টিনের চালে টুপটাপ ছন্দে বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়েছে। ঝুম বৃষ্টি নেমে আসার আগে এই যে একটা আগমনী বার্তা দেয়া, আকাশটাকে মেঘলা করে দিয়ে একমুহূর্তের জন্য সব স্থবির করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়া এই ভাবনাটাই বড্ড বেশি সুখের। বৃষ্টি আসার চাইতে এই আসি আসি ভাবটাই এক বিচিত্র আনন্দ দেয়, মনে হয় এসে গেলেই বুঝি বৃষ্টিটা ফুরিয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং এই আগমনী সাজটাই ধরে রাখুক।
শৈশবের দূরন্ত ছেলেটার কাছে এমন বৃষ্টির দিন মানেই, গড়ের মাঠে ফুটবল নিয়ে বন্ধুদের সাথে দাপিয়ে বেড়ানো কিংবা পুকুরে নেমে গলাজলে বসে হা করে বৃষ্টির ফোঁটা গেলা। আজকের দিনটা স্কুলে যেতে হবেনা এই ভাবনাটাই বড় বেশি আনন্দের। বাবার পিটুনি আর মায়ের গালমন্দটাও আজকের দিনের জন্য তোলা থাকে।
সদ্য কৈশোরে পা দেয়ার পর দুরন্তপনাগুলো নতুন বাঁক নিতে শিখে যায়। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিগারেটে দু'একটা টান দেয়াটা যেনো রাবণের লঙ্কাজয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ঝুম বৃষ্টিতে স্কুল ছুটি হলে হুডতোলা কোনো রিকশায় যখন সদ্য মন দেয়া প্রেমিকা নীল পলিথিনের নিচে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফেরে, তখন তো আর বন্ধুদের আড্ডায় বসে হেঁড়ে গলায় ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’ গাওয়া যায়না।
অষ্টাদশী তরুণীর হৃদয়ে বৃষ্টি ধরা দেয় অনাগত এক প্রেমিক হয়ে। হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি নিয়ে জানালার ফাঁক গলে বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে দেখা, সাথে রবীন্দ্রনাথের দু-একটি লাইন গুনগুন করতে করতে চেনা রাস্তায় অচেনা পথিকের পানে চেয়ে থাকা।
চল্লিশ পেরুলে মধ্যবিত্ত বাঙালি মনে বৃষ্টির দিনে রোমান্টিসিজম ভুলে ভুনাখিচুড়ির ছবিটাই ভেসে উঠে। গরম ধোঁয়া ওঠা একপ্লেট খিচুড়ির সাথে লেবু কচলে ইলিশ ভাজা থাকলে বউ চিরকাল বাপের বাড়ি থাকলেও আপত্তি নেই।
জীবন সায়াহ্নে এসে বর্ষারাতে ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টি আবার মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা টুকরো স্মৃতিগুলোকে। পাকধরা চুল নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে দু'জন দু'জনার দিকে চেয়ে রবীন্দ্রনাথের সুরে বলে উঠে, “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?”