শ্রমজীবী নারী শ্রমজীবী পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন পরিমাণ কাজ করে থাকে। একজন শ্রমজীবী নারী শুধুমাত্র যে সামাজিক শ্রমে আট-ঘন্টা বা তার অধিক সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখে তাই নয়, ঘরে ফিরে এর প্রায় সমপরিমাণ গৃহস্থালী কাজের ঝামেলাও তাকে পোহাতে হয়। আজকে পর্যন্তও পুরুষ গৃহস্থালী শ্রমের এমনকি হালকা কাজগুলোতেও নারীকে সহযোগিতা করা তার আত্মমর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে মনে করে থাকে। নারী বাহিরের সামাজিক শ্রমে যেমন পুরুষের সমতুল্য বা তার চেয়েও বেশী পরিমাণ একঘেয়ে কাজ (কর্তৃত্বহীন সামাজিক শ্রমের একঘেয়ে কাজগুলোতে নারীকে বেশী সংখ্যায় নিয়োগ দেয়া হয়) করেও পুরুষের তুলনায় কম পারিশ্রমিক পায়, তেমনিভাবে গৃহস্থালী নানা ধরনের কাজ যেমনঃ রান্না-বান্না, বাসন-কোসন মাঝা, ঘর-বাড়ি, আসবাবপত্র গোছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, বিশেষভাবে গ্রামীণ নারীদের ক্ষেত্রে টিউবওয়েল চেপে পানি সংগ্রহ করা বা দূর-দূরান্ত থেকে পানি বহন করে নিয়ে আসা, জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ ও খাদ্যশস্য চূর্ণ করা ইত্যাদি কাজে সে কোন ধরনের পারিশ্রমিকই পায় না উপরন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এধরনের কাজকে সার্বিকভাবে নিম্নমানের কাজ বলেও মনে করা হয়। এবং নারী এই ধরনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে বাধ্য হওয়ায় তার সামাজিক প্রতিপত্তিও পুরুষের তুলনায় অনেক কমে যায়।
আরেকটি ব্যাপার হল, বাহিরের সামাজিক শ্রম সেরে ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই গৃহস্থালী কাজে নারীকে মনোনিবেশ করতে হয় বিধায় মানসিক বৃত্তিগুলোকে উন্নত করে, চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটায়, সমাজে মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার আদায়ে সচেতন করে তোলে এমন ধরনের কোন কাজ যেমনঃ বই পড়া, চিন্তা করা, গান শোনা, শিল্প-সাহিত্য চর্চা ইত্যাদির জন্য তার হাতে বাড়তি কোন সময় থাকে না। অথচ একজন পুরুষ বাহিরের সামাজিক শ্রম থেকে ফিরে এসে এধরনের চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে মানসিক বৃত্তিগুলোকে বিকাশমান ও উন্নত করতে সক্ষম হয়ে উঠে। ফলে দেখা যায়, গার্হস্থ্য শ্রমের বোঝা পুরোপুরি ভাবে নারীর কাঁধে পড়ায় মানসিক নানা ভাবেও সে পুরুষের থেকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ে। অথচ নারীর এই যে পিছিয়ে পড়া, এটাকেই অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে এধরনের কাজে নারীকে অনুপযুক্ত ভেবে গতানুগতিক, একঘেয়ে গার্হস্থ্য শ্রমের দিকে তাকে আরো বেশীরকম ভাবে ঠেলে দেওয়া হয়।
ইতিহাসের যে পর্যায়ে এসে নারী ঘরের ভেতরে আটকা পড়ল, তখন থেকেই তৈরী হয়ে গেল নারী-পুরুষের মাঝখানে একধরনের শ্রমবিভাজন। বর্তমান সময়ে এসে নারী সকল ধরনের কাজে নিজের দক্ষতার যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও এই শ্রমবিভাজন দূর হয় নি। যার ফলে দেখা যায়, গার্হস্থ্য শ্রমের যে অংশ বর্তমানে কর্তৃত্বহীন সামাজিক শ্রমে পরিণত হয়েছে সেই কাজে নারীকে পুরুষের তুলনায় অনেকবেশী সংখ্যায় নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে। তৈরী পোশাকের কারখানাগুলোর দিকে একটু নজর দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ক্ষুদ্র পরিসরে পোশাক তৈরীর কাজ গৃহস্থালী কাজেরই অংশ ফলে যখন বৃহৎ পরিসরে সামাজিক শ্রম হিসেবে পোশাক তৈরী হতে শুরু হল, নারীই নিয়োগ পেল বেশী সংখ্যকভাবে। ফলে নারী সামাজিক শ্রমে যুক্ত হয়ে পড়লেও নারী-পুরুষের মধ্যকার শ্রমবিভাজন দূর হল না। এই তৈরী পোশাকের কারখানাগুলোতে পুরুষদেরকেও নিয়োগ দেয়া হয়- তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে হিসাব রক্ষণ, ব্যাবস্থাপনা ইত্যাদি বেশী বেতনের নানা দায়িত্বশীল মর্যাদাপূর্ণ কাজে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ফলে নারী আজকে সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ করলেও বৃহৎ পরিসরে গার্হস্থ্য শ্রমেই নিজের শরীর খাটাচ্ছে, যেখানে তাকে ঘরের কাজের মতই একঘেয়ে খাটুনি খাটতে হয়। তবে পুরুষের তুলনায় নারীর শ্রম সস্তা হওয়ার কারনে ভারী শারীরিক শ্রমের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরাঞ্চলে ভবন নির্মান ক্ষেত্রগুলোর দিকে চেয়ে দেখলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে উঠবে আশা করি।
অফিস-আদালতগুলোতে- বিশেষ কাজে দক্ষ শ্রম বাদে- আমরা নারীর শ্রমদানের এক ভিন্নরকম পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। সেখানে দেখা যায়, নারী কোন দায়িত্বশীল কাজের সাথে যুক্ত নয়; বলতে গেলে কোন ধরনের কাজের সাথেই যুক্ত নয়। দেখে মনে হয় যেন, তারা অফিস কক্ষের সৌন্দর্য-বর্ধনকারী নানা ধরনের সজ্জা হিসেবে শোভা পাচ্ছে, সেজেছে অফিস কক্ষের অভ্যন্তরে কর্মরত পুরুষদের মনোরঞ্জন করার বা বাহির হতে আসা পুরুষদেরকে আকৃষ্ট করার নানারকম আবেদনময়ী সাজে। অফিসে ঢুকতেই প্রথমে তাদের চোখে পড়ে, বের হয়ে যাওয়ার সময়ও তাদের সুন্দর মুখশ্রী দেখে স্নিগ্ধ হয় পুরুষ। ভেতরে তাদেরকে দেখতে পাওয়া যায় টেলিফোন ডেস্কের সামনে বসে আছে আর বাহির হতে আসা নানা ধরনের ফোন কলকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে অফিসের দায়িত্বশীল, কর্তৃত্বকারী পুরুষ কর্মকর্তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে; মোটা দাগে এই হচ্ছে নারীর কাজ, যেটাকে বলা চলে পুরুষকে তার জড়ভরত মুখশ্রী দেখানো এবং সুললিত কন্ঠস্বর শুনিয়ে পুরুষের কানকে মুগ্ধ করা। এরকম অনেকে হয়ত আছেন যারা অফিস-আদালতে নারীর এধরনের উপস্থিতিকে কাজের মর্যাদা না দেওয়ার ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারবেন না, তাদের জন্য বলছি- আজকের এই প্রযুক্তিরযুগে কম্পিউটারে একটা সফটওয়্যার ইনস্টল করার মাধ্যমে খুব সহজেই এই কাজগুলো সম্পন্ন করে ফেলা যায়। সেক্ষেত্রে বিশ হাজার টাকা মূল্যের একটা কম্পিউটার বসিয়ে যে কাজ অনায়াসে করা যায় সেই কাজের জন্য ঠিক এই পরিমাণ মাসোহারা দিয়ে কোন নারীকে এধরনের কাজে নিযুক্ত করা যে পুরুষের আনন্দ বর্ধনের খাতিরে হচ্ছে, তা সামান্য বোধ-বুদ্ধিওয়ালা যে কেউ খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারবে।
শিল্প-সাহিত্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বা বইয়ের দোকান ও বইমেলায় স্টলগুলোতেও নারীর এধরনের নিয়োগ অহরহ চোখে পড়ে। শিল্প-সাহিত্য বা বইয়ের মূল বা অনেক বড় উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই সমাজে অবস্থিত মানুষকে মানবিকবোধ সম্পন্ন হওয়ার দিকে ধাবিত করা। আমাদের সমাজ যেহেতু শোষণ ভিত্তিক সমাজ বা নানা ধরনের শোষণ-প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করেই সমাজটি দাঁড়িয়ে আছে এবং ফলত সমাজের ভেতরে নানা ধরনের বৈষম্যের অবতারণা করছে। এবং আমরা যেহেতু জানি, শোষণ প্রক্রিয়া এবং মানুষের সাথে মানুষের বৈষম্য মানবিক ক্রিয়া বা প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে থাকে, সুতরাং শোষণ প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে তাকে কমিয়ে নিয়ে এসে বৈষম্যকে অপসারণ করতে না পারলে মানবিক সমাজের দিকে আমাদের যাত্রা ব্যাহত হবে। আমাদের সমাজে নারী পুরুষকর্তৃক শোষিত হচ্ছে বিরামহীনভাবে এবং দীর্ঘদিন ধরে শোষিত হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে বৈষম্যের বিশালাকারের ফাটল তৈরী হয়েছে। সুতরাং সমাজকে একটা মনবিক অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে অন্যান্য নানা ধরনের বৈষম্যের যেমন ঠিক তেমনিভাবে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যেরও অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সমাজের শিল্প-সাহিত্য উদ্যোক্তা মানুষগুলোর অধিকাংশের সাহিত্য করার মানসিকতা যে অন্তত মানবিক সমাজ তৈরীর লক্ষ্যে ধাবিত নয়, সাহিত্য পত্রিকা ও বইয়ের দোকানগুলোতে নারীর এধরনের নিয়োগেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। শিল্প-সাহিত্যের এধরনের প্রণেতা এবং পৃষ্ঠপোষকরাই “শিল্পের খাতিরে শিল্প” ধারণার মুখোশ পড়ে তাদের তৈরী করা শিল্প-সাহিত্যে নারীদেরকে ললনা, রমনী, অবলা, কামিনী ইত্যাদি দুর্বলতাবাচক বিশেষণে অভিহিত করে তাকে শুধুমাত্র শারীরিক সৌন্দর্যের আধার, পুরুষের কাম ও যৌনপ্রেম উদ্রেককারী, সামাজিক-রাজনৈতিক অভিযাত্রায় বীরপুরুষের পার্শ্বসঙ্গিনী ও অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে উল্লেখ করার মাধ্যমে সমাজে পুরুষকর্তৃক নারী শোষণকেই শুধুমাত্র বজায় রাখে এবং ফলত এই দুইয়ের মধ্যকার বৈষম্যকে ত্বরান্বিত করে চলে।
ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যমগুলোতে নারীর শ্রম বৈষম্যের চিত্র একটু প্রকট ভাবেই চোখে পড়ে। সংবাদ সংগ্রহ, সেগুলোর সম্পাদনা করা এবং সর্বোপরি দেশের ভেতর-বাহিরের নানা ধরনের ঘটনাকে পরিবেশন উপযোগী সংবাদে রুপান্তরিত করার মত দায়িত্বশীল কাজগুলোর অধিকাংশই সম্পন্ন হচ্ছে পুরুষকর্মীদের দ্বারা এবং সম্পাদিত হয়ে আসা সংবাদগুলোকে শুধুমাত্র পরিবেশনের মত দায়িত্বহীন কাজগুলো করে যাচ্ছে অধিকাংশেই সুন্দরী নারীরা। সংবাদ পাঠিকাদের বাহ্যিক অবয়ব, অফিস কক্ষের সামনে ডেস্কে বসে থাকা নারীদের চেয়ে অনেকবেশী সুন্দর এবং তাদের কন্ঠস্বর টেলিফোন রিসিভারে কান পেতে রাখা নারীদের চেয়ে অনেক বেশী সুললিত হতে হয় এবং তাদের মুখে মেকাপের পরিমাণও অনেক বেশী থাকে বা নামী-দামী বিউটি পার্লার থেকে সাজিয়ে আনার প্রয়োজন পড়ে। কারন সংবাদ পরিবেশনের সাথে সাথে অনেক পুরুষের মনোরঞ্জনের দায়িত্বও সংবাদ পাঠিকাদের কাঁধে, যার ফলে তাদের বেতন কাঠামোও অন্যান্য চাকুরীজীবী নারীদের তুলনায় অনেক বেশী হয়ে থাকে।(বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় যতগুলো অসাধারণ আবেদনময়ী নারী দেখেছি, পরবর্তীতে তাদের প্রায় প্রত্যেককে দেখতে পেয়েছি টিভি পর্দায় সংবাদ পাঠিকা হিসেবে।) এই ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যমগুলোতে পুরুষ সংবাদ পাঠকও থাকে তবে নারী সংবাদ পাঠিকাদের তুলনায় তা নিতান্তই হাতে গোনা। আবার মাইক্রোফোন হাতে ও ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘটনাস্থল হতে সরাসরি সংবাদ পাঠানোর মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ববানদের অধিকাংশই আবার পুরুষ। নারী সংবাদ পাঠিকা তাপানুকূল মনোরম কক্ষে বসে টেলিফোনের মাধ্যমে সংকটপূর্ণ এলাকায় অবস্থান নেয়া পুরুষ সংবাদ কর্মীর কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চাইছেন- টিভি পর্দার দিকে চোখ রাখলে হরহামেশাই এধরনের একটি চিত্র চোখে পড়ে। সরাসরি নারী সংবাদদাতাও মাঝে মাঝে দেখা যায় তবে তাদের সংখ্যা পুরুষ সংবাদপাঠকদের সংখ্যা যেমন তেমনি হাতে গোনা; এবং এই নারী সংবাদদাতাদের সাধারণত কম সংকটপূর্ণ এলাকা যেমন বইমেলায় বিভিন্ন লেখকের(লেখকদের মধ্যে পুরুষদের সংখ্যা অনেক বেশী) সাথে তাদের প্রকাশিত বইয়ের ব্যাপারে কথা বলা বা বিভিন্ন ধরনের আনন্দপূর্ণ সমাবেশ থেকে বিনোদন বিষয়ক খবর সংগ্রহ করা।
ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যমগুলোর নানা ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় নারী-পুরুষের দুই রকম উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। রাজনীতি, প্রশাসন, সর্বোপরি ক্ষমতা সংক্রান্ত অধিকাংশ আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে(ইদানিংকার সবচেয়ে জনপ্রিয় টক-শো) দেখা যায় সেখানকার আলোচকরাও যেমন পুরুষ, তেমনিভাবে উপস্থাপকও একজন পুরুষ। আবার বিনোদন সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থাপনা করতে দেখা যায় নারীকে এবং আলোচকদের অধিকাংশও নারী। আর রান্নার অনুষ্ঠানগুলোর কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন আছে বলে বোধ হয় না। তার মানে ক্ষমতা সংক্রান্ত ব্যাপারে নারীরা যেন এখনও নিষিদ্ধ বস্তু! পুরুষদেরকে বিনোদন দেওয়া এবং রান্না করে খাওয়ানোতেই তাদের অধিকার একচেটিয়া।
সাধারণভাবে দেখা যায় বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প-সাহিত্য ও সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বে বিশেষ অবদান রাখা মানুষদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা সাধারণত নারীদের চেয়ে বেশী হয়ে থাকে। অনেকে বলতে পারেন তাহলে নিশ্চয় পুরুষের চিন্তা করার ক্ষমতা, অনুভব শক্তি এবং নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবণতা ও শক্তি নারীর চেয়ে বেশী! এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা উপরের একটি জায়গায় ইতিমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে, সামাজিক শ্রমের পাশাপাশি গার্হস্থ্য সকল একঘেয়ে কাজ তার নিজেকে সামলাতে হয় বলে এই ধরনের কাজে অবদান রাখতে যে পরিমাণ পড়াশুনা ও চিন্তার অবসরের দরকার হয় তা স্বাভাবিক ভাবেই নারীর হাতে থাকে না। ফলে এই ধরনের ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীর সংখ্যা কম হওয়ার কারনে যারা নারীর মস্তিষ্কের কল্পিত অনুর্বরতাকে দায়ী করেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এর জন্য যদি কেউ দায়ী হয় সেটা হল এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্যমূলক শ্রমবিভাজন; যে শ্রমবিভাজনে নারীকে পুরুষের চেয়ে দ্বিগুন পরিমান চিন্তাহীন কাজের বোজা মাথায় নিতে হয়। এখানে উদাহরণ হিসেবে, আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেভা মেরিকের কথা উল্লেখ করা যায়, ছোটবেলা থেকেই যার স্বপ্ন ছিল মাদাম কুরির মত বড় বৈজ্ঞানিক হওয়ার। শিক্ষাজীবনে তার মধ্যে সে ধরনের সম্ভাবনাও দেখা গিয়েছিল, এবং জার্মানীর বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান(পলিটেকনিক) এ অধ্যয়নকালীন সময়ের প্রথম দিকে, বলা চলে প্রেম হওয়ার পূর্বে, মিলেভা মেরিক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের চেয়ে মেধাক্রমে ভাল অবস্থানে থাকতেন। এবং ঠিক এ কারনেই আলবার্ট আইনস্টাইন মিলেভা মিরেকের প্রেমে পড়েছিলেন তার চেহারা কদাকার ও হাত-পায়ে সাবলীলতার অভাব থাকা সত্ত্বেও। তবে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হওয়ার পর পরই আইনস্টাইনের জন্য কফি বানাতে বানাতে ও অন্যান্য গার্হস্থ্য শ্রম ও সন্তান উৎপাদন ও তাদেরকে লালন-পালন করতে করতেই এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে পরীক্ষায় পাস করতে পর্যন্ত ব্যর্থ হতে থাকে মিলেভা মেরিক। এবং তার প্রতি আইনস্টাইনের প্রেমও বৃক্ষের বোটা নরম হলুদ পাতার মত খসে পড়ে। নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর থেকে ইতিহাসের সুদীর্ঘ রাস্তায়, গার্হস্থ্য শ্রমের বোঝা বইতে গিয়ে এভাবেই এমন অনেক নারী-মেধার অকাল মৃত্যু হয়েছে এবং যতদিন পর্যন্ত নারী-পুরুষ বৈষম্য থাকবে ততদিন পর্যন্ত অব্যাহতভাবে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে। এবং এটা আমাদের সমগ্র মানব জাতির সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতিকে ক্রমান্বয়ে ব্যাহত করছে। এই অকাল মৃত্যু হওয়া নারী-মেধাগুলো বিকাশের সুযোগ পেলে আমরা এতদূর এগিয়ে থাকতাম যে তা হয়ত এই মুহুর্তে আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে কল্পনাপ্রবণ ব্যাক্তিটির পক্ষেও ধারনা করা সম্ভব নয়।
সমাজের অভ্যন্তরে এত বাঁধা সত্ত্বেও কোন নারী যখন বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প-সাহিত্য ও সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তায় অবদান রাখার জন্য এগিয়ে আসে তখন পুরুষ সহকর্মীরা তাদের নারীজাতি হিসেবে উল্লেখ করে সমালোচনার এমন তীক্ষ্ণ ফলা নিয়ে এগিয়ে আসে যে সে পালাবার পথ পায় না। শিল্প-সাহিত্যে অবদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে ব্যাপারটা স্পষ্ট করা সহজ। কোন নারী সাহিত্যিক যখন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে তার নিজের শোষণ, যন্ত্রণা, কামনা, বাসনা, পুরুষের প্রতি তার প্রেম ও কাম বোধের কথা লেখতে শুরু করে তখন আমাদের সমাজের পুরুষতন্ত্র, ধর্ম ও মৌলবাদের ধ্বজাধারী হয়ে শানানো ছুড়িকা হাতে এমন ভাবে তেড়ে আসে যে তার পক্ষে জন্মভূমিতে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ও তার তৈরী করা সাহিত্য কর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বিপরীত ক্ষেত্রে কোন পুরুষ সাহিত্যিক যখন তার সৃষ্টি করা সাহিত্যের মধ্যে নারীকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে নানা ধরনের শারিরীক ক্রিয়া-কলাপের বর্ণনার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে তার ব্যাক্তিজীবনের অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা পরিপূরণ করে তখন সেটা হয়ে দাঁড়ায় শ্রেষ্ঠ শিল্প-কর্ম। যেসমস্ত পাঠক, নারীর যে ধরনের কাজের জন্য তাকে দেশ ছাড়া করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি সেই একই পাঠক, পুরুষের ঠিক সেই ধরনের কাজের প্রশংশায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। আবার এমনও হয়- কোন পুরুষ লেখক যদি তার কোন সৃষ্টিকর্মে নারীর চোখে পুরুষের প্রতি কাম ও প্রেমবোধ বা যৌনাকাঙ্ক্ষা, যৌনকাজের বর্ণনা দেয় তাহলেও তাকে পুরুষতন্ত্রের খড়গের তলে দাঁড়াতে হয়। ডি এইচ লরেন্সের “লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার” শিরোনামের উপন্যাসটিতে নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষার এবং নারী চরিত্রের মুখ দিয়ে স্বামী বহির্ভূত পুরুষের সাথে তার যৌনকাজের বর্ণনা দেওয়ার জন্য জন্য লেখক এমন ধারার আক্রমণের শিকার হয়েছিল। “রাতভোর বৃষ্টি” উপন্যাসে নারী চরিত্রের মুখ দিয়ে তার কাম-প্রেম বোধের কথা বর্ণিত হওয়ায় লেখক বুদ্ধদেব বসুকে দাঁড়াতে হয়েছিল আদালতের কাঠগড়ায় এবং সামাজিক ভাবেও কম নিগৃহীত হতে হয়নি। একই ধরনের কাজের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন আচরণ দেখে মনে বিস্ময় জাগেঃ শরীর, যৌনাকাঙ্ক্ষা, প্রেমবোধ কি শুধু পুরুষেরই আছে নারীর নেই! এতকিছুর পরও, এমন অনেক নারী আছেন যারা সমাজের শত বাঁধা ডিঙিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সমাজের জন্য বিশালাকারে অবদান রেখেছেন।
খেলাধুলা না করলে শিশুকাল থেকেই একজন মানুষের শারিরীকভাবে সুঠাম এবং মানসিকভাবে ক্রীড়াসুলভ হয়ে বেড়ে উঠার সম্ভাবনা কম। অথচ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সবসময় নারী-শিশুকে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে বাঁধা প্রদান বা অনুৎসাহিত করে থাকে। পুরুষতন্ত্রিক সমাজের মনোভাবটা যেন অনেকটা এরকম- নিয়মিত খেলাধুলা করে যাতে একজন নারী শারীরিক ভাবে শক্ত-সমর্থ, শক্তিশালী এবং মানসিকভাবে ক্রীড়া সুলভ হয়ে উঠতে না পারে এবং ফলত পরবর্তী জীবনে একজন পুরুষ যাতে নারীর উপর নির্বিচারে নানা রকম শারীরিক-মানসিক অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ চালানোর সুযোগ পায় এবং নারী যাতে করে পুরুষের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার জন্য উপযুক্ত শরীর ও মনস্তত্ত্ব লাভ করে। তাদেরকে খেলাধুলার(পুতুল খেলা) নামে যা খেলতে উৎসাহিত করা হয় তা নিশ্চিতভাবেই খেলাধুলা নয়- পরবর্তী জীবনে একঘেয়ে গার্হস্থ্য শ্রমে যাতে সে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে পারে সেজন্য আগে থেকেই তাকে একধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া মাত্র।
তবে, খেলাধুলায় নারীর একধরনের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়, যদিও এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাটা খেলোয়ারের নয়, পুরুষ খেলোয়ারদের উৎসাহদাতার। আমাদের জাতীয় কবি অবশ্য পুরুষদের নানা কাজে নারীদের এই উৎসাহদানের ব্যাপারটাকে অনেক বড় করে দেখিয়েছেন, এর মাধ্যমেই তারা নাকি মানবসভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে! আজকের স্যাটেলাইটের যুগে যখন কোন ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় তখন খেলাধুলায় নারীদের ভূমিকার ব্যাপারটি আরেকধাপ বেড়ে যায়। ঘরে বসে টেলিভিশনের পর্দায় যেসমস্ত পুরুষ খেলা দেখে তাদের মনোরঞ্জনের দায়িত্বটিও আবেদনময়ী নারী দর্শকদের নিতে হয়। যার ফলে দেখা যায় স্টেডিয়াম মাঠে একজন খেলোয়ার দুর্দান্ত একটা পারদর্শিতা দেখানোর সাথে সাথে পুরুষ দর্শককে আরো বেশী মনোরঞ্জন দানের প্রত্যাশায় ক্যামেরা চলে যায় স্টেডিয়াম বেঞ্চে রংমেখে সেজেগুজে বসে থাকা অতীব আবেদনময়ী কোন নারীর উল্লাস মুখর মুখের উপরে এবং পুরুষের কীর্তিগাথায় নারীর উৎসাহদানের ভূমিকাকে তাৎপর্যময় করে তুলতে, খেলোয়ারটির তীব্র আবেদনময়ী বউ বা প্রেমিকার মুখের উপর।
খেলোয়ারদের দুর্দান্ত পারদর্শিতার সাথে সাথে সুন্দরী নারী বা ঐ খেলোয়ারের আবেদনময়ী যৌনসঙ্গীর মুখটিকে খুঁজে বের করা ক্যামেরাম্যানের(শব্দ ব্যবহারেই বলে দেওয়া হচ্ছে এরা পুরুষ) জন্য বেশ কষ্টকর একটা কাজ; ফলে তাকে কষ্টকর কাজের হাত থেকে রেহাই দিতে ইদানীংকালে সুন্দরী নারীদেরকে ভাড়া করার প্রচলন শুরু হয়েছে। বাহারি সাজে সজ্জিত, শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ বের করে রাখা এই তরুণীরা বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের ফুল হাতে নিয়ে খেলা চলাকালীন পুরো সময় জুড়ে নৃত্যরত অবস্থায় থাকে। টেলিভিশন স্ক্রীনের সামনে বসে প্রায়সময়ই কোন না কোনভাবে এদেরকে দেখতে পায় পুরুষদর্শক। এবং যে মুহুর্তে খেলাটি তীব্র-প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ বা জমজমাট হয়ে উঠে তখন বার বার করে ক্যামেরা চলে যেতে থাকে এই নৃত্যরত মেয়েদের ক্লোজ শটে; এসময় এই তরুণীদেরকেও নাচের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে হয়। এই ভাড়া করা তরুণীদের নিয়ে আসার ফলে ক্যামেরাম্যানের কাজটাও যেমন সহজ হয়ে উঠে ঠিক তেমনি ভাবে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে থাকা নারীসঙ্গীহীন পুরুষদর্শকদেরও বাড়তি মনোরঞ্জন দানের সুযোগ তৈরী করা যায়, যে মনোরঞ্জন এতদিন ধরে টেলিভিশনের পর্দায় বসে খেলা দেখা পুরুষরা দর্শকরা শুধু পেত। কর্তৃপক্ষের কাছে নিশ্চয়- টেলিভিশনে খেলা দেখা দর্শকরা মনোরঞ্জন পাবে আর যারা টাকা খরচ করে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছে তারা নারীর শারীরিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পাবে না- এই ব্যাপারটা বৈষম্যমূলক মনে হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল আচরণে টিকেট কেটে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসা দর্শকরা নিশ্চয় খুশি হয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষের টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেওয়াকে মনে হয়েছে যথাযোগ্য।
আশার কথা হল, আজকের যুগে মেয়েরাও নানা ধরনের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করছে। এতদিন ধরে পুরুষালী খেলা বলে পরিচিত ফুটবল-ক্রিকেটের মত খেলায়ও তারা পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। আজকের যুগে নারীদের ক্রিকেট-ফুটবল খেলারও বিশ্বকাপের আসর বসে, নানা ধরনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। যদিও তাদের খেলাচলাকালীন সময়ে স্টেডিয়ামে দর্শকের উপস্থিতি এবং ঐ খেলা সম্প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেলে দর্শকের চোখ থাকে খুবই কম বা থাকেনা বললেই চলে; ফলে চ্যানেলগুলোও নারীদের খেলা সম্প্রচার করার দিকে বিমনা থাকে। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে হয়ত কিছু ক্রীড়া চ্যানেল বাধ্য হয় খেলাগুলো সম্প্রচার করতে। নারীদের বিশ্বকাপ বা টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময়ে -পুরুষ বিশ্বকাপ চলাকালীন যেমন আলোচনার ঝড় উঠে বা বাসা-বাড়িতে সমর্থিত ক্রীড়া দলের পতাকা উত্তোলিত হয়- আলোচনার ঝড় উঠা বা পতাকা উত্তোলন তো দূরের কথা ব্যাপারটি যেন সবসময় আমাদের মাথার উপর বাহিত হয়ে যায়। নারীদের খেলার টুর্নামেন্ট সংঘটিত হওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে সামান্য একটি খবর হয়ে উঠতেও ব্যর্থ হয়। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলোও যেন এক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। নারীদের ও পুরুষদের খেলার, দর্শক মনে প্রতিক্রিয়ার একটি তুলনামূলক ব্যাপার এখানে উপস্থাপন করা যাকঃ কোন একটি দেশের পুরুষ দল অন্য একটি দেশের পুরুষ দলের সাথে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে হেরে গেলে পরাজিত পুরুষ দলের দেশের তীব্র দেশ প্রেমিক সমর্থকরা পরাজয়ের বেদনায় বারবার মুর্ছা যাতে থাকেন। এবং বলা হতে থাকে, হায় হায়! আমাদের দেশ অমুক দেশের সাথে সামান্য ব্যাবধানে হেরে গেল! যদি এমন হয় ঐদিনই বা তার একদিন পরে বা আগে ঐ একই দেশের নারী দল একইধরনের খেলায় অপর দেশটির নারী দলকে হারিয়ে দিল; তখন কাউকেই বিজয়ের উল্লাসে উদ্ভাসিত হতে দেখা যায় না। এবং মনের ভুলেও এমনটি কখনই বলা হয় না যে আমাদের দেশ অমুক দেশকে নির্মমভাবে পরাজিত করেছে। নারী যথাসাধ্য শ্রম দিয়ে জয় অর্জন করলেও তা তাদের দেশের জন্য কোন গৌরব বহন করে নিয়ে আসে না, পুরুষতান্ত্রিকতার বারংবার ছোবলের কারনে দেশবাসী তাদের কীর্তিকে দেশের কীর্তি বলে মনে করেনা। ঠিক তেমনি ভাবে নারীর পরাজয়েও পরাজিত হয় না কোন দেশ বা সমাজ। নারীর জয় বা পরাজয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছুই যায়-আসে না। দেশ বা সমাজের বৈধ অধিবাসী যেন তারা নয়!
ফুটবল, ক্রিকেট বাদে আরো কিছু খেলা আছে যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ বেশ স্বতস্ফূর্ত যেমনঃ লন টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, হ্যান্ডবল ইত্যাদি। এই খেলাগুলোর মধ্যে নারীদের লন টেনিস টুর্নামেন্টকে মাঝে মাঝে খবর হতে দেখা যায়। লন টেনিস খেলায় নারীর শারীরিক(পোশাকটা বেশ খাটো এবং আঁটসাঁট হওয়ার কারনে শরীরের কিছু অংশ অনাবৃত থাকে ও শরীরের ভাঁজগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে) সৌন্দর্যটা বেশ ভালোভাবে উপভোগ করা যায় বিধায় এই খেলায় নারীর কদর অনেক বেশী। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা হয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠবেঃ আনা কুর্নিকোভা নামে এক রাশিয়ান নারী লন টেনিস খেলোয়ার ছিল, খেলাধুলা থেকে অবসর নিয়ে সে এখন পুরোপুরি শারীরিক সৌন্দর্য দেখানোর কাজ মডেলিং এ আত্মনিয়োগ করেছে। আনা কুর্নিকোভা লন টেনিস খেলায় খুব বেশী দক্ষতা দেখাতে না পারলেও বিশ্বজোড়া তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে শুধুমাত্র তার তীব্র শারিরীক আবেদনের কারনে। তার মত এত জনপ্রিয়তা অন্যান্য গ্রেট নারী লন টেনিস খেলোয়ারদের ভাগ্যে খুব কমই জুটেছে। আনা কুর্নিকোভা সমন্ধে আরো একটি ব্যাপার কথিত আছে, পুরুষ দর্শকরা নাকি আনা কুর্নিকোভার খেলা দেখতে আসত, শরীরের ঘাম মোছা একটি রুমালও যদি কুর্নিকোভা কখনও দর্শকের দিকে ছুড়ে দেয় তাহলে সেই ঘামে ভেজা রুমালটিকে কুড়িয়ে পাবার আশায় বা হাত দিয়ে খানিকটা স্পর্শ করার অতীব তাড়নায়। এরকম ব্যপার আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতের লন টেনিস খেলোয়ার সানিয়া মির্জা সমন্ধেও কিছুটা খাটে; কারন ঐ দেশেরই শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেটে সার্বিকভাবে বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়ার হওয়া সত্ত্বেও সানিয়া মির্জা লন টেনিসে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তেমন একটা পারদর্শিতা দেখাতে না পারলেও শুধুমাত্র শারীরিক আবেদনময়ীতার কারনে দেশের অভ্যন্তরে পুরুষ দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তায় শচীনকে বারবারই ছাড়িয়ে যেত। এই লন টেনিস খেলায় কোন নারী খেলোয়ার যতই পারদর্শী হোক না কেন তার বহিরাবয়ব যদি পুরুষকে আকর্ষণ করার মত যথেষ্ট সুন্দর বা আবেদনময়ী না হয় তাহলে সে বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা বা সুখ্যাতি খুব বেশী অর্জন করতে পারেনা। যে কয়জন লন টেনিস খেলোয়ারকে আমরা একনামে চিনি তাদের প্রত্যেকে খেলায় দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক ভাবে যথেষ্ট পরিমাণে পুরুষের যৌন আকর্ষক। পত্রিকার মাধ্যমে আমরা যখন লন টেনিস খেলায় কোন নারীর জয়ের সংবাদ পাই তখন শিরোনামে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে অমুক রুশ বা মার্কিন অথবা ফরাসী সুন্দরী এবারের গ্রান্ডস্লাম জিতে নিয়েছে। নারী খেলোয়ারটি সুন্দরী হলেও খেলায় জয়ের ব্যাপারে তার শারীরিক সৌন্দর্যের কোন ভূমিকা না থাকায় তার জয়ের খবরে যৌক্তিকভাবেই এই বিশেষণটি নিয়ে আসার কোন দরকার পড়েনা, দরকার পড়ে পুরুষের যৌনানুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে খবরের কাগজের কাটতি বাড়ানোর জন্য। কোন পুরুষ খেলোয়ার বিশেষ রকম পারদর্শিতা দেখালে বা রেকর্ড সৃষ্টি করলে তার শারীরিক সৌন্দর্যবাচক বিশেষণ দিয়ে খবর করার নজির খুব কমই দেখা যায়। কখনই বলা হয় না, আর্জেন্টিয়ান বা পর্তুগীজ অমুক হ্যান্ডসাম বা সুন্দর পুরুষটি এবার ফিফা বর্ষসেরা হয়েছে।
একজন নারী, শিশুর জন্মদান প্রক্রিয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ(প্রকৃতিই তার কাঁধে এই দায়িত্ব ন্যাস্ত করেছে) দায়িত্ব পালন করে থাকে। শিশুর জন্মদান প্রক্রিয়ায় পুরুষের ভূমিকা(এটাও প্রকৃতি নির্দিষ্ট) খুবই সমান্য, অথচ শিশুর লালন-পালনে নারীর -স্তন্যদান ব্যাতীত- অন্য কোন আলাদা ভূমিকা প্রকৃতি নির্ধারণ বা সুনির্দিষ্ট করে দেয় নি। অথচ শিশুর জন্মদান প্রক্রিয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও পরবর্তী লালন-পালনে মূখ্যভুমিকা একজন নারীকেই পালন করতে হয়। যে দম্পত্তির নারী সদস্যটি বেতনভূক্ত সামাজিক শ্রমের সাথে সম্পৃক্ত নয় সেখানে পুরুষটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সহযোগিতা দানের মাধ্যমে একটি ভূমিকা পালন করে থাকে। নারীর গৃহস্থালী কাজের পারিশ্রমিকের ব্যাপারটি বিবেচনায় আনলে পুরুষের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দানের ব্যাপারটি আরো অনেক গৌণ হয়ে যায়। শ্রমজীবী নারী বাহিরের সামাজিক শ্রমের পালা সেরে বাসায় ফিরে অন্যান্য গার্হস্থ্য শ্রমের পাশাপাশি সন্তান পালন যেমন করে থাকে ঠিক তেমনিভাবে সন্তান বড় হয়ে গেলেও তার উপার্জনক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত ভরণপোষণের প্রায় সকল দায়-দায়িত্ব ঐ কর্মজীবী নারীটি নিজ ঘাড়ে বহন করে। আমার আশে-পাশে যে কয়জন শ্রমজীবী মায়ের সন্তানকে দেখেছি, তাদের প্রায় সকলকে বলতে শুনেছি, তাদের শিক্ষা-চিকিৎসা, পোশাক-আশাক ও হাত খরচের সকল ব্যয়ভার তাদের মায়েরা বহন করে থাকে। এতকিছুর পরও আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, আইন-আদালত স্নেহ, মমতা, ভালবাসা ইত্যাদি কিছু বিমূর্ত বিষয় বাদে অন্য কোন ক্ষেত্রে সন্তানের উপর মায়ের কোন অধিকারই স্বীকার করে না। সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন প্রক্রিয়ায় এভাবেই নারীর শ্রম আরো অন্যান্য বিষয়ে নারীর শ্রমের মত বেহাত হয়ে যায়।
চিকিৎসা সেবা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায়, চিকিৎসকদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশী। অনেকে এরকম মনে করতে পারেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে হলে অনেক বেশী মেধাবী হতে হয়, পুরুষরা যেহেতু নারীর চেয়ে বেশী মেধাবী হয়ে থাকে তাই তারা চিকিৎসা বিজ্ঞান অধ্যয়ন করার সুযোগ পায় বেশী। মূল ব্যাপারটি হল, আজো আমাদের সমাজের নারীদেরকে শিশু অবস্থা হতেই মায়ের সাথে গার্হস্থ্য শ্রমে নিযুক্ত হয়ে পড়তে হয়। যার ফলে ছেলেদের চেয়ে সে পড়াশুনা করার সময় পায় কম। আর আমাদের অভিভাবকগন যে এখনও মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের পড়াশুনার ব্যাপারে বেশী মনযোগী সেকথা আমরা সকলেই জানি। এতকিছুর পরও নারী চিকিৎসকদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তবে বিপরীতক্ষেত্রে রোগীর সেবা-শশ্রুষাদানকারী নার্সের সংখ্যায় কিন্তু পুরুষরা নারীর চেয়ে বহুগুণ পিছিয়ে। এমনকি আমরা যখন নার্স শব্দটি শুনি, বা বলি তখন আমাদের চোখের সামনে সাদা পোশাক পরিহিত নারীর মুখই ভেসে উঠে। এর পিছনে অন্যান্য নানা সামাজিক পুরুষতান্ত্রিক কারনের পাশে আরেকটি মূল কারন হল স্বয়ং রাষ্ট্রের উলঙ্গ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি ৪৫ জন নারীর বিপরীতে ভর্তি করা যায় মাত্র ৫ জন পুরুষ। রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আরেকটি বড় প্রমাণ হল, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে পুরুষ ছাত্রের অধ্যয়ন করার কোন সুযোগই নেই। যেমন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঠিক তেমনি ভাবে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রও মনে করে নারীরাই কেবলমাত্র রোগীর সেবা এবং গার্হস্থ্য শ্রম করবে, পুরুষরা কোনমতেই নয়। যার ফলেই নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ গুলোতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষতত্ত্বাবধানে এমন নারী-পুরুষ বৈষম্যমূলক আইন তৈরী করা হয় এবং তা টিকে থাকে। এবং আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাসিন্দারা রাষ্ট্রের এই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করার প্রয়াস পাই না। যাহোক, নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে সামান্য কজন পুরুষ ছাত্রকে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেয়া হয়, এর একমাত্র কারন নারী নার্সদেরকে তত্ত্বাবধান করার জন্য কিছু পুরুষ সদস্য নিয়োজিত রাখা। এখানেও নারী দায়িত্বপূর্ণ, কর্তৃত্বময় কাজের হাত থেকে ছিটকে পড়েছে। পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে যেমন রোগীর সেবা করার সকল দায়িত্ব এসে নারী ঘাড়ে পড়ে, তেমনি ভাবে চিকিৎসা সেবার সামাজিক শ্রমেও রোগীর সেবা-শশ্রুষা করার দায়িত্বটি অবধারিতভাবে শুধুমাত্র নারীর কাঁধেই বর্তায়।
গার্হস্থ্য কাজের সম্পূর্ণটুকু নারী একা করতে বাধ্য হলেও সেই কাজের কোন অংশ বাহিরে এসে কর্তৃত্বমূলক সামাজিক শ্রমে পরিণত হলে নারী সেই কাজে তার অধিকারটুকে হারিয়ে বসে। বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে দেখা যায় রান্নাবান্নার সকল কাজ করে পুরুষ, এখানে এসে নারী দায়িত্ব প্রাপ্ত হয় পুরুষের রান্না করা সেই খাবার পরিবেশন করার। কারন এই সমস্ত জায়গায় রান্নার কাজ করার মধ্যে একধরনের দায়িত্বশীলতা যুক্ত হয়, ফলে এই কাজ যে করে তার মধ্যে একধরনের ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়। আমাদের সমাজ কখনই এমন কোন দায়িত্বশীল কাজের ভার নারীকে দিতে চায় না যাতে করে সে ক্ষমতার অংশভাগ হতে পারে। ঠিক একই কারনে আমাদের গ্রামীন সমাজে বিয়ে বা অন্য কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে রান্না করার দায়িত্বও তার হাত থেকে ফসকে পুরুষের হাতে চলে যায়। পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজে নারীকে সবসময় সুনির্দিষ্ট রাখা হয়, ফলে এখানে সেজেগুজে খাদ্য পরিবেশনের ভার পায় সে। নারীকে যে শুধুমাত্র পুরুষের মনোরঞ্জনের কাজে সুনির্দিষ্ট রাখা হয় কয়েকটি উদাহরনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিমান পরিবহনগুলোতে বিমান চালনায় নারীকে খুব কমই দেখা যায়। বড় বড় রেস্টুরেন্টগুলোর মত এখানেও তাকে সেজেগুজে খাবার পরিবেশন করতেই নিজকে ব্যস্ত রাখতে হয়। পারিবারিক বা সামাজিক কোন পিকনিক, বনভোজন বা অন্য যেকোন প্রমোদভ্রমণে নারীদের ছাড়া আমাদের চলে না, মদ্যপান-ধূমপান ইত্যাদিতে নারী পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকলেও এবং কোন নারীকে প্রকাশ্যে ধূমপান রত অবস্থায় দেখলে আমাদের শরীরে জ্বালা ধরা সত্ত্বেও শহরাঞ্চলের বিশেষ বিশেষ জায়গায় চার-দেয়ালের অভ্যন্তরে পান ও ভোজনের উৎসবগুলোতে অনভ্যস্ত নারীকেও এসবে বাধ্য করার প্রচলন শুরু হয়েছে। অথচ জমিজিরাত ভাগাভাগি, টাকাপয়সার লেনদেন, পদ বন্টন সর্বোপরি ক্ষমতা ভাগাভাগি সংক্রান্ত পারিবারিক বা সামাজিক বৈঠকে নারীর উপস্থিতি আমরা একদম সহ্য করতে পারিনা, সকলের মাঝে চা-বিস্কিট বা নানা ধরনের হালকা খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয় কেবল।
আমরা প্রগতিশীলরাও যখন ঈদ-পূজা বা অন্য কোন ধরনের ধর্মীয়-অধর্মীয় পার্বণ উপলক্ষে ভোজ উৎসবের আয়োজন করি, সেখানেও দেখা যায় আমরা পুরুষরা ড্রয়িং রুমে বসে রাশি রাশি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ও চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে নারীমুক্তি, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ-বিপ্লব ইত্যাদি সংক্রান্ত তুমুল আলোচনায় মেতে উঠেছি তখন আমাদের নারী সহযোদ্ধারা রান্না ঘরে আমাদের জন্য নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরী করতে নিজেদেরকে ব্যাস্ত রাখে ও নিয়মতি চায়ের যোগান দিয়ে চলে। এরকমও হয় যে আমরা হয়ত খাবার খেতে খেতেও নারীমুক্তি সংক্রান্ত আলোচনার অনেক গভীরে চলে গিয়েছি, অথচ যাদের মুক্তি হবে তারা তখন পুরুষ সহযোদ্ধাদের থালায় খাবার তুলে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত।
গ্রামীণ সমাজে শালিসী বৈঠকগুলোতে দেখা যায় উঠোন জুড়ে শুধু পুরুষ, নারীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে, যদি না কোন নারী প্রত্যক্ষ্যভাবে ফরিয়াদী বা বিবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ঘটনাস্থলে কোন নারীর উপস্থিতি থাকলেও এখানে নারীকে সাক্ষ্যদান করার জন্য ডাকা হয় না। তবুও কৌতূহলী নারী উপস্থিত থাকে, নানা ধরনের গলি-ঘুপচিতে বা আশেপাশের ঘরগুলোতে। শালিস চলাকালীন সময়ে যদি বাদী বা বিবাদী পক্ষের কোন নারী যদি আড়াল হতে যুক্তিসঙ্গত একটি কথাও বলে ফেলে বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কারনে চোখের সামনে দেখা কোন ঘটনার বর্ণনার জন্য একটি বাক্যও উচ্চারণ করে ফেলে তাহলে মাতাব্বররা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শালিসস্থল ত্যাগ করা উপক্রম করে। অন্যান্য লোকজন তৎক্ষণাৎ নারীটির স্বামী বা পরিজনের মধ্যকার কাউকে খুব দ্রুত খুঁজে বের করে তাকে ঘরের ভেতর পাঠায় নারীটিকে উচিত শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে। নারীটিকে অবিরত চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি মারার “দুমদাম” শব্দ এবং নারীটির করুন স্বরে বিলাপের আওয়াজ শুনতে পেলেই কেবল মাতাব্বরদের রাগ কমতে শুরু করে। পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কোন মতেই নারীদের কথা বলা উচিত নয়- এমন ধরনের কড়া সাবধান বাণী পর্দার আড়ালে শারীরিক-মানসিক দুইভাবেই অবরুদ্ধ হয়ে থাকা নারীদের শোনাতে শোনাতে পুনরায় শালিসের কার্যক্রম শুরু হয়।
আদিম সমাজে সম্পত্তির উৎপত্তির সময় হতে শুরু করে নারী আজও পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে পুরুষকে তার দেহ উপভোগ করার সুযোগ দিতে বাধ্য হয়। এটা পুরুষকে শারীরিক-মানসিক আনন্দদানের এমন একটি শ্রম প্রক্রিয়া যেখানে পুরুষটির প্রতি নারীটির কোন ধরনের যৌন প্রেম থাকে না এবং নারীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি পৌনঃপুনিক ঘটে বিধায় শারীরিক-মানসিক কোন ধরনের পরিতৃপ্তিই সে পায় না, এবং ধীরে ধীরে একসময় এই ধরনের শ্রম প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও প্রত্যেকটা শারীরিক সংসর্গের সময়ই তাকে একধরনের ধর্ষিত হওয়ার যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সুতরাং নারীর এই শ্রমদান নীরস এবং ভয়ানক রকম শারীরিক-মানসিকভাবে কষ্টদায়ক। নানা ধরনের যৌন অনুষঙ্গে ব্যবহার করার জন্য নিজের শরীরটাকে পুরুষের নিকট বিলিয়ে দেয় বলে নারীর এই শ্রমদান প্রক্রিয়াকে অক্রিয় শ্রমও বলা যেতে পারে। তবে আজকালের কিছু পুরুষ খদ্দের যৌনকাজে নারীর সক্রিয়তা আশা করে থাকে। সেই ক্ষেত্রে, মনে হয়, নারীর এই শ্রমদান প্রক্রিয়াটা আরো বেশী করে যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠে। অর্থের বিনিময়ে দেহদান সামাজিক নৈতিকতায় অশুদ্ধ কি বিশুদ্ধ সেই আলোচনায় না গিয়ে, এখানে শুধু, এই কাজে নারীর সামগ্রিক মূল্যায়ন ও তার পারিশ্রমিক সমন্ধে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারনে একান্ত বাধ্য না হলে বা নানা ধরনের প্রতারনার শিকার হয়ে এই কাজের ভেতরে আটকা পড়ে না গেলে কোন নারী স্বেচ্ছায় যৌনকর্মের পেশায় জড়িত হতে চায় না। এবং এই পেশায় জড়িত হয়ে পড়ার পরও সবসময় প্রত্যাশা করে থাকে এখান থেকে বের হয়ে গিয়ে অন্য কোন পেশার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে। একান্ত বাধ্য হয়ে এই পেশায় জড়িত হয়ে পড়লেও এখান থেকে তেমন কোন পারিশ্রমিকই সে পায় না। যা পায় তার অধিকাংশই আবার চলে যায় বিভিন্ন ধরনের দালাল, এই কাজে পৃষ্ঠপোষকতাকারী নানা অসাধু ব্যাক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। বিভিন্ন জেলা শহরে অবস্থিত যৌনপল্লী ও বিভাগীয় শহরের জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাতে তাদের আস্তানায় গেলে দেখা যায়, সামান্য দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে ধর্ষিত হওয়ার সমতুল্য যন্ত্রনাভোগকারী কাজ পাওয়ার আশায় কিভাবে এই অসহায় নারীরা খদ্দেরদেরকে আকৃষ্ট করে থাকে। এমনও দেখা যায় প্রচন্ড শীতে- সবাই যখন ভারী গরম পোশাক গায়ে চাপায় বা লেপের নীচ জুবুথুবু হয়ে শুয়ে থাকে- খদ্দের আকৃষ্ট করার আশায় স্বচ্ছ পাতলা কাপড় পড়ে ও শরীরের বিভিন্ন অংশ অনাবৃত রেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
অথচ যেসমস্ত পুরুষ এই নারীদের নিকট নিয়মিত গমন করে তারা সামান্য কয়েকটা টাকার বিনিময়ে ধর্ষণ করার আনন্দ যেমন পায় ঠিক তেমনিভাবে ক্ষেত্র বিশেষে সমাজে তার মান-সন্মান ও সামাজিক প্রতিপত্তিও বেড়ে যায়। যেমনঃ আমাদের সমাজে এমন একটা ওপেন-সিক্রেট ধারনা চালু আছে যে বেশ্যা পাড়ায় নিয়মিত গমন না করলে নাকি কবি-সাহিত্যিকরা মান সম্পন্ন শিল্প-সাহিত্য রচনা করতে পারেনা। এবং এটা জানা কথা যে, অনেক বড় বড় সাহিত্যিকদের নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যাতায়াত ছিল এবং ফিরে এসে নারীর শরীর ও মনের বিভিন্ন বাঁক ও ভাঁজ নিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখত। কোন লেখকের রচনায় নারী শরীরের বর্ণনা খুঁজে পেলেই পাঠক লেখকটির বেশ্যাপাড়া গমনের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে উঠে এবং লেখকের প্রশংশায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়। এবং অন্যান্য সাধারন পুরুষের ক্ষেত্রে নিয়মিত বেশ্যাপাড়ায় গমনে তাদের শারীরিক যৌনশক্তির প্রকাশ হয় এবং তাদের একধরনের পুরুষালী সন্মানবোধ বেড়ে যায়।
প্রাচীন গ্রীক সমাজে ব্যাপারটা খানিকটা ভিন্ন ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমাজেও যৌনকর্মীরা ছিল, বর্তমান সময়ের মতই তারা বাস করত সমাজের মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদাভাবে নিজেদের পল্লী গড়ে নিয়ে। সেই সময়কার দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, চিন্তাবিদেরা সেখানে অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত গমন করলেও তাদের সাথে একধরনের মানসিক সম্পর্ক গড়ে তুলত এবং তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি নিয়ে যৌনকর্মীদের সাথে খোলামেলা আলোচনা চালাত। তখনকার সমাজের নারীরাও যেহেতু এখনকার মত গার্হস্থ্য শ্রমে অধিকাংশ সময় কাটাত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তাদের অনুমতি না থাকার কারনে অনেকটা অন্ধকারের মধ্যে বাস করত। ফলে যৌনকর্মী নারীরা সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তায় ও দর্শন বিজ্ঞানের চর্চায় তাদের অংশগ্রহন থাকার ফলে এবং অর্থনৈতিকভাবে সবলম্বী হওয়ার কারনে সাধরন নারীদের চেয়ে অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করত। ফলত, তাদের প্রতি সমাজের মানুষের একধরনের সন্মান বোধও ছিল। বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাদের কাছে নিয়মিত গমন করলেও তাদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা চালানো তো দূরের কথা ন্যুনতম মানসিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ে তোলা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখে। এবং এই অসহায় নারীদেরকে যখন ধর্মের ধ্বজাধারী প্রভাবশালীরা সম্পত্তি দখলের হীন উদ্দেশ্যে তাদের নিজ বাসস্থান থেকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করে বাস্তুহীন করে তোলে তখন এমনকি বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন, মানবাধিকার কর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকের দল তাদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পর্যন্ত লজ্জা বোধ করে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুরুষ শ্রমিকের অভিবাসন, নারীর শ্রম দেওয়ার পরিমাণ ও সংসারের প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য অনেকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম প্রধান পুরুষ সদস্যের অনুপুস্থিতির কারনে গার্হস্থ্য কাজের পাশাপাশি অন্যান্য সকল দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয় যেমনঃ নিয়মিত কাঁচা বাজার করা, সন্তানের লেখা-পড়ার সমস্ত দায়-দায়িত্ব বহন করা, তাদের ও পরিবারের অন্যান্য সকল সদস্যের চিকিৎসার সুব্যাবস্থা করা ও পোশাক-আশাক কিনে দেয়া, টাকা-পয়সার লেন-দেন সংক্রান্ত নানা ধরনের ঝামেলাপূর্ন কাজও তাকেই সামলাতে হয়। এধরনের কাজের মধ্য দিয়ে অবশ্য সে একধরনের মুক্তি ও স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করে। যদিও এসব কাজের জন্য সমাজের নানা জনের কাছ থেকে তাকে বিভিন্ন রকম বাজে মন্তব্য ও সমালোচনা সহ্য করতে হয়। সকল নারীই যে বিদেশে কর্মরত তাদের পুরুষদের নিকট হতে নিয়মিত টাকা-পয়সা পায় ব্যাপারটা তাও নয়। এধরনের ক্ষেত্রে নারীটির উপর যে বোঝা চাপে তা সামলানো ভয়ানক মুশকিল হয়ে পড়ে। এই অভিবাসিত শ্রমিকের স্ত্রীরা বছরের পর বছর ধরে তাদের স্বামীকে কাছে পায় না অথবা চার-পাঁচবছর পর সামান্য দুই একমাস সময়ের জন্য মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। আবার কোন কোন অভিবাসিত শ্রমিক দশ-পনের বছরের মধ্যে একমাসের জন্যও ছুটি কাটাতে পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসে না, সেখানেই অন্য কোন শ্রমিক নারীকে বিয়ে করে ঘর সংসার পেতে বসার উদাহরনও বিরল নয়। তীব্রমাত্রার যৌনখরা সহ্য করতে না পেরে কোন নারী যদি সমাজের পুরুষতান্ত্রিক একগামী যৌন-নৈতিকতার অবাধ্য হয়ে অন্য কোন পুরুষের সাথে গোপনে মিলিত হয় এবং কোন একপর্যায়ে তা যদি প্রকাশিত হয়ে পড়ে তাহলে তার পক্ষে সমাজে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সমাজের অনেক অভিবাসিত শ্রমিকের স্ত্রীদের, অন্য পুরুষের সাথে মিলিত হতে গিয়ে ধরে পড়ে যাওয়ায় কলঙ্কের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে, গলায় দড়ি দিয়ে বা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছ।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আফ্রিকায় নারীরা কৃষিকাজের ৬০%-৮০%, পশুপালনের ৫০% এবং খাদ্য প্রক্রিয়ায় ১০০% কাজই করে থাকে। কৃষিনির্ভর উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেই এই পরিসংখ্যান সামান্য এদিক-সেদিক করে খাটে। আমাদের দেশের গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কৃষিতে নারী-পুরুষের শ্রমের হিসাব করলে দেখা যায়ঃ জমিতে হালচাষ, ফসল বোনা ও কাটা ইত্যাদি কাজ সাধারণত পুরুষরা করে থাকে। তবে কিছু কিছু সমাজে দেখা যায় এসব কাজেও পুরুষের পাশাপাশি নারী অংশগ্রহণ করছে। ফসলের ক্ষেতে নিড়ানি দেওয়া, ফসল মাড়ানো-শুকানো, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ-সংরক্ষণ, ফসলের বিচালীকে জ্বালানী বা অন্যান্য কাজে ব্যাবহার উপযোগী করে তোলা। বাড়ির উঠানে বা আশেপাশের পতিত জায়গায় নানা ধরনের শাক-সবজির আবাদ, বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যা, বাড়ির ফলজ বৃক্ষ হতে ফল সংগ্রহ, বিক্রির জন্য প্রক্রিয়াজাত করা ইত্যাদি নানা ধরনের কাজ সম্পূর্ণভাবে নারীকেই করতে হয়। হাস-মুরুগী, গরু-ছাগল ইত্যাদি গবাদি পশুপাখি প্রতিপালনের সম্পূর্ণটাই করে নারী। অথচ ফসল, গবাদি পশু-পাখি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উপর তার ন্যুনতম কোন অধিকার বা মালিকানা নেই। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠবেঃ আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ফসল কাটার মরশুমে ফেরীওয়ালার ফসলের বিনিময়ে বাদাম, ছোলা, গুড়ের টানা, ইত্যাদি নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য এবং কাচের চুড়ি, চুলের ফিতা, নেইল পালিশ, লিপস্টিক ইত্যাদি নানা রকমের মেয়েলী সাজের উপকরণ বিক্রি করতে আসে। এত শ্রম দেওয়ার পরও কোন নারী যদি সামান্য এক কেজি ফসলের বিনিময়ে কোন একটা জিনিস ক্রয় করে তাহলে তাকে চোরের অপবাদ মাথায় নিতে হয়। কৃষিকাজে, পশুপালনে, খাদ্যপ্রক্রিয়ায় অধিকাংশ শ্রম দেওয়ার পরও নারীর প্রতি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই হল সার্বিক মূল্যায়ন। আবার যখন বড় পুঁজি নিয়োগ করে ফার্মের মাধ্যমে পশুপাখি প্রতিপালন ও বাজারজাত করা হয় তখন সেখানে নারীর কোন অংশগ্রহন থাকে না। এই ধরনের ফার্মগুলোতে সকল কাজ সম্পন্ন হয় পুরুষ কর্মীদের দ্বারা। কর্তৃত্বে অংশভাক হতে পারে এই ভয়ে বড় বড় হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে রান্নার কাজ থেকে যেমন ঠিক তেমনি ভাবে এখান থেকেও নারীকে বহিস্কার করা হয়।
অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মত কৃষিতেও প্রযুক্তির আগমন ঘটেছে। পুরুষতান্ত্রিক শ্রমবিভাজনে বিভক্ত কৃষিতে নারী-পুরুষের আলাদা-আলাদা কাজে প্রযুক্তির দুই ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কৃষিতে পুরুষের শ্রম দেওয়ার অংশেই কেবল প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। বলদ দিয়ে হালচাষের পরিবর্তে এসেছে কলের লাঙ্গল, ট্রাক্টর, কাস্তে দিয়ে ফসল কাটার কাজকে একদম সহজ করে দিতে এসেছে ফসল কাঁটার অত্যাধুনিক যন্ত্র অথচ নারীর শ্রম দেওয়ার জায়গায় প্রযুক্তির তেমন কোন আবির্ভাব সচরাচর দেখা যায় না। প্রযুক্তি যেন পুরুষের শ্রমটাকেই সহজসাধ্য করে তুলছে নারীরটাকে নয়। পুরুষতন্ত্রের হাতে পড়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিও যেন পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে!
গ্রামীণ সমাজে কুটির বা হস্তশিল্পে পুরুষ শুধুমাত্র বাজার থেকে কাঁচামাল কিনে নিয়ে আসা বা তৈরীকৃত জিনিস হাটেবাজারে বিক্রি করা বাদে আর যাবতীয় সকল কাজ সম্পন্ন হয় নারীর দ্বারা। কৃষিকাজে ফসলের মালিক যেমন পুরুষ ঠিক তেমনিভাবে এই কুটির শিল্পগুলোর মালিক হিসেবে গণ্য হয় পুরুষ এবং অবধারিতভাবেই সকল উপার্জন চলে আসে পুরুষের পকেটে।
যাহোক, কিছু তথ্য-উপাত্ত হাজির করলে, পুরো বিশ্বে নারীর শ্রমদান ও তার মূল্যায়নের ব্যাপারটা কয়েক কথায় একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিশ্ব জনসংখ্যার ৫০% হল নারী। সম্ভবত আংশিকভাবে আরও অধিক। কারন তাদের গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে বেশী(এশিয়া অঞ্চলে কম)। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, সমগ্র পৃথিবীর কর্মঘন্টার দুই তৃতীয়াংশ নারীরাই করে থাকে। আর খাদ্য উৎপাদনের ৫০% হয়ে থাকে নারীর শ্রমে। তারা বিশ্ব আয়ের মাত্র ১০% পেয়ে থাকে এবং তারা বিশ্ব সম্পত্তির ১% এর মালিক। বিষয়টা পরিহাসমূলক। তাদের অন্যান্য দায়িত্বও আছে। এখনও পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ পরিবারের প্রধান নারী।
কৃতজ্ঞতাঃ প্রবন্ধে গৃহীত তথ্য-উপাত্তগুলো আইডান ফস্টার-কার্টার এর The Sociology of Development বই থেকে নেয়া হয়েছে। উন্নয়নের সমাজ তত্ত্ব নামে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাদাত উল্লাহ খান। নারী বিষয়ক কিছু তথ্য উপাত্তের জন্য লেখক আইডান ফস্টার-কার্টার ও বাংলা অনুবাদক সাদত উল্লাহ খানের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা বোধ করছি।