শুধু লুৎফুজ্জামান বাবরই নন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদের কেউই ভালো নেই। যারা বেঁচে আছেন, তারা নিজ নিজ দলে ভালো অবস্থানে নেই। যারা মারা গেছেন, তারাও ক্ষমতা ছাড়ার পর ভালো ছিলেন না। রাজনীতির নিয়তিই বোধহয় এমন, ক্ষমতায় থাকতে তাদের দাপটে চারপাশ কাঁপে, চারদিকে পুলিশের হুইসেল বাজে। আর ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেই করুণ পরিণতি। নিজ দলে অবহেলিত, না হয় রাজপথে নিগৃহীত অথবা কারাগারের নির্জন সেল কিংবা রিমান্ডের মুখোমুখি হওয়া।
ক্ষমতা হারানোর পর লুৎফুজ্জামান বাবরের মতোই নানাভাবে এমন নিগৃহীত হয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকাংশ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। চরমভাবে কোণঠাসা হয়েছেন নিজ দলে। পরবর্তী সরকারের নিশানায় পরিণত হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্তসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ক্ষমতাধর এসব দাপুটে ভালো নেই সাবেক
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পরবর্তী সরকার বাদেও নিজ দলের মধ্যেই খলনায়কে পরিণত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ১৩ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর (বর্তমান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বাদে) অতীত অভিজ্ঞতা এমনই অন্ধকারাছন্ন। ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়।
'আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছেন'_ এমন বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। এর পর থেকে তার লাগামছাড়া বক্তব্য কেউ থামাতে পারেননি। পরে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে। সরকারের পুরো মেয়াদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি তিনি। দল এবং সরকারের মধ্যেই বিতর্কিত হয়ে পড়েন বেফাঁস কথাবার্তার কারণে। আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে না পারায় সাধারণ মানুষ যেমন বিরক্ত ছিল, তেমনি দলের নেতা-কর্মীদের কাছেও তার জনপ্রিয়তা কমেছিল। সরকারের মাঝামাঝি সময়ে জনপ্রিয়তায় ধস নামার কারণ হিসেবে আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কথাবার্তাই মূলত দায়ী বলে মনে করতেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর ক্ষমতাধর এই মন্ত্রীও দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বর্তমান মহাজোট সরকার আমলে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়।
জোট আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সরকারের মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে টিকে ছিলেন। হাওয়া ভবনের লোক হওয়ায় দল ও সরকারের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব খাটিয়েছেন এই প্রতিমন্ত্রী। সরকারের ভেতর যেমন ক্ষমতাশালী ছিলেন, তেমনি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের টার্গেটেও পরিণত হন তিনি। কিন্তু জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তছনছ হয়ে পড়ে বিএনপি। ওয়ান-ইলেভেনের প্রথম দিকে ভালোই কাটছিল বাবরের দিনকাল। কিন্তু পরে গ্রেফতার হন। দলের খারাপ পরিণতির জন্য তখন বিএনপি নেতা-কর্মীরা যাদের ওপর ফুঁসছিলেন, সেই তালিকায় ওপরের দিকে নাম ছিল বাবরের। নেতা-কর্মীদের দাবি, বাবরদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে বিএনপি তছনছ হয়ে পড়ে। বাবরের এই দুঃসময়ে দলও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারাগারে আটকাবস্থায় তিনি নির্বাচন করতে চাইলেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন এবং অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। দলও হারে ওই নির্বাচনে। এতে ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড তাকে বহিষ্কার করে। দলের এমন ব্যবহারে ভেঙে পড়েন বাবর। এরই মধ্যে তিনি জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু আবারও গ্রেফতার করা হয় ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়। পরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় দেখানো হয় শ্যোন অ্যারেস্ট। তিনি বর্তমানে কারাগারে। এ অবস্থায় দল বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করায় বিভিন্ন মহল ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। তবে তিনিও বেশিদূর এগোতে পারেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও দলীয়ভাবে তিনি কোণঠাসা হতে থাকেন। অভিযোগ ওঠে, তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের কথা শোনেন না। তার সময়েই উদীচী হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। চরমপন্থিরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর হারিয়ে যান মেজর রফিক। সংসদ অধিবেশন ছাড়া তাকে কোথাও আর দেখা যেত না।
মেজর জেনারেল রফিককে সরিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেওয়া হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর মোহাম্মদ নাসিম দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। অস্ত্র জমা দিলে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন। এতে চরমপন্থি অনেক নেতা দলবল নিয়ে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এ ছাড়া খুলনার এরশাদ শিকদারকে গ্রেফতার ছাড়াও অপরাধ নির্মূলে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরই নাসিমকেও দলীয়ভাবে কোণঠাসা হতে হয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিক্ষোভের মুখেও তিনি পড়েন ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রোষানলে পড়ে রাজপথে পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটার শিকার হন বেশ কয়েকবার। হামলা আর মামলা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হয় সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ওয়ান-ইলেভেনের পর তিনি আটক হন। হয়রানির শিকার হয় তার পরিবার। বর্তমানে কোণঠাসা এই নেতা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী এখন ভালো নেই। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার ঠিকানা ঘরের বিছানা। দলীয় নেতা-কর্মীরাও তাকে দেখতে যান না। গত মার্চে বাংলাদেশ প্রতিদিন এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশের পর বেগম জিয়া তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে নানা ঘটনার দায় নিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া মতিন চৌধুরীর খবর এখন আর কেউ রাখেন না।
এর আগে এরশাদ সরকারের আমলের চার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মহব্বতজান চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, ডা. আবদুল মতিন ও মেজর জেনারেল (অব.) মান্নান সিদ্দিকী নানা ঘূর্ণিপাকে নিজেদের পথ এক রাখতে পারেননি। এদের মধ্যে মান্নান সিদ্দিকী এবং মহব্বতজান চৌধুরী মারা গেছেন। অন্যরা জাতীয় পার্টি ছেড়ে এখন দলছাড়া। ডা. মতিন দলবদল করতে করতে এখন কোনো দলে নেই। মাহমুদুল হাসান পরে এরশাদকে ছেড়ে বিএনপিতে গিয়ে ঠাঁই নেন এবং ব্যাকবেঞ্চার হিসেবে এখনো সেখানেই আছেন। এরাও পরবর্তী সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। জিয়া সরকার আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল (অব.) এ এস এম মোস্তাফিজুর রহমান পরবর্তীতে খালেদা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও মৃত্যুর আগে রাজনীতির অঙ্গন থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
এ ছাড়া স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালেক উকিল, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আবদুল মান্নানকেও চরমভাবে খেসারত দিতে হয়েছে। মনসুর আলীর বাড়িতে সশস্ত্র হামলাও পর্যন্ত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনিও টার্গেট হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে তাকে হত্যা করা হয়। আবদুল মান্নান দলীয়ভাবেই দীর্ঘদিন ছিলেন কোণঠাসা। হতাশা নিয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। মৃত্যুর পর তাকে দেখতে যাননি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকার শিকার হন। ক্ষোভে-অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন তরুণ এই প্রতিমন্ত্রী। এখন অধিকাংশ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। দেশে এসে নির্বাচনী এলাকায় পড়ে থাকেন। জনপ্রিয়তা হারানোর আগেই মন্ত্রণালয় ছাড়েন সোহেল তাজ। এ কারণে ঘরে-বাইরে তাজউদ্দীনের তনয়ের অবস্থান ভালো।