কাঁপতে থাকা হাতটা সে টেবিলের নিচে দুপায়ের মাঝখানে লুকিয়ে রাখে। জানালার দিকে তাকায়। সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাছগাছালি ঘেরা রাস্তার পাশে একটা পুরনো দালানের নিচে রাখা জঞ্জালের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওয়েটার এক গ্লাস দুধ-চা তার নিয়মিত কাস্টমারের সামনে রাখে এবং কোনও কিছু না বলেই চলে যায়।
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা কিছুণ চায়ের গ্লাসটা তার হাতে ধরে রাখে। তার চোখ স্থির হয়ে আছে প্রশস্ত প্রধান সড়কের পাশে ফেলে রাখা জঞ্জালের দিকে। সে ল্য করে জঞ্জালের স্তূপটায় কিছু একটা নড়ছে। তার হাতে কাপটা নড়ে ওঠে এবং চোখ বড় করে সে স্থিরভাবে লক্ষ করছে- কী নড়ছে।
একটু পর একটা শাদা বিড়াল বেরিয়ে আসে এবং সে জোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ‘হ্যালো!’ একজন অচেনা লোক তার সামনে একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল।
তার হাত থেকে চায়ের গ্লাসটা ছিটকে পড়ল। একটা বিকট শব্দ হল। তাতেই দুজনে চমকে উঠল।
ওয়েটার তাড়াতাড়ি করে ছলকে পড়া চা ও ভেঙে যাওয়া গ্লাসের টুকরোগুলো তুলে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিল। অচেনা লোকটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য বিব্রত বোধ করে। ‘আমি দুঃখিত!’ সে বলল, ‘আমি তোমাকে এরকম বিশ্রী অবস্থায় ফেলতে চাইনি।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা অচেনা লোকটার দিকে চাইল এবং দ্রুত তার হাতটা টেবিলের নিচে টেনে নিল। তারপর আবারও একদৃষ্টিতে প্রশস্ত প্রধান সড়কের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘আমি তোমার জন্য আরেক কাপ চায়ের জন্য বলি,’ অচেনা লোকটা বলল। ওয়েটার দুকাপ চা নিয়ে ফিরে এল।
‘তুমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ?’
লোকটা কিছুই বলল না।
‘আমি লক্ষ করেছি তুমি বেশ কিছুণ আগে এখানে এসে বসেছ। অস্থিরভাবে ছটফট করছ এবং রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ল্য করছ।’
লোকটা কিছুই বলল না।
অচেনা লোকটা হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই দিশেহারা নও; দিশেহারা কোনও লোক গাড়ি চালাতে পারে না।’ এরপর সে জানতে চাইল, ‘তুমি কী কোনও ব্যাপারে খুবই চিন্তিত?’
বিদ্যুৎগতিতে ফ্যাকাশে মুখের লোকটা আড় চোখে এক পলক অচেনা লোকটার দিকে তাকাল, তারপর চোখ ফিরিয়ে আগের মতো প্রশস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানোর ভঙ্গিতে যা প্রকাশ পেল, তাতে বুঝতে পারল অচেনা লোকটা তার প্রতি প্রশ্ন করছে, ‘তুমি শঙ্কিত কেন?’
‘আমি কোনও ব্যাপারে শঙ্কিত নই,’ চেঁচিয়ে ওঠে ফ্যাকাশে মুখের লোকটা। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় এবং টেবিলের ওপর প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুষি মারে। চা ভর্তি গ্লাস দুটো টেবিল থেকে আবারও ছিটকে পড়ে। কী ঘটেছে জানার জন্য এবারও অন্য কাস্টমাররা তাদের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে।
অচেনা লোকটা মৃদু হাসে এবং ফ্যাকাশে মুখের লোকটাকে বসতে বলে।
‘শান্ত হও, বন্ধু! এরকম উত্তেজিত হচ্ছ কেন?’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা কাশছে। মুখের সামনে হাত রেখে সে কাশি থামানোর চেষ্টা করছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে চেয়ারটা টেনে রাস্তার দিক থেকে সরে বসে।
‘এটা বেশ ভালো হলো।‘ অচেনা লোকটা বলল, ‘আমরা তো সামান্য কথা বলতে পারি।’
‘কী ব্যাপারে?’ ফ্যাকাশে মুখের লোকটা বলল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘তুমি কে?’
‘বন্ধু!’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য রাস্তার দিকে তাকাল।
‘তুমি বারবার পুরনো দালানটার দিকে তাকাচ্ছ কেন?’
‘এটা তোমার জানার দরকার নেই।’
‘আমাকে মা কর বন্ধু।’ সে বলল, ‘তুমি কি বিষয়ে এত দুঃশ্চিন্তা করছ, যা তোমাকে অসুস্থ করে ফেলেছে?’
হতভম্ব হয়ে ভয়ে চুপসে যাওয়া ফ্যাকাশে মুখের লোকটা চেষ্টা করছে সব ধরনের বিপদের আশঙ্কা মন থেকে মুছে ফেলতে; যা অচেনা লোকটা বলেছে তার আছে। তাচ্ছিল্য করে সামান্য হেসে সে বলল, ‘আমাকে ভয় পাচ্ছ! তুমি স্বপ্ন দেখছ।’
অচেনা লোকটা মাথা নাড়ল : ‘না, আমি তা নই।’ সে বলল, ‘ভয় আমাদের দুজনের মনেই আছে। আমি উদাহরণ হিসেবে বলছি, আমি সব সময় রাস্তা পার হওয়ার সময় ভয় পাই। মনে হয় যেন একটা গাড়ি আমার ওপর এসে পড়ল।’ সে শেষ বাক্যটা বেশ উৎসাহ নিয়ে ও উঁচু গলায় বলল।
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা এই প্রথম হাসল। বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যদি দুর্ঘটনার ভয়ে রাস্তা পার না হও, তাহলে তুমি সারাজীবন চলাফেরা করবে কীভাবে?’
অচেনা লোকটাও হাসল। শান্তভাবে বলল, ‘তুমি দেখে নিও আমার পেয়ারের দোস্ত! রাস্তা পারাপারের সময় আর আতঙ্কিত হব না, তোমার মতো।’
‘আমি তোমাকে বলছি তো, আমি আতঙ্কিত না।’
অচেনা লোকটা তার বুকের ওপর ভাঁজ করে দুহাত রেখে বলল, ‘ঠিক আছে তুমি কাউকে আতঙ্কিত কর না, আতঙ্কিত হও-ও না, শুধু বিরক্ত হও। কিন্তু তুমি কী ব্যাপারে এত বিরক্ত হচ্ছ? বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে সাহায্য করতেই এখানে এসেছি। আমাকে চেষ্টা করতে দাও?’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তার ঠোঁট দিয়ে জিভ চাটে। আর পুরনো দালানের নিচে ফেলে রাখা জঞ্জালের স্তূপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর বলে, ‘তুমি কি দেখেছ দালানের নিচে জঞ্জালের স্তূপ জমে আছে?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি, একটু আগে আমি সেদিক দিয়েই এসেছি।’
‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করবে!’
‘চেষ্টা করব!’
‘গত প্রায় এক মাস ধরে প্রতিদিন এখানে সে আমাকে অনুসরণ করছে এবং নজর রাখছি।’
‘কে?’
‘একটা বিড়াল।’
‘একটা বিড়াল?’ অচেনা লোকটা বিস্ময়ে ও কৌতুকের স্বরে বলে ওঠে।
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা রাগী চেহারা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমাকে বলিনি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না?’
‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি; কিন্তু আমি ওই কালো বিড়ালটা তো দেখিনি। সেটা কোথায়?’
‘কালো, তুমি বলছ? আমিতো বলিনি ওটা কালো ছিল। তুমি কী করে জানলে ওটা কালো?’
‘আসলেই কী কালো? নাকি এটা শুধু আন্দাজ! ব্যাপারটা খুলে বলো।’
‘আমি বলছি শোনো, বিড়ালটাও আমার প্রতি নজর রাখছে। কিন্তু আজ সেখানে নেই, ব্যাপারটা অদ্ভুত।’
অচেনা লোকটা বড় এক ঢোকে চা পান শেষ করে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং সেখান থেকে চলে যেতে থাকে। ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তাকে পেছন থেকে ডাক দেয়, ‘ এই যে আগন্তুক! তুমি বিশ্বাস করছ না আমাকে, করছ তো?’
‘আমি কী পাগল, তোমাকে বিশ্বাস করব? একটা বিড়াল তোমার ওপর নজর রাখছে? তুমি নিশ্চয়ই অসুস্থ।’
‘আমি মিথ্যা বলছি না!’ ফ্যাকাশে মুখের লোকটা বলল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর নিচুস্বরে বলল, ‘আমি আতঙ্কিত!’
অচেনা লোকটা চিৎকার করে তার কাছে জানতে চাইল, ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’
‘টয়লেটে, আমি আবার আসছি।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা আবার আগের মতো পুরনো দালানের নিচে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল এবং ফেলে রাখা জঞ্জালের ভেতর একটা কালো লেজ দেখতে পেল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে, ফ্যাকাশে মুখের লোকটা শরীর বাঁকিয়ে অচেনা লোকটাকে খুঁজতে লাগল। জঞ্জালের স্তূপ ফুঁড়ে একটা কালো বিড়াল উঁকি দিল।
বিড়ালটা নড়াচড়া করে স্তূপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর থমকে গিয়ে তাকিয়ে রইল কাফের দিকে। ফ্যাকাশে মুখের লোকটা হন্তদন্ত হয়ে অচেনা লোকটাকে খুঁজতে টয়লেটের দিকে গেল কিন্তু তাকে পেল না। সে হতাশ হয়ে কাফেতে ফিরে এল এবং দেখল অচেনা লোকটা ফিরে আসছে। সে জানতে চাইল, ‘কোথায় ছিলে?’
‘আমি একটা ফোন করার জন্য বাইরে গিয়েছিলাম। কী হয়েছে? তুমি এতটা দুঃশ্চিন্তা করছ কেন?’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা খপ্ করে অচেনা লোকটার হাত ধরে টেনে টেবিলে ফিরে আসে। জঞ্জালের স্তূপের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, ‘দেখ ওখানে সেটা আছে তো!’
অচেনা লোকটা সেদিকে তাকিয়ে উপহাস করে বলে, ‘কোথায়? আমিতো শুধু একটা কালো থলে দেখছি।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তার চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে। জঞ্জালের স্তূপের দিকে তীক্ষ্ণভাবে দেখে বলে, ‘বোধ হয় চলে গেছে! ওটা ওখানেই ছিল। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?’
‘বিশ্বাস করি। তুমি শান্ত হও। এখন বলত, তুমি কালো বিড়ালটার দিকে নজর দিচ্ছ কেন?’
‘আমি জানি না! বলতে পারব না!’
‘একটু ভাবো! একটা কালো বিড়াল নিয়ে কেন ভাবছ?’
‘ওটার একটা আছেঃ’
‘কী? খুলে বল!’
‘ব্যাপারটা অনেকদিন ধরেই চলছে। কিন্তু না, না, না; তবে কোনও একটা সম্পর্ক সেখানে রয়েছে।’ বলে সে থামল।
‘বল! কী হয়েছিল?’
‘অনেকদিন আগে আমি তখন বেপরোয়া তরুণ। একদিন একটা কালো বিড়ালকে তাড়া করেছিলাম। আমি ইচ্ছা করেই বেশ কিছুক্ষণ আমার গাড়ির চাকার নিচে পিষেছিলাম, তখন থেকেই আমি এরকম করছি। কিন্তু সেটা দশ বছর আগের ঘটনা।’
অচেনা লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কিন্তু ওই গাড়িতে চাপাপড়া বিড়াল ও এই বিড়ালটার সঙ্গে সম্পর্ক কী?’
‘তাতো জানি না! হতে পারে যে বিড়ালটাকে আমি গাড়িচাপা দিয়ে মেরেছিলাম এই বিড়ালটা এসেছে তার প্রতিশোধ নিতে।’
‘তুমি কী ঠাট্টা করছ?’
‘না। আমি একটা কালো বিড়ালকে গাড়িচাপা দিয়ে মেরে ফেলেছি ।’ ‘কালো’ শব্দটার প্রতি বেশ জোর দিয়ে বলল সে।
‘তুমি কী বলতে চাচ্ছ?’
‘এটা শয়তানী শক্তি।’
অচেনা লোকটা তার কপাল কুচকালো এবং গলা উঁচু করে বলল, ‘তুমি কী আমার সঙ্গে সত্যি ঠাট্টা করছ?’
তারা পরিবেশটা উত্তপ্ত করে ফেলায় কাফের কাস্টমাররা কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল।
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা ফিসফিস করে বলল, ‘এখন মনে হচ্ছে তুমিই আমার সঙ্গে ঠাট্টা শুরু করলে।’
‘ভেবে দেখ, আমার প্রিয় বন্ধু। একবার ভাবতো! একটা কালো বিড়াল এক সপ্তাহ ধরে তোমাকে অনুসরণ করছে।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি কীভাবে জানলে এটা এক সপ্তাহ ধরে চলছে?’
অচেনা লোকটা চিৎকার করে বলল, ‘তুমিইতো বললে!’
‘না, আমি বলিনি।’
‘ঠিক আছে! এটা একটা কথার কথা, হতেও পারে কারণ আমার মনে হচ্ছে, এক সপ্তাহ ধরেই তুমি এমনটি করছ।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা রাস্তার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে! তুমি এখন কী বলতে চাও?’
‘শয়তান কী কোনও কালো কুকুর বা কালো বিড়ালের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।’
‘আর?’
অচেনা লোকটা তার মুখ ফ্যাকাশে মুখের লোকটার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল, ‘সে তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘এর কোনও মানে হয় না!’
‘এটা তোমার দুর্ভাগ্য! তুমিই এই শয়তান বিড়ালের বাবাকে মেরেছ।’
‘তুমি কী করে জানলে ওটা তার বাবা, ভাই কিংবা বোন নয়?’
অচেনা লোকটা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল : ‘এটা শুধু অনুমান।’
‘শুধু অনুমান! তুমি আমাকে শুধুই পোচ্ছ, তাই না?’
‘আরে দোস্ত শোনো, শয়তানের আত্মা যে কোনও জিনিসের প্রাণ ফেরাতে পারে। এমন কী প্রাণীরও।’
‘তুমি এখন যাও তো!’
‘আমাকে চলে যেতে বলছ! আমি এক্ষুণি যাচ্ছি, কিন্তু চিন্তা করে দেখ?’
‘কী নিয়ে?’
অচেনা লোকটা রাস্তায় নেমে এসে বলল, ‘বিড়ালটা এখন কোথায়?’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কী জানি।’
‘সে এখানেই আছে।’
‘সে?’ ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তার চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল এবং ঘাবড়ে গিয়ে কাফের চারদিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ, আমিতো বললাম, শয়তান নিজের রূপ বদলে প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারে। তা হলে সে এখন কেন হবে না।’ অচেনা লোকটা একজন ওয়েটারকে উদ্দেশ্য করে বলল।
‘আমি তাকে অনেক বছর ধরে চিনি।’ ফ্যাকাশে লোকটা মন্তব্য করল। ‘ঠিক আছে, সে হতে পারে এখানকার ওই কালো লোকটা। সে তো ওই বিড়ালটার মতোই কালো!’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে অস্বীকার করে বলল, ‘না, আমি তাকে এখানে বসে থাকতে দেখেছি, যখন বিড়ালটা দালানের পাশেই ছিল। যারা এখানে নিয়মিত আসে তাদের সবাইকেই আমি চিনি। অবশ্য অনেক অচেনা লোকও আসে।’
‘আমার মতো!’ ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ!’
অচেনা লোকটা ফ্যাকাশে মুখের লোকটার মাথার সামনে মুখ এগিয়ে এনে বলল, ‘কেন ওই কালো বিড়ালটি নয়?’
‘তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছ!’ ফ্যাকাশে মুখের লোকটা বলল। তার চেহারায় একটা ভয়কাতর হাসি ফুটে ওঠে। ‘একটা ছোট্ট কালো বিড়াল দেখল, তার বাবা দৌড়ে গিয়ে একটা গাড়িতে চাপা পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। বিড়ালটা তার বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে বের হলো।’
‘কিন্তু গত দশটি বছর তুমি কোথায় ছিলে?’
‘আমি তোমাকে খুঁজেছি।’
‘তুমি আমাকে পোচ্ছ।’
অচেনা লোকটা তার রোদচশমাটা খুলল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখ। চোখ দুটো বিড়ালের মতো লাগছে না?’ অচেনা লোকটার চোখ সবুজ। ফ্যাকাশে মুখের লোকটা তার দিকে তাকিয়েই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। এটা বিশ্বাস করতে না পেরে বলল, ‘আমার দাদিমার চোখও সবুজ ছিল। তাই বলে তিনি নিশ্চয়ই বিড়াল ছিলেন না?’
অচেনা লোকটা তার চশমাটা পেছনে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি একটু আসছি!’
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘টয়লেটে।’
ফ্যাকাশে মুখের লোকটা অচেনা লোকটার টয়লেটের যাওয়ার পথে নজর রাখছিল। সে একটা সিগারেট ধরাল এবং ওয়েটারকে পান করার জন্য কিছু দিতে বলল। সে জানালার দিকে ঘুরে বসল। দেখল, পুরনো দালান থেকে একটা কালো বিড়াল তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সে খুব ভয় পেল, কিন্তু শিগগিরই নিজেকে সামলে নিয়ে মনটাকে ভয়মুক্ত করল। সে টয়লেটের প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে অচেনা লোকটার ফিরে আসার অপেক্ষা করছে। বিড়ালটার দিকে সে আবার তাকিয়ে দেখে। এবার একবার বাথরুমের দরজার দিকে আবার বিড়ালের দিকে চোখ রাখে।
তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে এবং নিজেকে নিজে বলে, ‘এভাবে কতক্ষণ সহ্য করতে হবে?’
ওয়েটার এক কাপ চা এনে টেবিলে রেখে বলল, ‘আমাকে কিছু বলছেন?’
কোনও জবাব না পেয়ে ওয়েটার চলে গেল। সে বিশেষ একটা ভঙ্গিতে তার হাত নেড়ে অন্য ওয়েটারদের বোঝাতে চাইল, লোকটার মেজাজ বিগড়ে আছে। ফ্যাকাশে মুখের লোকটা আবার আপন মনে বলতে লাগল, ‘এটা কী সম্ভব যে অচেনা লোকটা আসলে একটা বিড়াল। তা না হলে যখন বিড়ালটা দেখা যায়, তখন লোকটা থাকে না কেন?’
ইঁদুরের মতো নিশ্চুপ হয়ে সে আবারও বিড়ালটাকে দেখছে। দেখতে দেখতে সে ভয় পেয়ে যায় এবং নিজেকেই প্রশ্ন করে, ‘তাহলে কীভাবে লোকটা জানল, আমার একটা গাড়ি আছে? সে কীভাবে জানল, এক সপ্তাহ আগে একটা বিড়াল আমার পিছু নেওয়ায় আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আর সে জানলো কীভাবে, ওই বিড়ালটার রং ছিল কালো?‘
‘অচেনা লোকটা তো আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। সে যখন আমার সঙ্গে কথা বলে, সে একটা ব্যাপার বেশ জোর দিয়ে বলে- বিড়ালটাকে আমি গাড়ি চাপা দিয়ে মেরেছি, সে ওই বিড়ালটার বাবা।’ বিড়ালটা এখনও সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে এবং ফ্যাকাশে মুখের লোকটাকে দেখছে।
সে টয়লেটের দরজার দিকে লক্ষ রাখছে। মনে মনে ভাবছে, ‘অচেনা লোকটা দ্বিতীয়বার টয়লেটে গেছে আধা ঘণ্টা আগে, অথচ এখনও আসছে না। ব্যাপারটা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তা ছাড়া প্রথমবার যখন চলে গেল, তারপর দেখা গেল, সে বড় রাস্তার দিক থেকে আসছে। ওহ!’ দুশ্চিন্তায় লোকটা খুবই দিশেহারা হয়ে পড়ল।
তার বেরিয়ে আসা চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, ‘সেই লোকটাই কী ওই বিড়াল? তার চোখ দুটোতো সবুজ।’ ফ্যাকাশে মুখের লোকটা চোখে ধাঁধাঁ দেখছে। তার চোখে ভাসছে, তার সামনে অচেনা লোকটা বসে আছে। হঠাৎ সে তারওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তার খুব কাছাকাছি হয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে কান্না জড়ান কণ্ঠে বলতে থাকে ‘আমি ওকে খুন করব।’
নিয়মিত কাস্টমাররা ফ্যাকাশে মুখের লোকটার কান্না শুনে চমকে ওঠেন। পরক্ষণেই সে তার পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে এবং বাইরে এসে বিড়ালটাকে খুঁজতে থাকে। তার চোখে ভাসে, বিড়ালটাই সেই অচেনা লোক। সে চিৎকার করে বলে, ‘আমি ওকে খুন করব আর তোমাকেও।’
সে ছুরি হাতে বাইরে এসে বড় রাস্তা দিয়ে পুরনো দালানটার দিকে ছুটে গেল। একটা লরি তখন তাকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয়। সে পুরনো দালানের কাছে ছিটকে পড়ে। একদল ট্রাফিক চিৎকার করে ওঠে মার্চ করার সময়। লোকজন দৌঁড়ে আসে তার কাছে এবং তার চারপাশে গোল হয়ে ভিড় জমায়।
একজন লোক ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে এবং জোরে জোরে বলে, ‘আমি লোকটাকে চিনি! আমরা কিছুক্ষণ আগে একসঙ্গে বসেছিলাম।’সে মারা গেছে। কেউ একজন তার মুখটা এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। তার চোখ দুটো যেন এখনও ওই পুরনো দালানের নিচে ফেলে রাখা জঞ্জালের স্তূপের দিকে। একটা কালো বিড়াল সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।’
--------------------------------------------------------
মূল লেখকঃ ইয়াসির আবদেল বাকি
ভাষান্তর : রানা আশরাফ
ইয়াসির আবদেল বাকির জন্ম ১৯৭২ সালে এডিনে। তিনি ইতিহাস ও প্রত্মতত্ত্ব বিষয়ে বিএ ডিগ্রি নেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু ছোটগল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন। তিনি ইয়েমেন লেখক ইউনিয়নের আল-মানারা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলির পরিচালক। তার আরবি ভাষায় লেখা ‘আল-হিরা আল-আসওয়াদ’ (কালো বিড়াল) গল্পটি আলী আজেরিয়াহ ‘দ্যা ব্ল্যাক ক্যাট’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।