পড়া কাকে বলে ?
অর্থ না বুঝলেও শুধু আক্ষরিক উচ্চারণ করলেও সেটা পড়া হয় এমন কথা কোন সংজ্ঞায় আছে ?
পড়া মানেই লিখিত কোন কিছু পড়ে তার অর্থোদ্ধার করতে পারা ! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সংজ্ঞাও শিখে এসেছিলাম একটা কোর্সে। সেখানেও একই কথা শিখে এসেছি। পড়া মানেই অর্থ বুঝতে পারা ! অর্থ না বুঝতে পেরে জাস্ট উচ্চারণ করলে পড়া হয় এই সংজ্ঞা কোথায় আছে ??
কেউ প্রয়োজনে ইন্টারনেটেও what is reading লিখে দেখে নিতে পারেন বিশ্বজুড়ে কিভাবে Reading বা পড়াকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
অর্থ না শিখে শুধু জাপানিজ বর্ণমালা শিখে তারপর জাপানি ভাষায় রচিত মেডিকেল সাইন্সের বই পড়ে কি চিকিৎসা বিদ্যা শেখা সম্ভব ?? ওই "পড়া" কি কোন কাজে আসবে ??
কোন বিদেশি ব্যক্তি যদি বাংলা বর্ণমালা উচ্চারণ সহ শিখে কিন্তু যদি শব্দের অর্থ না শিখে এরপরে যদি লাইনের পর লাইন বাংলা পড়ে তো এটা কি পড়া হিসেবে গণ্য হবে ? এটাকি তার কোন কাজে লাগবে ??
পড়া মানেই তো লিখিত কিছু পাঠ করে এর অর্থ বুঝতে পারা।
ইউনিভার্সাল এই সংজ্ঞা কুরআন পাঠের বেলায় ব্যতিক্রম কেন ?? কেন কুরআন খালি উচ্চারণ করে না বুঝে আউড়ালেও সেটা পড়া হবে ???
আসেন দেখি কুরআনের কিছু আয়াত যাতে পড়া বিষয়টাকে আল্লাহ কিভাবে তুলে ধরেছেন,
আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা শোনো এবং নিশ্চুপ থাকো/মনোযোগ দাও যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়। [সুরা আরাফ - ৭:২০৪]
এখানে আল্লাহ কুরআন পাঠের সময় তাতে মনোযোগ দিতে বলেছেন যাতে এটা বুঝে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। এই ব্যাপারটি তার পরের আয়াত(৭:২০৫) পড়লে আরো পরিষ্কার হয় কেননা সেখানে আল্লাহর ওহী শোনার পরে কাঁদার ও ভীতি সঞ্চারণের কথা বলা যার জন্য অর্থ বুঝা আবশ্যিক।
একই সূরায় চার বার আল্লাহ একই কথা বলেছেন, কি বলেছেন ?
আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? [সূরা ক্বামার, ৫৪:১৭]
আমি কোরআনকে বুঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? [সূরা ক্বামার, ৫৪:২২]
আমি কোরআনকে বুঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? [সূরা ক্বামার, ৫৪:৩২]
আমি কোরআনকে বুঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? [সূরা ক্বামার, ৫৪:৪০]
শুধু এই একটা সূরায়ই (সূরা ক্বামার) আল্লাহ ৪ বার বলেছেন কোরআন বুঝার জন্য সহজ, চিন্তাশীলরা কোথায়....! অর্থই যদি না বুঝে তাহলে বুঝবে কিভাবে ?
এক নজরে আরো কিছু আয়াত দেখে নেওয়া যাক,
এটি একটি অত্যন্ত বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার ওপর নাজিল করেছি, যাতে এরা তার আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলরা তা থেকে শিক্ষা নেয়। [সুরা সা’দ - ৩৮:২৯]
তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে না?[সুরা নিসা - ৪:৮২]
হে লোকসকল! আমি তোমাদের প্রতি এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যার মধ্যে তোমাদেরই কথা আছে, তোমরা কি তারপরও বুঝো না? [সুরা আম্বিয়া - ২১:১০]
এভাবে আমি বিশদভাবে আয়াতের বর্ণনা করে থাকি তাদের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে। [সুরা ইউনুস - ১০:২৪]
আর আমি মানুষদের বোঝানোর জন্যে এ কুরআনে সব ধরনের উদাহরণই পেশ করেছি। [সুরা রূম - ৩০:৫৮]
আর এ কুরআনকে আমি অল্প অল্প করে নাজিল করেছি, যাতে করে তুমি যথাসময়ে তা লোকদেরকে পড়ে শোনাও এবং (এই কারণেই) তাকে পর্যায়ক্রমে নাজিল করেছি। [সুরা বনী-ইসরাঈল - ১৭:১০৬]
তুমি এ কাহিনি তাদেরকে শোনাতে থাকো, হয়তো তারা কিছু চিন্তা-ফিকির করবে। [সুরা আরাফ - ৭:১৭৬]
তাহলে বার বার দেখা যাচ্ছে কুরআনের অর্থোদ্ধার করা অর্থাৎ বুঝে পড়াটাই আল্লাহর নির্দেশ !
যদি জিজ্ঞেস করা হয় কলমের কাজ কি, উত্তর মিলবে লিখা। এখন যদি কেউ কলম কিনে লিখার বদলে কান খোঁচানো আরাম্ভ করে তাইলে কি কলমের আসল উপযোগটা পাওয়া গেলো ?
তেমনি আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন পড়ে হেদায়েত/পথনির্দেশনা লাভের জন্য, সেটা কিভাবে সম্ভব অর্থ না বুঝে পড়ে ?
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে খুব কম লোকই পাওয়া যাবে, যারা পুরো কুরআনটা অর্থ সহ একবার পাঠ করেছেন যদিও না বুঝে খতম দেয়া মানুষের হয়তো কমতি হবে না ! কিন্তু কথা হচ্ছে,
না বুঝে কুরআন ১০০০০০০০ বার খতম দিলেও কি এর থেকে কোন শিক্ষা লাভ করা সম্ভব ???
কুরআনের "সুরা নিসা - ৪:৪৩" তে আল্লাহ বলেছেন নেশাগ্রস্থ অবস্থায়, যখন কি বলে তার জ্ঞান থাকে না তখন সালাতের কাছেও যেও না, অথচ আমরা তো নেশা না করেও এমনিই অর্থ বুঝি না, কি বলছি না বলছি !
কুরআনের সহীহ শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার জন্য যেইরকম আমাদের মনোবাসনা কিন্তু এর কতোটুকুই বা এর অর্থ বুঝার জন্য আছে ?
সুতরাং কুরআন অবশ্যই অর্থ সহ পাঠ করা শিখতে হবে আমাদেরকে
কুরআন হেদায়েতের/পথনির্দেশনার বই
সেই নির্দেশ বুঝতে হলে অবশ্যই অর্থ বুঝা আবশ্যিক
পোস্টটা শেষ করতে চাই কোরআনের একটি আয়াত দিয়েই,
যাদেরকে তওরাত দেয়া হয়েছিল, অতঃপর তারা তার অনুসরণ করেনি, তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধা, যে পুস্তক বহন করে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে, তাদের দৃষ্টান্ত কত নিকৃষ্ট। আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। [সুরা জুম’য়া - ৬২:৫]
বই যতোই সমৃদ্ধ হোক তা না পড়ে সুযত্নে গাধার পিঠে চাপিয়ে আনা নেওয়া করলে যেমন জ্ঞানার্জন সম্ভব না তেমনি কুরআনের ঐশী জ্ঞান লাভ করতে হলে অবশ্যই এর অর্থ আমাদেরকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের অনুগামী হয় تَلَاهَا, [সুরা শামস - ৯১:২]
অনুগামী تَلَاهَا তালাহা এর রুট ওয়ার্ড হলো تلو তা লাম ওয়াও, যার অর্থ অনুগামী হওয়া বা পিছনে পিছনে চলা, অনুসরণ করা
তালাহা থেকেই এই থেকে তিলাওয়াত এর উৎপত্তি যেমন تَتْلُونَ يَتْلُونَ , যাকে আমরা আবৃত্তি বা সুর করে বা এমনি না বুইঝা পড়া মনে করি, কিন্তু [সুরা শামস - ৯১:২] থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এর অর্থ পাঠের অনুগামী হওয়া বা অনুসারী হওয়া।
কিন্তু এর প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থ হলো অনুসরণ করা। কোরআন পাঠ করে সেটা মেনে চলার নামই তিলাওয়াত, আর আল্লাহ কোরআনে আদেশ দিয়েছেন হাক্কা তেলাওয়াতের حَقَّ تِلاَوَتِهِ
আমি যাদেরকে গ্রন্থ দান করেছি, তারা তা যথাযথভাবে পাঠ حَقَّ تِلاَوَتِهِ করে। তারাই তৎপ্রতি বিশ্বাস করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। [সুরা বাকারা - ২:১২১]
তাহলে কোরআনরে যথাযথভাবে মানতে হবে, তাইলেই হাক্কা তেলাওয়াত হবে।
তেলাওয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থটা কতো ব্যাপক ভাবেন আর সেইটাকে এখন সুরেলা গলায় গান গেয়ে প্রতিযোগীতার সামগ্রী কিংবা ৫জি স্পিডে আউড়িয়ে টাকা ইনকামের সিস্টেম বানানো হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:১৯