১....
কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে পাকিস্তানী সৈন্য ভর্তি আর্মি ট্রাকের একটি বহর । তবে বহরে ২/৩ টির বেশি ট্রাক থাকে না কখনও । খানিক আড়ালে রাস্তার ঢালে অ্যামবুশ করার জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা কিছু তরুণ মুক্তিযোদ্ধার ।আর্মি লড়িগুলো কাছে এলে গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা
,তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাকে আগুন লেগে যায় । পরের সিকোয়েন্সে অবধারিত ভাবেই , আগুন লেগে যাওয়া ইউনিফর্ম নিয়ে পাকি সৈন্যদের ট্রাক থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়া । ঝাঁপিয়ে পড়া সৈন্যদের আড়াল থেকে গুলি করা হয় ।
যুদ্ধের আরেকটি পরিচিত দৃশ্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা কোন ঢালের আড়ালে
অবস্থান নেয় । বিপরীতে গাছপালা বা জংগলে বা অন্য কোন ঢালে
অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা । গোলাগুলি শুরু হওয়ার পরেই ঢালের আড়ালে অবস্থান নেয়া পাকী সৈন্যদের , খুব আনাড়ি ভাবে মাথা তুলে
উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ।আকস্মিকভাবে পাকিদের শ্যুটিং রেঞ্জের মধ্যে পেয়ে , আড়ালে থেকে
মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করলে ,পাখির মত একের পর এক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে । একের পর এক সঙ্গী মারা
যাচ্ছে দেখেও পাকিস্তানী সৈন্যদের হাস্যকর ভঙ্গীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে দৌড়ে আসতে দেখা যায় ।ফলাফলে ঝাঁকে ঝাঁকে
হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায় ।
২...
মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আঘাত প্রাপ্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা দু'হাত উপরে তুলে
ধনুকের মত পেছন দিকে বেঁকে খুব দ্রুত পেছনে পড়ে যেতে থাকে । গত চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় সব চলচ্চিত্রে মৃত সব পাকী সৈন্য একই স্টাইলে মৃতুবরণ করে গেছে ।
বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুটাও গতবাঁধা নিয়ম মেনেই চলে । গুলিতে
আহত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে না , কিছুটা
সময় নিয়ে , খুব কষ্টে কিছু কথা বার্তা বলে তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে
পড়ে ।
৩...
যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে মায়ের কাছে বিদায় নেবার দৃশ্যটাও স্টেরিওটাইপিং
থেকে চারদশকেও বেরিয়ে আসতে পারেনা । বিদায়ের দৃশ্যে চোখ বেয়ে
নেমে আসা পানি বা কান্নার শব্দ শুনিয়ে অনেক জোর করেই আবেগ সঞ্চারের চেষ্টা করা হয় ।
হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের বীভৎসতা দেখাতে বেশির ভাগ সময় বড় বড় গোঁফ ব্যবহৃত হয় , কথা বলার ফাঁকে বিকট শব্দে তাদেরকে হাসতে
দেখা যায় ।
৪...
যুদ্ধ সিকোয়েন্সগুলো খুব স্বল্প সময়ের মাঝে শেষ হয়ে যায় । সবচেয়ে
বেশি দেখানো হয় মেশিনগান থেকে ছিটকে যাওয়া গুলির খোসা , সবচেয়ে বেশি শোনানো হয় ব্রাশফায়ারের শব্দ ।এর বাইরে যুদ্ধের ডিটেইলস দেখানো হয় খুবই কম । মেশিনগানের শব্দের মাঝে মাঝে
জোরে জোরে বোমা বিস্ফোরণের বুমবুম শব্দটাকেই হাইলাইট করা হয় ।গ্রেনেড ছুঁড়ে দিলে বড় জায়গা জুড়ে ধুলোবালি উড়তে দেখা যায় । একের পর এক গ্রেনেড ছোঁড়ার দৃশ্যগুলো যুদ্ধের চেয়ে ধুলিঝড়ের কথা বেশি
মনে করিয়ে দেয় ।
৫...
কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধ , অপারেশন বা ব্যক্তির বীরত্বকে হাইলাইট করা হয়না
কখনও। সিনেমাগুলোতে মোটামুটি জেনারালাইজড কিছু দৃশ্য থাকে , যার শুরু হয় ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে , মাঝের অংশে মায়ের কাছে বিদায় , ঝাপসাভাবে দেখানো হয় কিছু অপারেশন , দু'একজন সঙ্গীর মৃত্যু হয় , সবশেষে নায়ক ফিরে আসে পাগল হয়ে যাওয়া মায়ের কোলে ।
৬...
কোন ক্ষয় ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ জয় করে নেয় , বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয় পাকিস্তানী সৈন্যরা ।
৭...
আবেগঘন দৃশ্য দেখাতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে তেমন কোন বৈচিত্র থাকে না।যেকোন পরিস্থিতিতেই অবশ্যাম্ভাবী হিসেবে একই টাইপের দু'তিনটা মিউজিক ব্যবহৃত হয় ।
কেন আমরা পারি না ?
(১)
নির্মাতাদের অনেকের অজুহাত , বাংলাদেশে যুদ্ধ দেখানোর মত প্রয়োজনীয় কারিগরী সামর্থ নেই। তাদের এই দাবীটিকে পুরোপুরি
অযৌক্তিক বলে মনে হয় । যুদ্ধ দেখানো মানেই ধুন্দুমার কিছু দেখাতে হবে
, এমন কথা বোধ করি কেউই স্বীকার করবেন না । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে গেরিলা পদ্ধতিতে । নদীমাতৃক দেশে ট্যাংক মিসাইল , অত্যাধুনিক রকেট নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে , সেসব কেউ দেখতেও চাইছে না । তাই বলে
বারবার একই ট্রাকে আগুন লাগানোর দৃশ্য থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার ভাবে যে যুদ্ধ হয়েছে , সেটা সেভাবেই ফুটিয়ে তুলতে দোষ কোথায় ? শুরুর দিকের খানিকটা অংশ ছাড়া যুদ্ধের দামামা বিহীন Enemy At The Gates মুভিতে সোভিয়েত স্নাইপার শ্যুটার ভ্যাসিলির শ্যেন দৃষ্টি আর জার্মান অফিসারের সাথে তাঁর ডুয়েল কি সিনেমাটিকে অসাধারণত্বের মর্যাদা এনে দেয়নি ?
(২)
শত্রুসেনাদের অদ্ভূত স্টাইলে মৃত্যুবরণ দেখানোটাও নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতার দৈন্যতা হিসেবেই বিবেচিত হয় । বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ নিয়ে
যেসব সিনেমা হয় , সেগুলোর মাঝে শত্রুসেনাদের এমন অদ্ভূতভাবে কই মাছের মত একটা ঝাঁকি দিয়ে চিৎপটাং হয়ে মৃত্যুবরণের দৃশ্য খুঁজে
পাওয়া যাবে না।
চলচ্চিত্র নির্মাতারা যদি মনে করেন , এমন দৃশ্যগুলো বীরত্বের প্রতিচ্ছবি , তবে তারা খুব বড় ভুলের মাঝে আছেন।একটা ব্যাপার খেয়াল রাখা
জরুরী , সবসময় সবকিছু স্পষ্ট করে দেখানোর কিছু নেই , সেটা যদি
দেখিয়েই দিতে হয় , তাহলে মানুষের অনুভব করার ক্ষমতার কি প্রয়োজন ছিল ? সাঈদের চোখে আটকে যাওয়া "Paradise Lost" সিনেমার শেষ দৃশ্যটা কি মানুষকে অবারিত সম্ভাবনা দিয়ে ভাবতে
শেখায়নি ?
(৩)
চলচ্চিত্রকারদের বেলাতেও খুব কঠিন কাজগুলোর অন্যতম হল , দর্শকেদের কোন দৃশ্যে আবেগে বিহ্বল করে দেয়া । বহু বছর ধরে একই বিদায় দৃশ্য দেখতে থাকলে দর্শকদের মনে আলাদা করে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না । চমৎকর নৈপুণ্যের সাথে ফুটিয়ে তুলতে পারলে ,
নায়ক নায়িকার চোখে জল ছাড়াই , দর্শকরা অঝোরে কাঁদতে পারে । আর আনাড়ি ভাবে জোর করে কাঁদানোর চেষ্টা করে গেলে মুভি সিকোয়েন্সে
শত কান্নাও দর্শকদের মাঝে প্রভাবে ফেলে না । "Ballad Of A Soldier" মুভিতে আলিয়েশো মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল হাসিমুখেই ,কিন্তু সে হাসিমুখ দেখে চোখের জল ফেলেনি , এমন কারও কি সন্ধান মিলবে ?
[৪]
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাগুলো হতে পারত , বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে
উপস্থাপনের অনন্য একটি উপায় । বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে এত গৌরবময় যুদ্ধের ইতিহাস খুব বেশি জাতির নেই , অথচ পরিতাপের বিষয় হল , আজ পর্যন্ত বিশ্বকে আমরা কোন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছি । মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে যুদ্ধের দৃশ্যগুলো ঘুরে ফিরে ২/১ রকমের মাঝেই ঘোরা-ফেরা করে , যার কোনটির মাঝেই নৈপুণ্যের সামান্যতম ছাপ নেই ।নির্মম কথাটি সম্ভবত
স্বীকার করে নেয়া ভাল ,জহির রায়হান কে হারানোর ক্ষতিটা সম্ভবত ৪০ বছর পরেও বাংলাদেশেকে বয়ে চলতে হচ্ছে । আপাত মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতারা আসলেই কতটা বাংলাদেশকে দিতে পেরেছেন , সেটা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে ।
(৫)
মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু খন্ড যুদ্ধ , শুধু বাংলাদেশ নয় , সমগ্র বিশ্বের গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসেই অন্যরকম গুরুত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
।বিপরীতে নির্মম সত্যিই হল , বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালকরা সম্ভবত একটা বারের মতও সেসব যুদ্ধের কোন একটিকেও পূর্ণাঙ্গভাবে
সেলুলয়েডের ফিতায় আলাদা কোন বিশেষত্ব নিয়ে তুলে আনতে
পারেননি । ঘুরে ফিরে যুদ্ধগুলোর বৈচিত্রহীনভাবে একইরকম হয় । চলচ্চিত্র শুধুই বিনোদনের মাধ্যম না , ইতিহাসেরও দলিলও বটে । প্রশ্ন উঠতেই পারে ঢাকা অপারেশন ,আখাউড়া বা চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা যেসব
বিখ্যাত অপারেশনগুলো পরিচালনা করেছিলেন ,সেগুলোকে আলাদা করে
হাইলাইট করে কেন কোন সিনেমা বা নাটক নির্মিত হয়নি ?
শুধু বিখ্যাত খন্ডযুদ্ধই না , সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে , ছোট ছোট কোন দল , বা ব্যক্তির বীরত্বগাঁথা । সেগুলো নিয়ে অসাধারণ চলচ্চিত্র হতে পারত , প্রায় ৪০ বছর পরে আজ যখন সেসব আমরা
ভুলতে বসেছি , কৌতুহল হয় , কেন সেসব ঘটনাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়নি ?
(৬)
ইতিহাস বলে যুদ্ধটা এত সহজে জেতা যায়নি । কিছুটা ক্ষয়ক্ষতির পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুল বিক্রমে ফিরে আসার ঘটনাগুলো যদি দেখানো যেত
, গল্পগুলো অনেক বেশি দর্শকদের মনে দাগ কাটত ।
বিপক্ষের সৈন্যদের অট্টহাসি হাসিয়ে আর বড় গোঁফ দেখিয়ে যদি তাদের নৃশংসতা প্রমাণ করতে হয় , সেটা আমাদের চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং
অভিনয় কলাকুশলীদের আরেকটি বিপর্যয়কর ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। নির্বিকার চিত্তে হত্যাযজ্ঞ চালাতে দেখানো বরঞ্চ অনেক বেশি দাগ কেটে যায় । ভিলেন মানেই বীভৎস হাসি , এটা কোন কোন পরিস্থিতেতে
চলচ্চিত্রেকারের চিন্তার পরিধিকেই প্রশ্নবিদধ করে ।বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোতে নেগেটিভ চরিত্রগুলোও বেশির ভাগ সময় পজেটিভ ইমেজের কোন অভিনেতাকে দিয়ে করানো হয় , মেকিং আর অভিনয়ের অভিনবত্বে তারা তাদের ক্রুড়তা ফুটিয়ে তোলেন ।
(৭)
সংগীতের অসামান্য ব্যবহার দিয়েও একটা সিনেমা বদলে যেতে পারে । "No Man's Land" চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যটি যারা দেখেছেন , তারা এটার সবচেয়ে বড় স্বাক্ষী হয়ে আছেন । সিকোয়েন্সের সাথে সংগতি
রেখে নতুন সংগীত ব্যবহারের ব্যর্থতার দায়টা কি আমাদের সংগীত পরিচালকদের সীমাবদ্ধতারই ফসল ?
যা বলতেই হল :
{স্বল্প বাজেটে নির্মিত প্যারাডাইস লস্ট , নোম্যানস ল্যান্ড , বা ব্যালাড অফ অ্যা সোলজার দেখার পর বারবার প্রশ্নটা মাথায় ঘুরে ... আমাদের কেন বিশ্বকে দেয়ার মত কোন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নেই ? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও হাতে গোনা ১ টি বা ২ টি চলচ্চিত্র পাওয়া যাবে , যেগুলো দেশের মাঝে সত্যিকার অর্থে সাড়া জাগিয়েছিল। লেখাটার মাঝে ক্ষোভের চাইতে কষ্টটা বেশি , আশা করি সে দৃষ্টিকোণ থেকেই সবাই দেখার চেষ্টা করবেন}