শিক্ষা নিয়ে মশকরা আর কতোকাল?
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়ে বছরের বছর ধরে চলছে সমালোচনা। কারো যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা নিজে যেন মজা লুটছে কেউ। মাঝে মাঝে মনে হয় শয়তান ব্যাটা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের কোনো খোপে বসবাস করে। আর যে মক্কেল সেখানে যায়। তাকেই পাকড়াও করে আবোল তাবোল কাজ করিয়ে নেয়। যখন তথাকথিত জ্ঞানী মানুষরা সেখানে বসে উদ্ভট সব কান্ড করে তখন শয়তান হেঁসে গড়াগড়ি খায়। শয়তানগুলো কেন যেন খুব বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষের পিছে না ঘুরে, আম জনতার ব্রেইনওয়াশ না করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে হাত করতে পারলে তার কাজ আসলেই সহজ হয়ে যায়। কারণ ওখান থেকে চাবি ঘুরিয়ে উল্টা পাল্টা কিছু করে দিতে পারলে জনে জনে গিয়ে কষ্ট করার দরকার নাই। বইতে যা লিখা থাকবে তামাম জাতির সন্তানেরাতো তাই গিলবে। কার খেমতা আছে কথা বলার। সেখানে যে সিস্টেম চালু করা হবে সেদিকেই ঘুরবে জাতির ঘড়ির কাঁটা। বাহ্ কি মজা। যদি শিক্ষা ব্যবস্থা আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় না থাকতো শয়তানের কতো পরিশ্রম করা লাগতো।
নীতি নির্ধারকদের সমালোচনা হয়ে গেলো কি? মনে হয় না বুঝে এভাবে বলা ঠিক নয়। কারণ যারা দায়িত্বে থাকে তারাই কেবল জানে যে একটা কাজ করতে গেলে কতো কাঠখড় পোহাতে হয়। কতো দিকে খেয়াল করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তা নইলে সবাই অমন হবে কেন? মোক্ষম যুক্তি। তাছাড়া কখনো কোনো সিদ্ধান্ত সব লোককে খুশি করতে পারবেনা। কিছু সমস্যা থাকবেই। একটা ভালোদিক চাইলে দুই একটা ছোটোখাটো সমস্যা থাকতেই পারে। বিলকুল সহি। হুম অন্যের সমালোচনা করা যায়। এতযে বলছেন পারলে নিজে করেন, তখনি বুঝবেন কত দানে কত তুষ? মন্ত্রী আমলারা দিনরাত খেটে খুটে মরছে, তবুও এদেশের পাবলিক খুশি নয়। পাবলিক যে কি জিনিস? আরে তাইতো!
এক
দেশে হাজার হাজার প্রেস থাকা সত্বেও দেশের প্রকাশনা শিল্পের ভাত মেরে, দেশের শ্রমিকদের বঞ্চিত করে বেশী দামে ভারত থেকে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে যারা দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাদের অন্যান্য সিদ্ধান্ত কি রকম গণবিরোধী হতে পারে তা বোঝার জন্য নিশ্চয় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করতে হবেনা?
দুই
অসংখ্য নীতিগত ভুল, দূর্বল সিলেবাস, মুদ্রণপ্রমাদ গত কয়েকবছর ধরে পাঠ্যপুস্তকের সাধারণ বৈশিস্ট্য হয়ে পড়েছে। পাঠ্যপুস্তক হয়তো নীতি নির্ধারকরা লিখেননি। কিন্তু তাদের নীতির ফলেই গত কয়েকবছর ধরে এটা হচ্ছে সেটা নিশ্চই প্রমাণ করার জন্য জীনের হাজিরা মেলাতে হবেনা। কারণ মনে হয়না এর সাথে জিনজাতি কোনোভাবে জড়িত।
তিন
প্রতিবছর বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। কিছু আমরা জানি কিছু জানি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশ্নপত্র নিশ্চই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ফাঁস হয়না? আর যদি মনে করা হয় এজন্য মার্কজুকাববার্গ দায়ী, সে বিরোধীদলের সাথে হাত মিলিয়ে এসব করছে তাহলে বলার কিছু নেই।
চার
কলেজে ভর্তির জন্য অনলাইনে কলেজ বাছাই করার প্রক্রিয়া ঠিক করা হয়েছে। অথচ শিক্ষার্থীর লোকেশান থেকে কলেজের দূরত্ব কতো সেটা ট্রেক করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফেইসবুক জানে আমার অবস্থান থেকে কে কত দূরে গুগল জানে কোন স্থানে যেতে কতক্ষণ লাগে। অথচ আমার দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানে না। আমার বাড়ি থেকে আমাকে যে কলেজে ভর্তির কথা বলছে সেখানে তেতে চারবার গাড়ি বদল তিনঘন্টা সময় লাগে। তাহলে মানুষের সাথে এ ধরনের মজার হেতু কি? প্রতিটি উপজেলার মাস্টার্স কলেজ না দিয়ে কেন এই মজালুট। কেন একজন গরিব পিতার ছেলেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের কলেজ দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেন একটি মেয়ে শিক্ষার্থীকে অপশন দেয়া হচ্ছে আড়াইঘন্টার রাস্তায় গিয়ে ক্লাস করার জন্য? সমস্যা তৈরী করার মাঝে যদি তাদের এত আনন্দ। তাহলে রাস্তার ধারে মরিচের গুড়া নিয়ে ছিটালেতো হয়। মানুষের চোখে পড়বে মানুষের চোখ জ্বলা করবে। আর তারা মজা পাবে।
পাঁচ
ক্লাসে পাঠদান পদ্ধতি মোগল আমলের, পরীক্ষা পদ্ধতি ব্রিটিশ আমলের আর মূল্যায়ন পদ্ধতি সৃজনশীল ফলাফল পদ্ধতি গ্রেডিং সেকশান। খুব সুন্দর ফর্মুলা। একমুঠ বালি, এক চিমটি হলুদের গুড়া আর আধাসের গরুর মূত্র। ব্যস হয়ে গেলো ওরস্যালাইন।
ছয়
কর্মমূখী শিক্ষার বিকল্প নাই, বিজ্ঞান শিক্ষা ছাড়া গতি নাই, কমপিউটার ছাড়া পথ নাই, প্রযুক্তি ছাড়া উপায় নাই, ইংরেজী ছাড়া অন্যথা নাই। নানা এসব কথার কথা। নইলে কেন ইংরেজী সিলেবাস উন্নত হচ্ছেনা। কলেজ পর্যায়ে কমপিউটার শিক্ষা যথাযথ নয়, বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য সুবিধা প্রতুল নয়?
সাত
বিভিন্ন এলাকার জনসংখ্যা, নতুন প্রজন্মের লোকসংখ্যা ইত্যাদির সংখ্যা, স্বাক্ষরতার হার, কিংবা স্কুল শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুসারে সেসব এলাকা উপজেলা বা ইউনিয়নে সরকার স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে কিনা, বা স্কুল কলেজে আসন তৈরী করে কিনা? বা অবকাঠামো উন্নয়ন করে কিনা? বা শিক্ষক সংখ্যা বাড়ায় কিনা? নাকি যে এমপি বা মন্ত্রী যতবেশী তদবির করতে পারে, যতবেশী চামচামি করতে পারে সে এলাকাতেরই সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হয়? আমি ঠিক জানি না। তাই এ ব্যাপারে কিছু বললাম না। আপনারা নিশ্চয় জানেন।
কি বলবো এমন কতো কিছুইতো আছে। পরীক্ষায় পাস করিয়ে বেশী এ প্লাস বানানো। ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ আরো কতো কথা নিন্ধুকেরা বলে বেড়ায়। কিজানি বাপু যা দেকিনি সে বলে আর কতা বাড়াতে চাইনে।
সমালোচনার জন্য সমালোচনা করতে পারি। বলতে পারি ওরা বিদেশের চর। তাদের টাকা খেয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করছে। বলতে পারি তাদের ছেলে মেয়ে বিদেশে পড়ে বলে পরিবের ছেলেরা যেন মানুষ হতে না পারে বা যোগ্য হয়ে উঠতে না পারে এটা তার একটা নীল নকশা। এতে করে তাদের পরে আবার তাদের ছেলে মেয়েরা এসে রাজত্ব করবে আর আম পাবলিক সারাজীবন মুরগীর মতো জবাই হবে। এজন্যই তারা এসব করে। তা বলতে চাইনা। শুধু বলতে চাই। চাইলে এই সমস্যা গুলোর সমাধান সম্ভব। নইলে এইসব সমস্যা পৃথিবীর সব দেশেই থাকতো।
আমাদেরতো সাফল্য আছে। দারিদ্র বিমোচনে আমরা মডেল, আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমরা প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে। যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় প্রত্যাশার চেয়ে বেশী সাফল্য আছে আমাদের। এসব সব কিছুই কোনো এনজিও কিংবা দাতা সংস্থার জন্য হয়নি। শ্রমিকদের শ্রম প্রবাসীদের রেমিটেন্স আর সরকারগুলোর বিভিন্ন কাজ, প্রকল্প ও সিদ্ধান্তেরই ফসল। এসব উন্নয়ন রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমেই হয়েছে। অরাজনৈতিক সরকারগুলো জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভালো হলেও উন্নয়ন যতটুকু হয়েছে সেটা রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমেই হয়েছে। দূর্নীতি থাকা সত্বেও উন্নয়নের চাকা এখনো ভালোভাবে সচল। তবে কেন শিক্ষাখাতকে নিয়ে চিনিমিন খেলা। একটা জাতির শিক্ষাই যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে কি থাকে আর?
একটু ভাবুন। আপনারা একদিন চলে যাবেন। বিদায় নিতে হবে। ক্ষমতা থেকে এবং দুনিয়া থেকে। আপনার এবং আপনাদের জায়গায় অন্য কেউ আসবে। কোনো একদিন এদশে এলীগ আর বিদল থাকবেনা। নিরপেক্ষভাবে সবার অবদান ও ‘‘অপদান’’ মূল্যায়ন করা হবে। তখন কিন্তু আজকের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসকারীদেরকে রাজাকার, মীরজাফরের কাতারে দাঁড়াতে হবে। ইতিহাস ক্ষমা করবেনা। আমি ভয় পাই না জানি আপনাদের ভুলের জন্য আপনাদের উত্তর বংশের লোকদেরকে আগামীতে লোকের কাছে নাক সিটকানী শুনতে হয় দেশের শিক্ষা ধ্বংসের অপরাধে। খোদা না করুন এমনটা যেন না হয়।
( জাহাঙ্গীর আলম শোভন )
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪১