কথায় কথায় শুনি হাদিস মানে না, হাদিস অস্বীকার এই সেই
এবার একটু হিসাবটা মিলিয়ে দিয়ে যান।
সুন্নিদের হাদিসের সবচাইতে বড় বিখ্যাত সংগ্রহের নাম বুখারী শরীফ। এই বুখারী শরীফের সংগ্রাহক ইমাম বুখারীরও আগের হাদিস সংগ্রাহক হলো মুয়াত্তা ইবনে মালেক। মুয়াত্তা মালেকের অনেক হাদিস ইমাম বুখারী তার বুখারী শরিফে স্থান দেননি। তাহলে ইমাম বুখারী কোন কারণে হাদিস অস্বীকারকারী হলো না??
কাহিনি আরো আছে, ইমাম বুখারীর সমসাময়িক ও উনার ছাত্র ইমাম মুসলিম যিনি সুন্নিদের দ্বিতীয় বিখ্যাত সহিহ হাদিসের গ্রন্থ মুসলিম শরীফের প্রণেতা উনাদের দুইজনের হাদিস সংগ্রহেও অনেক বৈপরীত্য বিদ্যমান। ইমাম মুসলিম এমন অন্তত ৬০০ জন রাবীর(হাদিস বর্ণনাকারী) হাদিস নিয়েছেন যাদেরকে ইমাম বুখারী রিলায়েবল মনে করেননি। এই ছয়শ রাবীর যদি অন্তত একটি করেও হাদিস থাকে তাহলে ইমাম বুখারী ইমাম মুসলিমের অন্তত ৬০০ হাদিস অস্বীকারকারী! এমন না যে ইমাম বুখারী এই হাদিসগুলো শুনেন নাই, শুনেছেন অবশ্যই কিন্তু সহিহ মনে না হওয়ায় নেননি। উদাহরণ স্বরূপ, বিদায় হজ্জের ভাষণের এই যে জিনিস আঁকড়ে ধরে রাখার কথা বর্ণনা মুসলিম শরিফে সহিহ সনদে বর্ণিত হলেও বুখারী শরিফে নাই!
এবার আসুন এর পরের হিসাবে, ইমাম বুখারী ও মুসলিমের পরবর্তীকালে উনাদের শাগরেদ নাসাঈ, ইবনে মাজা প্রমুখ যে হাদিস সংগ্রহ করেন তাতে বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক রিজেক্টেড অনেক হাদিস আছে। তাহলে ইমাম বুখারী মুসলিমের মতে অগ্রহণযোগ্য অনেক হাদিস তাদেরই ছাত্র নাসাঈ, ইবনে মাজার প্রমুখের কাছে সহিহ!
তাহলে ইমাম বুখারী ও মুসলিম কেন হাদিস অস্বীকারকারী হবে না?
হিসাব কি শেষ মনে করেছেন? না, আরো আছে কাহিনি!
এইসব হাদিস গ্রন্থের আবার পুনরায় তাহকীক বা যাচাই করেছেন অনেক মুহাদ্দিস, সেই কাজ করতে গিয়ে আবার অনেক কোম্পানির হাদিস বাতিলের লিস্টে চলে গেছে। যেমন আহলে হাদিসের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল ম্যানেজার নাসিরউদ্দিন আলবানি অনেক কোম্পানির সহিহ হাদিসকে জাল (মাউযু), দুর্বল (যঈফ) বলেছেন আবার অনেক মাউযু হাদিসকে আল হাদিস বলেছেন। উনার কথা বাদ দিলাম, সমসাময়িক কালের বিখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মৃত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির স্যারও হাদিসের নামে জালিয়াতি বইয়ে দেখিয়েছেন অনেক কোম্পানির প্রচলিত অনেক হাদিস আসলে জাল হাদিস! এজন্য উনিও অবশ্য হাদিস অস্বীকারকারী ফতোয়া খেয়েছেন, খাওয়ার কথাই কারণ যেই জিনিসের কোন সীমা নাই, মাত্রা নাই তা আপনি জানবেন কবে আর মানবেন কবে?
কোরআনের আয়াত মোট ৬২৩৬টি ফিক্সড। কিন্তু হাদিসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ঠিক কত? মোট সহিহ হাদিসের সংখ্যা কোনটি? উত্তর হচ্ছে জানা নাই কারণ হাদিস সহিহ না জাল এই নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির আলেমরা দ্বিধাবিভক্ত। যেমন পাকিস্তানের বিখ্যাত হুজুর মাওলানা তারিক জামিলের কোম্পানির মেইন উপজীব্য হচ্ছে পাগড়ি(এছাড়া তাবলীগ পন্থীদের নিকটেও পাগড়ির হাদিস সহিহ); উনি ছাড়াও বাংলাদেশের সুন্নিদের (যেমন এনয়েতুল্লা আব্বাসী, গিয়াসউদ্দিন তাহেরী) উনাদের কাছে পাগড়ি পরা সহিহ হাদিস সাব্যস্ত কাজ এইবার আসুন অন্য কোম্পানির বক্তব্য কি পাগড়ি নিয়ে...
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গির সহ আহলে হাদিস মতাদর্শীদের কাছে পাগরির সকল হাদিস জাল বা একদম দুর্বল!
এইবার আপনি কারটা শুনবেন? ওই হাদিস মানলে বিপরীত দলের কাছ থেকে বেদাতি ক্যাটাগরিতে জাহান্নামি ট্যাগ খাবেন আবার অস্বীকার করলে পক্ষের দলের কাছ থেকে হাদিস অস্বীকারকারী কাফের ট্যাগ খাবেন!
এই জাল সহিহের খেলা কি এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ?? মোটেও না
নবীর বাবা মা জান্নাতি না জাহান্নামি এটা নিয়েও চরম লেভেলের মতভেদ। সিহাহ সিত্তাহর সহিহ হাদিস অনুযায়ী নবীর বাবা মা জাহান্নামি অন্যদিকে সুন্নিদের স্বপ্নে পাওয়া "গায়েবে সিত্তাহ" হাদিস মতে তারা উভয়েই জান্নাতি! যাবেন কোন দলে এখন?
এবার আসেন আরো বড় পরিসরে, মুসলমানদের দুইটা মেজর ভাগ: সুন্নি ও শিয়া। সুন্নিদের মেইন হাদিসের কালেকশনগুলো সিহাহ সিত্তাহ (বিশুদ্ধ ছয়) নামে পরিচিত তেমনি শিয়াদেরও তাদের হাদিসের কালেকশন আছে, যেগুলো কুতুবে আরবা(চারটা বই) বা সিহাহ খামছা (বিশুদ্ধ পাঁচ) বলে পরিচিত। শিয়াদের হাদিসের বইয়ে কি কি হাদিস আছে সেসব জানা তো দূরের কথা এই বইগুলোর নামগুলো পর্যন্ত সুন্নিরা জানে না। শিয়ারা যেমন সুন্নিদের হাদিসগুলো অধিকাংশই মানে না তেমনি সুন্নিরাও শিয়াদের হাদিসগুলো মানে না।
তাহলে মোটাদাগে উপরের আলোচনার উপজীব্যগুলো হলো:
১. প্রচলিত হাদিসের মধ্যে নির্দিষ্ট সীমানাই। ঠিক কয়টি সহিহ হাদিস বিদ্যমান এমন কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নাই।
২. এক ইমামের হাদিসের গ্রেডিং পদ্ধতি অন্য ইমাম পুরোপুরি মানেন নাই। এজন্য তাদের হাদিস কালেকশনও ভিন্ন।
৩. এক ইমামের অনেক সহিহ হাদিস অন্য ইমামের কাছে জাল, দুর্বল হিসেবে সাব্যস্ত।
৪. সুন্নিদের মধ্যেই বিভিন্ন উপদলের মধ্যে হাদিসের গ্রেডিং নিয়ে ভয়াবহ দ্বিমত বিদ্যমান।
৫. শিয়া সুন্নিরা ভাইস ভার্সা একে অন্যের হাদিস সম্পূর্ণ বা বা প্রায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।
এবারে কতগুলো/ প্রশ্ন রেখে যাবো
১. ঠিক কয়টি প্রচলিত হাদিস অস্বীকার করলে কুফর হবে? কোরআনের ক্ষেত্রে তো একটি শব্দ অস্বীকার করলেও সে কাফির, প্রচলিত হাদিসের ক্ষেত্রে এর মাত্রাটা কি?
২. উপরের মাত্রাটি কে নির্ধারণ করে দিলো?
৩. কোন-কোন কোম্পানির হাদিস অস্বীকার করা যাবে?
৪. মাযহাবীদের ক্ষেত্রে মাযহাবের ইমামদের তাকলীদ(অন্ধ অনুসরণ করা) করা দূষণীয় হলে হাদিস সংগ্রাহক ইমাম ও বিভিন্ন মুহাদ্দিসদের তাহকীক অন্ধভাবে মেনে নেয়া কেন সেই মাযহাব হবে না? যেমন, আলবানি মাযহাব! বুখারী মাযহাব।
৫. হাদিস সংগ্রাহক ইমামরা একে অন্যের অনেক হাদিস ও উসুল(মূলনীতি) অস্বীকার করেছেন। তারা কি? তারা কেন হাদিস অস্বীকারকারী হবেন না?
৬. শিয়া সুন্নিরা যে একে অপরের হাদিস মানে না সে জন্য কেন তাদেরকে হাদিস অস্বীকারকারী বলা যাবে না?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৮:৪২