আমার প্রথম সমুদ্র দেখা ১৯৯৪ সালে। তখন আমি সবেমাত্র নড়িয়া সরকারি কলেজ শরীয়তপুরে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করেছি। আমরা চার বন্ধু মিলে ঠিক করলাম সেন্টমার্টিন ভ্রমণে যাব। বন্ধু চারজন হল তানভীর চৌধুরী ফকু, তসলিম আহমেদ, মুজিবুর রহমান শেখ বাবু এবং আমি মোঃ মুনাব্বির হোসেন নিপু। ডিসেম্বর মাসের আট তারিখ রাতে ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফের বাসে রওনা হলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। ভোরবেলা পৌছালাম টেকনাফে। টেকনাফে পৌঁছে প্রথমে আমরা একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেলটির নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
হোটেলে ঘন্টা দিয়ে ঘুমিয়ে তার পরে গেলাম নাস্তা করতে। নাস্তা শেষ করে বের হলাম টেকনাফ বীচের উদ্দেশ্যে। একটা সমস্যায় পড়লাম, সেটা ভাষাগত সমস্যা। রিকশাচালকদের ভাষা আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। যাই হোক তারপরে আপডাউন রিকশা নিয়ে গেলাম আমরা বিচে। সেখানে গিয়ে একেবারে অভিভূত হয়ে গেলাম। সমুদ্র এবং সাগর সৈকত দেখার অনুভূতি ছিল অত্যন্ত আনন্দের। আমরা চারজন ছাড়া সেখানে বেশ কয়েকজন স্থানীয় জেলে ছিল। ওনারা ওখানে মাছ ধরার সাম্পান ঠিক করছিলেন। সাগর সৈকত ছিল সম্পূর্ণ আবর্জনা মুক্ত পরিচ্ছন্ন। আমরা চারজন শুরু করে দিলাম ঝাপাঝাপি। সাগরের সাথে জড়াজড়ি করে সময় কাটালাম প্রায় দেড় ঘণ্টা। এ সময় দেখি মাঝিরা ঠেলে ঠেলে সাম্পান থেকে আরো উপরে নিচ্ছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে ওরা বলল যে জোয়ারের পানি এসে সাম্পানটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এজন্য নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। আমরাও ওদের সাথে হাত লাগালাম। মারো ঠ্যালা হেইওঁ।
দুপুরে হোটেলে ফিরে গোসল করে বালু মুক্ত হলাম। এরপর লাঞ্চ সারলাম। তসলিম গেল সেন্টমার্টিন ট্রলার এর সময়সূচী জানতে। কতক্ষণ আমরা তিনজন ডামি হ্যান্ডে অকশন ব্রিজ খেললাম। তসলিম এসে জানালো সেন্টমার্টিনের ট্রলার ছেড়ে যাবে ভোর পাঁচটায়। সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য সে সময় কোন জাহাজ ছিল না। সেন্টমার্টিনে যেতে হলে হয় ট্রলার ভাড়া করতে হবে অথবা লাইনের ট্রলারে যেতে হবে। লাইনের ট্রলার দিনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে যায়। জোয়ার ভাটার উপর ভিত্তি করে সেই সময়টা ঠিক করা হয়। সেন্টমার্টিন থেকেও ওই একই সময়ে ট্রলারগুলো ছেড়ে আসে। লাইনে ট্রলারে সেন্টমার্টিন নিয়ে গেলে তখন আর দিনে দিনে ফেরত আসার সুযোগ ছিল না। তাই আমরা এক রাত্র সেন্টমার্টিনে থাকার প্ল্যান করেছিলাম। বিকেল আর সন্ধ্যেটা কাটালাম টেকনাফের বার্মিজ মার্কেটে। অযথা ঘোরাঘুরি কেনাকাটা তেমন কিছু করলাম না। কিছু চিড়া মুড়ি কিনলাম, যদি সেন্টমাটিনে কোন খাবারে সমস্যা হয় সেজন্য। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। রাতে আর ব্রিজ খেলা হলো না, খুব ভোরে উঠতে হবে তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।
সেন্ট মার্টিন যাত্রা
হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে বলা ছিল আমরা খুব ভোরে চেক আউট করবো। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। কোনরকমে আমরা সবাই ব্যাগ গুছিয়ে ট্রলার ঘাট এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গিয়ে দেখলাম আমাদের ভাগ্য খারাপ ট্রলার চলে গেছে। এদিকে আমরা হোটেলে চেক আউট করে ফেলেছি। ট্রলার ঘাটে ম্যানেজার বলল আপনারা নাস্তা করে আসেন। আমি দেখি কী ব্যবস্থা করা যায়। আমরা সকালের নাস্তা সেরে আবার সাতটার সময় ট্রলার ঘাটে আসলাম। লেদার টেকনোলজি কলেজের একদল শিক্ষার্থী ট্রলার রিজার্ভ করে সেন্টমার্টিন যাবে। তাদের সাথে আমাদের যাত্রার ব্যবস্থা করল ট্রলার ম্যানেজার। ওরা বিষয়টি খুব ভালোভাবে নিলোনা। আমরা মোটামুটি খুশি হয়ে গেলাম। যাক অন্তত সেন্ট মার্টিনে যাওয়া আসার ব্যবস্থা হয়েছে। ভাটার সময় থাকায় নাফ নদীর কিনারে কাদার উপর দিয়ে নৌকা করে আমাদেরকে ট্রলারে উঠানো হল। যাত্রা শুরু হল। লেদার টেকনোলজি কলেজ এর দলটির সাথে একজন অধ্যাপক ছিলেন। আমরা তার সাথে পরিচিত হলাম। আমাদের মধ্যে একটু দুরত্ব কমল। ট্রলার যখন নাফ নদী ছেড়ে সাগরে পরল তখন সবার বুকের মধ্যে একটা কাঁপন দিল। সাগর শান্ত থাকলেও চারদিকে শুধু পানি আর পানি। ঢেউগুলিও আকারে ছিল বড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ঢেউয়ের দোলাতে অভ্যস্ত হয়ে পরলাম। লেদার টেকনোলজি শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ একটু বেশি ভীত হয়ে ট্রলারের ভিতরের দিকে গুটিসুটি মেরে বসেছিল। অন্যান্যরা স্বাভাবিকভাবে আড্ডা দিচ্ছিল। আমরা চারজন ও নানা বিষয় নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলাম। বেলা ১২টার দিকে আমরা সেন্টমার্টিনে পৌছালাম। আমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হলো সেন্টমার্টিন আমাদের অবস্থান হবে ৩ ঘন্টার জন্য।
আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম প্রথমে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি দেখতে যাব। সে অনুযায়ী আমরা সেন্টমার্টিন এর মূল সড়ক ধরে হুমায়ূন আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। তখন লক্ষ্য করলাম দু-তিনটি খাবার হোটেল আছে। এক ফাঁকে দুপুরের খাবার এখানে সারতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের বাড়ির সামনে গিয়ে শুরু হল আমাদের ছবি তোলা। হিসেব করে ছবি তুলতে হচ্ছে কারণ রিল শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের চারজনের কোন ছবি তুলতে পারছি না। যে কোন একজন বাদ পড়ছে। লেদার টেকনোলজি কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে দিয়ে আমরা চারজনের ছবি তুলে নিলাম। সময় কম তাই সাগরে নামতে পারলাম না। হুমায়ূন আহমেদের বাড়ির সামনে থেকে সৈকত ধরে আবার ট্রলার ঘাটে ফিরে আসলাম।
এরপর খাবার হোটেলে গিয়ে ঢুকলাম। সাগরের মাছ ভাত আর ডাল আমাদের লাঞ্চ মেনু ছিল। ঝালের কারণে তরকারির স্বাদ কেমন বুঝতে পারিনি। লাঞ্চের পর ট্রলার ঘাটে আসলাম। ঘাটের পাশে বসে এবার আমরা ডাব খেলাম। বিরাট বড় বড় ডাব। একটা ডাবের পানি একজনে খেয়ে শেষ করা খুব কষ্টের। তবে বেশ মজা পেলাম।
এ ভাবেই সময়টা কেটে গেল। চলে এলো ফেরার সময়। সাড়ে তিনটায় ট্রলার ছাড়লো টেকনাফের উদ্দেশ্যে। ফেরার সময় ক্লান্তিতে সবাই ঝিমোচ্ছিল। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা টেকনাফে পৌঁছে গেলাম। শেষ হলো আমাদের সমুদ্র দর্শন।