আজ ১৯শে ফেব্রুয়ারি ,সারা দেশের মেট্রিক পরীক্ষার্থীরা বাংলা ১ম পত্র পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে । এক দশক আগেও ফেব্রুয়ারী/মার্চ মাসের দিকে উদ্ভ্রান্ত , উস্কু খুস্কু ১৫/১৬ বছর বয়েসী কিশোর কিশোরীদের দেখে এসএসসি পরীক্ষার অবস্থানকাল নিয়ে সম্যকভাবে অবগত হওয়া যেত। দশক না ঘুরতেই দৃশ্যপটের ছন্দপতন হয়, কালের আবর্তে হারিয়ে যায় এসএসসি ভীতি । মেট্রিক পরীক্ষার দেখা মেলে এখন উৎসবে রঙে ,মধুর ঝংকার ওঠে তার চলার শব্দে। শুরু হয় গোটা দেশের প্রতিটা ছাত্রের প্রথম হওয়ার অপেক্ষার প্রহর ।
পুরনো মেট্রিক পরীক্ষার চিরাচরিত ভীতির ঐতিহ্যে "বাংলা" সবসময় বিশেষ স্থান অধিকার করে রাখত । "বাংলা" নিয়ে রহস্য ছিল বহুমাত্রিক।পরীক্ষা শেষে পরীক্ষা ভাল না খারাপ হয়েছে , সেটা বলা ছিল দুঃসাধ্য । ভাল পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলে খাদের অতলে নিজেকে আবিষ্কার করা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ।ভাগ্য বিধাতা রুপে শিক্ষক শিক্ষিকা আর তদীয় দয়া , মেজাজ , করুণা আর নিয়তি নির্ণয় করত পরীক্ষার ফলাফল ।
বাংলা পরীক্ষায় ভাল করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় শরীক ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যাও নেহায়েৎ কম ছিল না । পীররুপী বাংলা শিক্ষকগণের কাছে মুরিদ হিসেবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে বাইয়্যাত গ্রহন করতে দেখা যেত । বাংলা বিষয়ক মুশকিল আসানের জন্য শিক্ষকরা পানি পড়ার সমতুল্য তাদের মহামূল্য নোট সরবরাহ করতেন । মুরিদানের দায়িত্ব ছিল তেল চুপচুপে সেসব নোট আগা গোড়া উগড়ে দিয়ে দ্বীন-দুনিয়ায় অশেষ মার্কস হাসিল করা ।
এ প্রক্রিয়ায় ঘাত প্রতিঘাতও কম ছিল না । বড় বড় বিদ্যালয়ে ৯/১০ জন পর্যন্ত বুজুর্গ শিক্ষক অবস্থান করতেন । "এক ঘরমে দশ পীর" কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার হাতে নাতে প্রমাণ মিলত খাতা দেয়ার পর । পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা করেছেন যে শিক্ষক তার অনুসারী মুরিদান ব্যাতিত অন্য কারও কপালে নেমে আসত অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ।
শৈশবকাল থেকেই গলাধঃকরণ আর উগড়ে দেয়ার প্রক্রিয়ায় আমার প্বার্শ-প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র । সে কারণেই কারও বাইয়্যাত গ্রহনের সৌভাগ্য কখনও আমার হয়নি । তারপরও জীবন বাঁচানোর স্বার্থে পরীক্ষাকেন্দ্রে বসে অসংখ্য স্তুতিবাক্য সম্বলিত পান্ডুলিপি প্রস্তুত করতে হত । একেবারেই তাৎক্ষণিকভাবে লিখতাম বলে , মস্তিষ্কের উপর ঝড়ের সময়কালটা কেবল পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই আবদ্ধ থাকত ।
উত্তর লেখার পূর্বশর্ত ছিল লেখক বা কবির লেখকী ঢংয়ের তুমুল প্রশংসা , তার চিন্তাধারার জয়োধ্বোনি , কাব্যিক প্রতিভায় মুগ্ধ হওয়ার অবিরাম ভান করে চলা ।
মধ্যযুগীয় কবি আলাওল , শাহ মুহম্মদ সগীর যে কি অসম্ভব জনপ্রিয় তার প্রমাণ মিলত পরীক্ষার খাতায়। মনোমুগ্ধ পাঠক হওয়ার দাবী করে বিহ্বল হতাম, লিখতাম তাদের মানবিক প্রেমাপখ্যানের কথা ।আহ্লাদিত হয়ে উঠতাম আরাকান রাজসভায় আলাওলের বাংলার জয়গানের কথা বলে । শিল্পমূল্যের বিচারে কেউবা তাদের আখ্যা দিত সহস্রাব্দের বাংলা কাব্যিক জাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে ।
প্রয়াত স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লেখা বেগম সুফিয়া কামালের "তাহাকেই পড়ে মনে" কবিতাটির আলোচনাকালে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো চাপা মাতম শুরু হত । কবির স্বামীকে হারানোর বেদনায় বাকরুদ্ধ কিশোরেরা শক্ত চোয়াল আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে লিখে যেত তাদের হৃদয়ের গভীর ক্ষতের কথা । শোকের তীব্রতায় কাতর হয়ে পড়ার লক্ষণ মিললেই কেবল ভাল নম্বরের আশা করা যেত , এমন চাপ বিরাজ করত পুরোটা সময় ।
ফররুখ আহমেদের লেখা কোন কবিতার প্রশ্নোত্তর আমাদের স্থলভাগ ছাড়িয়ে নিয়ে যেত অকূল সমুদ্রে । উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে আমরা সহসা আঁধার দেখতে পেতাম । তীব্র গর্জনে শোনা যেত কিশতির মাস্তুল ভেঙে পড়ার আওয়াজ । তসবির , মার্জান , মর্মর , দরিয়া সহ উজাড় করে দিতাম আরবী ফার্সি ভাষার সমস্ত প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক শব্দ । আকুতি জানাতাম পাঞ্জেরিকে সে যেন দিক দেখায় ।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই সবাই মোহাবিষ্ট হতাম তাঁর ছন্দের জাদুতে । সুজনেরা তার দু'একটি ছন্দ তুলে দিয়ে বিরাট বিস্ময়ের ঘোরে আবদ্ধ হয়ে পড়ত ।
কেউ লিখত :
পাষাণেরা স্নেহধারা!তুষারের বিন্দু
ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু ।
এভাবে উত্তরের অর্ধেক জুড়ে থাকত তার ছন্দের প্রশংসামালা ।
সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিতায় কি লিখেছেন সেটার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর অকাল প্রয়াণের কথা । তার অকাল মৃত্যু বাংলা সাহিত্যাঙ্গন কি অসম্ভব ক্ষতির শিকার সে কথা লিখতেই লেগে যেত ২/৩ পাতা । মূল আলোচনায় থাকত বিদ্রোহ , শেকল ভাঙার প্রতিজ্ঞার শপথ । সুকান্তের কবিতার উত্তর লিখলে নজরুলের কবিতার উত্তর লেখাটা ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করতাম । পরীক্ষার খাতায় তাদের দু'জনের বিদ্রোহের কাঠামো ছিল হুবুহু একই রকম , দু'টো প্রশ্নের উত্তরকে আলাদা সত্ত্বা দিতে গিয়ে পেঁচিয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল প্রবল ।
নজরুলের কবিতার উত্তর লিখতে গেলে কবিতার প্রসংগে কথা বলা হত কদাচিত । পরাধীনতা , অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ , মানবমর্যাদা ও সৌন্দর্যচেতনাবোধ সমন্বিত করণের কথা বলতে গিয়ে সময় ফুরাতো । অকুতোভয় বলিষ্ঠ যে নেতৃত্ব কবি খুঁজে গেছেন , সে কথা পুনরোল্লেখ করে নেতা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার উপর কখনও বা বিরাট ভাষণ দিয়ে ফেলতাম। বাংলাসাহিত্য গগনে তাকে তুলনা দেবার নক্ষত্র খুঁজে বের করতে কেউ কেউ হত হয়রান ।
কবিগুরুর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মূল লক্ষ্য থাকত উপাধির ভারে কবিকে কোণঠাসা করে ফেলা । সে আলোচনায় বিশ্বদরবারে বাংলা সাহিত্য , গৌরব , সৃষ্টি আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু হয়ে চলে যেত জ্যোতির্বিদ্যার দিকে । কেউ বলতাম রবি , কেউ ডাকতাম নক্ষত্র , কেউবা বাংলা সাহিত্যের দরবার দেখতে গিয়ে চোখে ছায়াপথ দেখতাম , রবিবাবু সেখানে উজ্জল জোতিষ্ক হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন ।
আল মাহমুদ বা শামসুর রাহমান যে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় দু'জন কবি সে কথা লিখে লিখে শিক্ষকদের রীতিমত বিরক্ত করে ফেলার আপ্রাণে প্রয়াসে মত্ত হত সবাই । ক্লাশের যে ছেলেটি সারাটি বছর ফাঁকি দিয়ে শেষমেশ আল-মাহমুদ বা শামসুর রাহমানের কবিতাটি রিডিং পড়ার সময় পায়নি সেও বিরাট ভূমিকায় লিখত স্বাধীনতা শক্তি বা শৌর্য অবলোকনে এ দু'জন কবির বলদীপ্ততার কথা । দীর্ঘ ভূমিকা শেষে তুলে দিত তার একমাত্র সম্বল মুখস্থ দু'টি লাইন .......
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ ।
কায়কোবাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সিংহভাগ সময় কাটতো তার মহাকবি হওয়ার মহিমা , আর তাহার কাব্যিক শক্তির ব্যবচ্ছেদ নিয়ে । শিক্ষকরা কিছু বুঝতে না পেরে নম্বর দিয়ে ছেড়ে যেন দেন , সে উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় লেখার চেষ্টাটা থাকত পুরোদমে ।
জসিমউদ্দিনের কবিতার উত্তর লেখার আগে হুহু করে গাঁয়ের জন্য কেঁদে উঠতাম । বাঁশীর সুর , রাখালের গান আর অনন্ত সবুজের বর্ণনায় মুল প্রসঙ্গ থেকে সরে যেতাম বহু ক্রোশ দূরে ।
আহসান হাবীব , সৈয়দ আলী আহসান , আব্দুল কাদির কমবেশি তারুণ্যের জয়গান গাইতেন । তাদের কবিতার উত্তর লেখার প্রারম্ভেই সদলবলে বার্ধক্য , জরা , হতাশার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া হত ।
যাদের স্মৃতিশক্তি ভাল , তারা অনেকগুলো কবিতা আগা-গোড়া ঠোঁটস্থ করে যেতেন , উত্তর লেখার ফাঁকে ক্ষণে ক্ষণে কবিতার দু'চারটি লাইন ঝেড়ে দিতেন ।
মুখস্থ করতে পারি না বলে আমাকে ভীষণ বিড়ম্বনায় পড়তে হত । শেষমেশ দাঁতে দাঁত চেপে কবিতা থেকে দু'টো গিলে যেতাম । কায়কোবাদ বাংলার সবুজ প্রকৃতির কেমন বর্ণনা দিয়েছেন , এমন প্রশ্নের জওয়াবে ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করতাম হাওয়ায় কি করে গাছের পাতা নড়া , গাছের তলায় কিরুপ শীতলতার সন্ধান মেলে , তারপর ছুঁড়ে দিতাম আমার মোক্ষম হাতিয়ার নীলমনি অপ্রাসঙ্গিক দু'টো লাইন
বাংলার হওয়া , বাংলার জল
হৃদয় আমার , করে সুশীতল
এত সুখ-শান্তি , এত পরিমল
পরীক্ষায় নম্বর নির্ধারিত হত অনেককিছুর উপর ।মোটা খাতায় নম্বর বেশি , এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ প্রতি পৃষ্ঠায় দানা দানা আকৃতির ৩/৪ টির বেশি শব্দ লিখতে অস্বস্তি বোধ করত । কবিকুলের প্রশংসায় সবচাইতে তেল চুপচুপে খাতার নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত বেশি । বাজারে গাইড বই থেকে যারা উগড়ে দিত , তারা ভয়ে থাকত একাধিক জনের তেল কমন পড়ে যাবার । এক শিক্ষকের সরবরাহকৃত তৈল সামগ্রী অন্য শিক্ষকের আগুনে ঘি হয়ে জ্বলে উঠত । সে কারণে এক শিক্ষকের মুরিদানরা আতঙ্কিত হত অন্য শিক্ষকের রোষের শিকার হওয়ার ।
এত আয়োজনের পরও বাংলায় নম্বর পাওয়া ছিল জগতের দুষ্কর কাজগুলোর অন্যতম । ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষায় পুরো বাংলাদেশের মাটিতে একজন মুরিদও লেটার পাবার মত যথেষ্ট মন গলাতে সক্ষম হত না ।
পীরদের প্রতাপ আগের মত নেই , মুরিদানদের এখন তারা দোয়া করেন দু'হাত ভরে । বাংলা পরীক্ষায় লেটার প্রাপ্তদের আজ দেখা মেলে আনাচে কানাচে , পথে প্রান্তরে ।তারা আজ কাতারে কাতারে , বিপুল পরিমাণ , বেশুমার ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ ভোর ৪:২৮