্মম উপহাস ! আমাকেও এখন শহরে থাকতে হয় শহুরে হয়েই। শশুর মশাই একবার কী উপলক্ষে যেনো বাসায় এলেন গত রমজানে। নানান ফলমূল কিনে ঘর ভর্তি করে ফেললাম । তখনও ঘরে ফ্রিজ ওঠে নি । শশুর কিন্তু তেমন একটা খেত পারলেন না । বাসায় আমি আর গিন্নি । কে খাবে এই ফল ? ফ্ল্যাটের লোহার গেইট পেরিয়ে তো ভিক্ষুক ঢোকার সুযোগ নেই । পাশের ঘরে পাঠালাম কিছু অতি সংকোচে । একজন ভিক্ষুক ফাঁক পেয়ে উঠে এসেছিলো । তাকেও দিলাম বেশ করে । গরমের দিন । তাই দিয়ে-থুয়েও নষ্ট হয়ে গেছে সিকিখানি তরমুজ, কটা লিচু, পাঁচটা আম আর আধখানা কাঁঠাল ।

এইসব কারবার দেখে দেখে গিন্নিও এখন সচেতন হয়ে গেছে খুব । আমার বিশ বছর পরে শহরে এসেছে, তবু পুরো দস্তুর শহুরে মেয়ে বনে গেছে সে । সুতরাং শহরের কহর অনায়াসে ঢুকে পড়েছে আমার ঘরের কিচেনে । ছোট ভাই বাসায় আসবে শুনলে গিন্নি এখন শুধায়— হাসান কি রাতে খাবে?

আশ্চর্যের কথা হলো, বরাবরের মতো এই প্রশ্নের জবাব দিতে আজও আমার অস্বস্তি হয় । হ্যাঁ কিংবা না শোনার জন্যে হাসানকে ফোন করে জিজ্ঞেস করার সাহস আজও এই নরাধম কুলীনের হয় না । তাই বউকে বড় দু:খ নিয়ে উল্টো প্রশ্ন করি— তুমি কি কাকি হয়ে গেলা?

সবিশেষ— কবি আল মাহমুদকে কেউ একজন নাকি উপদেশ দিয়েছিলো— যদি পড়ে কহর, তবু ছেড়ো না শহর । কহর তো পড়েই গেছে শহরে । কিন্তু কে কাকে উপহার দিয়েছে এই কহর শহরে? আমরা শহরকে দিয়েছি, নাকি শহর আমাদের?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৪৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×