(প্রথম পর্ব )
মোঘল-ই-আজম এমন একটা সিনেমা যেটার সমপর্যায়ের কিছু নির্মাণ করা আর কারো পক্ষে বোধহয় সম্ভবনা। মকবুল ফিদা হোসেন যথার্থই বলেছেন, “to create such a film, i think K. Ashif has to come back to this world..nobody else can create that”
এমন মোঘল পরিসরের সিনেমা, যেটি বানাতে প্রায় ১০ বছর লেগেছিল আর খরচ হয়েছিল তখনকার দিনে (৬০ এর দশকে) প্রায় দেড়-কোটি রুপী। যা কিনা তখনকার দিনের গড়পড়তা বলিউডি মুভির চাইতে দশগুণ বেশী। K. Ashif এর স্বপ্ন, উদ্যম এবং তার এই সিনেমার প্রতি গভীর অনুরাগ-ই মুভিটা মোঘল-ই-আজম হয়ে উঠতে পেরেছিল। মুভিটা বানানোর সময় সেটের লোকেরা যারা তাকে পাগল ঠাওরেছিল মুভি রিলিজ হওয়ার পর তারাই তাকে বলতে লাগলো জিনিয়াস। একটা ঘটনার কথা বলা যায় K. Ashif-এর মুভিটার প্রতি অনুরক্তটা বুঝাতে। একটা দৃশ্য এমন ছিল যেখানে সম্রাট আকবরের দরবারের নবরত্নের একজন সুরসম্রাট তানসেন গাইবেন। তো K. Ashif সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ সাহেব-এর কাছে জানতে চাইলেন তখনকার দিনের তানসেন কে। নওশাদ সাহেব বললেন, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান সাহেব। তো দুজনে মিলে গেলেন ওনার কাছে। খান সাহেব তো কিছুতেই রাজী হবেননা। বললেন, আমি সিনেমাতে গাই না, আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন। K. Ashif বললেন, না আপনাকেই গাইতে হবে। শেষে এমন একটা দাম হেঁকে বসলেন যেটি দিয়ে তিনি ভেবেছিলেন পরিচালককে নিরুৎসাহ করা যাবে। উনি বলে বসলেন ঐ একটা গানের জন্য তাঁকে ২৫,০০০ রুপী দিতে হবে (যখনকার দিনে কিনা লতা মঙ্গেশকার, মোহাম্মদ রাফী ইনারা নিত ২০০-৩০০ রুপী করে একেকটা গানের জন্য)। K. Ashif বললেন, “মাত্র! খান সাহেব আপনি তো অমূল্য”, বলেই ১০,০০০ রুপীর আগাম চেক লিখে দিলেন।
K. Ashif নিজের কল্পনাশক্তির গুণে হলেও আমার ধারণা মোঘলদের সমপর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। এবং যার বহিঃপ্রকাশ আমার মতে অনেকটায় পর্দায় উঠে এসেছে। এমন একেকটা সেট, সংলাপ, ওহ সংলাপগুলো নিয়ে কি বলবো। মুভিটা দেখার এক পর্যায়ে থামিয়ে দিয়ে আমি গুগলে সার্চ করতে লেগে গিয়েছিলাম ডায়লগস গুলো পড়ার জন্য। এমন অসাধারণ। আর মুভিটার প্রতিটা খুঁটিনাটি এমন নিখুঁত করার দিকে পরিচালকের নজর ছিল যে এক কথায় অভূতপূর্ব। দিল্লী থেকে দর্জি আনিয়ে কস্টিউমস সেলায় করিয়েছেন, যার আবার এম্ব্রোড্রাইরী করার জন্য লোক লাগিয়েছেন Surat-Khambayat থেকে। হায়দারাবাদি স্বর্ণকারদের দিয়ে জুয়েলারীগুলো বানিয়েছিলেন। Kolhapuri-র শিল্পীরা বানিয়েছেন মুকুট, রাজস্থানী কামার-রা বানিয়েছেন অস্ত্র-শস্ত্র এবং আগ্রা থেকে ডিজাইন করে আনা পাদুকা। যুদ্ধের দৃশ্যগুলোর জন্য ব্যাবহার করেছেন ২০০০ উট, ৪০০০ ঘোড়া, ৮০০০ সৈন্য (যারা কিনা সত্যিকারের ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে ধার করা)
মুভিটা যখন শেষের পর্যায়ে তখন হিন্দী মুভিতে রঙ্গিন মুভির প্রচলন শুরু হয়েছিল। K. Ashif তখন মুভিটার শেষের কয়েকটা রীল রঙ্গীন ফিল্মে শ্যুট করেন। রেজাল্ট দেখে উৎসাহিত হয়ে তিনি চাইছিলেন পুরো মুভিটায় আবার রঙ্গিন করে শ্যুট করতে। কিন্তু পরিচালক এবং ডিস্ট্রিভিউটাররা আর অপেক্ষা করতে রাজী না হওয়ায় ১৫% রঙ্গীন আর বাকীটা সাদাকালো এমন ভাবেই রিলিজ করেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল পুরো ছবিটায় রঙ্গিন করে করার, যেটি পূরণ হয় ২০০৪ সালে K. Ashif-এর ছেলে আর পরিচালকের নাতির সহযোগীতায়। যদিও K. Ashif সেটি দেখে যেতে পারেননি।
কাহিনীর প্রসঙ্গে আসা যাক। গল্পের মূল বিষয়বস্তু সেলিম-আনারকলির প্রেমকাহিনী ঘিড়ে হলেও মোঘলদের জীবনযাত্রার অনেক দিকও উঠে এসেছে মুভিতে। মুভির শুরুর দৃশ্যটা এমন, সম্রাট আকবর (পৃথ্বীরাজ কাপুর) তপ্ত মরুভূমির বালুর উপর খালি পায়ে হাঁটছেন। মুখে তার ক্লান্তির ছাপ কিন্তু গন্তব্য স্পষ্ট। সেলিম চিশতীর মাজার। জানা যায়, বাস্তবিকই আকবর তার জমজ দুই সন্তানকে হারিয়ে আগ্রা থেকে খালি পায়ে হেটেই সেলিম চিশতীর মাজারে গিয়েছিলেন পুত্র সন্তানের মানত করার জন্য। প্রার্থনা পূরণ হওয়ায় ছেলের নাম রাখা হয় সেলিম (সেলিম চিশতীর নামানুসারে), যে কিনা পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর হয়ে উঠেন।
খালি পায়ের দৃশ্যটা চিত্রায়ণ করার জন্য পরিচালক পৃথ্বীরাজ কাপুরকে খালি পায়ে মরুভূমির উপর দিয়ে যখন হেটে আসতে বলছিলেন তখন পৃথ্বীরাজ কাপুর বলছিলেন তার পক্ষে অমন গরম বালির উপর দিয়ে হাঁটা সম্ভব না। তখন পরিচালক নিজের পায়ের জুতা খুলে বলেন, যতক্ষন তিনি হাঁটতে পারবেন ততক্ষন যেন আকবর রুপী পৃথ্বীরাজ কাপুরও হাটেন।
বালক সেলিমের বেলেল্লাপনায় ক্রুদ্ধ হয়ে আকবর তাকে দূরে পাঠিয়ে দেন নিয়ম শৃঙ্খলায় বেড়ে উঠবার জন্য। ১৪ বছর পর যখন যুদ্ধজয়ী সেলিম প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করেন সেই দৃশ্যটা ক্যামেরায় বন্দী করার জন্য পরিচালক পথে চড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইলেক্ট্রিক পোল সব নির্মূল করে ফেলেন।
তো প্রাসাদে ফিরে আসা সেলিমকে খুশী করার জন্য বাহার প্রাসাদের
ভাস্করকে গিয়ে বললো এমন একটা ভাস্কর্য তৈরী করে দিতে যা দেখে রাজা বাদশাহ্দের হুশ উড়ে যাবে। কিন্তু ভাস্কর সময়মতো ভাস্কর্যটা তৈরী করতে না পেরে নাদিরাকে প্লাস্টার লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। সেলিম তীর মেরে সেই ভাস্কর্যের অবঘুন্ঠন উন্মোচন করেন। আকবর মূর্তিরুপী নাদিরাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেন, যেন কোন হুরপরী নেমে এসেছে পৃথিবীতে। পরে আকবর, সেলিম আর বাকীরা যখন বিস্মিত হয়ে দেখলেন ভাস্কর্্য টা আসলে প্লাস্টার পড়া নাদিরা তখন আকবর অভিভূত হয়ে গেলেন নাদিরার সাহস দেখে। আকবর যখন জানতে চাইলেন তীর চলার সময় তার ভয় করেনি; নাদিরা উত্তর দেয়, “Kaniz dekhne chahtiti Afsanah haqiqat main kitna badaltien hain” নাদিরার সাহসিকতায়, রুপে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ আকবর তার নাম রাখেন “আনারকলি”।
এরপর সেলিমের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে এক আসরে আনারকলিকে আরো কাছ থেকে দেখে এবং তার নাচ উপভোগ করতে করতে সেলিম আনারকলির প্রেম পড়ে যান। আনারকলিও সেলিমের প্রেমে। বাস্তবিকই তখন দিলীপ কুমার আর মধুবালা পর্দার বাইরে প্রেম চলছিল। কিন্তু বেশীদিন ঠিকেনি সেই প্রেম। ছবির শ্যুটিং এর সময়কালেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। তো ছবিতে আকবর যখন জানতে পারলেন সেলিম আর আনারকলির প্রেমের কথা, তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। বিশেষ করে আনরকলি যখন প্রাসাদের একজন নর্তকী মাত্র, তা সে যতই রুপসী হোক না কেন। নিজের বংশে বিশুদ্ধ রক্তের ব্যাপারে আকবর অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। আনারকলিকে ভারী শিকল পড়িয়ে প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন (আদতেই মধুবালাকে পরিচালক সত্যিকারের ভারী শিকল পড়তে বাধ্য করেছিলেন তখন, যাতে বেদনার ছাপ চোখেমুখে ফোটে উঠে। পরিচালক অবশ্য এই কথাটা তখন জানতেন না যে মধুবালা তখন কঠিন কিডনীর অসুখে ভোগছিলেন, যার কারণে মুভিটা শেষ হওয়ার ক-বছরের মাথায় তার মৃত্যু হয়।)
আকবর আনারকলিকে এই বলে যে, যদি সে সেলিমকে বুঝাতে পারে যে তার প্রেম ক্ষমতার লোভে ছিল, তাইলে আনারকলিকে মুক্ত করে দিবে। আর সেই সময়-ই আকবরের আয়োজন করা এক আসরে আনারকলি নেচে গেয়ে বলে, “Jab Pyaar kiya tu darnaa kiya”। আহ্ কি সেই নাচ। নাচটার কোরিয়াগ্রাফী করেছিলেন পন্ডিত লাচ্চু মহারাজ যার বাপ চাচারা লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজেদ আলীর দরবারের কর্তকের আসর জমিয়ে এসেছেন।
সেলিম আনারকলী কাওকে নিরুৎসাহ করতে পারছেনা দেখে আকবর ছল করে সেলিমকে যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন দূরে আর আনারকলিকে বন্দী করে রাখেন। এই সময়ই আকবরের একটা সংলাপ খুব করে নাড়া নেয় –
আকবরঃ Selim tuje marne nehi denge, Aur hum Anarkali tuje jine nehi denge (সেলিম তোকে মরতে দিবে না, আর আমি আনারকলি তোকে বাঁচতে দিব না)
আকবর গোপনে আনারকলিকে মেরে ফেলবে এই খবর জানতে পেরে সেলিম আকবরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে বসেন এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন আকবরের সাথে, যদিও শেষে সেলিম বন্দী হন। এরপর আকবর কি চাল ছেলেছিলেন আর সেলিম-আনারকলির প্রেমের কি পরিণতি হল সেটি জানতে আপনাকে মুভিটা দেখতে হবে যে :-)
অভিনয় নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করা বৃথা হবে। দিলীপ কুমার, মধুবালা আর পৃথ্বিরাজ কাপুরের অভিনয় দক্ষতা বোধকরি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখায় যায়। কি একেকটা সংলাপ বলার স্টাইল। শুরুর দিকে আমার চোখে পড়ছিল দিলীপ কুমার আর পৃথ্বিরাজ কাপুরের শরীরের ভাষাও যেন রাজা বাদশাহদের আদলে কথা কইছে। সত্যি বলতে এমন করে এত নিষ্ঠার সাথে আর এতটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে আমি আর কাওকে এমন করে রাজা-বাদশাহ্দের রোল করতে দেখিনি। মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। আর মধুবালা তো মধুবালায়।
বন্দী অবস্থায় মধুবালার এই গানটা দেখা যেতে পারে। লতা মঙ্গেশকারের কন্ঠ আর মধুবালার অভিব্যক্তি একেবারে বুকের ভেতরটা নিংড়ে দেয়।
Muhabbat Ki Jhuthi Kahani Pe Roye
Ba.di Chot Khai (javani Pe Roye - 2)
Muhabbat Ki Jhuthi ...
Na Socha Na Samajha, Na Dekha Na Bhala
Teri Arazu Ne, Hame.n Mar Dala
Tere Pyar Ki Meharabani Pe Roye, Roye
Muhabbat Ki Jhuthi ...
Khabar Kya Thi Ho.ntho.n Ko Sina Pa.dega
Muhabbat Chhupa Ke Bhi, Jina Pa.dega
Jiye To Magar Zindagani Pe Roye, Roye
Muhabbat Ki Jhuthi ...
পরিশেষে বলতে হয়, বাস্তবের সেলিম-আনারকলির প্রেম-কাহিনী এবং পরিণতি নিয়ে যদিও ইতিহাসবিদদের মাঝে দ্বন্ধ আছে, কিন্তু পর্দার সেলিম-আনারকলির প্রেম এবং পরিণতি নিয়ে বোধহয় কারো মনে কোন সংশয় নেই।
অনলাইনে দেখুন এইখানে
IMDB-র রেটিং ১০ এ ৭.৮
http://www.imdb.com/title/tt0054098/
আমার যত সিনেমাকথন গুলো...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:১১