চোখ বুজলেই দিগন্ত স্পর্শ করে স্মৃতির দুয়ার । রাতটাকে পেতে ইচ্ছে ঠিক করছে ১৫ বছর আগের মত করে , যেখানে ছোট্ট মেহরাব মনে মনে লড়ছে নিজের সাথে । কখনো আনন্দে বিহ্বল , কখনো বা ভীত , সকালের অপেক্ষা , নির্ঘুম দীর্ঘ রাত , বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে ঘুমের অভিনয় , ছোট্ট ডিজিটাল হাতঘড়ির লাইট চেপে বারবার দেখে নেয়া সময় ,জানালা দিয়ে বারবার অন্ধকারে খাসি দু'টো খুজে ফেরা , ঘুমাতে যাবার আগে আব্দার ....."আম্মু আমাকে ফজরে ডেকে দিও" ।
ইরানের বন্ধুদেরকে খুব মিস করছি ,ঈদ পার্বণে যাদের কাছে আমার অসীম সম্মান ।ঈদের ঘনিয়ে আসার সাথে নাসের , ইদ্রিস ,জাহরা, সামিরের সামনে হঠাত করে বুক চিতিয়ে চলতে ইচ্ছা করে , পরক্ষণেই হয়তো নিজেকে সম্বরণ করি।
ইরানের যে এলাকায় আমরা ছিলাম , সেটা সুন্নী প্রধান, তবে মাজহাব ভিন্ন । আমরা হানাফী হলেও ওরা শাফেয়ী । শাফেয়ী মাজহাবে ক্বুরবানীর আদেশটা অনেকাংশে শিথিল , ওদের তুলনায় যেমন শিথিল আমাদের যাকাত আদায়ের নিয়ম ।ছোট্ট 'শারভিনাহ ' শহরে ক্বুরবানী হয় কেবল দু'টো , আমরা , আর আমাদের দেখাদেখি আমাদের এক প্রতিবেশী । এ নিয়ে আমার গর্বের সীমা নেই , বন্ধু মহলে আমাকে ঘিরে অনেক বিস্ময় , নিজেকে মনে হয় এক দিগ্বিজয়ী বীর । এমন অনুভূতি হওয়ার সাথে সাথে নিজেকে সম্বরণ করি ,আম্মুর কথা স্মরণ করি ......"লোক দেখানো বা মাংস খাওয়ার নিয়তে ক্বুরবানী করলে , বা ক্বুরবানীর পশু নিয়ে গর্ব করলে সৃষ্টিকর্তা নারাজ হবেন " । মনে মনে আল্লাহকে ডেকে বলি ......"আল্লাহ শুধু তোমারই জন্য" ।
ঈদের নামাজের শেষে আমাদের বাসার পেছনদিকে ছায়াঢাকা জায়গাটায় আমার সব বন্ধুদের ভীড় । পাশাপাশি বাধা আমাদের দু'টো আর নাসেরদের দু'টো খাসি । নাসের হঠাত বলে উঠে ........."আমাদের খাসি দু'টো অনেক বেশি মোটাতাজা "। আমার বিশ্বাস হয় না , দিব্যি দেখতে পাই আমাদের খাসি দু'টো অনেক বেশি সবল ,স্বাস্থ্যবান , এক দু'বার প্রতিবাদ করি । বন্ধুরাও দু'ভাগ হয়ে যায় , কেউ আমার , আবার কেউ নাসেরের পক্ষ নেয় । হঠাত করেই মনে পড়ে যায় আব্বুর কথা"এমন প্রতিযোগিতা করলে তো ত্যাগের মহিমা কলুষিত হয়ে উঠবে" । ক্ষান্ত দেই আমি ........"নাসের তুমি ঠিকই , তোমাদের দুটোই বড় " ।নাসের অবাক হয়, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নাসের হয়তো কিছু বুঝে নেয় , তারপর বলে .........."আমাদেরটাও খুব বেশি বড় না ,মোটামুটি একই রকম " ।
ক্বুরবানী শেষে নাসেররা সব বিলিয়ে দেয় , শাফেয়ী মাজহাবে এক বেলা খাওয়ার মাংস রেখে বাকিটা বিলিয়ে দিতে হয় । আমাদের সবটুকু বিলিয়ে দেয়া হয়না , বিলিয়ে দেবার মত এত গরীব লোক যে আছে তাও না । অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশ নিজের জন্য রেখে দেয়া হয় । আমার কিন্তু ভালো লাগে , আম্মুকে বলতে ইচ্ছা করে , "খাসির পায়াটা কবে রান্না করবে ?" কিন্তু বলি না , নিজের উপর লজ্জিত হই ,বাবা মায়ের শেখানো কথাগুলো মনে পড়ে........। "মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যই যদি হলো , তাহলে ত্যাগের মহিমা কোথায় ?" । আম্মুকে গিয়ে বলি , "আম্মু নাসেরদেরকে পায়াটা দিয়ে দিলে হয়না ?"
নাসের কোথায় আছো তুমি ? তোমারও কি আমাকে মনে পড়ে ?
আমি কিন্তু অনেক বদলে গেছি , ৭ বছর বয়েসে যেমন করে ক্বুরবানীকে উপলব্ধি করতাম , তার কিছুই এখন করা হয় না ।তোমরা একই রকম থেকো , আার মত বদলে যেও না। ভালো থেকো নাসের , ভালো থেকো জাহরা !!
ঈদ মোবারক ।
ঝাপসা হতে থাকা স্বপ্ন:
গতকাল আমাদের কেনা হয়ে গেলেও ,আজ সন্ধ্যায় আরেকবার গরুর হাটে গিয়েছিলাম এক আংকেলের সাথে । গরুর দাম সন্ধ্যার পর তলানীতে এসে ঠেকেছে । আংকেলের কেনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর একজন বুড়ো বিক্রেতা এসে হাত চেপে ধরলেন ....."স্যার , দশ হাজার ট্যাহায় দেই , তবুও নিয়ে যান ।ঢাহায়(ঢাকায়) ৩ ডা হাড(হাট) এবার কম , দুইডা দিন হাডে গরু নামাতে পারিনি। তিনদিন না ঘুমায়া,না নায়া , রাস্তায় গরু নিয়ে সারারাত পাহারা দিসি। সারাডা বছর গরুডা পালছি , নিজে না খেয়ে খাওয়াইসি , শুধু ঈদে ছেলেমেয়ের একটু হাসি দেখার জন্যি ।সব গাড়িও বন্ধ আজ, যদি বিক্রি না হয় , ফেরতও নিতি পারবো না স্যার । ঘরে আমার ছাওয়াল বেডি অপেক্ষা করে আছে, ৩ টা গরুর একডাও বেচতি পারিনি ,বাইত(বাড়িতে) কিভাবি যাবো স্যার ?" ....এই বলে কেঁদে ফেললেন ।
বিক্রেতাদের এমন অসহায় চেহারা আমার অচেনা , এমন করে দাম ছেড়ে দেয়াটাও অপরিচিত ঘটনা । এমন অসহায় অবস্থায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন অসংখ্য গরু বিক্রেতা । দশ হাজার টাকার এই গরুটিই গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৬/১৮ হাজারে , তবুও কোন ক্রেতা মিলছে না ।ঈদের সকাল যত কাছে আসছে , অসহায় মানুষগুলোর সারা বছরের স্বপ্ন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে .......