৯৪ বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগেই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে , বিশ্বকাপ জ্বর। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত যোগ হয় ঢাকার আকাশ, যেদিকে তাকাই পতাকা আর পতাকা ।
মনপ্রাণ ঢেলে কল্পনা সাজাই , আমারো একটা পতাকা আছে , ব্রাজিলের পতাকা , একতলা বাসার ছাদে লম্বা বাঁশের ডগায় পতপত করে উড়ছে। প্রাইমারি পড়ুয়া ছেলে এমন অকালপক্কের মত ফুটবলের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে কেন, আমার আম্মুর সে হিসাব কিছুতেই মেলে না। পড়াশোনা ছেড়ে দিনরাত নিউজপ্রিন্টে ছাপা বিশ্বকাপ প্রস্তুতির খবর গেলার দায়ে বেশ কয়েক রাউন্ড উত্তম মধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার পর, পতাকার কল্পনা মুখ ফুটে বলার সাহস হয়ে ওঠে না।
পতাকাহীন এই আমার ক্ষুধা মেটে তাই অন্যের পতাকা দেখে। রামপুরা টু মতিঝিল , স্কুলে যাওয়া আসার একটা ঘন্টা আমার ঘাড়টা আকাশের বরাবর ১২০ ডিগ্রী কোণাকুনি হয়ে থাকে, কোণের ব্যাপারে কোন আপোষ নয়। মাঝে মাঝে কেবল ডানে বাঁয়ে রোটেট করে। রাস্তার ধারে যতদূর চোখ যায় আমি পতাকা খুঁজি। এমন করে খুঁজি যেন একটিও চোখ না এড়ায়। দেখি , আর গুনি, আশি , সাতাশি , বিরানব্বই ব্রাজিলের পতাকা নাকি আর্জেন্টিনার পতাকা কোনটা বেশি , কোনটা বেশি ? চঞ্চল মনের ভাবখানা এমন যেন ব্রাজিলের পতাকা বেশি হলে বিশ্বকাপে এক্সট্রা ৩ টা পয়েন্ট মিলে যাবে , পতাকার খেলায় যে জিততেই হবে। কিন্তু মনে হয় ব্রাজিল সামান্য পিছিয়েই থাকে। খায়েশের শেষ অবশ্য এখানেই শেষ নয়, মনের তীব্র দাবী মানুষকে অন্য দেশের পতাকাও ওড়াতে হবে, নয়ত বিশ্বকাপের মাহাত্ম কোথায় (আমি অবশ্য ব্রাজিলই থাকব) । পূর্ব রামপুরা গলির শুরুর দিকে এক বারান্দায় জার্মানির পতাকা ঝোলে , দলটাকে তখন দেখতে পারি না , কিন্তু পতাকাটা ভাল লাগে। ভাল লাগার আরেক দল ইতালির হয়ত গোটা দশেক আর ক্যামেরুনের গোটা বিশেক (৯০ এর ক্যামেরুনের অবসেশন) পতাকা এদিক ওদিক চোখে পড়ে, ব্যস এত টুকোই।
৯৮ বিশ্বকাপ যখন দুয়ারে তখন হাইস্কুলে পড়ি , একতলা বাড়িটা বেড়ে চারতলা হয়েছে , ছাদে উঠে ঠিক পুরনো দিনের মতই দিগন্ত এফোঁড় ওফোঁড় করে পতাকা গুনি। শুধু গুনেই ক্ষান্ত দিই না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। বেশির ভাগ ব্রাজিলের পতাকার তো অনুপাতটা অদ্ভূত করে বানানো, পুরোটা সবুজের মাঝে ছোট একটু হলুদ , তারও মাঝে ডটের মত ছোট একটা নীল , আহারে পতাকাগুলোর কি হাল টাই না করেছে দর্জিরা । অবশ্য সান্ত্বনা হল আর্জেন্টিনার পতাকার সূর্যটা , কারো সাধ্য নাই ঐ সূর্যটা বানায় । সবাই তাই ডেকোরেটরের কাপড় কেটে আকাশি -সাদা স্ট্রাইপেই খালাস। সহস্র ব্রাজিল -আর্জেন্টিনার মাঝে হাতে গোনা কিছু জার্মানি , ইতালি , নাইজেরিয়া। এদের পতাকাগুলো সহজ , তাই ভুল নেই।
বার্গক্যাম্পের ম্যাজিকে আর্জেন্টিনা বিদেয় হয়ে যাবার পর বাঁদিকের বাড়ির ছাদে সাদা-আকাশি নেমে হঠাৎ করেই ফ্রান্সের পতাকা উদয় হয়। বেশ বেশ ! ডাইভার্সিটি , ভাল লাগে ফ্রান্সকে দেখে , নতুন একটা রংয়ের পতাকা উড়ল, আবার হাসিও পায় , হেহে , পল্টি মেরেই তবে না ফ্রান্স । তারপর ফাইনাল হয় , ছয় মাস এক বছর হয়ে যায় , ফ্রান্সের পতাকাটা নামে না , যতবার মনের ভুলে চোখ পড়ে ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে । শেষমেশ কালবোশেখির ছোবলে পতাকাটা ছিঁড়ে হারিয়ে যায় , নামিয়ে দিয়ে যায় বুকে চাপানো পাথর।
২০০২ এর বিশ্বকাপটা একদম এইচএসসি পরীক্ষার মাঝে, পরীক্ষার কারণে খেলা মিস হয় না যদিও, কিন্তু নির্বিঘ্নে খেলা দেখতে দেয়ার কৃতজ্ঞতায় পতাকা ওড়ানোর বাড়াবাড়িটা আর করিনা। ২০০৬ টার বেশিরভাগ খেলা দেখা হয় রশীদ হলে বসে , তাই বাসায় পতাকাটা এবারো আর কেনা হয় না। কিন্তু ছোট বেলার অভ্যেসটা যায় না , সুযোগ পেলেই পতাকা দেখি, ঢাকার আকাশে বাতাসে উৎসবের আমেজটা দোলা দিয়ে যায়। তীতুমীর নাকি শেরে বাংলা ? যতবার ঢাউস সাইজের ব্রাজিল আর্জেন্টিনা জার্মানির পতাকাটা দেখি আপনাই স্ট্রেস হরমোনের তুমুল নিঃসরণ টের পাই।
অবশেষে আসে ২০১০ , নিজের স্বাধীনমত পতাকা কেনার সুযোগের বছর। পিউরিটান আমি পতাকা খুঁজি , মাপে ঝোঁকে ঠিক হতে হবে , রংয়ের হেরফের চলবে না , মাঝের নীল গোল্লায় তারার সংখ্যা ভুল হওয়া চলবে না, Ordem O Progresso লেখা ছাড়া তো পতাকা কেনার প্রশ্নই ওঠে না। সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায় , কিন্তু আসল পতাকার খোঁজ পাই না। শেষমেশ যেদিন কিনি , সেদিনই কোয়ার্টার ফাইনাল , শেষ বেলায় বাঁশের ডগায় চড়িয়ে বাঁশ দাঁড় করাতেই মাঝ বরাবর পচা বাঁশ ভেঙে দু'টুকরো হয়ে যায়। থাক তাহলে! হল্যান্ডের সাথে না হয় কাল সকালেই ওড়াবো , এই যে ভাবনা , ভাবনাই রয়ে যায় , জেতার সকালটা আর আসে না।
১৪ সালে টেক্সাসের অফুরন্ত নীল আকাশ দেখে ঢাকার কথা খুব মনে পড়ে , কে জানে কোন কোণে পড়ে আছে শৈশবের আরাধ্য, না ওড়ানো পতাকা?
১৮ সাল এসে গেল, ছোটবেলার পতাকার উত্তেজনার স্মৃতিটা আবছাভাবে এখনো ছুঁয়ে যায়। প্রিয় বাংলাদেশ, জুন-জুলাইয়ের আকাশ এখনো কি রঙে রঙে ভরে ওঠে ?৯৪ বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগেই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে , বিশ্বকাপ জ্বর। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত যোগ হয় ঢাকার আকাশ, যেদিকে তাকাই পতাকা আর পতাকা ।
মনপ্রাণ ঢেলে কল্পনা সাজাই , আমারো একটা পতাকা আছে , ব্রাজিলের পতাকা , একতলা বাসার ছাদে লম্বা বাঁশের ডগায় পতপত করে উড়ছে। প্রাইমারি পড়ুয়া ছেলে এমন অকালপক্কের মত ফুটবলের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে কেন, আমার আম্মুর সে হিসাব কিছুতেই মেলে না। পড়াশোনা ছেড়ে দিনরাত নিউজপ্রিন্টে ছাপা বিশ্বকাপ প্রস্তুতির খবর গেলার দায়ে বেশ কয়েক রাউন্ড উত্তম মধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার পর, পতাকার কল্পনা মুখ ফুটে বলার সাহস হয়ে ওঠে না।
পতাকাহীন এই আমার ক্ষুধা মেটে তাই অন্যের পতাকা দেখে। রামপুরা টু মতিঝিল , স্কুলে যাওয়া আসার একটা ঘন্টা আমার ঘাড়টা আকাশের বরাবর ১২০ ডিগ্রী কোণাকুনি হয়ে থাকে, কোণের ব্যাপারে কোন আপোষ নয়। মাঝে মাঝে কেবল ডানে বাঁয়ে রোটেট করে। রাস্তার ধারে যতদূর চোখ যায় আমি পতাকা খুঁজি। এমন করে খুঁজি যেন একটিও চোখ না এড়ায়। দেখি , আর গুনি, আশি , সাতাশি , বিরানব্বই ব্রাজিলের পতাকা নাকি আর্জেন্টিনার পতাকা কোনটা বেশি , কোনটা বেশি ? চঞ্চল মনের ভাবখানা এমন যেন ব্রাজিলের পতাকা বেশি হলে বিশ্বকাপে এক্সট্রা ৩ টা পয়েন্ট মিলে যাবে , পতাকার খেলায় যে জিততেই হবে। কিন্তু মনে হয় ব্রাজিল সামান্য পিছিয়েই থাকে। খায়েশের শেষ অবশ্য এখানেই শেষ নয়, মনের তীব্র দাবী মানুষকে অন্য দেশের পতাকাও ওড়াতে হবে, নয়ত বিশ্বকাপের মাহাত্ম কোথায় (আমি অবশ্য ব্রাজিলই থাকব) । পূর্ব রামপুরা গলির শুরুর দিকে এক বারান্দায় জার্মানির পতাকা ঝোলে , দলটাকে তখন দেখতে পারি না , কিন্তু পতাকাটা ভাল লাগে। ভাল লাগার আরেক দল ইতালির হয়ত গোটা দশেক আর ক্যামেরুনের গোটা বিশেক (৯০ এর ক্যামেরুনের অবসেশন) পতাকা এদিক ওদিক চোখে পড়ে, ব্যস এত টুকোই।
৯৮ বিশ্বকাপ যখন দুয়ারে তখন হাইস্কুলে পড়ি , একতলা বাড়িটা বেড়ে চারতলা হয়েছে , ছাদে উঠে ঠিক পুরনো দিনের মতই দিগন্ত এফোঁড় ওফোঁড় করে পতাকা গুনি। শুধু গুনেই ক্ষান্ত দিই না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। বেশির ভাগ ব্রাজিলের পতাকার তো অনুপাতটা অদ্ভূত করে বানানো, পুরোটা সবুজের মাঝে ছোট একটু হলুদ , তারও মাঝে ডটের মত ছোট একটা নীল , আহারে পতাকাগুলোর কি হাল টাই না করেছে দর্জিরা । অবশ্য সান্ত্বনা হল আর্জেন্টিনার পতাকার সূর্যটা , কারো সাধ্য নাই ঐ সূর্যটা বানায় । সবাই তাই ডেকোরেটরের কাপড় কেটে আকাশি -সাদা স্ট্রাইপেই খালাস। সহস্র ব্রাজিল -আর্জেন্টিনার মাঝে হাতে গোনা কিছু জার্মানি , ইতালি , নাইজেরিয়া। এদের পতাকাগুলো সহজ , তাই ভুল নেই।
বার্গক্যাম্পের ম্যাজিকে আর্জেন্টিনা বিদেয় হয়ে যাবার পর বাঁদিকের বাড়ির ছাদে সাদা-আকাশি নেমে হঠাৎ করেই ফ্রান্সের পতাকা উদয় হয়। বেশ বেশ ! ডাইভার্সিটি , ভাল লাগে ফ্রান্সকে দেখে , নতুন একটা রংয়ের পতাকা উড়ল, আবার হাসিও পায় , হেহে , পল্টি মেরেই তবে না ফ্রান্স । তারপর ফাইনাল হয় , ছয় মাস এক বছর হয়ে যায় , ফ্রান্সের পতাকাটা নামে না , যতবার মনের ভুলে চোখ পড়ে ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে । শেষমেশ কালবোশেখির ছোবলে পতাকাটা ছিঁড়ে হারিয়ে যায় , নামিয়ে দিয়ে যায় বুকে চাপানো পাথর।
২০০২ এর বিশ্বকাপটা একদম এইচএসসি পরীক্ষার মাঝে, পরীক্ষার কারণে খেলা মিস হয় না যদিও, কিন্তু নির্বিঘ্নে খেলা দেখতে দেয়ার কৃতজ্ঞতায় পতাকা ওড়ানোর বাড়াবাড়িটা আর করিনা। ২০০৬ টার বেশিরভাগ খেলা দেখা হয় রশীদ হলে বসে , তাই বাসায় পতাকাটা এবারো আর কেনা হয় না। কিন্তু ছোট বেলার অভ্যেসটা যায় না , সুযোগ পেলেই পতাকা দেখি, ঢাকার আকাশে বাতাসে উৎসবের আমেজটা দোলা দিয়ে যায়। তীতুমীর নাকি শেরে বাংলা ? যতবার ঢাউস সাইজের ব্রাজিল আর্জেন্টিনা জার্মানির পতাকাটা দেখি আপনাই স্ট্রেস হরমোনের তুমুল নিঃসরণ টের পাই।
অবশেষে আসে ২০১০ , নিজের স্বাধীনমত পতাকা কেনার সুযোগের বছর। পিউরিটান আমি পতাকা খুঁজি , মাপে ঝোঁকে ঠিক হতে হবে , রংয়ের হেরফের চলবে না , মাঝের নীল গোল্লায় তারার সংখ্যা ভুল হওয়া চলবে না, Ordem O Progresso লেখা ছাড়া তো পতাকা কেনার প্রশ্নই ওঠে না। সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায় , কিন্তু আসল পতাকার খোঁজ পাই না। শেষমেশ যেদিন কিনি , সেদিনই কোয়ার্টার ফাইনাল , শেষ বেলায় বাঁশের ডগায় চড়িয়ে বাঁশ দাঁড় করাতেই মাঝ বরাবর পচা বাঁশ ভেঙে দু'টুকরো হয়ে যায়। থাক তাহলে! হল্যান্ডের সাথে না হয় কাল সকালেই ওড়াবো , এই যে ভাবনা , ভাবনাই রয়ে যায় , জেতার সকালটা আর আসে না।
১৪ সালে টেক্সাসের অফুরন্ত নীল আকাশ দেখে ঢাকার কথা খুব মনে পড়ে , কে জানে কোন কোণে পড়ে আছে শৈশবের আরাধ্য, না ওড়ানো পতাকা?
১৮ সাল এসে গেল, ছোটবেলার পতাকার উত্তেজনার স্মৃতিটা আবছাভাবে এখনো ছুঁয়ে যায়। প্রিয় বাংলাদেশ, জুন-জুলাইয়ের আকাশ এখনো কি রঙে রঙে ভরে ওঠে ?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৪