সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সামান্য একটু আগে মনি মেডিকেল হলের সামনে একটা রিকশা এসে থামে। সজ্ঞানে হোক অথবা অসতর্ক আঙ্গুলের চাপেই হোক, টুংটাং করে সেই রিকশার বেল বেজে ওঠে দুবার। আরোহী ভদ্রমহিলার সেদিকে বিশেষ ভ্রূক্ষেপ নেই। তার দৃষ্টি দোকানের সাইনবোর্ডের উপরে।
ছোট্ট এই গ্রাম্য বাজারে উল্লেখযোগ্য ওষুধের দোকান বলতে এ একটাই। রিকশাঅলারও মোটেই অচেনা নয়। তবে সে এ দোকানটাকেই বলে ডিসপেনসারি, কালাম ডাক্তারের ডিসপেনসারি। ভদ্রমহিলা প্রথমে কপাল কুঁচকে তাকান, মনের সংশয় তার মুখে ফুটে বেরোয়- কালাম ডাক্তার!
একগাল হেসে রিকশাঅলা জানায়,
হ্যাঁ, চিনি। এ তল্লাটের নামকরা ডাক্তার, সবাই চেনে।
ভদ্রমহিলা শেষবারের মতো যাচাই করে নিতে চান। বলেন,
ডাক্তার তো কালামের বাবা। জালাল ডাক্তার।
রিকশাঅলা হাসিমুখে ভুল শুধরে দেয় আগন্তুকের,
জালাল কম্পাউন্ডারের ছেলেই তো কালাম ডাক্তার। আপনি যাবেন কোথায়- ডিসপেনসারি, নাকি ডাক্তারবাড়ি?
আমি দুজাগাতেই যাব। রিকশায় উঠে বসে আগন্তুক জানতে চান, আগে-পড়ে কোনটা, বাড়ি না দোকান?
রিকশাঅলা আঙ্গুল তুলে দেখায়,
ওই তো সামনেই কালাম ডাক্তারের ডিসপেনসারি।
আগন্তুক সামনে তাকায়। পেছনে তাকায়। বড় বড় শিলকড়-ইয়ের গাছ ডালপালা মেলে ছোট্ট এ বাজারকে কী সুন্দর ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে! কিন্তু এখানে কি আদৌ এ বাজার ছিল আগে! কী যে স্নিগ্ধ প্রাণজুড়ানো ছায়া! সেই ছায়ায় ছায়ায় রিকশা এসে থামে মনি মেডিকেল হলের সামনে। ভেতরে একবার উঁকি দিয়ে রিকশাঅলা বলে,
ওই তো ডাক্তার সায়েব রোগী দেখছেন!
আরোহী নেমে পড়েন রিকশা থেকে। ছোটখাটো ট্রাভেল ব্যাগটা রিকশার পাদানিতে রেখেই তিনি ধীর পায়ে গিয়ে ঢোকেন মনি মেডিকেল হলের ভেতরে। ভেতরে ঠিক নয়, বাইরে বারান্দাতেই ঠেস বেঞ্চে বসে আছে বেশ কজন গ্রাম্য রোগী, বেঞ্চের উল্টোদিকে ডাক্তারের টেবিল-চেয়ার।
এক বৃদ্ধ মহিলার বুকে-পিঠে স্টেথো লাগিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে রোগ নির্ণয় করছেন ডাক্তার। আগন্তুক তবু ব্যস্তকণ্ঠে ডেকে ওঠেন- ডাক্তার বাবু!
আগন্তুকের দিকে না তাকিয়েই ডাক্তার বলেন,
এমন তাড়াহুড়ো করলে তো চলবে না। বসতে হবে।
আগন্তুক আশপাশে তাকিয়ে বুঝিবা বসার জায়গা খোঁজেন। বেঞ্চে বসে থাকা মধ্যবয়সী এক মহিলা পাশের বাচ্চাটিকে হাঁটুর উপরে উঠিয়ে নিয়ে একটুখানি জায়গা করে দিয়ে আগন্তুকের দিকে তাকায়। এদিকে তার বুকের মধ্যে ন্যাকড়া-জড়ানো শিশুটির স্তন্যপানে বিঘ্ন ঘটায় ট্যাঁ করে চেঁচিয়ে ওঠে।
এদের তিনজনের মধ্যে কে যে রোগী, আগন্তুক সেটা নির্ণয় করতে পারেন না, তবে বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটুকুর দিকে আড়চোখে তাকান। অতঃপর তার দৃষ্টি আটকে যায় দোকানের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরের দিকে। ফর্সা ধবধবে সুন্দর চেহারা, মাথাভরা কালো কোঁকড়ানো চুল।
আলমারি থেকে ওষুধপত্তর নামাচ্ছে, তুলছে, রোগীর হাতে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আগন্তুক এগিয়ে এসে সেই কিশোরকে জিজ্ঞেস করে,
তুমি তো ডাক্তারবাবুর ছেলে, তাই না?
ছেলেটি সংক্ষেপে উত্তর দেয়- জি।
কী নাম তোমার?
পলাশ। শরিফুল ইসলাম পলাশ।
এতণে ডাক্তারের দৃষ্টি পড়ে এ দিকে। গলায় ঝুলন্ত স্টেথোর একপ্রান্ত হাতের মুঠোয় দাঁড়িয়ে থাকে অচঞ্চল, তিনি আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চেয়ারের খোঁড়ল ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন,
অর্চনাদি তুমি!
আগন্তুক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন,
থাক থাক। তুমি ব্যস্ত ডাক্তার। যা করছ করো। আমি ছেলের সঙ্গেই কথা বলি।
না না, ডাক্তারি মানে
সহসা মনি মেডিকেল হলের পরিবেশটাই বদলে যায়। নিজের চেয়ার ছেড়ে ত্রস্তপায়ে কালাম ডাক্তার এগিয়ে আসেন সামনে, চোখে-মুখে তার অপার বিস্ময়, ছেলেকে ডেকে বলেন,
তোর অর্চনা পিসিকে চিনতে পারছিস তো পলাশ? আমাদের অর্চনাদির কথা বলিনি তোকে!
আগন্তুক এবার মিষ্টি করে হাসেন। মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে, তবু হাসলে এখনও তার গালে টোল পড়ে। পলাশ লাজুক চোখে তাকায়। তারপর বলে,
আমি চিনতে পারিনি পিসি। ভুল হয়ে গেছে।
এতক্ষণে শব্দ করেই হেসে ওঠেন আগন্তুক। পলাশের মাথায় হাত রেখে বলেন,
পাগল ছেলে! তুই চিনবি কী করে? দেখেছিস কখনও আমাকে? তোর বাবাই এখন চিনতে চাইছে না দেখছি!
ডাক্তারের কণ্ঠে আছড়ে পড়ে আর্তনাদ,
দিদি! এখনও আমি বুঝতে পারছি না- সত্যি দেখছি তো! তুমিঃ
আমি অর্চনার প্রেতাত্না, তাই তো!
না না অর্চনাদি, সত্যিই তুমি এলে!
হ্যাঁ, এলাম। আসব, সে তো আমি বলেই ছিলাম।
সে তোমার কবেকার কথা, মনে আছে?
বছরপাঁচেক হবে হয়তো। তা হোক। এলাম তো শেষে!
একাই এলে?
হ্যাঁ, আমার গরজে আমি একাই এলাম।
ভিসা-পাসপোর্ট লাগেনি?
লাগেনি আবার! সেই হাঙ্গামা পোহাতেই তো দেরি হয়ে গেল!
কাকিমা কেমন আছেন অর্চনাদি?
সব খবর এখানে বসেই দিতে হবে? বাড়ি যাব না আমি?
এতক্ষণে যেন কালাম ডাক্তারের খেয়াল হয় যে অতিথিকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। সহসা অতি তৎপর হয়ে ওঠেন। তখনও গোটা তিনচারেক রোগী বসে আছে। কিন্তু তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, আজ আর রোগী দেখবেন না। এ কথা শুনে আগন্তুক ভয়ানক তেড়ে ওঠেন, রোগী দেখার কাজ শেষ করে বাড়ি আসতে বলেন।
কালাম ডাক্তার শেষ পর্যন্ত ছেলেকে দায়িত্ব দেন- পিসিকে নিয়ে বাড়ি যাও, আমি আসছি।
পলাশ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু আগন্তুক হেসে বলেন,
এ গাঁয়ের পথঘাট এখনও আমার মনে আছে ডাক্তার বাবু, কিছুই ভুলিনি।
আগন্তুকের কণ্ঠে হঠাৎ বিষন্নতা ছলকে ওঠে। সেই বিষন্নতার কালো মেঘ তার মুখের হাসিকেও যেন আড়াল করে দাঁড়ায়। কী বুঝে যেন কালাম ডাক্তার তখন বেশ জোর দিয়ে বলেন,
না না ভুলবে কেন! মাটির টান আর নাড়ির টান, একই কথা।
আগন্তুক রিকশার দিকে পা বাড়ান। ডিসপেনসারির বাইরে এসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, মামা এখন কেমন আছেন কালাম?
ঠিক তখনই দপ করে বাতি নিভে যায়। প্রগাঢ় অন্ধকারে গ্রাস করে চরাচর। এ সুযোগে কালাম ডাক্তার বেচারা রিকশাঅলার ওপরে তম্বি করেন- অ্যাই, কেরে? শমসের না? অন্ধকারে যেতে পারবি তো?
রিকশাঅলা শমসেরের জবাব শোনার আগেই আবার তাড়া লাগান,
কইরে পলাশ! টর্চ নিয়ে আয় দেখি!
আগন্তুকও আহ্বান জানান,
চল বাবা, আমরা বাড়ি যাই। তোর বাবা পরে আসছে।
যে প্রশ্নের অপ্রিয় উত্তর এড়াবার জন্য কালাম ডাক্তার অন্ধকারের আড়াল নেন, কৌশল খাটান, শমসেরকে ধমকান এবং অতিথিকে রিকশায় তুলে বিদায় দেন, ডাক্তার বাড়ি পৌঁছানোর পর আবার সেই প্রশ্নটিই এক ধাক্কায় সামনে চলে আসে।
রিকশা থেকে নেমে আগন্তুক একবার অন্ধকারেই ঘাড় উঁচু করে তাকান ডাক্তারবাড়ির দিকে। স্থানীয় মানুষ এখনও ডাক্তারবাড়িই তো বলে! শমসের রিকশাঅলার মুখেও ওই নামই শোনা গেছে। বদলে গেছে কত কিছুই। তবু রয়ে গেছে ডাক্তারবাড়ির নাম।
মনি ডাক্তার নেই, তবু কি তারই নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ মনি মেডিকেল হল? অন্ধকারে প্রাচীন দোতলা বাড়িটিকে কেমন দৈত্যদানবের মতো মনে হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আগন্তুকের। পাশেই আছে পলাশ, তবু কেমন যেন ভয় পাওয়া গলায় সজোরে ডেকে ওঠেন- মামা!
কোথাও কোনও উত্তর নেই।
মামা ডাকটুকুই বাতাসে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়। রিকশার পাদানির ওপর থেকে ট্রাভেল ব্যাগ হাতে নিয়ে পলাশ ডাকে,
পিসি, বাড়ির মধ্যে চলুন আগে।
দাঁড়া, দাঁড়া। তুই বল তো পলাশ, মামা কোথায়?
পলাশের মুখে কথা সরে না। হ্যারিকেনের আলো উসকে এক বৃদ্ধা সদর দরজার বাইরে এসে খিনখিনে গলায় জিজ্ঞেস করেন,
কে গো বাছা, কে এলে?
পলাশ আগ বাড়িয়ে জানায়,
ইন্ডিয়া থেকে অর্চনা পিসি এসেছে দাদী।
কে এসেছে?
আগন্তুক দৌড়ে গিয়ে বৃদ্ধাকে আঁকড়ে ধরেন,
আমি অর্চনা মামী, তোমার পোড়ামুখী মেয়ে।
অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধা ডুকরে ওঠেন। অর্চনার মুখে তবু সেই দুর্মর প্রশ্ন,
আমার মামা কোথায়?
উচ্চারিত বাক্যে নয়, বৃদ্ধার বাঁধভাঙা কান্নাপ্রবাহ থেকেই প্রকটিত হয়ে ওঠে ওই প্রশ্নের উত্তর। আগন্তুকের তখন কি যে প্রতিক্রিয়া হয়, উচ্ছ্বসিত কান্নার ধাক্কা টের পাওয়া যায় না তার চোখেমুখে; ধপাস করে বসে পড়ে মাটিতে। তার বুক ফুঁড়ে ডুকরে ওঠে আর্তনাদ- মামা নেই!
দুই.
বছরপাঁচেক আগে কালাম ডাক্তারের বাবা জালাল কম্পাউন্ডারের পীড়াপীড়িতেই এপার ওপার দুই পরিবারের মধ্যকার ছিন্নপ্রায় সম্পর্কসুতোটি আবারও একরকম জোড়া লেগে ওঠে। স্মৃতির বালিয়াড়িতে অনেক খোঁড়াখুঁড়ি চলে, চোখ ঝাপসা করা কথার কাসুন্দি উঠে আসে রাশি রাশি, সেই সঙ্গে বুকভাঙা তপ্ত দীর্ঘশ্বাসও।
অনেকদিন থেকেই জালাল কম্পাউন্ডারের মেরুদণ্ডে অসুখ। নিজের ঘটে চিকিৎসাবিদ্যার যেটুকু আছে, তা মোটেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাওয়া নয়; ডাক্তার মনীশ রায় তাকে হাতে-কলমে যা শিখিয়েছেন বা দেখিয়েছেন, সম্বল সেটুকুই।
তা সেই বিদ্যা গ্রামের মানুষের সাধারণ চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট হলেও নিজের চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি অচিরেই টের পানÑ প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটা অপ্রতুল। কুষ্টিয়ায় গিয়ে ডাক্তার দেখান, ছ’মাস পর ঢাকায় গিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মুখে জানা গেল- স্পাইনাল কর্ডের জটিল সমস্যা। সেরে উঠতে ঢের সময় লেগে যাবে। এসব শোনার পর জালাল কম্পাউন্ডার মনে মনে কী যে অঙ্ক কষেন, তার খুব বাঁচার সাধ হয়, একদিন ছেলেকে ডেকে বলেন,
আমি কলকাতা যাব কালাম, ব্যবস্থা করো।
কলকাতা যাবেন? কালাম যেন চমকে ওঠে- ঢাকার চিকিৎসায় কাজ হবে না?
সোজাসাপটা উত্তর,
না, হবে না। কিছুণ দম ধরে থেকে তারপর ঘোষণা দেন, মনিদাকে না দেখালে আমার অসুখ সারবে না।
কালাম খুব অবাক হয়ে তার জন্মদাতার মুখের দিকে তাকায়। সারামুখে বিষন্নতার মেঘ জমে আছে। দুচোখে দূরের আভাস। মনিদা মানে কালামের মনিকাকা, ডাক্তার মনীশ রায়। এ ডাক্তারবাড়ির মালিক। জালাল কম্পাউন্ডারের গুরুদেব। একাত্তরে সব হারিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে, কলকাতার উপকণ্ঠে বেলঘোরিয়ায়।
একমাত্র ছেলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে, কালামের বড়ভাই সালামের সঙ্গে, দুজনের কেউ বাড়ি ফেরেনি। একমাত্র মেয়েকে পাকিস্তানি নরপশুর দল এসে একদিন ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেছে আর্মিক্যাম্পে। বলা যায় সেও আর ফিরে আসেনি। যুদ্ধের পর পরিত্যক্ত আর্মিক্যাম্প থেকে তার নামে যাকে উদ্ধার করা হয় সে যেন তার প্রেতাত্না।
তো এভাবে সন্তান হারানোর পর আর কী-ইবা বাকি থাকে হারাতে! মনি ডাক্তারের দম বন্ধ হয়ে আসে পরানপুরের বাতাসে। ঘরবাড়ি, বাগান-পুকুর, জমিজিরেত এমনকী ডাক্তারি পেশায় অর্জিত খ্যাতিসম্মান সব কিছু পিছনে ফেলে তিনি সস্ত্রীক চলে যান ওপারে।
এপারের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি এককথায় দিয়ে যান প্রিয় শিষ্য জালাল কম্পাউন্ডারকে। কিন্তু জালালউদ্দীন দিনে দিনে সে সম্পত্তি একটু একটু করে বিক্রি করে বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে টাকা-পয়সা পাঠিয়েছেন কলকাতায় মনিদার কাছে। পঁচাত্তরের পর এ ডাক্তারবাড়ি এবং বাড়িসংলগ্ন পুকুর বিক্রির কথা উঠলে মনীশ রায় চিঠি লিখে জানান- এ সম্পত্তি নাকি তার নয়, কাজেই এ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দিতেও পারবেন না।
এ ডাক্তারবাড়ি তা হলে মনি ডাক্তারের নয়? পরের চিঠিতেই কিনারা হয় রহস্যের। এ বাড়ি ও পুকুরের কাগুজে মালিক ডাক্তার মনীশ রায়ের স্ত্রী অতসী রায়। জালালউদ্দীন তাকে বৌদি না ডেকে দিদি ডাকে, তার পেটের ছেলেমেয়েরাও সেই সুবাদে জালাল মামা ডাকে।
অতসী রায় এ সম্পত্তি বিক্রি না করে ভাইকে দান করেন। এসব সেই কবেকার কথা! দুই দেশের সরকারে পরিবর্তন এসেছে, সীমান্তে কড়াকড়ি হয়েছে, দুই পরিবারের যোগাযোগও কমে এসেছে। সামান্য চিঠিপত্রের আদান-প্রদান পর্যন্ত কবে কবে থেমে গেছে, সেটাও যেন ঠিকমতো মনে পড়ে না।
এতদিন পর বাবার মুখে মনিকাকার নাম শুনে তাই কালাম প্রথমে একটুখানি চমকে ওঠে, বাবার অন্তর জরিপ করে, বুঝতে চেষ্টা করে ‘মনিদাকে না দেখালে আমার অসুখ সারবে না’- এ কথার মানে কী! না দেখালে, নাকি না দেখলে?
অসুস্থ মানুষ, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার মনীশ রায়ের কথা তার মনে পড়তেই পারে; বিশেষত তিনিও ডাক্তারি-বিদ্যার হাতেখড়ি লাভ করেছেন তার কাছেই। কিন্তু এর অধিক কিছুই নয়! কালাম এ গ্রাম্য পরিবেশে পরশ্রীকাতর কিছু মানুষের মুখে শুনেছে- তার বাবা মনি ডাক্তারের সহায়-সম্পত্তি ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে।
একজন তো কাগজপত্র জাল করে কোর্টে মামলা পর্যন্ত ঠুকেছিল। সে মামলা অবশ্য টেকেনি পরে। কালামের মনে একবার সংশয় জাগে- এসব নিয়ে বাবার অন্তরে কোনও অনুশোচনা জমেছে নাকি! অথবা এসব কিছুই নয়, বহুদিন পর মনিকাকার স্মৃতি মনে পড়ায় ভেতরে ভেতরে উথাল-পাথাল হয়ে পড়েছেন, তাই এখন একবার দেখা করার জন্য এত ব্যাকুলতা।
তা যাব বললেই তো আর এক দেশান্তরে উড়ে যাওয়া যায় না! পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা চুকিয়ে তবেই বর্ডারে পা বাড়াতে হয়। অবশেষে অসুস্থ বাবাকে কাঁধে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে খুঁজে পেতে মনিকাকার বাড়ি ঠিকই আবিষ্কার করে কালাম, কিন্তু পিতাপুত্র দুজনেই ভয়ানক হোঁচট খায়। বিধবার বেশে সামনে এসে দাঁড়ান কাকিমা।
জালালউদ্দীনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই কান্নাপ্রবাহ কিঞ্চিৎ থিতিয়ে এলে আপেভরা কণ্ঠে বলেন, সেই তুমি এলে ভাই, আরও আগে কেন এলে না! তোমার দাদা চোখ বুঁজবার আগে দিনরাত তোমার কথা বলত, তোমাকে দেখতে চাইত। মাত্র মাসচারেক আগে গত হয়েছেন মনীশ রায়।
সেই শোকে সারা বাড়ি এখনও থমথমে। এর মধ্যে অসুস্থ জালালউদ্দীন এসে এই সংবাদ শুনে আরও শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তখন বুকের মমতা ঢেলে সেবাযত্ন করেন কাকিমা এবং অর্চনাদি। সেই অচেনা নগরীতে রোগীর চিকিৎসা নিয়ে বিশেষ কিছুই ভাবতে হয় না কালামকে। একা সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন অর্চনাদি।
মনিকাকার সাধ ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়াবেন, হয়নি। ছেলেই হারিয়ে গেছে যুদ্ধে। দুধের সাধ ঘোলে মেটাবার মতো হলেও অর্চনাদি নার্সিং পড়ে বাবাকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছেন। বাবার অবর্তমানে সংসারের হাল ধরেছেন। জালাল মামাকে হসপিটাল-নার্সিংহোমে টানাটানিও তার দায়িত্ব।
আর জালালউদ্দীন তো মা বলতে অজ্ঞান। নিজের মেয়ে নেই। কালামের স্ত্রীকেই মেয়ের মতো ভালবাসেন। তবু পুত্রবধূ বলে যে সূক্ষ্ম দূরত্ব নিভৃতে অনুভব করতেন, অর্চনাদির আদরভক্তি সেই দূরত্বও নিঃশেষে ঘুচিয়ে দেয়। কালামের চেয়ে বছরদুয়েকের বড় হবে অর্চনা।
বয়সের এ সামান্য ব্যবধান শৈশব-কৈশোরে বন্ধুত্ব গড়তে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। গ্রামের ঝোপঝাড়ে, পুকুরপাড়ে, নদীর তীরে দু’জনের শিশুবেলার কত না রঙিন স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। নির্দ্বিধায় পরস্পরকে তুই-তোকারি চালিয়ে যাওয়ার কি যে বেহিসেবি ছিল সেইসব দিন!
মুক্তিযুদ্ধের সেই বছরে কালামের বাবাই একদিন ধমকে বলেন- অর্চনা পড়ে কাস টেনে, বয়সে তোমার চেয়ে বড়, দিদি বলতে পারো না? বাবার সামনে ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানালেও বাস্তবে তা পারেনি কালাম। দুচারদিন চেষ্টাও করেছে, অর্চনা জিভ ভেংচিয়ে সব নষ্ট করে দিয়েছে।
একদিন সে স্পষ্ট জানিয়েছে, তুমি তুমি করলে কেমন যেন বড়মানুষের মতো লাগে; ওসবে আমার দরকার নেই বুঝেছিস? এত বছর পর কলকাতায় এসে কত সহজেই কালাম ‘তুমি’ বলতে পারে, অর্চনাদি বলে ডাকতে পারে; বাধে না কিছুতেই। অর্চনাদিও আর তুই পর্যন্ত নামতে পারে না।
এখন বরং দৃশ্যাতীত অন্য এক সংকোচের বাধা কালামকে ম্রিয়মাণ করে রাখে। অর্চনার সিঁদুররাঙা সিঁথি দেখে খুব ভালো লাগে, কিন্তু তার ঘর সংসার কিংবা সন্তানাদি প্রসঙ্গে কিছুই শুধানো হয় না। কোথায় যে বাধা সেটাও ঠিক নির্ণয় করতে পারে না। অথচ নিজের স্ত্রী-পুত্রের কথা সে দিব্যি জাহির করে বলেছে।
ছেলেটি ক্লাস ফাইভে পড়ে। ভালো ছাত্র। ওর দাদুর ইচ্ছে ডাক্তারি পড়াবার। এসব নিয়ে কত কথা হয়; হয় না কেবল অর্চনাদির ব্যক্তিগত জীবনের এ অধ্যায়ের কথা।
কলকাতার নামকরা ডাক্তারের চিকিৎসা এবং প্রিয় পরিজনের আন্তরিক সেবাযত্নে জালালউদ্দীনের স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলে দেশে ফেরার জন্য প্রাণ আনচান করে।
ছেলেকে তাড়া লাগান- ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে এল, বাড়ি যেতে হবে না কালাম! ধীরে ধীরে সবদিক গুছিয়ে কালামও সেই আয়োজন করে। কাকিমার অনুরোধে একদিন, অর্চনাদির আবদারে আরও একদিন, এভাবে সময় একেবারে ফুরিয়ে এলে বিদায় নেওয়ার আগের রাতে কালাম হঠাৎ জিজ্ঞেস করে- আমাদের দেশে কখনও যেতে ইচ্ছে করে না অর্চনাদি?
দীর্ঘশ্বাসের গা পেঁচিয়ে অর্চনাদি জবাব দেয়, তোমাদের দেশে?
না মানে বাংলাদেশে। আমাদের সেই পরানপুরে একবার যাবে না?
হ্যাঁ, যাব একবার।
যাবে? কালাম একেবারে লাফিয়ে ওঠে, কবে যাবে বলো তো দিদি!
তা তো জানি না। তবে যেতে খুব ইচ্ছে করে।
বেশ তো! তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট করে ফ্যালো দেখি!
ওই তো মুশকিল। পাসপোর্টের কথা শুনলেই যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে যায়। আমাদের পরানপুরে যেতে আবার পাসপোর্টের হাঙ্গামা কেন?
পরানপুরের অবস্থান বাংলাদেশে। আর তুমি এখন ভারতে বাস কর। দুটো দুই দেশ। যাওয়া-আসার জন্য পাসপোর্ট তো লাগবেই। এ সহজ কথাগুলো কালামের মনে আসে ঠিকই, মুখে বলতে পারে না। এ জবাব নিশ্চয় অর্চনাদিও খুব জানে। আসলে তার মনের মধ্যে জমে আছে ব্যথার পাহাড়। সেই পাহাড়চূড়া থেকে যেনবা বরফ গলে পড়ে। একটু দম নিয়ে সে বলে,
তোমাদের বাংলাদেশের জন্য আমাদের গোটা জীবন ওলোটপালোট হয়ে গেল। তবু আজ পাসপোর্টটাই বড় হল!
কালামের মুখে কথা সরে না। একাত্তরের অনেক ঘটনাই তার মনে পড়ে। বড় হতে হতে সে সব ঘটনার একরকম ব্যাখ্যাও সে মনে মনে করে নিয়েছে। তা নিয়ে কাউকে কিছু শুধায়নি। তবু অর্চনাদিকে জড়িয়ে নানা কথা কানে এসেছে। এতদিন পর এক ঝটকায় সব কিছু ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। কথা বলবে কী করে কালাম?
শেষ পর্যন্ত অর্চনাই ঘোষণা করে- তবু একবার আমি যাব পরানপুরে।
এসবের কিছুই না জেনে সকালে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে অর্চনার মাথায় হাত রেখে জালালউদ্দীনও শিশুর মতো আবদার করেন- তুই একবার পরানপুরে আসিস মা।
বায়নাধরা অবুধ বালিকার মতো করে অর্চনা বলে,
যেতে পারি এক শর্তে মামা।
শর্ত! কী শর্ত মা?
আমি যা চাইব, তাই দিতে হবে।
জালালউদ্দীন আনন্দের সঙ্গে জানান,
তোদের বাড়িঘর বাগান পুকুর- সব আগের মতো আছে। শুধু মনিদার ডিসপেনসারিটা কালাম নিয়ে গেছে বাজারে।
মাঝপথে জালাল মামার কথা থামিয়ে অর্চনা বলে,
ওসব আমি কিছুই চাইনে মামা, চাই অন্য কিছু।
আমি সব দিতে প্রস্তুত। কী চাস বল তো মা!
না মামা, সেটা পরানপুরে গিয়েই চাইব।
বেশ তাই হবে। তুই আগে আয় তাহলে।
তিন.
অর্চনার সেই আসা আসতে আসতে এই এতদিন।
এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। প্রথম দিকে বছরখানেক বেশ পত্রযোগাযোগ গড়ে ওঠে। দুপরে চিঠিতেই থাকে স্মৃতিজাগানিয়া বিবরণ। এদিকে কালামের চিঠিতে থাকে উদার আমন্ত্রণ- অর্চনাদি, এসে বেড়িয়ে যাও। জালাল কম্পাউন্ডারও একবার বেড়াতে আসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন অর্চনাকে।
সে চিঠির এক কোণায় পুনশ্চ দিয়ে লেখেন- ‘তোমার যে কোনও দাবি পূরণ করিতেই আমি ইচ্ছুক। কিন্তু দাবিটি যে কী তাহা আগাম জানাইলে তোমার এই অধম সন্তানের পক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণ করা সহজ হইবে।’ অর্চনার কোনও চিঠিতে সেই শর্ত কিংবা দাবির ব্যাখ্যা ছিল কীনা কে জানে!
বছরখানেক পর চিঠি চালাচালিই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। মনে পড়ে না তা নয়, গরজ করে চিঠি লেখা আর হয়ে ওঠে না।
তাই বলে জালাল মামার মৃত্যু সংবাদটা পর্যন্ত দেবে না কেউ!
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে অর্চনার দম বন্ধ হয়ে আসে। মামাও এভাবে ফাঁকি দিয়ে গেল! তবে আর পাসপোর্ট-ভিসার এত হাঙ্গামা পেরিয়ে, এত পথ ঘুরে এই এ্যাদ্দূরে আসার কী মানে হয়! অর্চনা সত্যি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না। কথা বলার ইচ্ছেই জাগে না।
কালাম ডাক্তার অনুতপ্ত হয়, সোজাসুজি মাই চেয়ে বসে- আমার ভুল হয়ে গেছে দিদি। বাবার মৃত্যুর পর আমার মাথা ঠিক ছিল না। খবরটা তোমাকে জানানো হয়নি। তুমি মাফ করে দাও।
রাত যায়। দিন যায়। সারাদিনে অর্চনা কারও সঙ্গেই কথা বলে না। নাওয়া-খাওয়া করে না। ওর বাবা-মা যে ঘরে বাস করতেন সেই ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কলকাতায় বসে কালামের সঙ্গে পরিকল্পনা হয়েছিল- একদিন দুজনে মিলে আমরা আবার বাগানে গিয়ে প্রজাপতির সঙ্গে নাচব, ফড়িঙের পেছনে ছুটব, ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে টুনটুনি পাখি খুঁজব। একদিন একবেলার জন্য না হয় ছেলেমানুষ হয়ে যাব।
ইশারা-ইঙ্গিতে সেসব পরিকল্পনার কথাও মনে করিয়ে দেয় কালাম। কাজ হয় না কিছুতেই। পরদিন গভীর রাতে মামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে হঠাৎ ডুকরে ওঠে অর্চনা। মামী ডানহাত দিয়ে সারা গায়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। অর্চনার সারাশরীর ফুলে ওঠে, কেঁপে ওঠে। মামী এবার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলেন- ওঠ মা, একটা কিছু মুখে দে। দানাপানি পেটে নেই। বাঁচবি কী করে?
অর্চনা সেদিকে যায় না। মামীর শরীর আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,
একদিন তুমি আমাকে পোড়ামুখী মেয়ে বলেছিলে, মনে আছে মামী?
এবার মামীর বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়,
সে-সব কথা মনে করতে নেই মা।
কেন মনে করতে নেই? কেন পোড়ামুখী বলেছিলে মামী?
সেই কবেকার কথা, মন থেকে মুছে ফেলতে পারিসনি হতভাগী!
অর্চনার গায়ে হাত রেখে মামী এবার কেঁদে ফেলেন। নিজের পেটে কন্যাসন্তান আসেনি বলে খুব দুঃখ তার। সেই দুঃখের দাহ জুড়িয়েছিল এই অর্চনাকে হাতে পেয়ে। মেয়েটিকে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, বছরখানেক প্রায় শয্যাগত থাকতে হয়।
সে সময় মা-মেয়ে দুজনেরই সেবাযত্ন করেছেন এই মামী। অর্চনা বড় হতে হতে যতটা তার মায়ের গা-লাগা হয়েছে, মামীর গা-ন্যাওটা থেকেছে তার চেয়ে বেশি। অর্চনার মা মুখ ফুটে স্বীকারও করেছেন- অর্চনার অর্ধেকটা মায়ের, আর অর্ধেকটা মামীর। কিন্তু একাত্তরে এসে ভাগাভাগির সেই হিসাবে ভুল হয়ে যায়।
কাউকে কিছু না বলে সালামের সঙ্গে অবিনাশও মুক্তিযুদ্ধে গেছে, এ ধাক্কা ডা. মনীশ রায় এবং তার স্ত্রী একভাবে সামলে ওঠেন। কিন্তু পাকিস্তানি নরপশুরা একদিন ছোঁ মেরে অর্চনাকে তুলে নিয়ে গেলে ওর বাবা-মা দুজনেই পাগলপ্রায় হয়ে যান।
ভারতে গেলে অবিনাশের দেখা পাওয়া সম্ভব, এরকম এক ছেলেমানুষী হিসাব মাথায় নিয়ে একদিন তারা দুজনেই বর্ডার টপকে চলে যান ওপারে। অর্চনার কী হবে? অর্চনার মা অনেক কাঁদাকাটি করেন। কিন্তু জবাব দিতে পারেন না মুখ ফুটে। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায়- ভাটপাড়া ক্যাম্প থেকে যদি কোনওদিন ছাড়া পেয়ে যায়,
তখন সে দাঁড়াবে কোথায়? তবে কি অর্চনার ফিরে আসাটা মা-বাবা কেউই আর চাইছেন না? মানে চাইতে পারছেন না? কিন্তু যুদ্ধশেষে মুক্তিসেনারা ভাটপাড়া ক্যাম্প থেকে যে কজন অর্ধ উলঙ্গ জীবিত নর-নারীকে উদ্ধার করে আনে, অর্চনাকে তাদের মধ্যেই পাওয়া যায়। আর অর্ধেক নয়, পুরো অর্চনাই তখন মামীর হয়ে যায়।
কিন্তু অর্চনার পেটে যে অনাকাঙ্ক্ষিত মানবপিণ্ড আসছে তার কী হবে? নিজের শরীরের এ হাল, বাড়িতে মা-বাবা নেই, অর্চনা তখন কী করে? আত্নহত্যা করতে উদ্যত হয়। এ মামী বুক দিয়ে আগলে নেন, কিন্তু মুখে তিরস্কার করেন- মরবি তো ওই ক্যাম্পে মরতে পারিসনি পোড়ামুখী মেয়ে!
এত বছর ধরে সেই কথা মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছে অর্চনা। কেবল মামীর সেই তিরস্কারটুকুই নয়, অবাঞ্ছিত সেই মানবপিণ্ডকেও সে মনে রেখেছে। জীবন সংশয় করে হাতুড়ে কবিরাজের দ্বারা গর্ভপাত ঘটান হলে একসময় অর্চনা ভারতে চলে যায় মা-বাবার কাছে।
অবিনাশ নয়, অর্চনাই দিনে দিনে হয়ে ওঠে মা-বাবার ভরসার জায়গা। নার্স হিসেবে সেবা দিতে গিয়েই সৌরভ নামের এক সংস্কৃতিবান যুবকের সঙ্গে পরিচয় থেকে পরিণয় পর্যন্ত ঘটে। কিছুই লুকায়নি তার কাছে। নারী জীবনের এত বড় অপমানকেও সে ভালবেসে সম্মানিত করে।
পোড়ামুখী অর্চনার এতসুখ সইবে কেন? সন্তানহীন নিষ্ফলা সময় যতই গড়ায় সৌরভের ভালবাসার রঙ ততই ফিকে হয়ে আসে। একদা অনাকাক্সিত সন্তানের সম্ভাবনা তার জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিল বটে, তবু মাতৃত্বের দুয়ার তো খুলে দিয়েছিল!
কে জানত যে তাকে হঠাতে গেলে সে যাওয়ার সময় মাতৃত্বের স্বর্ণ দুয়ার এভাবে রুদ্ধ করে দেবে! সৌরভের সব উদারতা এখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। দশ বছরের প্রতীা এবং প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে শেষে সংসার ভেঙে যায়। তখন থেকেই সেই অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের স্মৃতি তাকে দগ্ধায়।
তলপেট ভারি হয়ে আসছে, দুগ্ধভারে নুয়ে আসছে স্তন, শিশু ওষ্ঠের স্পর্শের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে স্তনবৃন্ত- এসব আজ শুধুই স্মৃতি। গভীর রাতে মামীকে জড়িয়ে ধরে অর্চনা জানতে চায়, আমার পেটের সেই অবাঞ্ছিত মানবপিণ্ড তোমরা কোথায় পুঁতেছিলে মামী? সেই মাটি একবার ছুঁতে দাও না!
একটু দম ধরে থেকে মামী জবাব দেন- সারা বাংলাদেশের মাটিই তো তোর সন্তানের মতো! পাগলি মেয়ে! বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখ যে কোনও জায়গায়!