বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে এ সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হিসেবে উঠে এসেছে রাশিয়া এবং জর্জিয়ার সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি । ১৯৯১ সালের পর রুশ সামরিক বাহিনী এই প্রথমবারের মত দেশের বাইরে সামরিক হস্তক্ষেপ করলো । বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখে এবং ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির মধ্যস্ততায় রাশিয়া , জর্জিয়ার অভ্যন্তরভাগ থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।
রাশিয়ার এই সামরিক অভিযান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব মিডিয়া তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে ।বিগত শতাব্দীতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রে অসংখ্য সামরিক হস্তক্ষেপ করে । তবে বিশ্লেষকদের মতে ২১ শতকে এসে এ ধরণের সামরিক হস্তক্ষেপ নজিরবিহীন এবং অগ্রহনযোগ্য । তবে ঘটনাটি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে ।
১৯৯১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকেই পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে । বরিস ইয়েলেৎসিনের ৯ বছরের শাসনামলে রাশিয়া বিশ্ব অংগনে সামরিক , অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে । ককেশিয় অঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত ক্ষুদ্র চেচনিয়া পরাক্রমশালী রুশ বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে প্রদেশটিকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ।অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর জন্য ইয়েলেৎসিন সরকারকে বাধ্য হয়ে মার্কিন সাহায্যের শরণাপন্ন হতে হয় । ফলে এককালের প্রবল প্রতিদন্দ্বী রাশিয়া বাস্তবিক অর্থেই মার্কিনীদের পদানত হয়ে পড়ে ।
২০০০ সালে কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা ভ্লাদিমির পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহনের পর রাশিয়ার নীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন । স্পষ্ট করে তিনি জানিয়ে দেন রাশিয়াকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চান ।
পুতিন তার কার্যক্রম শুরু করেন চেচনিয়ায় সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে শক্তভাবে চেচেন বিদ্রোহীদের দমন করে রাশিয়ার সাথে একীভূতকরণের মাধ্যমে । পেট্রোলিয়াম কোম্পানীগুলোর পুনরজ্জীবন সহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহনে রাশিয়ার অর্থনীতি দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে ।বিশ্বের শীর্ষ ৮ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের গ্রুপ জি-৮ এ রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে
১৯৯১ সালের সোভিয়ত ইউনিয়নের পতনের পর চীন হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের প্রধান প্রতিদ্বন্দী । ঠিক এ সময় মঞ্চে রুশদের পুনরুথানের সম্ভাবনায় মার্কিনীরাও খানিকটা শঙ্কিত হয় । মার্কিনী এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের ন্যাটো জোটকে ঠেকানোর জন্য পুতিন পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজান । এর অংশ হিসেবে সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ১৫ দেশকে রুশ প্রভাব বলয়ের আওতাভুক্ত করে রাখার সিদ্ধান্তটি মার্কিন কৌশলের কাছে মার খেয়ে যায় ।
শুরুটা হয় ইউক্রেনকে দিয়ে । অরেণ্জ রেভিউলেশনের মাধ্যমে রুশপন্থী সরকারকে গণঅভ্যুথানের মাধ্যমে উৎখাত করে মার্কিন এবং পশ্চিমা পন্থী জোট । একে একে রুশ প্রতিপত্তি খর্ব করে গণঅভ্যুথানে পশ্চিমাপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় কিরগিজিস্তান , বেলারুশে । ইউরোপে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র সার্বিয়া ভেঙ্গে কসোভোর স্বাধীনতা লাভের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র । রাশিয়া এসব ঘটনায় প্রচন্ডভাবে ক্রুদ্ধ হয় ।
রুশ বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেশগুলোর তালিকায় যোগ হয় ককেশিয় অঞ্চলের জর্জিয়ার নাম ।এর আগেই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জর্জিয়া গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ।যুদ্ধে উত্তর পশ্চিমে ব্ল্যাক সী উপকূলীয় প্রদেশ আবখাজিয়া এবং রুশ সীমান্তবর্তী দক্ষিণ ওশেটিয়া কার্যত জর্জিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ।
আমেরিকায় স্নাতক তীব্র মার্কিনপন্থী মিখাইল সাকাশভিলি জর্জিয়ার রুশপন্থী সরকারকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেন ।সাকাশভিলি সরকারের প্রধান মিত্র হিসেবে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাম চলে আসতে শুরু করে ।খোদ রাশিয়ার ভৌগলিক সীমানার ভেতরে চলে আসতে থাকা মার্কিন প্রভাবকে ভ্লাদিমির পুতিন ভালোভাবে নেননি।
ক্ষমতায় এসে সাকাশভিলি রুশ প্রভাব হ্রাসের জন্য সাহসী পদক্ষেপ গ্রহন শুরু করেন । এর অংশ হিসেবে ২০০৬ এর শেষদিকে বেশ কিছু রুশ নাগরিককে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক করা হয় । এ ঘটনায় রাশিয়া প্রচন্ডভাবে ক্ষুদ্ধ হয় । জর্জিয়াকে করা গ্যাসের সরবরাহ রাশিয়া বন্ধ করে দেয় । রাশিয়ায় বসবাসরত বিপুল সংখ্যক জর্জীয়কে ধরপাকড় করা শুরু হয় । এসব ঘটনায় শাকাশভিলি কোনঠাসা হয়ে পড়েন এবং বাধ্য হয়ে নতি স্বীকার করেন ।
২০০৭-০৮ এ রাশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল হয় ।বিপুল জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট পুতিন সংবিধান অনুযায়ী দু'বারের বেশি সরকার পরিচালনা করতে পারবেন না বলে পদ ছেড়ে দেন । তবে পুতিনের উত্তরসূরী হতে পারেন এমন কাউকেই রুশরা খুঁজে পায়নি । ফলে পু্তিন মনোনীত মেদবেদেভকেই রুশরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে । ক্ষমতার মঞ্চ থেকে পুতিনও সরে যাননি , তিনি প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ন হন । রুশ সংবিধানে প্রেসিডেন্টের তুলনায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নগণ্য হলেও অনেকেই মনে করেন পুতিনই মেদবেদেভকে পরিচালনা করছেন ।
এর মাঝে জর্জিয়া ন্যাটো জোটে যোগদানের জন্য জোর তৎপরতা চালাতে থাকে । এ ঘটনায় রাশিয়া ক্রুদ্ধ হয়ে সুযোগ খুঁজতে থাকে ।
গত সপ্তাহে জর্জিয়া , তার অখন্ডতা রক্ষার জন্য আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওশেটিয়াকে মূল ভূখন্ডের সাথে একীভূত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে ওশেটিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করলে রাশিয়ার সামনে সুযোগ এসে যায় । ওশেটিয়ায় গণহত্যার অভিযোগ এনে রাশিয়া সামরিক বাহিনী পাঠায় । জর্জিয় বাহিনীকে পরাভূত এবং পিছু হটতে বাধ্য করতে শক্তিশালী রুশ বাহিনীর তেমন বেগ পেতে হয়নি ।
জর্জিয়ার মূল ভু-খন্ডের অভ্যন্তরে গোরি শহরে রুশ বোমারু বিমান থেকে বিপুল বোমাবর্ষণ করা হয় , আক্রান্ত হয় তিবিলিসির উপকন্ঠ ।সাতদিনের সংঘর্ষে বহুসংখ্যক বেসামরিক লোক প্রাণ হারায় উত্তরে আবখাজিয়া প্রদেশও রুশ বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে জর্জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর ঘোষণা দেয় ।
জর্জিয় বাহিনী পিছু হটে এসে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিলেও রাশিয়া প্রথম দু'দিন তাতে কর্নপাত না করে জর্জিয় ভূ-খন্ডের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে থাকে । অবশেষে ফ্রান্সের মধ্যস্ততায় আপাতত অভিযানের সমাপ্তি ঘটে ।
গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কয়েকটি ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে :
* রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশগুলোকে পশ্চিমা ঘনিষ্ঠতা থেকে বিরত থাকার জন্য কড়া বার্তা পাঠাচ্ছে ।
* দীর্ঘদিন পর সামরিক অভিযান পরিচালনা করে সামরিক অঙ্গনে রুশরা পুনরায় তাদের উপস্থিতি ঘোষণা করছে ।
* এ ঘটনায় জর্জিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে হুশিয়ার করা ছাড়া কার্যত কিছুই করেনি । রাশিয়া , যুক্তরাষ্ট্রের হুশিয়ারিকে কোন গুরুত্ব দেয়নি । পশ্চিমাদের এমন নির্লিপ্ত ভূমিকা জর্জীয়দের
মনেও প্রবল ক্ষোভের সূচনা করেছে ।
* জর্জিয়ার অখন্ডতা রক্ষা পাবার সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে গেছে ।
সামনের দিনগুলোতে ইরান , কোরিয়া বা সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিতে গেলে রাশিয়ার ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার ইংগিত দিচ্ছে ।
১৩ আগস্ট ,২০০৮