তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ: একটি পদযাত্রার গল্প
জাহাঙ্গীর আলম শোভন
অবশেষে দেশদেখা নাম দিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট থেকে পদযাত্রা শুরু করে ‘দেখবো বাংলাদেশ গড়বো বাংলাদেশ’ স্লোগান ধারণ করে গত ২৮ মার্চ ২০১৬ টেকনাফ ভ্রমণ সম্পন্ন করেছি।
স্কুলের বইয়ের চেয়ে যে বালক বাইরের বই বেশী পড়েছে, মনতো তার ঘরের বাইরে থাকবেই। উত্তর মেরু দক্ষিণ-মেরু অভিযান, আমাজান অরন্যে অভিযান, নায়াগ্রা জলপ্রপাত, নীলনদের উৎসমুখ আবিষ্কার, হিমালয় আর সাহারা অভিযানের রক্তহীমকরা সত্যিকার গল্পগুলো তাকে টানতো। বইয়ের পড়া শেষ স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যেতেন কোনো নির্জন দ্বীপে কিংবা পিরামিডের গোপন গহবরে। এক নি:শ্বাসে পড়ে শেষ করতেন জেমস কুক, জোনাথন সুফট, আরো নানা অভিযানের গল্প। সুইস ফ্যামিলি রবিনসন, সার্কাসের কুকুর, হোয়াইট ফ্যাং, একশ আশি দিনে পৃথিবী ভ্রমণ, রবিনসন ক্রুশো, মা, কাশতানকা, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, আনা ফ্রাংকের ডায়রী। তাবত বই মনোজগতে ঝড় তুলতো। আর দেখতো নাবিকদের মতোকোনো দ্বীপ আবিষ্কার, কিংবা রুদ্ধশ্বাস কোনো অভিযানের। এসময় ড. আবদুল্যাহ আল মুতির বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা, ভবষে রায়ের বিশ্ব জয়ের কথা সত্যজিত রায়ের ফেলুদা ও শরৎচন্দ্ররে শ্রীকান্ত, তাকে অনুপ্রানীত করতো। রোমনো আফাজ, নীহার রঞ্জন গুপ্ত, বিভুতিভূষন বন্ধোপাধ্যায় এবং কাজী আনোয়ার হোসেনও বাদ পড়েনি।
কিন্তু বাংলাদেশের কোনো প্রান্তে থাকা এক কিশোরের জন্য এসব স্বপ্ন ছিলো অলীক কল্পনা মাত্র। তারপর বাংলাদেশের ছেলেরা এভারেস্ট জয় করলো ইংলিশ চ্যানেলতো আগেই জয় করা ছিলো। চারদিকে এতো এতো মানুষের সাফল্যের গল্প তাকে প্রতিনিয়ত উসকে দিতো। কিন্তু আটপৌরে জীবনে লেখাপড়া শেষ করে হাতে টাকা এলে অেনেক কিছু করা যাবে এই ভাবনায় কর্মজীবন শুরু হলো। হাতে টাকা আসে কিন্তু মাসশেষ হাওয়া। শেষে একদিন পন আঁটা হলো আর কোনো কথা নয় আর কোনো স্বপ্ন নয় এবার শুরু হবে অভিযান। ২০০৭ সালে প্রতিজ্ঞাই করে বসলাম আর কিছু না তেঁতুলিয়া থেকে হেঁটে টেকনাফ যাওয়ার কাজটা অন্তত করবো। এর মধ্যে কতগুলো বছর চেলে গেলো। শোভন ঘুরে বেড়িয়েছেন ৪২ টিরও বেশী জেলা এবং ভারত ও নেপালের কিছু স্থান। এর মধ্যে জাগতিক নিয়মে শুরু দ্বৈত জীবন বিয়ের তিনবছরে শেষে এক সন্তানের পিতা হলে বসলেন তিনি। পিতৃত্ব তাকে যেন আরো বেশী স্পৃহা এনেদিলো।
সরকার ২০১৬ সালকে পর্যটন বছর বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাই পায়ে হেঁটে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পাড়ি দেবেন নাম জাহাঙ্গীর আলম শোভন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ট্যুর ডট কম ডট বিডির সহযোগিতায় ১১৭৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লক্ষ্য স্পর্শ করেন শাহপরীর দ্বীপের গোলারচরে ২৮ তারিখ বিকেল ৫টায়। এ সময় তিনি লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে দেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।
এই সফরে দেশের ১৮টি জেলা পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছি। এই পথে হাজার কিলোমিটার রাস্তা হলেও পথে পথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেখাও সামাজিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহনের কারণে দেড়শো কিলোমিটার পথ বেশ পাড়ি দিতে হয়েছেিআমকে। পায়ে হেঁটে দেশভ্রমণের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ স্থানগুলোর তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করেছি, চলার পথে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সেখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং দেশের হয়ে কাজ করার জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করেছি। এছাড়া এ সময়ে তিনি বিভিন্ন এলাকায় শিশু নির্যাতন বন্ধ, লোকসাহিত্য সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষ রোপণ, বাল্যবিয়ে রোধ ও মাদকবিরোধী জনমত গঠনে কথা বলেছি। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সাথে নানা বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি এবং মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি। এগুলো মূলত তার হাঁটার পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ বহণ করে। এছাড়া তিনি ১৮ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি মাপের একটি বেবী স্ট্রলার বা ট্রলি নিয়েছেন যাতে তার ব্যাগপত্র বহন করা যায়। প্রতিদিনের আপডেটগুলো তার ফেসবুক প্রোফাইলে দিয়েছি।
এই দেশটা আমাদের, আমরাই এই দেশকে গড়ব। আমরা যার যার অবস্থান থেকে দেশের জন্য কিছু করব। এ ছাড়া তিনি শিশু নির্যাতন বন্ধ, লোকসাহিত্য সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, গাছ লাগানো, বাল্যবিবাহ রোধ ও মাদকবিরোধী জনমত গঠনে কাজ করেছেন। শোভন বলেন, এটা একটা ভ্রমণ কর্মসূচী হলেও এর সামাজিক দিক রয়েছে। আমার মূল স্লোগান হলো ‘‘দেখবো বাংলাদেশ গড়বো বাংলাদেশ’’ এর মানে হলো আমার আমাদের দেশ ও এর সৌন্দর্যকে দেখবো এর সম্পর্কে জানবো এবং দেশ গড়ার কাজে অংশ নেবো। সমাজের যে স্তরেই থাকিনা কেন আমাদের দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের নিজস্ব দায়িত্ব রয়েছে জাতি আমাদের কাছে তা প্রত্যাশা করে। আমারদের উচিত প্রত্যেকের নিজের জায়গা থেকে দেশের জন্য কিছু না কিছু করা। অনেক কিছু করতে না পারলেও আমরা অন্তত এতটুকু করতে পারি যে আমরা এমন কোনো কাজ করবো না যাতে আমাদের দেশের ক্ষতি হয়।
আমরা বড়ো হয়ে দেশের হয়ে কাজ করবো, দেশের জন্য কাজ করবো, পরিবেশ সংরক্ষণ করবো, গাছ লাগাবো, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ করবো শিশু অধিকার আদায়ের চেষ্টা করবো, প্রতিটি শিশুর শিক্ষার যে অধিকার রয়েছে তার জন্য চেষ্টা করবো, বাল্যবিবাহ সমাজের এক অভিশাপ এর প্রতিরোধ করবো ,মাদক থেকে দূরে থাকবো মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখেবা। আমাদের দেশের যে নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে তার জন্য আমরা কাজ করবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫১