আমরা সবাই জানি এবং সমাজে প্রচলিত যে পুরুষরা সবসময় টাখনুর উপরে কাপড় পরতে হবে। কেননা হাদীসে আছে টাখনুর নিচে কাপড় পরলে জাহান্নামে যেতে হয় এবং টাখনুর নিচে কাপড় পরা হারাম ! আসলেই বিষয়গুলো এভাবে আছে হাদীসে ??? চলুন একটু ঘেঁটে দেখা যাক।
টাখনুর নিচে কাপড় পরাকে সোজাসাপ্টা হারাম প্রমাণ করতে যেসব হাদীস ব্যবহার করা হয়(মিসকোট বা অপূর্ণাঙ্গভাবে উদ্ধৃতি দেয় তারা, তাই সেভাবেই উল্লেখ করলাম, বিশ্লেষণের সময় পুরো হাদীস দেখানো হবে)
■১
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘লুঙ্গির যে অংশ টাখনুর নিচে থাকবে তা জাহান্নামে যাবে।’ (বুখারি: ৫৭৮৭)
■২
“যে ব্যক্তি অহংকার বশে তার লুঙ্গি মাটির সঙ্গে টেনে নিয়ে বেড়াবে, কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি দৃষ্টি দিবেন না।’ -(সহীহ বুখারী, হাদীস, ৩৬৬৫)
■৩
আবু জর ( রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা তো বলবেনই না, বরং তাদের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না। এমনকি তিনি তাদের গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না বরং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা? এদের তো সর্বনাশ হবে। তাদের বাঁচার কোনো রাস্তা নেই।
রাসুল (সা.) এ কথা তিনবার বলেছেন, তারা হলো—
এক. যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে।
দুই. যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে পণ্য বিক্রি করে।
তিন. যে ব্যক্তি কারো উপকার করে আবার খোটা দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ১০৬; নাসায়ি, হাদিস : ২৫৬৩)
এবারে আসুন হাদীসগুলো একটু বুঝার চেষ্টা করি,
শুরুতেই একটা হাদীস দেখা যাক সহীহ বুখারী থেকে
৫৩৬৮। আহমাদ ইবনু ইউনুস (রহঃ) ... সালিম তাঁর পিতা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি অহংকারের সাথে নিজের পোশাক ঝুলিয়ে চলবে, আল্লাহ তার প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দিবেন না কিয়ামতের দিন। তখন আবূ বকর (রাঃ) বললেনঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার লুঙ্গির এক পাশ ঝুলে থাকে যদি আমি তাতে গিরা না দেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও যারা অহংকার করে এরূপ করে। রেফারেন্স: সহীহ বুখারী, ৬৪:পোষাক পরিচ্ছদ অধ্যায়, হাদীস নং ৫৭৮৪(আন্তর্জাতিক)
এখানে স্পষ্ট লিখা অহংকার বশত কাপড় ঝুলিয়ে রাখা। অহংকার করে কাপড় কেন, লুঙ্গি নিয়ে অহংকার করলেও তা হারাম। তাহলে বুঝা যাচ্ছে ঐ সময়টায় মানুষ হয়তো বা অহংকারের নিদর্শন হিসেবে কাপড় ঝুলিয়ে রাখতো, সেটাকেই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
অহংকার করা নিঃসন্দেহে জঘন্য একটি কাজ। এতোটাই জঘন্য ও মহাপাপ যে শুধুমাত্র অহংকারের কারণে শয়তান শয়তানে পরিণত হলো এবং আল্লাহর নৈকট্য থেকে বিতাড়িত হলো,
এবং যখন আমি হযরত আদম (আঃ)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। [সুরা বাকারা - ২:৩৪]
এছাড়া কুরআনে স্পষ্টভাবে অহংকার করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, যেমন
অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। [সুরা লুকমান - ৩১:১৮]
আমি আমার নিদর্শনসমূহ হতে তাদেরকে ফিরিয়ে রাখি, যারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে গর্ব করে। যদি তারা সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে ফেলে, তবুও তা বিশ্বাস করবে না। আর যদি হেদায়েতের পথ দেখে, তবে সে পথ গ্রহণ করে না। অথচ গোমরাহীর পথ দেখলে তাই গ্রহণ করে নেয়। এর কারণ, তারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা বলে মনে করেছে এবং তা থেকে বেখবর রয়ে গেছে। [সুরা আরাফ - ৭:১৪৬]
আমাদের ইলাহ একক ইলাহ। অনন্তর যারা পরজীবনে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহংকার প্রদর্শন করেছে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের গোপন ও প্রকাশ্য যাবতীয় বিষয়ে অবগত। নিশ্চিতই তিনি অহংকারীদের পছন্দ করেন না। [সুরা নাহল - ১৬:২২-২৩]
তাহলে বুঝা গেলো অহংকার না করার নিমিত্তে হাদীসটি অত্যন্ত চমৎকার একটি শিক্ষামূলক হাদীস। অহংকার করলে আরবে তখন টাখনুর নিচে কাপড় পরার চল ছিলো, তার নিমিত্তেই হয়তো নবী এমন কথা বলতে পারেন। অহংকার যে খারাপ তা কে না জানে, অহংকার করে নামের আগে আল্লামা, মহা পন্ডিত ইত্যাদি লাগানোও যেমন মহাপাপ তেমনি কথায় আচরণে বড়াই করাটাও।
টাখনুর নিচে কাপড় পরাতে কি আসে যায় যদি অহংকার না করা হয়। তাই হাদীসের মূল উপজীব্য অহংকার নিরুৎসাহিত করা তা যেকোন ফরম্যাটে হোক। অহংকারের সাথে না করলে টাখনুর নিচে কাপড় পরলেও কোন সমস্যা থাকে না।
এই সংক্রান্ত একটি কুযুক্তির উত্তর:
প্রশ্ন: সহীহ মুসলিমের ১০৬ নং হাদীস(আন্তর্জাতিক নাম্বার) অনুযায়ী বলা আছে টাখনুর নিচে কাপড় পরলে জাহান্নামে যেতে হবে, তাতে অহংকারের বিষয়টির উল্লেখ নাই, এর দ্বারা কি প্রমাণ হয় না অহংকার করুক বা না করুক টাখনুর নিচে কাপড় পরলেই জাহান্নাম ?
উত্তর: আসুন আগে হাদীসটা পড়ে দেখা যাক,
"১৯৪-(১৭১/১০৬) আবূ বকর ইবনু আবূ শাইবাহ, মুহাম্মাদ ইবনু আল মুসান্না ও ইবনু বাশশার (রহঃ) ..... আবূ যার (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। বর্ণনাকারী বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটি তিনবার পাঠ করলেন। আবূ যার (রাযিঃ) বলে উঠলেন, তার তো ধ্বংস হবে, সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হে আল্লাহর রাসূল! এরা কারা? তিনি বললেন, যে লোক পায়ের গোছার নীচে কাপড় ঝুলিয়ে চলে, কোন কিছু দান করে খোটা দেয় এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৯৫, ইসলামিক সেন্টারঃ ২০১)" রেফারেন্স: সহীহ মুসলিম, ১-ঈমান অধ্যায়, হাদীস নং: ১৯৪ (আন্তর্জাতিক)
এই হাদীসে (১) টাখনুর নিচে কাপড় পরা, (২) দান করে খোঁটা দেওয়া, (৩) ভুয়া কথা বলে পণ্য বিক্রি করাকে জাহান্নাম যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
(২) ও (৩) খুবই স্পষ্ট যে দান করে খোঁটা দেওয়া (যা কুরআনেও নিষিদ্ধ, রেফারেন্স: সূরা বাকারা ২৬৪)
▶হে ঈমানদারগণ!ত োমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব, এ ব্যাক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ঐ বস্তুর কোন সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। [সুরা বাকারা - ২:২৬৪]
এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি (যা কুরআনও সমর্থন করে, রেফারেন্স: সূরা আল ইমরান ৭৭)
▶যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মুল্যে বিক্রয় করে, আখেরাতে তাদের কেন অংশ নেই। আর তাদের সাথে কেয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না। তাদের প্রতি (করুণার) দৃষ্টিও দেবেন না। আর তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্তুতঃ তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। [সুরা ইমরান - ৩:৭৭]
কিন্তু টাখনুর নিচে কাপড় পরা সংক্রান্ত কোন অপকারী দিকের উল্লেখ নাই। তাইলে কেন হুদাই এটা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে ??
এজন্য এ সংক্রান্ত আরো হাদীসগুলো পর্যালোচনার দরকার, সেই নিমিত্তে বুখারী শরীফে গেলেই ৫৭৮৩ নং হাদীসটি লক্ষ্য(রেফারেন্স: সহীহ বুখারা,৭৭-পোষাক অধ্যায়, হাদীস নং: ৫৭৮৩ (আন্তর্জাতিক)
"৫৭৮৩. ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ সে লোকের দিকে (দয়ার দৃষ্টিতে) দেখবেন না, যে অহঙ্কারের সাথে তার পরিধেয়) পোশাক টেনে চলে। [৩৬৬৫; মুসলিম ৩৭/৮, হাঃ ২০৮৫, আহমাদ ৫৩৭৭] (আধুনিক প্রকাশনী- ৫৩৫৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫২৫৪)"
অর্থাৎ অহংকার করাটাই কারণ। অহংকার করে টাখনুর নিচে কাপড় পরলেই সেটা হাদীস মতে জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে।(এটা কুরআনও সমর্থন করে কেননা কুরআনে অহংকার করা নিষিদ্ধ এবং আল্লাহর বিরাগভাজন হওয়ার কারণ(দেখা যেতে পারে ৩১:১৭-১৮; ৭:১৪৬; ১৬:২২-২৩)
কোথায় হলো অহংকার নিরুৎসাহিত করণ আর কোথায় এটা উল্টা বুঝে হয়ে গেলো ড্রেসকোড!!!
শীতের দেশে টাখনু উদোম রেখে ফ্রস্ট বাইট হয়ে মানুষের পা অকেজো হয়ে যাবে, এছাড়া টাখনু খোলা রাখা হলো আবার মোজা পরা হলো, এসব কিরকম সেলফ কন্ট্রাডিক্টরি হয়ে যায় না !
তাই টাখনুর নিচে কাপড় পরাতেও কোন সমস্যা নাই যদি না অহংকার করা হয়। আর অহংকার করলে টাখনু মাখনু কেন, গায়ে ঢাবির লোগো ওয়ালা হুডি পরে শোঅফ করাটাও মহাপাপ ! অহংকার না করলে সব ডালভাত !
নবী বললো কি, আর বুঝলো কি !
এজন্যই বলতে হয়,
আল্লাহ নবীকে দিয়েছেন হিকমাহ (wisdom/প্রজ্ঞা)
আর কতিপয় মানুষকে দিয়েছেন আহাম্মকি !!!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৫:৪২