ঢাকা মহানগরীর সকলেরই কমবেশি যানজটের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা রয়েছে। গাড়ি ব্যাবহারকারীরা জোরেশোরে রিকশা কমানো বা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের যুক্তি, দ্রুতগামী মোটরযানের সঙ্গে ধীরগতির রিকশা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং অশিক্ষিত রিকশাওয়ালারা ট্রাফিক আইন মানে না। কিন্তু শিক্ষিত গাড়ি ও বাস চালকেরাও যে আইন খুব মানে এমন বলা যায় কী? আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে এদেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা বিদ্যমান। কিন্তু মাথা ব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলাটাও কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না। আর তাই আমার এ লেখা রিকশার পক্ষে।
ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মসলিন, মসজিদ এবং বর্ণময় অলংকৃত রিকশা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ঈদের ছুটিতে বা হরতালের দিনের আনন্দময় রিকশা চড়ার অভিজ্ঞতা অনেকে মজা করে গল্প করেন। ঢাকা ঘুরে গেছেন এমন কোনো বিদেশীর কাছে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি অবশ্যই রিকশা চড়ার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন। এ সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের কথা মনে করা যেতে পারে। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে রিকশাকে উপেক্ষা করা যায় না।
উপরন্তু রিকশা একটি পরিবেশবান্ধব যান। ইহা বায়ু ও শব্দ দূষিত করে না। শুধু এ কারণে হলেও রিকশা থাকা উচিত। উন্নত দেশগুলো যান্ত্রিক যানবাহনের অপকারিতা অনুধাবন করে এখন মোটরবিহীন যানবাহন বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। পরিবেশবান্ধব যান রিকশা নিউইয়র্কেও দেখা যায়। লন্ডনে এ জাতীয় বাহনকে পেডিক্যাব ও টেক্সাসে বাইক ট্যাক্সি বলে। বাহনের পরিসর বিচারেও রাস্তায় মোটরগাড়ীর তুলনায় রিকশার যাত্রীধারন কার্যদক্ষতা বেশী দেখা যায়।
এবার মানবিক দিকটা বিবেচনায় নেয়া যাক। ২০০৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে (রিকশা তৈরি, যন্ত্রাংশ সরবরাহ ইত্যাদি) রিকশা চালকদের আয়ের উপর নির্ভরশীল (সূত্র: ওয়ার্ল্ড কেয়ারফ্রি নেটওয়ার্ক )। অন্যদিকে রিকশা চালকদের জীবনধারন অনেক কষ্টকর। তারা বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে; তাছাড়া রাস্তায় তারা সবচেয়ে নিন্ম শ্রেণীর। ফলে তারা প্রায়ই ট্রফিক পুলিশ, গাড়ির চালক, যাত্রী, বাসের চালক ও সাহায্যকারীদের নির্যাতনের স্বীকার হয়। ট্রাফিক পুলিশ প্রায়ই তাদের শারিরিকভাবে আঘাত করে। ট্রাফিক আইনে এধরনের কোনো বিধান থাকার কথা নয়, এটা সরাসরি মানবাধিকারের লঙ্গন। বিবিসি’র এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রিকশা চালকদের গড় আয়ু ৪৫ বছর, যেখানে বাঙ্গালির গড় আয়ু পঁয়ষট্টির বেশী। এরপরও এই কঠর পারিশ্রামি রিকশাওয়ালাদের জীবিকার বিরুদ্ধে একতরফা ক্যাম্পেইন কতটা সঙ্গত?
সবশেষে আসি বাস্তব দিকটায়। অনেকে হয়ত বলবেন, হাঁটা স্ব্যাস্থের জন্য ভাল। কিন্তু কখনো সময়ের অভাবে আবার কখনো পারিপার্শ্বিক কারণে হাঁটা সম্ভব হয় না। শহরের যেখানেই বা ফুটপাথ আছে তার বেশির ভাগ ছোট ছোট দোকান, বাসের টিকিট কাউন্টার, ডাস্টবিন ও সিকিউরিটি চেকপোস্টের দখলে। আবার কেউ কেউ জ্যাম এড়াতে মোটর সাইকেল তুলে দেন ফুটপাতে, কেউবা গাড়ি পার্ক করেন; তাছাড়া যেকোনো সময় কান্ডজ্ঞাহীন বাসযাত্রীদের থুথুর শিকার হওয়ার আশংকা তো রয়েছেই। কখনো কখনো ছিনতাইকারী ও বখাটে ছেলেদের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতেও অনেককে রিকশায় চড়তে হয়। অন্যদিকে আছে সিএনজি চালিত স্কুটার। মিটার চালু থাকলে বেশী ভাড়া আসে না। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই চালকরা মিটারে যেতে রাজি হয় না, বিশেষ করে দূরত্ব কম হলে। যেমন গুলশান থেকে বারিধারা, এমন দূরত্বে সিএনজি-চালকরা ৮০ বা ১০০ টাকার কমে যেতে রাজি হয় না। স্বাভাবিকভাবে নগরবাসীদের মধ্যে ৪৯% যাতায়াতের জন্য রিকশার উপর নির্ভরশীল; সিলেট, কুমিল্লা ও রংপুরের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৭৮%, ৮০% ও ৫৫%(সূত্র: বাংলাপিডিয়া )। এর বিপরীতে ঢাকা মহানগরীর মাত্র নয় ভাগ মানুষের গাড়ি আছে। এ পরিসংখ্যানও রিকশা বন্ধের পক্ষে যায় না।
ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট-এর অধীনে মিরপুর ডেমনস্ট্রেশন করিডর প্রজেক্টের উপর গবেষণা করে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে মিরপুর রোডকে রিকশা(non-NMT/ নন-মোটরাইজড ভেহিকল) মুক্ত করার ফলাফল হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়, সার্বিক বিবেচনায় সেগুলো রিকশা বন্ধের পক্ষে যায় না। ফলাফলগুলো এরকম-
• উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে আগের তুলনায় অধিক সময় ধরে, বিশেষ করে পিক আওয়ারে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
• মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের বিকল্প কোনো যানবাহন নেই।
• কিছুক্ষেত্রে রিকশা ভাড়া ও সময় বেশি নেয়।
প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয় যে উক্ত প্রেক্ষাপট রিকশা নেটওয়ার্ক অপসারনের পক্ষে পর্যাপ্ত বিবেচনার অভাব প্রতীয়মান করে।
পরিশেষে বলতে চাই, রিকশা বন্ধ বা চলাচলের পরিধি সীমিত করে খুব বেশি লাভ হবে, জোর দিয়ে এ কথা বলা যাবে না। যানজট সমাধানের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করা উচিত। আশা করছি নীতি নির্ধারকরা নগর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এ ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৭